পোস্ট বার দেখা হয়েছে
কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতিসত্তার এক পরিপূর্ণ ও সচেতন মুখপাত্র। ব্রিটিশ শাসন আর আধিপত্যবাদের যাঁতাকলে পিষ্ঠ ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ যখন এক মহা সংকটের মুখে পতিত হয়েছিল, ঠিক এমনই দুর্বিসহ সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম শতাব্দীর ধূমকেতু হয়ে উদিত হলেন বাংলা সাহিত্যের গগণে। এক 'ধূমকেতুর' হাতে আরেক ‘ধূমকেতুর’ প্রজ্জ্বলন ঘটালেন তিনি:
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুন:মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু। [ধূমকেতু]
আজন্ম স্বাধীনতার চেতনা লালনকারী এই পরাধীনতার যাঁতাকল থেকে কবি এদেশকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে। তিনি আধিপত্যবাদী ও অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে একটি সর্বব্যাপী স্বাধীনতা চেতনার জন্ম দিতে চেয়েছিলেন এ দেশের প্রতিটি মানুষের মনে। সে কারণে তিনি ঘোষণা করলেন Ñ ‘ধূমকেতু সর্ব প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়’।
ধূমকেতুর পথচলায় মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন যুগ যুগ ধরে চলে আসা ঐতিহ্যের মিশেলে বিদ্রোহের ক্ষুরধার বাণী। সে বাণীকে গ্রহণ করল স্বদেশবাসী সকলেই। সে সময়ের সাহিত্য-ভূবনের অগ্রপথিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধূমকেতু’কে স্বাগত জানিয়ে লিখলেন-
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু-
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু
আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
দুর্দিনের এই দূর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন,
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে আছে যারা অর্ধচেতন। [২৪ শ্রাবণ, ১৩২৯, শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
কেন তিনি এমন ঘোষণা করলেন? হ্যাঁ, কারণ আছে। আধিপত্যবাদী অন্যায় অবিচারের পক্ষে যাওয়া তো দূরের কথা, নীরবে এ সব মেনে নিতেই নারাজ কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলকে আমরা স্বাধীনতার কবি, আধিপত্যবাদ বিরোধী দ্রোহের কবি ইত্যাদি বলে গৌরব বোধ করে থাকি। নজরুলকেও সম্মানের আসনে বসাই। ঠিক আছে, কিন্তু তার বিদ্রোহ কি কেবল ব্রিটিশ সম্রাজের বিরুদ্ধেই ছিল? তাঁর স্বাধীনতা মানে কি কেবলই বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া? না, সেটা ভাবলে নজরুলের কাব্যাদর্শকে ছোট করে দেখা হবে। কেননা, তাঁর কাব্য দর্শন তার থেকে অনেক উপরে। তাঁর মননশীলতার চেতনা হলো সকল প্রকার বন্ধন থেকে মুক্তি, সকল প্রকার অনিয়ম, অনাচার, অবিচার থেকে মুক্তি। এমনকি আমাদের ভেতরে জেঁকে বসা যে কুসংস্কার যা আমাদের মনকে অবচেতন করে রাখে, আমাদেরকে স্বাধীনতাহীন নির্জীব-জড় করে রাখে সেই আত্মশৃঙ্খল থেকে মুক্তির গানও নজরুল গেয়েছেন। সকল প্রকার বিবেকহীনতা ও আত্মপ্রতারণা থেকে মুক্ত হয়ে পরিপূর্ণ মানুষ হবার বাসনাও তাঁর। ফরাসী দার্শনিক রুশো লিখেছিলেন “গধহ রং নড়ৎহ ভৎবব, নঁঃ যব রং পযধরহবফ বাবৎুযিবৎব” (মানুষ মুক্ত হয়েই, স্বাধীনভাবে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সর্বত্রই সে হয় শৃঙ্খলিত)। আর কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “যুগবাণী” প্রবন্ধগ্রন্থে সংকলিত “আমাদের শক্তি স্থায়ী হয় না কেন?” প্রবন্ধাংশে লিখলেনÑ মানুষ প্রথমে জন্মে তাহার প্রকৃতিদত্ত চঞ্চলতা স্বাধীনতা ও পবিত্র সরলতা লইয়া। সে চঞ্চলতা চিরমুক্ত, সে স্বাধীনতা অবাধ গতি, সে সরলতা উম্মুক্ত উদার, মানুষ ক্রমে যতই পরিবারের গÐি সমাজের সংকীর্ণতা, জাতির, দেশের ভ্রান্তি, গোঁড়ামী প্রভৃতির মধ্য দিয়া বাড়িতে থাকে, ততই তাহার জন্মগত প্রবাহের ধারা সে হারাইতে থাকে, ততই তাহার স্বচ্ছ প্রাণ এই সব বেড়ির বাঁধনে পড়িয়া পঙ্কিল হইয়া উঠিতে থাকে।” নজরুলের এই মূল্যায়ন থেকেই তাঁর কলমকে তিনি শাণিত করেছেন মানুষের সর্বত মুক্তির লক্ষ্যে।
যে কারণে তাঁকে “বিদ্রোহী ” নামের তকমায় ভূষিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন সত্য ন্যায়ের পক্ষে মহা এক বিপ্লবী, যে নেতিবাচক অর্থে ব্রিটিশ আধিপত্যবাদীরা কাজী নজরুল ইসলামকে ‘বিদ্রোহী’ নামে অভিহিত করেছিল, প্রকৃতার্থে তিনি সে বিদ্রোহী ছিলেন না। তিনি অন্যায় ও অবিচারকে যেমন মেনে নিতে পারেননি, তেমনি সত্য ও ন্যায়ের পরাজয়ও তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই তো তিনি লিখেছেন:
তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী,
রসনা তাহার শ্যামল এ ধরায় করিছে সাহারা গোবী! [ফরিয়াদ]
তিনি আরও লিখলেন-
যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামী ভাই, করব সেথায় বিদ্রোহ,
ধামাধরা জামাধরা মরণভীতু চুপ রহো।
আমরা জানি সোজা কথা- পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ,
এই দুলালুম বিজয় নিশান, মরতে আছি মরব শেষ। [বিদ্রোহীর বাণী]
অর্থাৎ নজরুলের যে আধিপত্যবাদ বিরোধিতা তা যেন বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে তাঁর রচনায়। তবে আধিপত্যাবাদ বলতে আমরা কি বুঝি - সে দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে আসা যাক।
আধিপত্য শব্দটি দুটি বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। একটির অর্থ হলো জবরদস্তিমূলক অধিপত্য, আর অপরটি হলো নেতৃত্ব, যার মধ্যে সম্মতি প্রচ্ছন্ন থাকে।
১. আধিপত্য বলতে একটি দেশ বা জাতির দ্বারা অন্য দেশ বা জাতির উপর প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ বুঝায়।
২. আধিপত্য মানে একটি রাষ্ট্র বা একটি সামাজিক গোষ্ঠীর দ্বারা অন্য একটি রাষ্ট্র বা সামাজিক গোষ্ঠীর উপর নেতৃত্ব।
৩. ইতালীয় মার্কসবাদী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামশি সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে যে- একটি সমাজের মূল্যবোধ ব্যবস্থার উপর শাসক শ্রেণীর আধিপত্য এবং আরও বেশি করে, যাতে শাসক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়। এইভাবে সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি সমাজের আধিপত্য বলতে একটি শাসক শ্রেণীর সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে বর্ণনা করে, যা অন্যান্য সামাজিক শ্রেণীর অধীনতাকে বাধ্য করে।
'প্রিজন নোটবুকস'-এ গ্রামশি দাবি করেছেন যে পুঁজিপতিরা কেবল মাত্র সহিংসতা এবং অর্থনৈতিক জবরদস্তির মাধ্যমেই আধিপত্য বজায় রাখে না বরং আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখার মাধ্যমে বা "সুশীল সমাজের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আদর্শিক আধিপত্যও বিম্তার করে।"
অর্থাৎ আধিপত্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণই নয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আদর্শিক বা মানসিক প্রভাব বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রণও বটে। আধিপত্যবাদীরা নানাভাবেই অন্যের উপরে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তার জন্য নিজের স্বার্থে কখনো তারা জোর জুলুম ও জবরদস্তি বা সন্ত্রাসের পথও গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু নজরুল এমনই একজন 'জ্যান্ত মানুষ' ও সমাজ সচেতন কবি যে, সকল প্রকার নিন্দা ও নিপীড়নমূলক আধিপত্যবাদ দূরে সরাতে চেয়েছেন কলমের চাবুকে। তাঁর কলম কখনও কখনও হয়ে উঠেছে তীক্ষè তরবারি। সকল প্রকার বিদেশী শাসনতান্ত্রিক আধিপত্যবাদ এবং এ দেশীয় মানসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৃত্তাবর্ত আধিপত্যবাদের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশী ভদ্রজনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। আর লক্ষ্যেই সাজিয়েছেন তিনি তাঁর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জীবন।
আধিপত্যবাদ বিরোধী চেতনাকে শাণিত করতে নজরুল তাঁর সাহিত্য জীবন গড়ে তুললেন বহুবছরের ভারতীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলিম ঐতিহ্যের রঙে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের গণমানুষের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক ঐতিহ্যের হাওয়া দিয়ে জ্বালালেন দ্রোহের অনল। তাঁর সে দ্রোহের অনল দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্য বাদের বিরুদ্ধে, সে দাবানল ‘কালানল’ হয়ে জ্বলতে লাগলো অন্যায়-অবিচার, মিথ্যা, ভন্ডামী, অত্যাচার, নিপীড়ন আর অপশাসনের বিপরীতে।
ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক নান্দনিকতায় সাজানো স্বাধীন মননের সচেতন ও সংবিৎজারিত উচ্চারণ আধিপত্যবাদী প্রভুত্বের বিপরীতে নাম লাভ করলো “বিদ্রোহের বাণী” আর কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠলেন গর্বিত এক ‘বিদ্রোহী’।
পলাশী যুদ্ধের বিপর্যয়ের পরে বাংলা অঞ্চল তথা পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ হয়ে পড়লে এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা যেমন হৃত হয়, তেমনি ধর্ম সমাজ, সংস্কৃতি এবং স্বদেশীয় ও স্বজাতীয় ঐতিহ্যের উপরে নেমে আসে এক অন্ধকার অমানিশা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্রোহ ও আন্দোলন গড়ে উঠলেও সেগুলোকে কর্তৃত্ববাদীরা দমন করে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে। যেখানে শারীরিক শক্তি পরাজিত হয়ে যায়, সেখানে প্রয়োজন পড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও চেতনাগত শক্তির। এমনি এক যুগ সন্ধিক্ষণে ‘হুজুগ’ এর নাম নিয়ে আবির্ভূত হন যুগের কবি কাজী নজরুল ইসলাম, যার মননে ছিল আবহমান বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য এবং চেতনায় ছিল স্বাধীনতা ও দ্রোহ বা আধিপত্যবাদের বিরোধিতা।
বাংলা সাহিত্যের জমিনে ঝড়ের মতন আগমন কাজী নজরুল ইসলামের। ঝড়ের নাড়াতে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলেন তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। এই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশ একটি চেতনাগত ঝড় দেখলো নজরুলের কলম-চিত্রে, কবিতার বাণীতে। ভারতীয় উপমহাদেশ যখন বিদেশী শাসনের নামে শোষণের বেড়িতে হা-পিত্তেস করছে, মানবিক চেতনাকে যেখানে দমন করা হচ্ছে বিশৃঙ্খলার নামে, অর্থনৈতিক শোষণের যাঁতাকলে যখন মানুষ পর্যুদুস্ত, তখন এক ক্রান্তিলগ্নে কাজী নজরুলের আবির্ভাব এক মহা ধূমকেতুর মতন।
অধিকার আদায়ে অধীনতার জালছিঁড়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুনলেন তিনি। এই স্বপ্ন বুনতে গিয়ে আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর কলম কে বানালেন কখনো প্রতিরোধী লাঠি, আবার কখনো ক্ষুরধার অসি। প্রমাণ করলেন -অসির চেয়ে মসি শক্তিশালী। লিখলেন ‘বিদ্রোহীর’ মত অসংখ্য কবিতা ও গান। মাটির মানুষকে শেখালেন পর্বতের মত মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবার মন্ত্র!
বল বীর-
বল উন্নত মম শির।
শির নেহারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির। [বিদ্রোহী]
বিদ্রোহীর মন্ত্রপাঠ শেখাতে গিয়ে সকল আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন তিনি। মানুষ ও মানবতা এবং স্বাধীনতার পক্ষে নিয়েছেন নিজের অবস্থান। আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন কঠিন ছন্দভাষা:
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন।
আমি স্রষ্ট-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! [বিদ্রোহী]
আধিপত্যবাদ বলতে শুধুমাত্র ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদই নজরুলের কাছে মুখ্য নয়, বরং মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ বহুবিধ আধিপত্যবাদের বিপরীতে নজরুলের অবস্থান বলেই তার রচনায় প্রতিভাত হয়। মোটা দাগে নজরুলের কয়েকটি আধিপত্যবাদ বিরোধী কথা তুলে ধরা যাক।
মানসিক ও অতীত আচার বিষয়ক আধিপত্য বিরোধীঃ
দীর্ঘদিন ধরে অনাচার ও লাঞ্চনা সইতে সইতে তা যখন গা-সওয়া হয়ে যায়, তখন অনাচারকেই মানুষ আচার মনে করে। অবিচারকে মানুষ তার ভাগ্যের লিখন বলে মনে করে। মানুষের যে নিজস্ব চেতনা ও যোগ্যতা আছে তা যেন ভুলেই যায়। মেনে নেয় সাময়িক ও অতীত আচারনিষ্ঠ আধিপত্যবাদকে। নজরুল এর বিপরীতে দাঁড়ালেন এবং গাইলেন আত্মোপলব্ধির গান:-
আজাদ আত্মা, আজাদ আত্মা, সাড়া দাও, দাও সাড়া
এই গোলামীর জিঞ্জির ধরে ভীম বেগে দাও নাড়া।
ঘরে ঘরে তব লাঞ্চিতা মাতা ভগ্নিরা চেয়ে আছে,
ওদের লজ্জা বারণ শক্তি আছে তোমাদেরই কাছে।
ঘরে ঘরে মরে কচি ছেলেমেয়ে দুধ নাহি পেয়ে হায়,
তোমরা ওদের বাঁচাবে না আজ বিলাইয়া আপনায়? [আজাদ]
কবি ও আলোচক সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য তার “নজরুল ইসলাম: কবি নজরুল’’ গ্রন্থে লিখেছেন- “বন্ধন মুক্তির যে প্রেরণা কবি নজরুলের মনে সক্রিয় ছিল, তা একটি আসন্ন সাহিত্য আন্দোলনেরই অগ্রদূত।’’ আমি বলব শুধু একটা সাহিত্য আন্দোলনেরই অগ্রদূত নয়, বরং এটা সামাজিক বিপ্লবের পথ প্রদর্শকও বটে। কেননা মূল সমস্যাটি হলো সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বা অতীত থেকে বয়ে নিয়ে আসা আচারনির্ভর ভ্রান্ত বিশ্বাসের আধিপত্য। এখান থেকে মুক্তি পেতে গেলে নিজের মস্তিষ্কের কারফিউকে আগে ভাঙতে হবে। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
যেই চরণ দিয়ে ফুটবল নিয়ে জাগাইলে বিস্ময়,
সেই চরণের শক্তি জাগুক আঁধার ভারতময়,
এমনই চরণের আঘাতে মোদের বন্ধন ভয় ভয়
লাথি মেরে মোরা দূর করি যেন- আল্লাহু আকবর। [মোবারকবাদ]
ধর্মীয় আধিপত্যবাদ বিরোধীঃ
ধর্মের নামে যে আধিপত্যবাদী শক্তি সমাজের ঘাড়ে জেঁকে বসেছে, ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা মানুষদেরকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাদের বিরুদ্ধেও শাণিত ছিল কাজী নজরুল ইসলামের কলম। মন্দির ও মসজিদ থেকে খাবার না পেয়ে ক্ষুধার্ত মানুষ যখন বঞ্চিত হয়, তখন নজরুল লিখেন-
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!
কোথা চেঙ্গিস, গজনি-মামুদ, কোথায় কালা পাহাড়?
ভেঙ্গে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেওয়া দ্বার।
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সকল দ্বার এক খোলা রবে চালা হাতুড়ি শাবল চালা। [মানুষ]
জাতের নামে আধিপত্যঃ
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সাম্য ও অভেদের কবি। উঁচু-নীচু জাতিভেদ তাঁর কাছে ছিল না। তিনি সকলকে জানতেন মানুষ হিসেবে:
গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। [মানুষ]
কিন্তু সমাজ তো আর তেমন নয়। সমাজে জাতের অহমিকা সহসাই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এই যে জাতের নামে যে মানুষের উপরে মানুষের আধিপত্য তার প্রতিবাদে কাজী নজরুল লিখলেন:-
জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত জালিয়াত খেলছ জুয়া,
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতে নয় তো মোয়া।
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি- ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাই তো বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ খান।
এখন দেখিস ভারত জোড়া
পচে আছিস বাসি মড়া
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত শেয়ালের হুক্কাহুয়া \
বলতে পারিস বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন্ ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
নারায়ণের জাত যদি নাই
তোদের কিসের জাতের বালাই
(তোরা) ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া \ [জাতের বজ্জাতি]
পুরাতন গোঁড়ামীপূর্ণ ধর্মীয় আচারনিষ্ঠ আধিপত্যবাদের বিপরীতে তিনি লিখেছেন-
আদি শৃংখল সনাতন শাস্ত্র আচার
মূল সর্বনাশের, এরে ভাঙিব এবার
ভেদি দৈত্য কারা
আয় সর্বহারা,
কেহ রহিবে না আর পর-পদ-আনত। [অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত]
তিনি আরও লিখেছেন-
ও কে চন্ডাল? চমকাও কেন? নহে ও ঘৃন্য জীব,
ওই হতে পারে হরিশ চন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।
আজ চন্ডাল, কাল হতে পারে মহাযোগী- সম্রাট
তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দি পাঠ। [মানুষ]
হাড়ি-ডোম ও মেথর যারা আমাদেরকে পরিচ্ছন্ন রাখে, যারা সভ্যতাকে পরিপাটি রাখে তাদেরকে ছোট জাত বলে অহরহ আমরা গালি দিয়ে থাকি। নজরুল তাদেরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে ঠাঁই দিয়ছেন তাঁর সাহিত্যে। উঁচু জাতের তথাকথিত আধিপত্যপরায়ণ যে অহংকার, তাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন তিনিঃ-
সকল রুচি ও শুচিতা তেয়াগি
আবিলতা কাঁধে বহিয়া,
ফিরিছ দেবতা হাড়ি ডোম হয়ে
সকলের ঘৃণা সহিয়া। [শূদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র]
তিনি আরও লিখেছেন-
ক্ষুদ্র তুচ্ছ কাঙাল ভাবিয়া
রেখেছি যাদেরে চরণে দাবিয়া
তাদের চরণধূলি মাখি যদি,
আসিবে সে শুভদিন।
নবীন আলোকে জাগিবে পুলকে
জননী ব্যথা-মলিন \ [গান: স্বদেশ আমার জানি না তোমার]
হিন্দু ধর্মের জাত-ভেদের আধিপত্যের বিপরীতে যেমন প্রতিবাদী ছিলেন নজরুল, তেমনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন মুসলমানদের আশরাফ ও আতরাফ ভেদের বিরুদ্ধেও:
ইসলামে নাই ছোট বড়, আশরাফ ও আতরাফ
নিষ্ঠুর হাতে এই ভেদ-জ্ঞান কর মিসমার সাফ।
[গান: হাতে হাত দিয়ে আগে চল, হাতে নাই থাক হাতিয়ার]
কৃষি, শিল্প ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নামে শোষকের আধিপত্যবাদ বিরোধী নজরুলঃ
অর্থ-সম্পদই পৃথিবীর সকল পরিবর্তনের মূল নিয়ামক ও চালিকা শক্তি। অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করতে মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পোন্নয়নের উপরে নির্ভর করে থাকে। আর এটা করতে গিয়ে এবং মানব সভ্যতাকে একটা উন্নত মাত্রা দান করতে গিয়ে মানুষ মানুষের উপর প্রভুত্ব করেছে এবং করে। মানুষের রক্ত-মাংস শুষে নিয়েই গগণচুম্বী হয়েছে এই সভ্যতার ইতিহাস। ফলে একদিকে মানুষকে যেমন অর্থনৈতিক দাসত্বের সীমাহীন নির্মমতাকে দেখতে হয়েছে, আরেক দিকে তেমনই অর্থনৈতিক আধিপত্যের দাপটে হতে হয়েছে দিশেহারা, সহ্য করতে হয়েছে সীমাহীন যন্ত্রণা। কাজী নজরুল ইসলাম একজন সচেতন সমাজদ্রষ্টা হিসেবে তাঁর চোখে পৃথিবীর অর্থনৈতিক এই অসামঞ্জস্যতা যেমন পরিদৃষ্ট হয়েছে, তেমনি ব্যথিত হয়েছেন অর্থনৈতিক এই আধিপত্যের দাপটে। ফলে তাঁর কলম অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে হয়েছে খড়গ-হস্ত। আমাদের এই সভ্যতার পিলসুজ যারা, যাদের রক্তে, শ্রমে ও ঘামে এই সভ্য সভ্যতার সৌকর্য সাধিত হয়েছে, তাদেরকে নজরুল হৃদয়ে ধারন করেছেন। তাদেরকে অভিহিত করেছেন দেবতা হিসেবেঃ
বেতন দিয়াছ? চুপ রও যত মিথ্যা বাদীর দল!
কত পাই দিয়ে কুলিদের তুই কত ক্রোর পেলি বল।
রাজপথে তব চলিছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,
রেলপথে চলিছে শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,
তুমি জানো না’ক পথের প্রতি ধূলিকণা জানে,
ঐ পথ, ঐ জাহাজ, শকট, অট্টালিকার মানে। [কুলি মজুর]
কৃষি, শিল্প, সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যারা শোষণ চালায় কাজী নজরুল ইসলাম সেই শোষক শ্রেণীকে তুলনা করেছেন জোঁকের সাথে। গরীবের সম্পদ লুট করে, ছোটদের খাবার হরণ করে, তারা নিজেরা সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছে শোষকের আধিপত্য। যারা ধনী, যারা জমিদার, যারা রাজা তারা সমাজের ভাগ্যাহত মানুষের জীবনকে করে তুলেছে আরও শোচনীয়, আরও করুণ। এই সমস্ত শোষকের বিপরীতে শোষিত মানব জাতিকে জাগানোর জন্য নজরুলের মসি যেন অসি হয়ে উঠেছে:
কেঁদে বলি- ও গো ভগবান তুমি আজিও আছো কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক তাহাদের গালে, যারা কেড়ে খায় এই শিশুর খুন? [আমার কৈফিয়ত]
তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন-
জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন্তান সম যারা পালে জমি, তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ
জমির মালিক তাহারাই হন
যে যত বড় ভন্ড, ধড়িবাজ, আজ সেই তত বড় বলবান \ [ফরিয়াদ]
কৃষকদের দূরাবস্থা, কৃষক নিপীড়ন এবং কৃষক শোষণের বিপরীতে নজরুলের দৃঢ় উচ্চারণঃ
ওঠ্ রে চাষী জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল,
আমরা মরতে আছি- ভাল করেই মরব এবার চল\
... .. .. .. .. .. .. .. .. ..
আজ চারদিক হতে ধনিক বণিক শোষণকারীর জাত
ও ভাই জোঁকের মতন শুষছে রক্ত, কাড়ছে থালার ভাত।
আর সতী মায়ের কেড়ে খেলছে খেলা খল\
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
ও ভাই আমরা শহীদ মাঠের মক্কায় কোরবানী দিই জান,
আর সেই খুনে যে ফলছে ফসল, হরছে তা শয়তান।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
আজ জাগ রে কৃষাণ, সব তো গেছে, কিসের বা আর ভয়,
এই ক্ষুধার জোরেই করব এবার সূধার জগৎ জয়। [কৃষাণের গান]
শোষিত কৃষকবর্গকে জাগাতে নজরুলের আরও লিখেছেনঃ
তোর খালের ঘাটে পাট পচে ভাই পাহাড় প্রমাণ হয়ে,
তোর মাঠের ধানে সোনা রং-এর বান যেন যায় বয়ে,
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
উঠোনে তোর শূন্য মরাই মরার মতন পড়ে -
স্বামীহারা কন্যা যেন কাঁদছে বাপের ঘরে।
... .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
তোর গাঁয়ের মাঠে রবির ফসল ছবির মতন লাগে,
তোর ছাওয়াল কেন খাওয়ার বেলায় নুন লঙ্কা মাগে?
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
তোর হাঁড়ির ভাতে দিনে রাতে যে দস্যু দেয় হাত,
তোর রক্ত শুষে হলো বণিক, হলো ধনীর জাত,
তাদের হাড়ে ঘুণ ধরাবে তোদেরই এই হাড়,
তোর পাঁজরার ওই হাড় হবে ভাই যুদ্ধের তলোয়ার। [ওঠ্ রে চাষী]
অন্ন-বস্ত্রের স্বাধীনতাই সবার আগে প্রয়োজন- সে দাবী নজরুলের কবিতাকে করে তুলেছে অনলবর্শী। কিন্তু সমাজের শোষক ও শাসকশ্রেণী সেটা তো চায়ই না বরং তৈরি করে আরও শোষণের কল। নজরুল লিখছেনÑ
রাজার প্রাসাদ উঠিছে প্রজার জমাট-রক্ত ইটে,
ডাকু ধনীকের কারখানা চলে নাশ করি’ কোটি ভিটে।
দিব্যি পেতেছ খল কলওয়ালা মানুষ পেষানো কল,
আঁখ-পেষা হয়ে বাহির হতেছে ভূখারি মানব দল। [চোর ডাকাত]
এই সমাজপতি, ধনিক-বণিকদের দাপটের বিপরীতে নিষ্পেষিত মানব সমাজকে জাগানোর জন্য নজরুল লিখলেন:
যত শ্রমিক শুষে, নিঙড়ে প্রজা
রাজা উজির মারছে মজা,
আমরা মরি বয়ে তাদের বোঝা রে,
এবার জুজুর দল ঐ হুজুর দলে
দলবি রে আয় মজুর দল।
ধর হাতুড়ি তোল কাঁধে শাবল। [শ্রমিকের গান]
মৎসজীবী মানুষ যারা, নিজেদের জীবন বাজি রেখে মাছ শিকার করে, তাদেরকে গুনতে হয় মহাজনের সুদ আর হতে হয় সর্বহারা। মহাজনদের জালের জমা দিতেই তাদের সব শেষ। তারা যে বড় বড় মাছ ধরে কন্তিু তাদেও ভাগ্যে জোটে না সে মাছের স্বাদ। জীবনের বিনিময়ে তাদের জীবন বাঁচানোই যেন কঠিন হয়ে পড়ে। এই মহাজনী প্রথার আথিপত্যবাদের বিপরীতে নজরুলের উচ্চারণ:
আমরা নীচে পড়ে রইব না আর
শোন্ রে ও ভাই জেলে
এবার উঠব রে সব ঠেলে\
.. .. .. .. .. .. .. .. ..
তারা বাজের মতন ছোঁ মেরে খায়
আমরা মৎস পেলে\
এবার উঠব রে সব ঠেলে\
.. .. .. .. .. .. .. .. ..
ও ভাই আমরা জলে জাল ফেলে রই
হোথা ডাঙার পরে
আজ জাল ফেলেছে জালিম যত
জমাদারের চরে।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
আমরা অতল জলের তলা থেকে
রোহিত মৃগেল আনি ছেঁকে
এবার দৈত্য-দানব ধরব রে ভাই
ডাঙ্গাতে জাল ফেলে\
এবার উঠব রে সব ঠেলে\
.. .. .. .. .. .. ..
ওই আঁশ বটিতে মাছ কাটি ভাই
কাটব অসুর এলে\
এবার উঠব রে সব ঠেলে\ [ধীবরদের গান]
রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ বিরোধীঃ
রাজনৈতিক শক্তি সব সময়ই দেশ পরিচালনার প্রধান শক্তি ছিল। সকল ভাল কিছু বা কল্যাণ যেমন রাজনৈতিক শক্তি করে থাকে, তেমনি অত্যাচারীর ভূমিকাতেও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে লক্ষ্য করা যায়। যুগে যুগে সব বিদ্রোহীরাই রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। “যে বেদনা রুশোকে বিদ্রোহী করেছে, শেলীকে করেছে ঘর ছাড়া, .. .. .. যে যন্ত্রণায় বিদ্রোহীরা মাথা খুড়েছেন বাস্তিলের কারাকক্ষে, সাইবেরিয়ার ঊষরপ্রান্তরে, সেই প্রেরণায় নজরুল বিদ্রোহী। নজরুলও শেলীর প্রমিথিউসের মত উচ্চারণ করেছেন-
শৃঙ্খল-হানা অত্যাচারীর বুকে বাজপাখী সম
পড়িয়া তাহারে ছিঁড়িতে চেয়েছি হিংসা-নখরে মম,
সে আক্রমন ব্যর্থ কখন করেছে কারার ফাঁদ
বন্দিনী দেশ-জননীর সাথে বেঁধেছে আমারে বাঁধ।
হাতে পায়ে ক’টি-গর্দানে মোর বাজে শত শৃঙ্খল,
অনাহারে তনু ক্ষুধা-বিশীর্ণ; তৃষায় মেলে না জল;
কত যুগ যেন এক অঞ্জলি পাইনি’ক আলো বায়ূ,
তারি মাঝে আমি রক্ষী-দানব বিদ্যুতে বেঁধে ¯œায়ু।” [বিষের বাঁশীঃ উৎসর্গপত্র]
রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের বিপরীতে তাঁর কলম ছিল এক অকুতভয় সৈনিক। কেননা রাজনীতির নামে ক্ষমতার যে পেষণ তা তাঁর কোমল হৃদয়কে করেছিল বড় বেদনাক্লিষ্ট। তিনি নিপীড়িত সকল মানুষের ব্যথাকে ধারণ করেছেন তাঁর বুকের গভীরে। “রাজবন্দীর জবানবন্দি”তে তিনি লিখেছেনÑ “এ ক্রন্দন কি আমার একার? এ আমার কণ্ঠে ঐ উৎপীড়িত নিখিল নীরব ক্রন্দসীয় সম্মিলিত সরব প্রকাশ। আমি জানি আমার কণ্ঠের ঐ প্রলয় হুঙ্কার একা আমার নয়, সে যে নিখিল আর্তপীড়িত আত্মার যন্ত্রণার চিৎকার।”
মানুষের ভেতরে ভন্ডামী ও প্রতারণা যেমন তাঁর বিদ্রোহের প্রতিপাদ্য, তেমনি মানুষের বেদনা ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাও তাঁর বিদ্রোহের প্রতিপাদ্যঃ
যেথায় মিথ্যা ভন্ডামী তাই করব সেথায় বিদ্রোহ
ধামা-ধরা জামাধরা মরণ-ভীতু চুপ রহো।
আমরা জানি-সোজা কথা-পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ
এই দুলালুম বিজয় নিশান, মরতে আছি, মরব শেষ। [বিদ্রোহীর বাণী]
তিনি আরও লিখলেন:
বিদ্রোহী করেছে মোরে আমার গভীর অভিমান
তোমার ধরার দুঃখ কেন
আমায় নিত্য কাঁদায় হেন
বিশৃঙ্খল সৃষ্টি তোমার, তাই তো কাঁদে আমার প্রাণ।
বিদ্রোহ মোর থামবে কিসে ভূবনভরা দুঃখ শোক
আমার কাছে শান্তি চায়
লুটিয়ে পড়ে আমার গায়
শান্ত হবো, আগে তারা সর্ব দুঃখ মুক্ত হোক। [চির বিদ্রোহী]
এই বিশৃঙ্খলার বিপরীতে নজরুলের কলম যেমন শক্তিশালী, পরদেশী আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধেও তাঁর কলম অত্যন্ত অগ্নিমুখর। পরদেশী আধিপত্যবাদী শক্তিকে ডাকাত অভিহিত করে নজরুল লিখলেন:-
পরের মূলক লুট করে খায়, ডাকাত তারা ডাকাত,
তাই তাঁদের তরে, বরাদ্দ ভাই আঘাত, শুধু আঘাত।
আজাদ মানুষ বন্দি করে, অধীন করে স্বাধীন দেশ,
কুল মুলুকের কুষ্টি করে জোর দেখালে ক’দিন বেশ;
মোদের হাতে তুর্কি নাচলে তাধিন তাধিন শেষ। [কামাল পাশা]
তিনি আরও লিখলেনÑ বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেকে ছেলেবেলা থেকেে শুধু এই ্েক মন্ত্র শেখাও:
এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালির, আমাদের।
দিয়া প্রহারেন ধনঞ্জয়
তাড়াবো আমরা, করি না ভয়
যত পরদেশী দস্যু ডাকাত,
রামাদের, গামাদের।
বাংলা বাঙালির হোক!
বাংলার জয় হোক,
বাঙালির জয় হোক। [প্রবন্ধ: বাঙালির বাংলা]
রাজনৈতিক অপশক্তির আস্ফালনকে নজরুল ‘দস্যু’, ‘ডাকাত’, ‘জোচ্চোর’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করে তাদের বিরুদ্ধে জ্বালিয়েছেন দ্রোহের অনল। তিনি তাদের আইনকে দেখিয়েছেন বৃদ্ধাঙ্গুলি:
আমি অনিয়ম, উচ্ছৃঙ্খল
আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন, শৃঙ্খল।
আমি মানি না ক কোন আইন,
আমি ভর তরী করি ভরাডুবি, আমি টর্পেডো
আমি ভীম ভাসমান মাইন। [বিদ্রোহী]
কালের চরকা ঘোর
দেড়শত কোটি মানুষের ঘাড়ে চড়ে দেড়শত চোর। [রাজা-প্রজা]
নজরুলের দাবী হলো- শাসকগোষ্ঠি হবে লোভ ও শঠতাহীন। তারা মানুষের কল্যাণে কাজ করবে নিঃস্বার্থভাবে। কিন্তু বর্তমানের শাসকগোষ্ঠি কেবল নিজেদের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। শাসনের নামে তাদের শোষণে নাজেহাল প্রজাদের জীবন। আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতার বলি এবং পেষণের শিকার সাধারন মানুষের কষ্টে নজরুলের আক্ষেপ:
তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী
রসনা তাহার শ্যামল এ ধরায় করিছে সাহারা গোবী।
মাটির টিবিতে দু’ দিন বসিয়া
রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া। [ফরিয়াদ]
এই রাজনৈতিক অপশক্তির দাপট শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেই এই দাপটে পর্যুদস্ত মানুষ। নজরুল লিখছেন:
কে তোমায় ডাকাত বলে বন্ধু, কে তোমায় চোর বলে?
চারিদিকে বাজে ডাকাতী ডঙ্কা, চোরেরই রাজ্য চলে।
চোর ডাকাতের করিছে বিচার কোন্ সে ধর্মরাজ?
জিজ্ঞাসা কর বিশ্ব জুড়িয়া কে নহে দস্যু আজ?
বিচারক, তব ধর্মান্ধ ধর,
ছোটদের সব চুরি করে আজ বড়রা হয়েছে বড়।
যারা যত বড় ডাকাত, দস্যু, জোচ্চোর, দাগাবাজ,
তারা তত বড় সম্মানী, গুণী জাতি সঙ্ঘেতে আজ। [চোর ডাকাত]
এই যে সর্বব্যাপী রাজনৈতিক অপশক্তির দাপট, তা দেশব্যাপী একটা দাসত্বের শৃঙ্খল তৈরী করেছে। যে যুবশক্তি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কথা ছিল, সেই শক্তিকে চাকরির ফাঁদে ফেলে দেশ ও জাতির ঘাড়ে চেপে বসার হীন মনোবৃত্তির প্রতিবাদে নজরুল লিখেছেন:Ñ
হায় গণনেতা, ভোটের ভিখিারী, নিজের স্বার্থ তরে,
জাতির যাহারা ভাবী আশা, তাদের নিতেছ খরিদ করে।
.. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
তাহাদের ধরে গোলাম করিয়া ভরিতেছো কার ঝুলি?
চা-বাগানের আড়কাঠি যেন চালান করিছো কুলি!
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ... .. .. ..
তুমি চাকরির কসাইখানায় ঘুরিছো তাদেরে লয়ে,
তুমি জানো না- ওখানে যে যায়, সে যায় জবেহ্ হয়ে।
দেখিতেছো না কি শিক্ষিত এই বাঙালির দুর্দশা!
মানুষ যে হত, চাকরি করিয়া হয়েছে সে আজ মশা!
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
আগুন যে বুকে আছে- তাতে আরও দুঃখ-ঘৃতাহুতি দাও,
বিপুল শক্তি লয়ে ওরা হোক জালিম পানে উধাও।
আজাদ আত্মা! সাড়া দাও, দাও সাড়া
এই গোলামীর জিঞ্জির ধরে ভীমবেগে দাও নাড়া। [আজাদ]
শুধুমাত্র অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সব সময়ই রাজনৈতিক অধিপত্যবাদী অপশক্তির বিদায় হয় না বলেই নজরুল মনে করতেন। তার জন্য কখনো সশস্ত্র আন্দোলনেরও প্রয়োজন হয়। তিনি লিখছেন:
আর কত কাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
............... .. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
মাদিগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি ।
হান তরবার আন মা সমর অমর হবার মন্ত্র শেখা।
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা। [আনন্দময়ীর আগমনে]
হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিবিধ পৌরাণিক উপখ্যানের মাধ্যামে আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা যেমন সাজিয়েছেন নজরুল, তেমনি ইসলামের সুমহান শিক্ষা, গৌরবময় ইতিহাস ও শৌর্য্য বীর্যের কাহিনী দিয়েও সাজিয়েছেন তাঁর দ্রোহের কবিতার শব্দঝঙ্কার। খালেদ কবিতায় তিনি লিখছেনঃ
খালেদ! খালেদ! সত্য বলিব, ঢাকিব না আজ কিছু,
সফেদ দেও আজ বিশ্ববিজয়ী, আমরা হটেছি পিছু!
তোমার ঘোড়ার খুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা,
মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরই বিভীষিকা!
.. .. .. .. .. .. .. .. . . .. .. .. .. .. .. .. .. . .
হায় হায় হায়, কাঁদে সাহারায় আজিও তেমনই ও কে?
দজলা-ফোরাত নতুন করিয়া মাতম করিছে শোকে!
.. .. .. .. .. .. .. .. . . .. .. .. .. .. .. .. .. . .
ও বুঝি ইরাকি? খালেদ! খালেদ! আরে মজা দেখো, ওঠো,
শ্বেত-শয়তান ধরিয়াছে আজ তোমার তেগের মুঠো!
.. .. .. .. .. .. .. .. . . .. .. .. .. .. .. .. .. . .
খালেদ! খালেদ! মিসমার হল তোমার ইরাক শাম,
জর্ডন নদে ডুবিয়াছে পাক জেরুজালেমের নাম!
খালেদ! খালেদ! দুধারি তোমার কোথা সেই তলোয়ার?
তুমি ঘুমায়েছ, তলোয়ার তব সে তো নহে ঘুমাবার!
.. .. .. .. .. .. .. .. . . .. .. .. .. .. .. .. .. . .
খালেদ! খালেদ! জিন্দা হয়েছে আবার হিন্দা বুড়ি,
কত হামজারে মারে জাদুকরি, দেশে দেশে ফেরে উড়ি!
.. .. .. .. .. .. .. .. . . .. .. .. .. .. .. .. .. . .
খালেদ! খালেদ! জাজিরাতুল সে আরবের পাক মাটি
পলিদ হইল, খুলেছে এখানে য়ুরোপ পাপের ভাঁটি!
মওতের দারু পিইলে ভাঙে না হাজার বছরি ঘুম?
খালেদ! খালেদ! মাজার আঁকড়ি কাঁদিতেছে মজলুম।
খোদার হাবিব বলিয়া গেছেন আসিবেন ইসা ফের,
চাই না মেহেদি, তুমি এসো বীর হাতে নিয়ে শমশের। [খালেদ]
নারীদের উপরে সমাজের জবরদস্তিমূলক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে নজরুল লিখেছেনঃ
সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক’, নারীরা আছিল দাসী।
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি’।
নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে
আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে!
.. .. .. .. .. .. .. .. . ... .. .. .. ..
যে ঘোমটা তোমা’ করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ,
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!
.. .. .. .. .. .. .. .. . ... .. .. .. ..
ভেঙে যমপুরী নাগিনীর মতো আয় মা পাতাল ফুঁড়ি!
আঁধারে তোমায় পথ দেখাবে মা তোমারি ভগ্ন চুড়ি!
পুরুষ-যমের ক্ষুধার কুকুর মুক্ত ও পদাঘাতে
লুটায়ে পড়িবে ও চরণ-তলে দলিত যমের সাথে!
এতদনি শুধু বিলালে অমৃত, আজ প্রয়োজন যবে,
যে-হাতে পিয়ালে অমৃত, সে-হাতে কূট বিষ দিতে হবে।
সেদিন সুদূরে নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়! [নারী]
উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, কাজী নজরুল ইসলাম শুধু পরদেশী ব্রিটিশ আধপিত্যবাদ বিরোধী ছিলেন না, কিংবা শাসকশ্রেণির ক্ষমতার আধিপত্যবাদ বিরোধী ছিলেন না, তিনি ছিলেন শাসনের নামে সকল প্রকার শোষণের আধিপত্যবাদ ও দুর্বৃত্তায়ন বিরোধী, তিনি ছিলেন আধিপত্যবাদের নামে সকল প্রকার অনাচার ও অবিচারের বিরোধী, তিনি ছিলেন সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় আচারের নামে অনাচার বিরোধী এবং যুগের পরে যুগ ধরে মানুষের ছায়ার মত চলে আসা মানসিক আধিপত্যবাদবিরোধী। শুধু তাই নয়, তিনি দাবী করেছেন যে- সকল প্রকার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর এই অভিযান চলবে ততদিন, যতদিন উৎপীড়ন মুক্ত হয়ে এই পৃথিবী শান্ত না হবেঃ
মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত। [বিদ্রোহী]
#
[লেখক: এ কে আজাদ, কবি গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। মোবাইল: ০১৭১৪ ৫১৩ ৫০৪। ইমেইল: ধশধুধফশড়নর@মসধরষ.পড়স]
গ্রন্থসহায়িকাঃ
১. নজরুল কাব্য সমীক্ষাঃ আতাউর রহমান।
২. নজরুলঃ কবি ও কাব্য, সম্পাদনায় প্রণব চৌধুরী
৩. নজরুল রচনাবলীঃ প্রকাশনায় বাংলা একাডেমি
৪. বহুমাত্রিক নজরুল, হাজান হাফিজ সম্পাদিত
৫. নজরুলের প্রবন্ধ সমগ্রঃ কবি নজরুল ইনস্টিটিউট
৬. সঞ্চিতাঃ কাজী নজরুল ইসলাম
৭. ইন্টারনেটঃ উইকিপিডিয়া
0 মন্তব্যসমূহ