এই শতাব্দীর ভয়াবহতম ট্রেন দুর্ঘটনা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

এই শতাব্দীর ভয়াবহতম ট্রেন দুর্ঘটনায় দুর্ঘটনাগ্ৰস্ত বহু মানুষের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন কিছু দেবতুল্য মানুষ । যাঁরা নিজেদের বিবেক মনুষ্যত্বের আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদে । রইল এমনই কিছু মানুষের কথা :


শুক্রবারের অভিশপ্ত সন্ধ্যায় স্টেশন সংলগ্ন বাহানাগা বাজারের মুরগির মাংস বিক্রেতা রঞ্জনকুমার মল্লিক সচকিত হয়ে উঠেছিলেন আচমকা এক অদ্ভুত রকমের ভয়াবহ বিকট শব্দে । এই শতাব্দীর ভয়াবহতম রেল দুর্ঘটনার বিষয়টি উপলব্ধি করা মাত্র দোকানের ঝাঁপ ফেলে ছুটে যান সেখানে । সব সংশয় হেলায় উড়িয়ে রঞ্জন আরও তিনজন সহযোগীকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন । স্থানীয়ভাবে জোগাড় করা মই, লোহার রড ইত্যাদির সাহায্যে মালগাড়ির উপরে উঠে যাওয়া কামরা থেকে টেনে বার করে আনেন নিথর ও যন্ত্রণায় কাতর বহু যাত্রীকে । উদ্ধারকারী দল পৌঁছনোর আগেই তিনি ও তাঁর সহযোগীরা প্রায় ২৫০ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি একাই প্রায় ৭০ জনকে জখম বা সুস্থ অবস্থায় কামরা থেকে বাইরে এনেছেন । বাজারের অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও এক কথায় স্বীকার করছেন রঞ্জনের এই মহান কৃতিত্ব ।


বাহানাগার স্থানীয় যুবক সঞ্জয়কুমারের বাড়ির খুব কাছেই দুর্ঘটনাস্থল । আর পাঁচদিনের মতো সন্ধ্যায় চা খাচ্ছিলেন তিনি । হঠাৎই আচমকা এক অদ্ভুত রকমের ভয়াবহ বিকট শব্দে হাত থেকে চায়ের কাপ মাটিতে পড়ে যায় । পড়িমরি করে আওয়াজ লক্ষ্য করে এই শতাব্দীর ভয়াবহতম রেল দুর্ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেই নিজের সাধ্যমতো উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন । রক্তস্রোত, গগনবিদারী আর্ত চিৎকারের ভয়াবহতার ভিতর থেকেও দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া অভিশপ্ত কামরার ভিতর থেকে জনা আঠাশ ব্যক্তিকে জীবিত বের করে এনে নতুন জীবন দিতে সক্ষম হন তিনি । তবে আরও বেশি মানুষকে বাঁচাতে না পারার আক্ষেপ রয়ে গেছে তাঁর ।


উত্তর ২৪ পরগণার বসিরহাটের পরিযায়ী শ্রমিক বছর আঠাশের আব্দুল আলীম গাজী করমন্ডল এক্সপ্রেসে কেরালায় যাচ্ছিলেন কাজ করতে । আচমকা ভয়াবহ দুর্ঘটনার অভিঘাতে তিনি নিজে মারাত্মকভাবে আহত হন । প্রাণে বাঁচলেও দেহের বহু জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হয় ও রক্ত ঝরতে থাকে । তা সত্ত্বেও চোখের সামনে এতগুলো মরণাপন্ন মানুষের আর্তনাদ দেখে নিজেকে শক্ত করে জীবন বাঁচানোর লড়াইতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকজন যাত্রীকে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া রেলের কামরা থেকে টেনে টেনে বের করে করে আনেন । তাঁর প্রচেষ্টায় রক্ষা পায় বেশ কিছু মানুষের জীবন । তবে বেশিক্ষণ তিনি লড়াই চালিয়ে যেতে পারেননি । একে তো নিজেই ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত, তার ওপর চোখের সামনে এতো বীভৎস রক্তাপ্লুত দৃশ্য জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি । তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন ।


সেদিনের সেই অভিশপ্ত ট্রেনে ছিলেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের সেনা জওয়ান গোবিন্দ মাকুড় । সঙ্গে ছিলেন তাঁর পরিবারের সকলে । বরাতজোরে সেদিন গোবিন্দ সহ তাঁর পরিবারের সকলেই রক্ষা পান । তবে তিনি নিজে আহত হন । বেশ জোরালো রকমের চোট লাগে তাঁর দুই হাঁটুতে । সেই অবস্থাতেই তিনি তাঁর পরিবারের অন্য সকল সদস্যদের তো বটেই, দুর্ঘটনাগ্রস্ত আরও বহু যাত্রীকে উদ্ধার করেছিলেন দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কামরার ভিতর থেকে । তিনি না থাকলে হয়তো প্রাণ রক্ষা হত না তাঁদের । তিনি নিজেও বর্তমানে চিকিৎসাধীন ।


দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাসন্তীর বস্ত্রব্যবসায়ী মিজানুর রহমান লস্কর যখন জানতে পারেন তাঁর এলাকার কয়েকটি ছেলে ওই অভিশপ্ত ট্রেনে ছিলেন এবং দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন, তখন আর কিছু না ভেবে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে একটি গাড়ি ভাড়া করে চলে যান ঘটনাস্থলে । দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিচিতদের খুঁজে বের করে একত্রিত করেন । আহতদের প্রাথমিক শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেন । অবশেষে মিজানুর ২৩ জনকে নিয়ে রওনা দেন পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে । সবাইকে বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে, নিজের খরচে ।


এঁরা ছাড়াও আরও বহু দেবতুল্য মানুষ রয়ে গিয়েছেন, যাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় রক্ষা পেয়েছে বহু অমূল্য জীবন । কিংবা তাঁদের সুষ্ঠুভাবে বাড়ি ফেরানো বা আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রেও রেখে গিয়েছেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান । রইল তাঁদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও অন্তরের ভালবাসা ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ