দর্পণ || ধারাবাহিক || এক সমুদ্র অনেক নদী ~ প্রদীপ গুপ্ত পর্ব ( এক )




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

তালসারি সমুদ্রের বালিয়াড়িতে বসে আছে শ্রেয়ান। সন্ধ্যা নামার সময়টাতে এই বালিয়াড়ি ওকে ভীষণভাবে টানে। দীর্ঘপথ পরিক্রমার পর সুবর্ণরেখা এখানে বঙ্গোপসাগরের বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দীর্ঘ বালিয়াড়ির পর সুবর্ণরেখা নদীর খাত পেরিয়ে ফের বালিয়াড়ি। সেই বালিয়াড়ির শেষে সমুদ্র এসে যেন দুহাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিয়েছে সুবর্ণরেখাকে। মধ্যিখানে বেশ কিছুটা চরা জেগে আছে, আর সেই চরায়...
নাহ্, থাক, এখন সে কথা নয়। সেকথা সময় বলবে তার কথকতায়।


কথকতা শব্দটা বসে যাওয়ার পরেই মনে হলো -- এটা কী হলো? এই যে আমি গরাণকাঠ কেটে, বাঁশ ফালি দিয়ে , পেরেক ঠুকে, সুতলি দড়ি পেঁচিয়ে কাঠামোটা বানানো শুরু করে দিলাম, সেটা বাঁধার আগে তো সঠিকভাবে ভেবে নেওয়া দরকার -- যে যাঁর মতো এগোলে, যারা পিছিয়ে রয়েছে তাদের নিয়ে এগোবো কীভাবে? কথায় বলে প্রকৃতই যদি এগোতে চাও তাহলে পেছন থেকে এগোতে শুরু করো । অগত্যা সেভাবেই শুরু করা যাক।

সেই তেল, লবন আর কাঁচা লংকা আমের কষির সাথে ডলে আচার খাওয়ার সময় থেকেই শ্রেয়ান নিজের চেতনার অজান্তেই ঘোড়ার লেজ মুচড়ে দিয়ে বল্গাহীন বুনো ঘোড়ার পিঠের সওয়ারী হয়ে উঠেছিলো।  ওর দুটো মায়াভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আর সিঁথির মাঝ বরাবর দুদিকে ছড়িয়ে পড়া অবাধ্য ঘন ব্রাশের মতো চুলগুলোকে বাধ্য করার তাড়নায় পাশের বাড়ির বিধবা যুবতী হেমনন্দিনী ওর কাঁচুলি বিহিন সাদা ফিনফিনে থানের ভেতরে চাপা দেওয়া দুখণ্ড উদ্ধত মাংসপিণ্ডর ভেতর যখন শ্রেয়ানের মুখটাকে চেপে ধরতো তখন শ্রেয়ানের বয়েস খুব বেশী হলে এগারো। অন্যকিছু না বুঝলেও একটা কাঁঠালিচাঁপার সুবাস যেন ওর সারাটা শরীর অবশ করে দিতো। 
হেমনন্দিনী যেদিন ওর বৈধব্যের আশ্রয়, ওর বড়ো ভাইয়ের বাড়ি ছেড়ে অজানায় মিশে গেলো, সেদিন অনেক চেষ্টা করেও শ্রেয়ান ওর সেই প্রথম প্রশ্রয়ের কাছে যেতে পারেনি। পারেনি কথাটা না বলে বরং বলা ভালো যেতে দেওয়া হয়নি।
পরে ওর বুড়ি পিসী, ওকে বলেছিলেন যে হেমকে নাকি ওর বৌদি শ্রেয়ানকে অন্যায়ভাবে বুকের ভেতর চেপে ধরতে দেখেছিলেন। আর সেই অপরাধেই...
অপরাধ কিনা সেদিন শ্রেয়ান সেসব বুঝে উঠতে পারেনি, তবে হেমের কাছে গেলে যে ও কিছু একটা সুখ পেতো সেটা...

যাকগে সেসব কথা। ওর সেই বুড়ি পিসীমা ওকে পইপই করে বলতেন -- নিজেকে মেয়েদের কাছ থেকে সামলে রাখিস বাবা। তোর ওই চোখজোড়ার ভেতর এমন কিছু আছে যে পতঙ্গকে পুড়ে মরতে ডেকে আনে।
এই তালসারির তটে বসে শ্রেয়ান অনেক ভেবেছে, তাহলে কী ওই বুড়িও মনে মনে পুড়ে মরতো ওকে দেখলে!
শোন বাছা, ধর একটা বাগানে পঞ্চাশটা আমকাঠালের গাছ আছে। কিন্তু দেখবি সব গাছ ছেড়ে মৌচাক বাঁধতে মৌমাছিরা ওই পঞ্চাশটার ভেতর দুএকটাকেই বেছে নেয়। তুই হচ্ছিস গে সেরকমই একটা আমগাছ রে।
সেই বুড়ি যখন মারা যান, সবাই ওকে বলেছিলো মুখাগ্নি করার জন্য। কিন্তু ও রাজী হয়নি। ও নিশ্চত জানতো যে সেই বৃদ্ধাও ওর আগুনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতো। যাকে শ্রেয়ান প্রেমের আগুনে পুড়িয়েছে তাকে কীভাবে ...
শ্রেয়ান ওর চিতার ওপর শোয়ানো শরীরের কাছে গিয়ে পরম মমতায় বৃদ্ধার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিলো -- যেখানেই থাকো, ভালো থেকো পিসী, শান্তিতে থেকো। 

( ক্রমশ )

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ