গর্বের তেইশে আগস্ট ~ সুজিত চক্রবর্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

গর্বের তেইশে আগস্ট 

 সুজিত চক্রবর্তী 


   ইদানিং অনেক দিন  যেন কোনও ভালো খবর আসে না আমাদের কাছে। একটার পর একটা বেদনাদায়ক অথবা চরম বঞ্চনার খবর পেয়ে আমরা ক্লান্ত। মনে হতো এমন কোনও খবর কেন আসে না যাতে সব ভেদাভেদ আর দলাদলি ভুলে একশো চল্লিশ কোটি মানুষ একসাথে  আনন্দে ভেসে যাওয়া যেতে পারি, যেমনটা হয়েছিল আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে।


         চল্লিশ বছর আগে ঠিক কী হয়েছিল? তাহলে খুলেই বলি। 1983 সালের 25 শে জুন কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রথমবার বিশ্বকাপ বিজয়ের জন্যে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে । যতটা অপ্রকাশিত ছিল, ততটাই অবিশ্বাস্য ছিল এই জয় । চল্লিশ বছর পর আবার গর্ব করার মতো  সাফল্য দেখল ভারতবাসী। 2023 সালের 23 শে আগস্ট আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ভারতীয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের তৈরি করা চন্দ্রযান-3 ইসরোর অধিকর্তা সোমনাথ স্যারের নেতৃত্বে কেমন  মসৃণভাবে চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে নেমে আসছে!


           নানা কারণে ঘটনাটা অবিশ্বাস্য তো ছিলই। ইতিপূর্বে চাঁদের মাটিতে তিন দেশের মহাকাশযান নামতে পেরেছে। এই তিন দেশের নাম : আমেরিকা,   রাশিয়া ( সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) এবং চিন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেই হোক কিম্বা বৈভবের বিচারেই হোক,  ভারতকে যে এই তিন মহাশক্তিধর  দেশগুলোর সাথে এক আসনে বসানো যায় না একথা বুঝতে কারও অসুবিধে হওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু এই চাঁদ ছুঁয়ে যাওয়া এক শরৎের বিকেলে ভারত চতুর্থ দেশ হিসেবে এই দেশগুলোর সাথে তার মহাকাশ গবেষণার জন্য বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে গেল সেটা সত্যিই খুব গর্বের বিষয়।


    তবে অবিশ্বাসের কারণ শুধুমাত্র এইটুকুই ছিল না! আরও বহবিধ কারণে এই অবিশ্বাস জমা হয়েছিল। তার মধ্যে প্রধান কারণটা এখন সবার জানা :  চন্দ্রযান-3 চাঁদের দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি অঞ্চলে অবতরণ করতে চাইছিল যেখানে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ ইতিপূর্বে চেষ্টা করেও পৌঁছতে পারে নি । উন্নাসিকতার ছড়ায় একে বলা যায় : 

" হাতি ঘোড়া গেল তল/ ব্যাং বলে কত জল!"

এখানেও শেষ নয়,  আরও অনেক কারণ আছে । 2019 সালে ভারতের পাঠানো মহাকাশ চন্দ্রযান-2  এখানে নামতে ব্যর্থ হয়েছিল । এর পরেও চমক ছিল একেবারে শেষের দিকে হঠাৎ পাওয়া একটা খবরে যখন আমরা জানতে পারলাম যে রাশিয়ার মহাকাশযান লুনা-25 চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছে যাবে চন্দ্রযান-3 এর সেখানে পৌঁছানোর দু'দিন আগেই। একশো চল্লিশ কোটি নাগরিকের  কাছে এর অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে ভারত যদি তেইশ তারিখে চাঁদের ওই অঞ্চলে সফলভাবে অবতরণ করতেও পারে তবু তার ফার্স্ট বয় হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে না। কিন্তু,  শেষ পর্যন্ত লুনা পারে নি।  এরপরও একটু দ্বিধা হয়তোবা ছিল এই ভেবে : রাশিয়া যা পারল না,  ভারত কি তা পারবে! এখন সেসব কথা নাহয় থাক, আসুন  দেখে নেওয়া যাক লুনা কেন পারল না!


     চন্দ্রযান-3 ইসরোর  শ্রীহরিকোটা  উৎক্ষেপন কেন্দ্র থেকে যাত্রা শুরু করেছিল 14ই জুলাই। তার লক্ষ্য ছিল চল্লিশ দিনের যাত্রা শেষ করে সে চাঁদের মাটিতে পা দেবে 23শে আগস্ট। সেইমতো যখন সব ঠিকঠাক চলছে, চন্দ্রযান অনেকটা এগিয়ে গেছে তার লক্ষ্যভেদের পথে তখন 12ই আগস্ট আমরা জানতে পারলাম যে লুনা-25 নামের এক রাশিয়ান মহাকাশযান 11ই আগস্ট রাশিয়া থেকে তার যাত্রা শুরু করেছে এবং সে চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে পা রাখতে চলেছে 21 শে আগস্ট। অর্থাৎ চন্দ্রযানের দুদিন আগেই ওভারটেক করে সেখানে পৌঁছে যাবে। যার অর্থ এখানে প্রথম পৌঁছানোর স্বীকৃতি ভারতের হাতছাড়া হতে চলেছে। যদিও বিজ্ঞানীরা বললেন, এই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে প্রতিযোগিতার কোনও স্থান নেই এবং এই দুই অভিযান সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল যে তবে কি ভারত বিশ্বকাপের ফাইনালে শেষ পর্যন্ত  রানার্সআপ হবে, চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে না? জেনে নেওয়া যাক ভারতীয়   বিজ্ঞানীরা সেদিন কী কারণকে দায়ী করেছিলেন চন্দ্রযানের দেরি করে পৌঁছানোর জন্য।


      ইসরো জানিয়েছে, এই দুই দেশের মহাকাশ যাত্রার মধ্যে আসল ফারাক ঠিক কোথায় ছিল। দেশের অর্থনীতির কথা মাথায় রেখে তাঁদের মিতব্যয়ী হয়ে কম খরচের উদ্ভাবনী শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে পদে পদে। সেই কারণে চন্দ্রযান এগিয়েছে পৃথিবীর আর চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্য নিয়ে উপবৃত্তাকার পথে অপেক্ষাকৃত ধীর গতিতে। 

সেখানে লুনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাশিয়া ব্যবহার করেছে অতি শক্তিশালী সোয়ুজ় 2.1 রকেট যার শক্তিশালী ইঞ্জিনের জ্বালানির ভান্ডার এতটাই চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম যা শেষ পর্যন্ত এই মহাকাশযানকে বাইরে থেকে কোনও সাহায্য ছাড়াই তার গন্তব্যে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিতে পারে। অর্থাৎ তফাৎটা সেই ধনী পরিবারের ইমপোর্টেড গাড়ির সাথে গরিবের গরুর গাড়ির মতোই যেন। কিন্তু বিধি বাম! শেষ পর্যন্ত এই উচ্চ শক্তির জ্বালানিই কাল হলো লুনার জন্যে। লুনা মাঝপথেই জ্বলে গেল তার রকেটের ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ার কারণে। আর চন্দ্রযান জিতে গেল।  তেইশে আগস্ট বিকেলে ভারত ফার্স্টবয় বা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করতে শেষ পর্যন্ত সক্ষম হয়েছে একথা তো আজ সারা পৃথিবীর মানুষ জানে ।


    সবশেষে আমার নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির  কথা বলতে ইচ্ছে করছে।  তেইশে আগস্টের বিকেলে তখন আমরা জড়ো হয়েছি এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হবো বলে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে থির থির করে । কেমন একটা সাসপেন্স: এবার কী হবে এই নিয়ে!  ছ'টা বাজতে তখন পাঁচ মিনিট বাকি। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে শেষ ওভারের খেলা দেখার মতো টান টান উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে গোটা দেশে , হয়তো বিদেশের মাটিতেও।  কিছুক্ষণ আগে ইসরোর নিজস্ব ওয়েবসাইটে আয়োজন করা  নেটিজ়েনদের চ্যাটবক্সে দুলক্ষ আটান্ন হাজার মানুষের সাথে আমিও যোগ দিয়েছি । হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একজন কী দু'জন নেটিজ়েন বলছেন যে ভারত চাঁদে নামতে আবারও ব্যর্থ হবে ! অজস্র মানুষ সাথে সাথেই রে রে করে উঠলেন এই নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা করা মানুষগুলোর বিরুদ্ধে। আমি ভাবছিলাম এখন সময় নষ্ট করার ক্ষণ নয় ।

অথবা দুই সংখ্যাকে দুলক্ষ আটান্ন হাজারের সাথে শতাংশ গনণায় ফল শূণ্য ধরে নেওয়াটাই যুক্তিপূর্ণ হবে । চাঁদ আর চন্দ্রযানের মধ্যে দূরত্ব তখন ক্রমশ কমে আসছে। পাঁচ কিলোমিটার থেকে কমতে কমতে একসময় এক কিলোমিটার হয়ে গেছে।  এখন তো বাকি আছে যাকে বলে নিয়মরক্ষার খেলা, সেইটুকু ...l তিনশো মিটার কমে দুশো, একশো ... । ঘড়িতে তখন ঠিক ছ'টা বেজে চার মিনিট। অর্থাৎ ইসরোর নির্ধারিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! এবং সাফল্য। ততক্ষণে ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে ফেলেছে । জয় হোক ইসরোর।  জয় হোক বিজ্ঞানের।  বন্দে মাতরম!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ