বৃক্ষ জননী - সালুমারাদা থিম্মাক্কা মাতা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বৃক্ষ জননী - সালুমারাদা থিম্মাক্কা মাতা 


ধ্বংসের পৃথিবী জুড়ে কতো জানা অজানা সৃষ্টি লুকিয়ে , ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । আমরা কতোটা জানতে বুঝতে পারি। বহু মানুষ এমন আছেন বিশ্বাস করেন তাদের একাগ্রতা এবং কর্মের উপর। জাঁকজমকের কী দরকার? কী প্রয়োজন প্রচার - বিজ্ঞাপনের ?  সমাজ প্রকৃতি ও মানুষের কল্যাণে কর্মই একমাত্র মানুষ তৈরীর রূপকার। 

নিজেকে খুঁজে পেতে নিজের থেকে বড়ো কেউ হয়না।

একজন সাধারণ মানুষ তার কর্মের সুবাদে এই সমাজ ও পৃথিবীতে যে অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ সালুমারাদা থিম্মাক্কা। প্রকৃতিপ্রেমিক এই নারীর কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। কিন্তু স্বশিক্ষিত মানুষ হিসেবে তিনি জানেন, প্রকৃতির মাঝেই খুঁজেই পাওয়া যায় জীবনের প্রতি ভালোবাসা।


বয়স ১০০ ছাড়িয়েছে প্রায় এক দশক আগে। আজও রোজ সকালে জলের পাত্র হাতে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। চার কিলোমিটার রাস্তা ধরে যে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সন্তানরা। সেই সারিবদ্ধ বটগাছের গোড়ায় পরম স্নেহে জল ঢেলে দেন। এই গাছেদেরই ৭০ বছর ধরে সন্তান বলে জেনে এসেছেন তিনি। আরও নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন। তবে এই ৩৮৫টি বটগাছের জন্যই সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি। তিনি আর কেউ নন, কর্ণাটকের বৃক্ষ-জননী সালুমারাদা থিম্মাকা।


সন্তানহীন থিম্মাকা দম্পতি অভিভাবকত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন এই গাছেদের মধ্যেই। সে আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের কথা। প্রথম বছর লাগিয়েছিলেন ১০টি গাছ। পরের বছর ১৫টি। তার পরের বছর ২০। ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়তেই থাকে। ৪ কিলোমিটার রাস্তায় ৩৮৫টি বটগাছ লাগিয়েছেন। নিজেরাই তাদের পরিচর্যা করেছেন। গরু-ছাগল যাতে গাছ মুড়ে খেতে না পারে, তাই কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন চারপাশ। বটগাছ ছাড়াও আরও নানা প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন আশেপাশে। তারপর ১৯৯১ সালে স্বামীকে হারালেন সালুমারাদা। সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল একা তাঁর কাঁধেই। আর আজও সমানে সেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি। বয়স হয়েছে ১০৮।

বিয়ের ২৫ বছর বিবাহিত জীবনের পরেও থিম্মাক্কা কোনও সন্তানের জন্ম দিতে পারেননি । আজও সমাজে প্রচলিত আছে সন্তান না হলে কোনও নারী পূর্ণ হয় না। তাই সমাজ তাকে এক ঘরে করে দিয়েছিল । কিন্তু থিম্মাক্কা দুর্বল হয়ে পড়েন নি সমাজের প্রতি নিয়েছিলেন এক মধুর প্রতিশোধ। তাদের সন্তান না হওয়ায় সেই দুঃখ ভুলে থাকতে তিনি এবং তার স্বামী সিদ্ধান্ত নেন যে তারা প্রচুর গাছ লাগাবেন। এবং সন্তানের মত তাদের যত্ন করে বড় করবেন । থিম্মাক্কার কোনও স্কুল-কলেজের শিক্ষা নেই । আর পাঁচজন দরিদ্র ভারতীয় নারীর মতো শ্রমিক ছিলেন তিনি। ভূমি হীন দিনমজুর এই দম্পতির কোনও সন্তান না থাকায় সমাজ তাদের বর্জন করেছিল। কথা বলার সমস্যা থাকায় চিক্কাইয়াকে সবাই বলতো তোতলা চিক্কাইয়া। সমাজবিচ্যুত একলা দিনগুলোতে বিষন্ন মনে তারা সমাজকে একটা যথাযথ জবাব দেওয়ার কথা ভাবতেন। তখনই তাদের মাথায় আসে গাছ লাগানোর কথা। তারপর ধিরে ধিরে সবকিছু ইতিহাস হয়ে যায়।

প্রথাগত মাতৃত্বের বাইরে বেরিয়ে তিনি আজ প্রায় ৮০০০ বৃক্ষ সন্তানের গর্বিত মা।তাঁর কাজকে সম্মান জানিয়ে গ্রামবাসীরা তাঁকে ডাকতে শুরু করেন ‘সালুমারাদা’ নামে, কন্নড় ভাষায় যার অর্থ ‘গাছেদের দল’।

২০১৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত করা হত তাঁকে । 

২০১৬ সালে বিবিসি প্রকাশিত বিশ্বের সেরা ১০০ মহিলার তালিকায় ওঠে তাঁর নাম। এছাড়াও পেয়েছেন হাম্পি ইউনিভার্সিটির নাদোজা পুরস্কার, ন্যাশানাল সিটিজেন পুরস্কার এবং দেশবিদেশের আরও নানা সম্মান। দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনেও তাঁর নিজের হাতে লাগানো একটি গাছ বড় হচ্ছে। এই বিপন্ন পরিবেশকে বাঁচাতেই হবে, এটুকুই জানেন থিম্মাকা। তাই এখন তিনি বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কাজ করছেন। আর এরপর প্রয়াত স্বামীর নামে একটি হাসপাতাল তৈরির ইচ্ছাও আছে তাঁর। তথাকথিত অক্ষরপরিচয়হীন এই মানুষটিই শেখাচ্ছেন সভ্যতার নতুন শিক্ষা।

______

ছবি ও তথ্যসূত্র : সংগৃহীত 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ