পোস্ট বার দেখা হয়েছে
প্রসঙ্গ চন্দ্রযান ৩ আর চাঁদ নিয়ে কিছু কথা।
লিখনে : ডা: এ এম আসিফ রহিম
চাঁদ এই পৃথিবিতে স্রস্টার সুন্দরতম নির্দশন । এই পৃথিবীতে যখন দিনের আলো হারিয়ে রাতের আধার নেমে আসে তখন চাঁদ আলো দিয়ে পথ দেখায় একাকি রাত জাগা কস্টে থাকা মানুষের সাথি যেন এই চাঁদ। তাই চাদকে নিয়ে কবি সাহিত্যিক সবাই কবিতা গান লিখেছেন প্রেমিকেরা চাদের সাথে প্রিয়তম প্রেমিকার মুখের অনিন্দ্যসুন্দর রুপের তুলনা দিয়ে বলেন চাঁদ মুখ। আবার ভরা পুর্নিমার চমৎকার আধার কালোর মাঝেও মানুষ আবেগতাড়িত হয় প্রেম ভালবাসা উতসারিত হয়। কবি সুকান্ত বলেছেন পুর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। অসম বিয়ের আলোচনার ক্ষেত্রেও সমাজে প্রবাদ বাক্য আছে বামুন হয়ে চাদে হাত বাড়িও না কারন চাঁদ শুধু দেখা যায় ছোয়া যায় না। অথচ চাদের আলোয় প্রিয়ার চোখে জল সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। সেই চাদের দেশে মানুষ অবতরন করেছে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য আর সেটা করেছে আমাদের প্রতিবেশি ভারত ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে আনন্দ উচ্ছ্বাসের পাশে বিজ্ঞান দিয়ে অজানাকে জানা অজেয় কে জয়ের নেশা আরো শানিত হয়ে উঠে।
চাঁদের রহস্যে ঘেরা দক্ষিণ মেরুতে প্রথম কোনও দেশ হিসেবে পা রাখলো ভারত।
বুধবার ২৩ শে আগস্ট ভারতের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় দেশটির চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার বিক্রম অবতরণ করতে শুরু করে। ৬টা ৪ মিনিটে চাঁদের মাটি স্পর্শ করে ইতিহাস গড়ে চন্দ্রযান-৩।
পৃথিবীর আর কোনও দেশ সেখানে এখন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। ভারতের কোটি কোটি মানুষের চোখ ছিল চন্দ্রপৃষ্ঠের সেই অনাবিষ্কৃত দক্ষিণ মেরুতে।
ঐতিহাসিক এই অভিযানের চূড়ান্ত মুহূর্ত সরাসরি সম্প্রচার করছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-ইসরো।
ভারতের দেড় শ’ কোটি মানুষ সম্মিলিতভাবে প্রতীক্ষা করে ছিল এই মহার্ঘ প্রহরের জন্য। চন্দ্রযানের চূড়ান্ত সাফল্যের কামনায় নমাজ, বিশেষ পূজা থেকে শুরু করে স্কুলে স্কুলে লাইভ অবতরণ দেখানোর ব্যবস্থা ছিল।
চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে ‘বিক্রম’। সেখানে এখনও পর্যন্ত কোনো দেশের কোনো মহাকাশযান নামতে পারেনি। ইসরো চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফলভাবে ল্যান্ডার নামাতে সক্ষম হওয়ায় ইতিহাস তৈরি করেছে ভারত।
গত ১৪ জুলাই ভারত চাঁদের উদ্দেশে তৃতীয় অভিযান শুরু করে। ওই দিন দুপুরে অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটা উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে চাঁদের দিকে রওনা দেয় চন্দ্রযান ৩। একটি এলভিএম ৩ রকেট দিয়ে চাঁদের উদ্দেশে চন্দ্রযানটিকে উৎক্ষেপণ করা হয়।
চন্দ্রাভিযানে রয়েছে একটি ল্যাণ্ডার ও একটি রোভার। ল্যাণ্ডার চাঁদের মাটিতে অবতরণ করবে আর রোভার চাঁদের মাটিতে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকবে। ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা বিক্রম সারাভাইয়ের নামে ল্যাণ্ডারটির নাম রাখা হয়েছে ‘বিক্রম’ আর রোভারটির নাম ‘প্রজ্ঞান’।
এই অভিযানে সফল হওয়ায় চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণকারী চতুর্থ দেশ হলো ভারত। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন চাঁদে নামতে সফল হয়েছিল।
আগের অভিযানে ২০১৯ সালে ঠিক চাঁদের মাটি ছোঁয়ার সময় ল্যাণ্ডার-রোভারটি ধ্বংস হয়ে যায়। তবে চন্দ্রযান-২-এর সেই অরবিটার এখনও চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর বেস-স্টেশনে নিয়মিত তথ্য পাঠিয়ে চলেছে।
চন্দ্রপৃষ্ঠের দক্ষিণ মেরু অঞ্চল নিয়ে এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে চন্দ্রযান-৩ ওই অঞ্চলে অবতরণের ফলে চাঁদের বিজ্ঞানীদের সেই ধাঁধাঁ ঘুচবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চন্দ্র পৃষ্ঠের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করে চাঁদের বয়স আবিষ্কারেরও চেষ্টা হবে বলে ইসরোর বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
দিল্লির শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্সের শিক্ষক ড. আকাশ সিনহা বলছেন, চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে অবতরণের ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সম্ভাবনাও এই অঞ্চলেই বেশি।
চন্দ্রপৃষ্ঠের ওই দক্ষিণ মেরু অংশেই ২০০৮ সালে জলের সন্ধান পেয়েছিল চন্দ্রযান-১।
এবার আসুন জানি চাঁদ আসলে কি?
চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব হচ্ছে ৩৮৪,৪০০ কিলোমিটার (প্রায় ২৩৮,৮৫৫ মাইল) যা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৩০ গুণ। এর অর্থ দাড়াচ্ছে, চাঁদের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ।এর পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বল পৃথিবী পৃষ্ঠে অভিকর্ষ বলের এক-ষষ্ঠাংশ। পৃথিবী পৃষ্ঠে কারও ওজন যদি ১২০ পাউন্ড হয় তা হলে চাঁদের পৃষ্ঠে তার ওজন হবে মাত্র ২০ পাউন্ড। পৃথিবী থেকে চাঁদের এই যে দূরত্ব এটা কিন্তু সবসময় এক থাকে না। কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। বর্তমান শতাব্দীতে চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে এসেছিল গত ১৯১২ সালের ৪ জানুয়ারি তারিখে। এই তারিখে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ছিল মাত্র ৩,৪৮,২৫৯ কিলোমিটার ( ২১৬৩৯৮ মাইল)। এই শতাব্দীতে চাঁদের সাথে পৃথিবীর দূরত্ব সর্বোচ্চ স্তরে গিয়েছিল ১৯৮৪ সালের ২রা মার্চে। এই দিনে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ছিল ৩,৯৮,৫৯৮ কিলোমিটার (২,৪৭,৬৭৫ মাইল)। চাঁদের বয়স প্রায় ৩৯০০ মিলিয়ন বছর। চাঁদের ব্যাস ৩,৪৭৪.২০৬ কিলোমিটার (২,১৫৯ মাইল) যা পৃথিবীর ব্যাসের এক-চতুর্থাংশের চেয়ে সামান্য বেশি। ওজন ৭.২৩×১০(১৯) অর্থাৎ ১০ এর ডানে ১৯টি শূণ্য বসিয়ে তাকে ৭.২৩ দিয়ে গুণ করলে যা হয়। ঘনত্ব জলের চেয়ে ৩,৩৪২ ভাগ ঘন। গতি ৩৬৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়(২২৮৭ মাইল )। এটি প্রতি ২৭.৩২১ দিনে পৃথিবীর চারদিকে একটি পূর্ণ আবর্তন সম্পন্ন করে। প্রতি ২৯.৫ দিন পরপর চন্দ্র কলা ফিরে আসে অর্থাৎ একই কার্যক্রম আবার ঘটে। পৃথিবী-চাঁদ-সূর্য তন্ত্রের জ্যামিতিতে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের কারণেই চন্দ্র কলার এই পর্যানুক্রমিক আবর্তন ঘটে থাকে।
চাদের ইতিহাস
প্রাচীনকালে সংস্কৃতি ছিল বিরল, বেশির ভাগ মানুষেরই নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান ছিল না। তারা মনে করত, চাঁদ প্রত্যেক রাত্রি মরে ছায়ার জগতে চলে যায়। অন্যান্য সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করত যে চাঁদ সূর্যকে পিছু করছে। পিথাগোরাসের সময়ে, চাঁদকে একটি গ্রহ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। মধ্যযুগে কিছু মানুষ বিশ্বাস করত যে চাঁদ হয়তো একটি নির্ভুলভাবে মসৃণ গোলক যা অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব সমর্থন করত এবং অন্যান্যরা মনে করত সেখানে সাগর আছে (সাগর বলতে চাঁদের উপরিতলের অন্ধকার অঞ্চলকে বোঝায় যা চিত্র শব্দতে এখনও ব্যবহার করে)। ১৬০৯ সালে গ্যালিলিও যখন তাঁর দূরবীক্ষণ চাঁদের দিকে ধরলেন, তিনি দেখলেন যে চাঁদের উপরিতল মসৃণ ছিল না। তা ক্ষুদ্র কালো রেখা, উপত্যকা, পর্বত এবং খাদের গঠিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকে তিনি অনুভব করতে শুরু করেন যে এটি পৃথিবীর মতোই একটি কঠিন গলিত পদার্থ ছিল যা পরে এই রূপ নেয়। ১৯২০ সালেও মনে করত যে চাঁদের শ্বাস গ্রহণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল আছে (অথবা ঐ সময় বিজ্ঞানের কাল্পনিক বানোয়াট গল্প বলত) এবং কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি ক্ষুদ্র বায়ু স্তরের উপস্থিতি আছে বলে অনুমান করত কারণ চাঁদ পর্যবেক্ষণ সময় তারা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু উড়ন্ত বস্তু দেখে ছিল।
একমাত্র জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু যাতে মানুষ ভ্রমণ করেছে এবং যার পৃষ্ঠতলে মানুষ অবতরণ করেছে। প্রথম যে কৃত্রিম বস্তুটি পৃথিবীর অভিকর্ষ অতিক্রম করেছিল এবং চাঁদের কাছ দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তা হল সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ১। লুনা ২ প্রথবারের মত চাঁদের পৃষ্ঠতলকে প্রভাবান্বিত করেছিল। চাঁদের দূরবর্তী যে অংশটা স্বাভাবিকভাবে লুকায়িত থাকে তার প্রথম সাধারণ ছবি তুলেছিল লুনা ৩। এই তিনটি ঘটনাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিচালনায় ১৯৫৯ সালে সংঘটিত হয়। ১৯৬৬ সালে লুনা ৯ প্রথমবারের মত চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে এবং লুনা ১০ প্রথমবারের মতো চাঁদের কক্ষপথ পরিক্রমণ করতে সমর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্র এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে পাল্লা দিতে অ্যাপোলো প্রকল্প শুরু করে। পরে ১৯৬৯ সালে, অ্যাপোলো-১১ অভিযান প্রথমবারের মতো চাঁদে মনুষ্যবাহী নভোযান অবতরণ করাতে সমর্থ হয়। নিল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন ছিলেন প্রথম মানুষ যাঁরা চাঁদে হেঁটেছেন । পরে আরও ১০ মানুষ কেবল চাঁদে হেঁটেছিল। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ছয়টি নভোযান চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে। অ্যাপোলো অভিযানের পর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চাঁদে মানুষ পাঠানোর সকল পরিকল্পনা ত্যাগ করে। ২০০৯ সালে প্রথম দিকে ভারত, চন্দ্রযান নামে একটি মহাকাশযান চাঁদে পাঠায়। কিন্তু প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। মহাকাশযান চাঁদে পৌঁছার পর পরেই তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু অল্প সময়ে যে তথ্য পাঠিয়েছে তা মানব জাতিকে নতুন করে আশার আলো দেখিয়েছে চাঁদে জীবের অস্তিত্ব থাকার কারণ সেখানে পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে৷ তবে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ভারতের ইসরো, চন্দ্রযান-২ নামে পুনরায় একটি মহাকাশযানের সফল উৎক্ষেপণ করে।
চন্দ্রগ্রহন ও সুর্যগ্রহন কি ও কেন হয়
পৃথিবীর নিত্যসঙ্গী চাঁদ। একমাত্র উপগ্রহ। তবে চাঁদের নিজের কোনো আলো নেই। নেই পৃথিবীরও। আলো আসে সূর্য থেকে। পৃথিবী যখন সূর্য আর চাঁদের মাঝখানে থাকে, তখন চাঁদের ওপর পৃথিবীর ছায়া পড়ে। ফলে পুরোটা চাঁদ বা এর কিছু অংশ পৃথিবী থেকে আর দেখা যায় না। এটাই চন্দ্রগ্রহণ। আর চাঁদ যখন পৃথিবীর চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে সূর্য আর পৃথিবীর মাঝাখানে চলে আসে, তখন সূর্যের আলো আর পৃথিবীতে এসে পৌঁছাতে পারে না। এটাই সূর্যগ্রহণ। শুনে সহজ মনে হলেও বাস্তবে বিষয়টা এত সহজ নয়। এর মধ্যে কিছু ‘কিন্তু’ আছে। বিষয়টা ভালোভাবে বোঝা যাবে একটা উদাহরণের কথা ভাবলে।
ধরা যাক, আজ পূর্ণিমা। এর মানে হচ্ছে সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ মোটামুটি একটি সরলরেখায় আছে। আর চাঁদের পুরো অংশটাই সূর্যের আলো প্রতিফলিত করছে পৃথিবীর বুকে। চাঁদ ২৭.৫ দিনে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে। সে হিসাবে সাড়ে ২৭ দিন পরে আর একটি পূর্ণিমা হওয়ার কথা। কিন্তু সেটা হয় না। প্রশ্ন হলো, কেন? কারণ সেই সময়ে পৃথিবী তার কক্ষপথ ধরে এগিয়ে যায়। তাই সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদকে একটি সরলরেখায় আনতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয় পুরো দুটো দিন। চাঁদ তার কক্ষপথে আরেকটু এগোতে, আর পৃথিবীর পেছনে সূর্যের সঙ্গে একটি সরলরেখায় চলে আসতে, অর্থাৎ একটি পূর্ণ চন্দ্রমাস হতে সময় লাগে ২৯.৫ দিন। তাহলে বিষয়টা আসলে কী দাড়াচ্ছে? চাঁদ প্রতি ২৯.৫ দিনে একবার সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে চলে আসে। তার মানে, প্রতি ২৯.৫ দিনে সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ এক সরলরেখায় থাকলে তো চন্দ্রগ্রহণ হওয়ার কথা, তাই না? কিন্তু আমরা জানি, বাস্তবে এমনটা হয় না। প্রশ্ন হলো, কেন? কিংবা প্রতি ২৯.৫ দিনে অমাবস্যার সময় কেন সূর্যগ্রহণ হয় না? চাঁদের ছায়া পৃথিবীর ওপরেই-বা পড়ে না কেন? রহস্যটা এখানেই।
সূর্যকে পৃথিবীটা যে সমতলে প্রদক্ষিণ করে, সেটাকে বাংলায় বলে অয়ন বৃত্ত। চাঁদ কিন্তু সেই একই সমতলে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না। চাঁদের কক্ষপথ সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর অয়নবৃত্তের সঙ্গে পাঁচ ডিগ্রি কোণ করে আছে। এই পাঁচ ডিগ্রি পার্থক্যের জন্য চাঁদ সবসময় পৃথিবী ও সূর্যের সঙ্গে এক সরলরেখায় থাকে না। পৃথিবী থেকে দেখলে—চাঁদ কখনো সূর্যের নিচে, আবার কখনো সূর্যের ওপরে থাকে। একপাক ঘুরে আসার সময় চাঁদের কক্ষপথ অয়নবৃত্তকে দুবার ছেদ করে। এই ছেদবিন্দুগুলোকে বলা হয় চন্দ্রযোগ। আর এই চন্দ্রযোগের সময় সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ চলে আসে এক সরলরেখায়। শুধু এ সময়ই হতে পারে গ্রহণ। অর্থাৎ এই ঘটনা বা মহাকর্ষীয় রেখায় আসার ঘটনা ঘটে বছরে দুই বারের মতো।
সূর্যের ব্যাস চাঁদের ব্যাসের চেয়ে প্রায় ৪০০ গুণ বড়। আবার পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বও পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের প্রায় ৪০০ গুণ। তাই আমাদের চোখে চাঁদ আর সূর্যের আকার একই মনে হয়। চাঁদের কক্ষপথ বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। এই কক্ষপথে চাঁদ যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকে, তাকে বলা হয় অনুভূ (Perigee)। আর যখন সবচাইতে দূরে থাকে, তাকে বলা হয় অপভূ (Apogee)। এই দূরত্বের কম বেশির জন্যই আমরা কখনো চাঁদকে বড় দেখি, আর কখনো ছোট দেখি। এই ছোট-বড় হওয়ার পরিমান প্রায় ১৪ শতাংশ।
সূর্যগ্রহণ কেমন হবে, সেটার সঙ্গে চাঁদের এই আকারের সম্পর্ক নিগূঢ়। একই সমতলে না থাকার ফলে চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে না দিয়ে সূর্যের তলের আংশিক নিচ বা ওপর দিয়ে যেতে পারে। ফলে তখন চাঁদ, সূর্য ও পৃথিবী এক রেখায় থাকলেও গ্রহণ হয় না।
আবার যদি একই সমতলে থাকে—কিন্তু চাঁদ যদি ছোট থাকে, তাহলে সেটা সূর্যকে পুরোপুরি ঢাকতে পারে না। ফলে তখন গ্রহণ হলেও চাঁদের চারপাশ থেকে সূর্যের খানিকটা রশ্মি বেরিয়ে আসে। পৃথিবী থেকে এই আলোকে আংটির মতো দেখায়। এর নাম বলয় গ্রাস।
আর চাঁদ যদি অনুভূতে থাকে, তাহলে চাঁদকে পৃথিবী থেকে বড় দেখায়। এটা সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে। তাই একে বলা হয় পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। এই গ্রহণ দেখতে হলে আমাদেরকে পৃথিবীর সঠিক স্থানে থাকতে হবে। আলোর গতিপথে কোনো অস্বচ্ছ বস্তু থাকলে বস্তুটির পেছনের অন্ধকারছন্ন অঞ্চলটিকে ছায়া বা প্রচ্ছায়া বলা হয়। প্রচ্ছায়ার চারপাশে একটি কম অন্ধকারাছন্ন স্থান থাকে, যেখানে আলোক উৎসের কিছু অংশ থেকে আলো পৌঁছায়। এই কম অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চলটিকে বলে উপচ্ছায়া। এর বাইরে সূর্যকে আর দেখা যায় না। সূর্যগ্রহণ খুবই ক্ষণস্থায়ী। খুব বেশি হলে সাত মিনিট দেখা যায়।
চাঁদের ওপর পৃথিবীর ছায়ার আকার বেশ বড় হলে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের সময়কাল বড় হয়। এ সময় পৃথিবীর একটা বড় অংশ থেকে দেখা যায় পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। চন্দ্রগ্রহণও কিন্তু অনেকটা সূর্যগ্রহণের মতো। তবে এক্ষেত্রে চাঁদ ঢাকা পড়ে পৃথিবীর ছায়ায়। অর্থাৎ পৃথিবী সূর্য ও চাঁদের মাঝখানে থাকার ফলে চাঁদে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে এ সময় রাত থাকে, সেসব অঞ্চল থেকেই এই গ্রহণ দেখা যায়। এই গ্রহণ কয়েক ঘন্টাও হতে পারে। ২০২১ সালের নভেম্বরের ১৯ তারিখ ছিল এরকম একটি বিশেষ দিন। সেদিন প্রায় ৬০০ বছরের দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ হয়েছিল। এর স্থায়িত্ব ছিল প্রায় ছয় ঘন্টা।
তবে পূর্ণ গ্রহণের সময়ও কখনো কখনো সূর্যের আলোর কিছুটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রতিসরিত হয়ে চাঁদে পড়তে পারে। এ সময় চাঁদকে লালচে দেখায়। আমরা যাকে বলি ব্লাডমুন।
চাঁদ পৃথিবী থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এই দূরত্ব যত বাড়বে, চাঁদের ছায়া ও আকারও তত ছোট হতে থাকবে। ধারণা করা হয়, আজ থেকে ১০০ কোটি বছর পরে হয়তো পৃথিবী থেকে আর কোনো গ্রহণই দেখা যাবে না। গ্রহণহীন সেই পৃথিবীতে জোয়ার-ভাটা কেমন হবে? সে আরেক মজার বিষয়।
ধর্মীয় উতসব কিংবা আচার পালনে চাদের ভুমিকা
মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাই বিশেষ করে মুসলিমরা চন্দ্র মাস দেখে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। যেমন রমজান হজ্ব ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহা ইত্যাদি।প্রশ্ন হল সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশ ও ভারত যথাক্রমে ৩ঘন্টা ও আড়াই ঘন্টা এগিয়ে থাকলেও চাঁদ দেখা যায় ওদের একদিন পরে। কিন্তু কেন?
পৃথিবী নিজের অক্ষের চারদিকে পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরে চলেছে। যাকে আহ্নিক গতি বলে। গতিটা সহজে বোঝা যাবে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিক বা অ্যান্টি ক্লকওয়াইজ বললে। সাধারণভাবে বললে আমরা এভাবে বলতে পারি, সূর্য পূর্বদিকে উদিত হয় বলে পূর্বের দেশ হিসেবে আমাদের দিন আগে শুরু হয়। জাপানের দিন সবার আগে, যে কারণে জাপানকে সূর্যোদয়ের দেশ বলা হয়। এদিকে ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী পশ্চিমের দেশগুলোর দিন আমাদের পরে শুরু হয়। যে কারণে আমরা আঞ্চলিক সময়ের হিসাবে এগিয়ে আছি। যেমন আমরা কাছের মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রায় ৩ ঘন্টা, দূরের ইউরোপ থেকে গড়ে ৬ ঘন্টা এবং আরও পশ্চিমের আমেরিকা থেকে প্রায় ১২ ঘন্টা এগিয়ে আছি। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, সৌর হিসেবে সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য মাত্র ৩ ঘণ্টা হলেও চন্দ্রের হিসেবে সৌদি আরব ও আমাদের পার্থক্য ২১ ঘণ্টার।
এখন আসি চাঁদের হিসাবে। সাধারণত চাঁদ পশ্চিমে উদিত হয় আর পূর্বে অস্ত যায়। সেই হিসাবে আমরা যারা পূর্বের দেশগুলোতে অবস্থান করছি, স্বাভাবিকভাবে চাঁদ আমাদের কিছুটা পরে দেখাই উচিত এবং তাই হয়ে থাকে। বছরের সবসময় এমন ঘটনা ভূমন্ডলে সম্পাদিত হয়। কিন্তু চাঁদের হিসাব শুধু ঈদ আসলে আমাদের চোখে ধরা পড়ে বিধায় আমরা ঈদ আগে বা পরে নিয়ে অহেতুক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হই।
সাধারণত মাধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবে মাঝে মাঝে সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগেই চাঁদ দেখা যায়। এখন আসি অন্য একটি পরিসংখ্যানে, যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে যখন চাঁদ দেখা যাবে, তখন সে চাঁদটি দেখার জন্য কানাডার ইস্ট কোস্টে অবস্থানরত মানুষদের অপেক্ষা করতে হবে ভোর ৩-৪ টা পর্যন্ত। এবার ওই একই চাঁদকে দেখার জন্য জাপান থেকে দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে পরেরদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত। অর্থাৎ হাওয়াই অঞ্চলে রমজান শুরু হয়ে গেলেও জাপানের মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব হবে না সেই চাঁদ দেখে রোজা শুরু করা। কারণ, কোনো এক দেশে চাঁদ দেখা গেলেও অন্যদেশে দেখা যেতে দেরি হতে পারে। কেননা খালি চোখে চাঁদকে দেখতে হলে চন্দ্র আর সূর্যের মাঝে ১০.৫ ডিগ্রি কোণ থাকতে হবে এবং যে পরিমাণ দূরত্ব অর্জন করলে এই কোণ তৈরি হবে, সে পরিমাণ যেতে যেতে চাঁদের ১৭ থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত লেগে যায়। এ কারণে আজ আমেরিকাতে চাঁদ দেখে গেলেই যে বাংলাদেশেও দেখা যাবে, সেটা ভুল ধারণা। যতক্ষণ না পর্যন্ত সেই কোণ অর্থাৎ ১০.৫ ডিগ্রি অর্জন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেখা যাবে না। একই বিষয় সৌদি আরব ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও।
এই সঙ্কট কোণকে বিজ্ঞানের ভাষায় ইলঙ্গেশন বলে। তাই চাঁদের বয়স কত সেটা আদৌ আসল কথা নয়, সেই কোণ হয়েছে কিনা সেটার ওপর নির্ভর করে চাঁদ দেখা যাবে কিনা। ফলে আমরা সৌদি আরব থেকে ৩ ঘণ্টা সূর্যের হিসেবে এগিয়ে থাকলেও, চাঁদের হিসেবে ২১ ঘণ্টা পিছিয়ে আছি। অর্থাৎ আমরা প্রায় একদিন পিছিয়ে আছি। সেজন্য সৌর বছরের হিসেবে একদিন পরে চাঁদ দেখি। সেই হিসাবে সৌদি আরবে একদিন আগে ঈদ হয়।
চন্দ্রপৃষ্ঠ নিয়ে কিছু কথা
চাঁদের সৃষ্টির পরপর, এর পৃষ্ঠ অনেক গরম ছিল এবং কোনো প্রকার গর্ত ছিল না। চাঁদে বিপুল পরিমাণে ধূমকেতু ও গ্রহানুর আঘাতে গর্তের সৃষ্টি হয়। এই সময়টি late heavy bombardment নামে পরিচিত।
চাঁদের দুই পার্শ্ব
চাঁদের ঘূর্ণনটি সঙ্কালিক অর্থাৎ ঘূর্ণনের সময় সবসময় চাঁদের একটি পৃষ্ঠই পৃথিবীর দিকে মুখ করা থাকে। চাঁদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এর ঘূর্ণন ধীরতর হতে হতে একটি নির্দিষ্ট গতিতে এসে locked হয়ে যায়। পৃথিবী দ্বারা সৃষ্ট জোয়ার-ভাটা সংক্রান্ত বিকৃতির সাথে সম্পর্কিত ঘর্ষণ ক্রিয়ার কারণেই এই লকিং সৃষ্টি হয়। উপরন্তু, চান্দ্র কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা থেকে যে ক্ষুদ্র পরিবর্তনের সৃষ্টি হয় তার কারণে পৃথিবী থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠের শতকরা প্রায় ৫৯ ভাগ দৃশ্যমান হয়ে উঠে। এই পরিবর্তনের ক্রিয়াটিকে লাইব্রেশন বলা হয়।
চাঁদের নিকট পার্শ্ব
চাঁদের দূর পার্শ্ব
চাঁদের যে পৃষ্ঠটি পৃথিবীর দিকে মুখ করে থাকে তাকে নিকট পার্শ্ব বলা হয় এবং এর বিপরীত পৃষ্ঠটিকে বলা হয় দূর পার্শ্ব। দূর পার্শ্বের সাথে আবার অন্ধকারাচ্ছন্ন পার্শ্বের সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। চাঁদের যে গোলার্ধে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যের আলো পৌঁছায় না সে গোলার্ধকে অন্ধকারাচ্ছন্ন পার্শ্ব বলা হয়। ১৯৫৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ৩ নামক নভোযান প্রথমবারের মতো চাঁদের দূর পার্শ্বের ছবি তুলেছিল। এই পার্শ্বের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে একেবারেই কোনো মারিয়া (চাঁদের বিশেষ ভূমিরূপ, আক্ষরিক অর্থে সাগর) নেই।
চাঁদের লাইব্রেশন
পবিত্র কোরানে চাঁদ নিয়ে কি বলা হয়েছে
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বিভিন্ন জায়গায় চাঁদের কথা অবতারণা করেছেন। চাঁদের সৃষ্টি, চাঁদ তার কক্ষপথে চলে, চাঁদকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে—এমন অনেক প্রশ্নের জবাবও কোরআনে কারিমে এসেছে। নিম্নে আমরা চাঁদ বিষয়ে কয়েকটি আয়াত নিয়ে আলোচনা করব।
এক. চাঁদ আল্লাহর এক মহান সৃষ্টি।
তাই আল্লাহ তাআলা কোরআনে চাঁদকে নিয়ে শপথ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘কখনোই নয়, শপথ চাঁদের।’ (সুরা : মুদ্দাসসির, আয়াত : ৩২)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এবং (আমি শপথ করছি) চাঁদের, যখন তা ভরাট হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে।’ (সুরা : আল-ইনশিকাক, আয়াত : ১৮)
দুই. মানুষের স্বভাব, বড় কোনো কিছু দেখলে তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি বেড়ে যায়।
এমনকি তার উপাসনা শুরু করে দেয়। আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে দিয়েছেন যে চাঁদ আল্লাহর একটি সৃষ্টি মাত্র। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁরই নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত হলো রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা কোরো না এবং চন্দ্রকেও না; বরং সিজদা করো আল্লাহকে, যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, যদি বাস্তবিকই তোমরা তাঁর ইবাদত করে থাকো।’ (সুরা : হা-মিম আস-সিজদাহ, আয়াত : ৩৭)
তিন. ঝলমলে চাঁদকে দেখার পর ভাবনার কথা এসেছে কোরআনে। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন সে চাঁদকে উজ্জ্বলরূপে উদিত হতে দেখল তখন বলল, ‘এই আমার রব’। কিন্তু যখন সেটিও ডুবে গেল, তখন বলতে লাগল, আমার রব আমাকে হিদায়াত না দিলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্ট লোকদের দলভুক্ত হয়ে যাব।’ (সুরা : আল-আনআম, আয়াত : ৭৭)
চার. চাঁদ আল্লাহপ্রদত্ত নুর। ইরশাদ হয়েছে, “তিনিই আল্লাহ, যিনি সূর্যকে রশ্মিময় ও চন্দ্রকে জ্যোতিপূর্ণ করেছেন এবং তাঁর (পরিভ্রমণের) জন্য বিভিন্ন ‘মনজিল’ নির্ধারণ করেছেন, যাতে তোমরা বছরের গণনা ও (মাসের) হিসাব জানতে পারো।
আল্লাহ এসব যথার্থ উদ্দেশ্য ছাড়া সৃষ্টি করেননি। যেসব লোক জ্ঞান-বুদ্ধি রাখে, তাদের জন্য তিনি এসব নিদর্শন সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন।” (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৫)
পাঁচ. চাঁদের মাধ্যমে মানুষ হিসাব করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘(তিনিই) ভোরের উদঘাটক। তিনিই রাতকে বানিয়েছেন বিশ্রামের সময় এবং সূর্য ও চন্দ্রকে করেছেন এক হিসাবের অনুবর্তী। এসব মহাপরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ সত্তার পরিকল্পনা।’ (সুরা : আল-আনআম, আয়াত : ৯৬)
অর্থাৎ এ সব কিছুতে তিনি স্বীয় প্রভুত্ব বিকাশ করেছেন এবং বান্দার উপকারও এর মধ্যে নিহিত রেখেছেন, যথা—বছরসমূহের পরিগণনা প্রত্যেক কিছুর মেয়াদ হিসাব করা চন্দ্র-সূর্যের ওপর নির্ভর করে হয়।
ছয়. চাঁদ-সুরুজ সৃষ্টি করে তিনি তাদের ছেড়ে দেননি, বরং তারই আজ্ঞাধীন করে রেখেছেন। যেগুলো সর্বদা মানুষের সেবায় নিয়োজিত। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক সেই আল্লাহ, যিনি সব আসমান ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি আরশে ইস্তিওয়া গ্রহণ করেন। তিনি দিনকে রাতের দ্বারা ঢেকে দেন, যা দ্রুতগতিতে ধাবিত হয়ে তাকে ধরে ফেলে। এবং সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি (সৃষ্টি করেছেন), যা সবই তাঁরই আজ্ঞাধীন। স্মরণ রেখো, সৃষ্টি ও আদেশ দান তাঁরই কাজ। আল্লাহ অতি বরকতময়, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক।’ (সুরা : আল-আরাফ, আয়াত : ৫৪)
অন্য আয়াতে বলেন, ‘তিনি দিন-রাত ও চন্দ্র-সূর্যকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। নক্ষত্ররাজিও তাঁর নির্দেশে কর্মরত আছে। নিশ্চয়ই এর ভেতর বহু নিদর্শন আছে সেসব লোকের জন্য, যারা বুদ্ধি কাজে লাগায়।’ (সুরা : আন-নাহল, আয়াত : ১২)
সাত. চাঁদ সব সময় ঘূর্ণায়মান থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের কাজে নিয়োজিত করেছেন, যা অবিরাম পরিভ্রমণরত আছে। আর তোমাদের জন্য রাত ও দিনকেও কাজে লাগিয়ে রেখেছেন।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৩৩)
আট. চাঁদ আল্লাহর জন্য সিজদা করে থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখোনি আল্লাহর সম্মুখে সিজদা করে যা কিছু আছে আকাশমণ্ডলীতে, যা-কিছু আছে পৃথিবীতে এবং সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি, পাহাড়, বৃক্ষ, জীবজন্তু ও বহু মানুষ? আবার এমনও অনেক আছে, যাদের প্রতি শাস্তি অবধারিত হয়ে আছে। আল্লাহ যাকে লাঞ্ছিত করেন তার কোনো সম্মানদাতা নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ করেন যা তিনি চান।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ১৮)
নয়. চাঁদ নির্দিষ্ট কক্ষপথে চলে। এর মধ্যে কোনো ধরনের ব্যত্যয় হয় না। ইরশাদ হয়েছে, ‘চাঁদের উদয় এবং অস্তের নির্দিষ্ট সময় রয়েছে এরপর তার এই পরিক্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। তুমি দেখোনি আল্লাহ রাতকে দিনের মধ্যে প্রবিষ্ট করান এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবিষ্ট করান এবং তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিয়োজিত করে রেখেছেন, প্রত্যেকটি নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বিচরণশীল এবং (তুমি কি জানো না) আল্লাহ তোমরা যা কিছু করছ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত?’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ২৯)
দশ. চাঁদ তার কক্ষপথে সাঁতার কাটে। আল্লাহ বলেন, ‘এবং তিনিই সেই সত্তা, যিনি রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্র সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো কক্ষপথে সাঁতার কাটছে।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৩৩)
এগারো. সূর্যের নির্দিষ্ট কক্ষপথ রয়েছে সে কখনো চাঁদকে ধরতে পারবে। আল্লাহ বলেন, ‘সূর্য নাগাল পায় না চাঁদের আর রাতের পক্ষে সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা। প্রত্যেকেই নিজ নিজ কক্ষপথে সন্তরণ করে।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৪০)
বারো. চাঁদের অনেক মঞ্জিল রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর চাঁদের জন্য আমি নির্দিষ্ট করে দিয়েছি বিভিন্ন মনজিল। পরিশেষে তা (নিজ মনজিল অতিক্রম করে) ফিরে আসে পুরনো খেজুর ডালার মতো (সরু হয়ে)।’ (সুরা : ইয়াসিন, আয়াত : ৩৯)
তেরো. চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া সম্ভব। ইরশাদ হয়েছে, ‘কিয়ামত কাছে এসে গেছে এবং চাঁদ ফেটে গেছে।’ (সুরা : আল-কামার, আয়াত : ১)
চৌদ্দ. স্বপ্নে চাঁদকে সিজদা করতে দেখার ঘটনা এসেছে কোরআনে। আল্লাহ বলেন, ‘(এটা সেই সময়ের কথা) যখন ইউসুফ নিজ পিতা (ইয়াকুব আ.)-কে বলেছিল, আব্বাজি, আমি (স্বপ্নযোগে) ১১টি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্রকে দেখেছি। আমি দেখেছি তারা সবাই আমাকে সিজদা করছে।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪)
পনেরো. এমন একদিন আসবে, যেদিন চাঁদ জ্যোতিহীন হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, ‘এবং চাঁদ নিষ্প্রভ হয়ে যাবে। এবং চাঁদ ও সূর্যকে একত্র করা হবে।’ (সুরা : কিয়ামা, আয়াত : ৮-৯)
কাজল কালো রাতের আকাশে অজস্র তারকার মধ্যখানে রুপার থালার মতো উজ্জ্বল যে বস্তুটি রাতভর তার স্নিগ্ধ আলোয় আলোকিত করে রাখে পুরো পৃথিবীকে, তার নাম চাঁদ। চাঁদকে চেনে না কে? চাঁদকে আমরা অনেক নামেই চিনে থাকি। এই যেমন চন্দ্র, চন্দ্রিকা, শশী ইংরেজিতে চাঁদকে বলা হয় মুন। আর কোরআনে চাঁদের নাম রাখা হয়েছে ক্বামার। ক্বামার নামে পবিত্র কোরআনে একটি সুরাও আছে। নতুন চাঁদকে আরবি ভাষায় অবহিত করা হয় হেলাল বলে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের মানুষজন বিভিন্ন ভাষায় চাঁদকে বিভিন্ন নামে ডাকেন। সত্যিই! চাঁদ আমাদের সবার কাছে অতি আদরমাখা একটি নাম। পৃথিবীতে এমন লোকের সংখ্যা খুব কমই হবে, চাঁদ যাদের তার মায়াবী জোছনায় বিমোহিত করেনি।
চাঁদের সৃষ্টির তথ্য নিয়ে আমাদের মধ্যে মত-দ্বিমতের শেষ নেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, চাঁদ পৃথিবীরই একটি অংশ। মহাবিস্ফারণের ফলে এর জন্ম হয়েছে। তারা মনে করেন চাঁদ তৈরি হয়েছে একটি ছোট গ্রহের সঙ্গে পৃথিবীর ধাক্কা লাগার কারণে। এই সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীর যে ধ্বংসাবশেষ হয়েছে, সেই ধ্বংসাবশেষগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। ঘুরন্ত সেই মেঘগুলোই একপর্যায়ে জমাটবদ্ধ হয়ে চাঁদে পরিণত হয়।
এবার আসুন জেনে নিই এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন কী বলে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘কল্যাণময় তিনি, যিনি নভোম-লে রাশিচক্র সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে রেখেছেন সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্র।’ (সুরা আল ফুরকান, আয়াত : ৬১)
চাঁদকে কেন্দ্র করে যেমন রূপকথার শেষ নেই, তেমনি শেষ নেই উপ-কথারও। পাশ্চাত্য দেশের মানুষরা মনে করতেন, ‘চাঁদে একটা মানুষ আছে, আর সে মানুষটি প্রায় চাঁদের সমান বড়। প্রাচীন যুগের কিছু মানুষ মনে করতেন, চাঁদ প্রত্যেক রাতে মরে গিয়ে ছায়ার জগতে মিলিয়ে যায়। আবার কেউ কেউ মনে করতেন, সূর্য আর নক্ষত্রের মতো চাঁদও বুঝি তাদের আরেকটি দেবতা। চাঁদকে তারা নাম দেন চন্দ্রদেব।
0 মন্তব্যসমূহ