দর্পণ || ছোট গল্প || বিনয় মল্লিকের একটি সকাল ~ অমর মিত্র




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
বিনয় মল্লিকের একটি সকাল 
অমর মিত্র 

 বিনয় মল্লিক বাজার থেকে ফিরছিল।বাম হাতে একটি মাছের থলে, অন্যতে  সব্জির। বিনয় এমনি খুব সকালে ওঠে। বয়স মধ্য ষাট। মরনিং ওয়াক করে। তার এক সঙ্গী আছে সঞ্জয় গুপ্ত। তিনি সম্পূর্ণ একা। স্ত্রী নেই। কন্যা দুর্ঘটনায় চলে গেছে। জামাইকে তিনিই  আবার বিয়ে দিয়েছেন। জামাই মাঝে মধ্যে ফোন করে। খোঁজ নেয়। আবার বিয়ে করে সুখেই আছে মনে হয়। বিনয় সকাল সন্ধে তাঁর সঙ্গে ঘোরেন। বিনয়ের একটি পুত্র। কন্যার বিবাহ হয়ে গেছে। পুত্রটি চাকরির খোঁজ করছে। বিনয় যে পেনশন পান, ভালো মন্দ দুদিকেই ঝুলে তা। খুব হিশেব করে চলতে হয়। ছেলেও টিউশানি করে। গবেষণার জন্য তৈরি হচ্ছে। বিনয় দেখল গলির মুখে চারজনের জটলা। পাশের ফ্ল্যাটের অসিত ও কুমকুম, আর এলাকার তিন অল্প বয়সী যুবক। কুমকুমের বিয়ে হয়ে গেছে। প্রথম বিয়ের পর সে মা বাবার কাছে ফিরে এসেছিল। এখন আবার বিয়ে করেছে অবস্থাপন্ন এক যুবককে। গাড়ি করে বাড়ি আসে।  সে প্রমোটার। পুরোন বাড়ি ভেঙে বহুতল খাড়া করে। নাগেরবাজারের দিকের এক বাংলা মিডিয়াম প্রাইমারি  ইস্কুলে আগুন লাগানো নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। ভাড়াটে তুলতে পারছিল না জমি আর বাড়ির মালিক। ইস্কুলের নিজস্ব জমি ছিল না তা। এই নিয়ে জল ঘোলা হয়েছিল অনেক। বিস্তর প্রতিবাদ, স্যোসাল নেটওয়ারকিং সাইটে লেখা, খবরের কাগজে চিঠি, কিন্তু  শেষ অবধি কিছুই হয়নি। ইস্কুল উঠে গেছে। জমিতে বাড়ি উঠতে আরম্ভ করবে শিগগির। যে মেয়েটি বাড়ি ফিরেছিল স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়, সে এখন টাকার গদির উপর ঘুমোয়। মাঝে মধ্যে  বিনয়ের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়ায়। বিনয়ের স্ত্রী তিথিকে দেখায়, এই হিরের আংটিটা দেখ কাকিমা, ম্যারেজ অ্যানিভারসারিতে দিল। এই বালাটা দেখ কাকিমা, নিলাম। মাসে মাসে একটা করে গয়না দেয় তোমার জামাই।
   
   হুঁ, বেশ ভালো। তিথি কম কথা বলে। দেখে হাসে। বিনয়ের ছেলে বলে, তুমি কি হিরে চেন মা ?

   হিরেই তো।
   
   ঐ অঞ্জন গুহর  আর একটা বউ আছে তা জানো ? নীল বলে।

 নীল, নীলাভর বন্ধু সূর্য বলেছে তা। লোকটা ভালো না। ওদিকে একটা উদ্বাস্তু কলোনি ছিল, তার একটা অংশে আগুন লাগিয়েছিল ঐ অঞ্জন গুহ। সেখানেই ওর প্রথম কাজ। একটা ক্রিমিনাল ছাড়া কিছুই না। বিনয় ভীতু লোক নয়, কিন্তু বয়স বাড়তে,  রক্ত ঠান্ডা হয়ে যেতে, তার সাহস ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে ভিতর থেকে। সাবধানে কথা বলে। নীলের কথার  ভিতরে প্রবেশ করে বিনয় বলে, থাক, সবটা সত্যি না হতেও পারে।
     
 সূর্য এলে জিজ্ঞেস করো।
      
তখন তিথি বলে, ওর ফ্ল্যাট তো কালিন্দিতে।
      
নীল বলে, সে তো অন্য কাহিনি মা, যাক মা আর শুনতে হবে না।
     
 বিনয় দেখল কুমকুম দাঁড়িয়ে এই সকালে। রাস্তার ধারে কুমকুমের গাড়ি। ঝকঝক করছে নীলরঙের লম্বাটে মারুতি সুইফট। বিনয় গাড়ি চেনে না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেখে। বিনয় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, এত সকালে ? 
    
 কুমকুম বলল, আমি ছিলাম না আঙ্কেল, দিল্লি থেকে ভোরের ফ্লাইটে এসেছি ফোন পেয়ে।
     
বিনয় জিজ্ঞেস করল, কেন কিসের ফোন?
   
  কদিন ধরে খাওয়া ত্যাগ করেছিল কাকা, অসিত বারবার ফোন করছিল, আমি তো গেছি কাজে, দিল্লি থেকে  আমাকে ডেকেছিল বিজনেস পারপাস,   আমার এখন অনেক কাজ, অনেক দায়িত্ব, নতুন প্রজেক্ট খুলছি ইউ কে তে,   কুমকুম বলতে বলতে থামল, একটু দম নিয়ে বলল, কাল বিকেলেও কথা বললাম, আমার কথা খুব শোনে তো, বললাম কাকা, তোমাকে দিল্লি আসতে হবে, নতুন প্রজেক্টের  ম্যানেজার হতে হবে। 
    
 নব ? জিজ্ঞেস করতে করতে নবগোপালের মুখটি মনে পড়ল বিনয়ের। নব দিল্লি যাবে। দিল্লিতে গিয়ে নতুন দায়িত্ব নেবে, শীর্ণ, জীর্ণ নব। সন্ধেবেলায় স্বাভাবিক থাকে না। ২ নম্বর বস্তির দিকে একটা বাংলা মদের দোকান আছে। চোলাই বেশি, কল্যাণী ব্রুয়ারিজের দেশি মদ কম। বছর খানেক আগে দুটি লোক চোলাই খেয়ে মারা গিয়েছিল শুনেছিল বিনয়। বোতল কিনে মাঠে বসে খেতে খেতে মরে পড়ে ছিল সমস্ত রাত্রি। তখন গুঞ্জন উঠেছিল, ঐ দোকানেরই কাজ। কিন্তু সবটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। নবগোপাল ঐ শুঁড়িখানার নিয়মিত খরিদ্দার। খেয়ে কখনো কখনো  ঝামেলা করে অসিত বা কুমকুমের কাছে মার খেত, কখনো বাইরের বন্ধ ইট-বালি-সিমেন্টের দোকানের সিঁড়িতে বসে নিজের মনে বকবক করত। অসিত নবগোপালের ভাইপো, কুমকুমের ভাই। তার সঙ্গেই থাকে নবগোপাল। বিনয়ের  চেয়ে নব  কয়েক বছরের ছোট। দুর্বৃত্ত প্রকৃতির ছিল। মনে আছে সেই প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। জরুরি অবস্থার সময় নবর কী  প্রতাপ! ওর দাদা ভব ছিল এলাকার কাউন্সিলর যোগেন দত্তর সাগরেদ। জনা চার নির্দোষ ছেলেকে এসমা  আইনে  ঢুকিয়ে দিয়েছিল। ভবর ছেলে সরকারি দল করে। আগেও তাই করত। পরেও তাই করবে। বিনয় আগে ভয় করত না, কিন্তু এড়িয়েই চলত। এখন ভয় করে। নেশা করে অশ্রাব্য ভাষা বলতে আরম্ভ করলে, আর উপায় নেই ওকে থামানর। নোংরা ভাষা ওর মুখে। বিনয় জিজ্ঞেস করে,  ভালো আছিস, গাড়িটা তোর?
  
 এই জিজ্ঞাসার ভিতরে বিনয়ের যত না কৌতুহল, তার চেয়ে বেশি কুমকুমকে সন্তুষ্ট করা। ধনগর্বী কুমকুমের প্রতি নিজের সমর্থন প্রকাশ। এই রকম কথায় তার স্ত্রী পুত্র ক্ষুব্ধ হতো। বলত, নিজেকে ছোট করো  কেন, কার  মারা টাকার গাড়ি  কে  জানে!

 হেসে কুমকুম বলল,  হ্যাঁ, জন্মদিনে দিয়েছে তোমার  জামাই, দুটো তো আছে, এইটা থার্ড, হুঁ,  নীলকে দেখা করতে বলেছিলাম, করেনি তো।
    
 আমি বলে দেব। বলে বিনয় ভাবল নীল শুনলে ক্ষেপে যাবে। যাবেই না। 
    
 অবশ্য আমিই বা কদিন কলকাতায় থাকতে পারি বল, এই তো দিল্লি থেকে আসছি, এরপর তেহরান যেতে হবে বিজনেস পারপাসে…,ইন্ডিয়ান ডেলিগেট টিমে  থাকতে হবে ব্রাজিল সফরে।
    
 তাই, তুই অতদূর যাবি? 
     
তখন অসিত তাদের  কথার ভিতরে মাথা গলায়, বলল, আঙ্কেল তুমি কিছু শুনেছ ? 
     
না, কী শুনব ? বিনয় খুব নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।  
     
শুনবে কী করে, জানবেই বা কী করে না বললে ? কুমকুম বলতে থাকে, গত সন্ধ্যায় আমাকে এমন করে বলল, ফিরে আসতে, জানো তো আমি কাকার কোলেই বড় হয়েছি, কাকার কথা আমার কাছে আদেশ, কাকার কথায় আমি ইওরোপ থেকেও চলে এসেছি একবার। 
     
কবে ইওরোপ গেলি? বিনয় মিথ্যে কথায় আরো শিলমোহর বসালো। 
     
কেন লাস্ট ইয়ারে, ইটালি আর ফ্রান্স গেছিলাম, আমি তো গেস্ট হয়ে গেছিলাম, লেকচার দিয়েছিলাম তিনটে ইউনিভার্সিটিতে, কী দেশ! আমাদের দেশও ঐ পথে যাচ্ছে কাকা, দেখবে কী হয়, ইন্ডিয়ান বলতে গর্বে বুক ভরে যাবে, আমি একটা বিগবাজার করব এ পাড়ায়, পাড়াই চেঞ্জ করে যাবে কাকা।  
     
আচ্ছা। বিনয় চুপ করে গেল। ভাবল জিজ্ঞেস করে, কী বিষয়ে লেকচার দিতে গিয়েছিল? কিন্তু কুমকুমের কথায় সায় দিলেই ও খুশি। বেশি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে একবার সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। চোখ লাল করে কুমকুম জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি আমার কথা কি বিশ্বাস করছ না বিনয়দা?
   
 তখন সে বিনয়দা হয়ে গিয়েছিল। তখন এম পি তার নিকটজন, নমিতাদি আসবে তার বাড়ি । এই তো বছর খানেক আগের কথা। তার বাড়ি মানে কালিন্দির ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটে তাকে ডেকেছে কতবার কুমকুম। কত কথাই না বলে, হাইকোরটের জাজ তার জেঠামশায়, চিফ সেক্রেটারি তার অতি পরিচিত । মেয়েটা তুখোড়। বলত প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজি অনার্স, এইচ এস পার হয়েছে কি না সন্দেহ। চেহারায় আলগা চটক আছে। বিনয় তখন আলিপুরে চাকরি করে। উকিলের শামলা পরে কদিন ঘুরঘুর করেছিল। তখন বিনয় যেন লুকিয়ে বেড়িয়েছে। তাকে দেখলেই বলবে, এটা করে দাও, অমুক অফিসারকে সে চেনে কি না। যাই হোক, কুমকুম তো পারে। যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল বেহালায়, সামান্য কেরানি। আধ-খেচড়া বাড়ি। দুই বোন অবিবাহিত। ভবগোপাল তার বেশি জোগাড় করতে পারেনি। সেই মেয়ে জন্মদিনে গাড়ি উপহার পায় স্বামীর কাছ থেকে।  মানুষ কোথা থেকে যে কোথায় যায়!
     
অসিত তার বন্ধুকে বলল, ডাক্তারকে আবার ফোন করব ?
     
সাড়ে নটায় আসবে বলেছে, এখন ফোন করে কী হবে ? 
      
তোদের দাদার কথা বলেছিস? কুমকুম জিজ্ঞেস করল।
       
না তো। অসিতের বন্ধু বলল। 
       
বল  মনোময় পাল বলেছেন, হিজ ব্রাদার ইন ল অসুস্থ, ফিজ ডাবল করে দেব।  
       
বলছি দিদি। অসিতের বন্ধু মোবাইল নিয়ে সরে গেল। অসিতও তার পিছু পিছু গেল। বিনয় জানে নবগোপাল সুস্থ থাকে কমদিন,  অসুস্থ হয় প্রায়ই । লিভার গেছে, তাই মুখে কালো ছোপ পড়ে গেছে। জীর্ণ হয়ে গেছে দেহ। হাঁটতে পারে না। তবুও  নেশা বন্ধ করেনি। নবগোপাল বলে, কুমকুমকে সে নিজ হাতে গড়েছে,  তার হাতেই যেন জীবন গড়তে শেখা। বিনয় জিজ্ঞেস করল, তুই  তোর কাকাকে নেশা করতে বারণ করতে পারিস তো।
    
- কেয়া কহে না, কাকা! কী বলব কাকা, কতবার বলেছি,  ওইটা না খেতে, তুই ভালো জিনিশ খা, একবার ফ্রেঞ্চ কনিয়াক এনে দিয়েছিলাম, ছুঁয়েও দেখল না, বললাম, আমি টাকা দিচ্ছি, ভালো জিনিশ খা,  কিন্তু নেশা নেশা নেশা, আর ঐ সব বাজে কয়েকটা সঙ্গী আছে, একটু ওয়েট কর, সবার ভিতরে আছোলা বাঁশ ঢুকে যাবে। 
     
যাইরে।
     
বলছি নীলের চাকরি আমি দেখছি, ও যায় না কেন? জিজ্ঞেস করল  কুমকুম।
    
  বিনয় হাসে, বলল, ও পি এইচ ডি করবে, নেট পরীক্ষা দেবে। 
     
 আমাকে বলুক, আমি ব্যবস্থা করছি, জে এন ইউ, কি  প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি...। 
      
মেঘের ছায়া বিস্তৃত হয়েছে। বিনয় কী বলবে ভেবে উঠতে পারে না। কুমকুম বেশ বলে যাচ্ছে। নীলাভ শুনলে রেগে যাবে। কুমকুম তাকে ছাড়ছে না। বলছে, এখানে যদি কান্ট্রি লিকার না পায় তো শ্যামবাজার চলে যাবে হাঁটতে  হাঁটতে, কত বারণ করেছি, ক্ষমতায় আসি, কান্ট্রি লিকার ব্যান করে দেব, শোনে না কাকা, আমি ওকে বলছি, আমার তুমি দীক্ষা গুরু, সব কিছু  আমি তোমার কাছে শিখেছি কাকা, এখন আমার কথা শোনো,  জাস্ট কয়েকটা সিগনেচার, দিল্লির এইমস-এ নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দেব তোমাকে, গোঁয়ার, এবার আর রাখব না এখানে, মুঝে কুছ ভি করনা হোগা।  
      
 বিনয় আর দাঁড়ায় না। বোঝা গেল নবগোপাল অসুস্থ। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছে ওরা। আরো জানা গেল, মেয়েটা প্ল্যাটফর্ম বদল করেছে। বিজনেস করতে হলে তা করতে হয়।  সঠিক সময়ে সঠিক  সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ক্ষমতা আছে। এখন ও চল্লিশের কাছাকাছি। বছর কুড়ি থেকেই ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রবেশ নবগোপালের হাত ধরে। তারপর সময়ের আগে আগেই  দল বদল, তারপর এখন আবার…...। 
    
গলিতে ঢুকতে সেই গন্ধটা পায় বিনয়। বাজারে যাওয়ার সময়ও পেয়েছিল। মনে হয় ধেড়ে  ইঁদুর মরেছে। নাকে রুমাল দিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে গন্ধটা এড়াতে পারল না।  ফ্ল্যাটে গন্ধটা ঢুকে পড়েছে। বাজারের থলে রাখতে রাখতে বিনয় তিথিকে বলল, পচা গন্ধ পাচ্ছ?
   
  -হুঁ, জমাদারকে দিয়ে খুঁজতে হবে কোথায়।
     
-নব অসুস্থ, ডাক্তার আসছে।
     
-সে তো অনেকদিন অসুস্থ, লাস্ট কবে দেখেছ?
    
 ইলেকশনের আগে, ভোটার স্লিপ নিয়ে বাইরে অন্ধকারে বসে ছিল, নেশায় ঢোল, তাকে ডেকে স্লিপগুলো দিল। বিনয় মনে করার চেষ্টা করল, তারপর কবে দেখেছে মনে করতে পারে না। হ্যাঁ মাংসের দোকানের সামনে কবে যেন দেখেছিল। সিগারেট মুখে নিয়ে বসে আছে কঙ্কালসার নবগোপাল। অমনিই থাকত সন্ধেবেলায়। তারপর দ্যাখেনি মনে হয় অনেকদিন।  
     
-তুমি কি বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলে?
     
-হ্যাঁ,  ওকে এইমস নিয়ে যাবে বলছে কুমকুম। বলতে বলতে বিনয় ভিতরের ঘরে ঢুকল। 

নীল উঠে পড়েছে। বলল, যতসব বারফাট্টাই কথা, পাড়ার ডাক্তারকে ফিজ দেয় না আবার এইমসে নিয়ে যাবে, কে বলল?
     
-ও এখন দিল্লি থেকে আসছে।
     
-ও, ঘুরঘুর করছে দিল্লিতে, ওকে কে পাত্তা দেয় ?
      
-হ্যাঁ, ও নাকি বিজনেস পারপাসে   পি এম-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
      
-সেখেনে ঝিগিরি করবে, উফ! নীল কথাটা বলেই সামলে নিল। ঠিক হয়নি। তার বাবা এই ভাষা পছন্দ করে না। নীল একটু থেমে থাকে, তারপর বলে, তুমি বিশ্বাস করে নিলে কুমকুমদির কথা? হাসতে চেষ্টা করে নীল, একটু  চুপ করে থাকে, তারপর বলে, গন্ধটা বাড়ছে মা, আমি জমাদারকে ডেকে আনি।
       
-দ্যাখ। তিথি বলল, চা খেয়ে দেখে আয়।         
        
তখন বাইরে গলার স্বর শোনা গেল। কুমকুমেরই। উঁচু গলায় কাউকে বলছে, কতবার বলেছি সেরে ওঠ, এইমস নিয়ে যাব ফুল চেকাপের জন্য...কথাই শোনে না। ডাক্তার ডাকতেই দেবে না,দেখুন  আপনি,  কালই আমি দিল্লিতে খবর পেলাম…...।  দরজা খুলে গেল ওদের। কে যেন ওক তুলল। তিথি ছুটে এল কিচেন থেকে। বলল, গন্ধটা আসছে  ওদের বাড়ি থেকে, বমি পাচ্ছে গো।
       
সব চুপ। ওদের দরজা বন্ধ। নীল ধুপ জ্বালিয়ে দিল গন্ধের হাত থেকে রেহাই পেতে। মিনিট পনের বাদে পাশের ফ্ল্যাটের দরজা শব্দ করে  খুলল। ডাক্তার বেরিয়ে গেল মনে হয়। ডাক্তারের পিছনে অসিত যাচ্ছে। অসিতের গলা শোনা যাচ্ছে। তাদের দরজায় ধাক্কা পড়ল। বিনয় নাকে রুমাল দিয়ে দরজা খুলতেই দ্যাখে কুমকুম, নেই গো, আমি পারলাম না, নেই, এই এখনই, সেই কোন ভোরে দিল্লি থেকে ছুটে এলাম...।
         
-নেই! বিনয় জিজ্ঞেস করে, কিন্তু গন্ধটা  ? জিজ্ঞেস করেই বুঝল ভুল করেছে। কুমকুম রেগে যাবে। তার কথায় সন্দেহ রয়েছে। তার চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে।  বাসি মড়ার পচনের গন্ধ ইঁদুর পচনের গন্ধ  ভেবে অনুসন্ধান করছিল তারা। কুমকুমের চোখ লাল, কই কিসের গন্ধের কথা বলছ?
       
 বিনয় বলল, খুব পচা গন্ধ আসছে, কী হয়েছে বল দেখি।
        
-কী হবে, কাকা নেই, ভোরে চলে গেছে।
        
-কিন্তু গন্ধটা যে ভয়ানক, মর্গের গন্ধ, একবার মর্গে গিয়েছিলাম, কবে মারা গেছে ?  
        
-তার মানে,  তুমি তো আচ্ছা লোক, কী সব বলছ বিনয়দা,  আমার কাকা নেই বলতে এসেছি, তোমাদের ঘর থেকেই পচা গন্ধ...। বলতে বলতে কুমকুম খ্যাসখেসে গলায় বলে উঠল, তুই আর একটু অপেক্ষা করতে পারলিনে কাকা, দিল্লিতে সব ব্যবস্থা করে এসেছিলাম, নীলকে ডাকবে। 
        
বিনয় পারল। এই প্রথম উগ্র পচা এক  গন্ধজালে ঘিরে যেতে যেতে তা থেকে মুক্তি পেতে কুমকুমের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিল সশব্দে। আগে এই সাহস তার ছিল না। দরজা বন্ধ করে নীলকে বলল, পচা মড়ার গন্ধ, ওরা মনে হয় দরজা বন্ধ করে ফেলে রেখেছিল নবকে, বুঝতে পারেনি যে মরে গেছে, পচতে আরম্ভ করতে…...।                                                                                               
      
বাইরে আর কোনো গলার স্বর নেই। সব নিঝুম করে দিয়ে গন্ধটা ঘিরে ফেলতে লাগল সবদিক।
==

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ