পোস্ট বার দেখা হয়েছে
" আইস অ লো সঙ্গতি সবাই হাত ধরে নাচি লো -
একমনে জাওয়া দিব , জাওয়া যেমন বাড়হে লো।
কাঁসাই লদির বালি আইনে জাওয়া পাতাব লোক -
হামদের জাওয়া উঠে শাল ধুধের পারা লো -
আবার কখন গাওয়া হয় -
" কাঁসাই লদির বালিয়ে জাওয়া পাতিব লো ।।
সুরজ উঠে খিনি খিনি আমার জাওয়া উঠে না।
জাওয়ার লাগি দিন উপাসগো।
সাত দিনকার জাওয়ার লাগি দিন পালন করি গো ।
তাও আমরা জাওয়া পাতাব গো ।
আজ করম পরব । আমাদের দেশ রামায়ণ , মহাভারতের দেশ । তাই সেখানে আছে নানান কাহিনী নানান মিথ। যে মিথের প্রতি আছে আমাদের অমোঘ আকর্ষণ। আমাদের অনেকের হয়তঃ জানা আছে যে আদিবাসীদের একটা বড় উৎসব হল # করম# পুজা। ভাদ্র মাসের এগারো চাঁদের দিন এই পরব অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র ছোটনাগপুর , মানভূম এবং উড়িষ্যার কোনো কোনো অঞ্চলে যেখানে আদিবাসীরা বসবাস করেন সেখানে এই পরব দেখা যায়। করম দেবতা মূলতঃ শক্তি , যৌবন, সুখ ও শান্তি এবং সমৃদ্ধির প্রতীক । করম ( কদম) গাছের ডাল, করম দেবতার প্রতীক। আদিবাসী যুবকেরা জঙ্গলে গিয়ে ফুল ও ফল সংগ্রহ করে। এরপর এই করম গাছকে ঘিরে চলে নৃত্য গীত। এবার দুটো গল্প বলি এই করম পুজোকে ঘিরে।
কথিত আছে এই জঙ্গলমহলে একটি গ্রামে সাত ভাই এবং তাদের সাত বৌ বাস করত । তাদের বৌ'রা দুপুরে তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসত মাঠে। একদিন ওরা খাবার না খেয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে রইল বৌ' রা সেদিন খাবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল ! পরের দিন দুপুরে খাবার এলো না । সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর চাষীরা বাড়ি গিয়ে দেখে এক কদম গাছের নীচে তাদের বৌ'রা নৃত্যগীতে ব্যস্ত। ওমনি তাদের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো তারা ওই ডালটি ভেঙে ফেলল। এরপর থেকেই অশান্তি ঘরে প্রবেশ করল। উপায় খুঁজতে থাকে সাত ভাই ।এরপর এক পুরোহিত বলেন করমের পুজো করলে সবকিছু ফেরত পাওয়া যাবে। প্রথমটা রাজি না হলেও পরবর্তীতে তারা এই পুজো করে। অবশেষে তারা পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসেন। গাছপালা যে আমাদের প্রধান সম্পদ এবং প্রকৃতিতে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছে এই সত্যটাকে গল্পের মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে। আর এটা তো সকলের জানা আদিবাসীদের সকলেই প্রায় অরণ্যচারী। এতো হল গল্প ! এবার কিছু ঐতিহাসিক তথ্য এবং সত্যতার অনুসন্ধান চালাই। " করম ঠাকুর সিং ( রাজা) ছিলেন মেবারের এক প্রদেশের। পার্শ্ববর্তী রাজা ছিলেন শিরোহি । বাংলাদেশ জয়ে সাহায্য করার জন্য রাজা শিরোহি আহ্বান করেছিলেন রাজা করিম কে । করিম সাহায্য করতে এসে এই জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেললেন। এবং বেঁচে থাকার জন্য চাষবাস শুরু করলেন। তাই করমের কিছু গানে আজ ও মিশে আছে ধার, ইন্দোর শিরোহি স্থানের নাম। ছৌ আর ঝুমুরের তালে তালে চলে নাচ গান। জানি না কতোখানি ঐতিহাসিক সত্যতা আছে এতে তবে এটাও অস্বীকার করা যায় না রাজা করম সিং এর কাহিনীটি ধীরে ধীরে আদিবাসীদের উৎসব হিসেবে মান্যতা পেয়েছে। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশী তিথিতে করম পরব উৎসব হয়ে থাকে। এর সাত/ পাঁচ / তিন দিন আগে মেয়েরা ভোরবেলায় শালের দাঁতন কাঠি ভেঙে নদী বা পুকুরে স্নান করে বাঁশ দিয়ে বোনা ছোট টুপা ও ডালায় বালি দিয়ে ভর্তি করেন । তারপর গ্রামের প্রান্তে একস্থানে ডালাগুলো রেখে জাওয়া গান গাইতে গাইতে তিনপাক ঘোরে । এরপর তাতে তেল হলুদ দিয়ে মটর, মুগ, বুট,জুনার ও কুত্থির বীজ মাখানো হয়। অবিবাহিত মেয়েরা স্নান করে ভিজে কাপড়ে ছোট শাল পাতার থালায় বীজগুলো কে বুনে দেন ও তাতে সিঁদুর ও কাজলের তিনটে দাগ টানা হয়, যাকে জাওয়া ডালি বলে।প্রত্যেকের ডালি নির্দিষ্ট করার জন্য কাশকাঠি পুঁতে দেওয়া হয়। এরপর কুমারী মেয়েরা সারাদিন উপোস করে সন্ধ্যার পরে করম ঠাকুর ধরম ঠাকুর হিসেবে পূজিত হন। এরপর করম ডাল ও জাওয়া ডালিকে কে ঘিরে নাচ, গান চলে। পরদিন সকালে মেয়েরা জাওয়া থেকে অঙ্কুরিত বীজগুলিকে উপড়ে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন। এরপর করম ডালিকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় জলাশয়ে। কথিত আছে যে অবিবাহিতা কন্যাটির চুবড়ি যত লাবণ্য পায় তার তত উর্বরতা বেশি বলে মনে করা হয়। মোটের উপর প্রজনন এবং উর্বরতা দেবী কে তুষ্ট করা। অবিবাহিত মেয়ে যেন বিবাহ এবং সন্তানের জন্ম দিয়ে গৃহস্থ এগিয়ে নিয়ে চলেন অপরদিকে মাটি মাও যেন উর্বর হয়ে ওঠেন। তবে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে ওঁরাও - এই সমাজের কিশোর - কিশোরী এবং যুবক - যুবতীরা হয়ে ওঠে নৃত্যচঞ্চল , সঙ্গীত মুখর , এবং পানাহার মত্ত । এ কেবল কারাম বৃক্ষের আবাহন নয় এদের মন দেওয়া নেওয়া, আশা- আকাঙ্ক্ষা ও কামনা - বাসনা প্রকাশের ও উৎসব বটে! শহরে যেভাবে পালন হয় সরস্বতী পুজো কিমবা ভ্যালেন্টাইনস্ ডে ! এহেন উৎসব কে লোক সংস্কৃতির অঙ্গ বললে কি খুব ভুল করা হবে? লোক না থাকলে তার ঐতিহ্য ধরে রাখার কেউ থাকে না। ঐতিহ্য অনুসারে বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস , আচার - আচরণ ও অনুষ্ঠান জীবন যাপন প্রণালী , শিল্প ও বিনোদন ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি কে আমি তো সহজ ভাষায় লোক সংস্কৃতিই বুঝি...!!!!*** আজকে যেভাবে জঙ্গল উচ্ছেদ করে বড় বড় উন্নয়নের ভাবনায় মেতেছেন তাঁদের উদ্দেশ্যে বলছি একটু ভাবুন। ওঁরা বড় সহজসরল জীবনে অভ্যস্ত কিন্তু এটাও তেমনই সত্যি ওঁরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে শিখেছে বহুকাল আগে। ওরা যেকোনো বিদ্রোহের আসল অংশীদার।
0 মন্তব্যসমূহ