চিরায়ত রবীন্দ্রনাথ ~ এ কে আজাদ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

একজন কবি হলেন আবেগের শিল্পী, ইমোশনের শিল্পী, শব্দের শিল্পী। মানুষের আবেগকে নিজের করে নেয়া এবং সেই আবেগ বা ইমোশনকে শব্দের সুন্দরতম নানান শৈলী দিয়ে মানুষের কাছে আবার শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করাই একজন কবির প্রধানতম কাজ। আর এই কাজটি যে কবি যত বেশী করতে পারেন তিনি তত বেশী মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। এ ক্ষেত্রে মানুষের আবেগ বলতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের আবেগ অনুভূতির বিষয়ই প্রণিধানযোগ্য। কেননা হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খৃষ্টান সব ধর্মের এবং ধনী গরীব সব শ্রেণীর মানুষের দেহের কোন অংশ কাটলে যেমন একই রঙের রক্তপ্রবাহ দৃশ্যমান হয় ঠিক তেমনি সব মানুষের আবেগ অনুভূতিও একই রকম; হয়তোবা প্রকাশ ভঙ্গি বা প্রকাশের ধরন ভিন্ন। একজন মুসলিম মা তার সন্তানের জন্য তার মন এবং মননে যে অনুভূতি অনুভব করেন একজন হিন্দু মা ও সেই একই রকম অনুভূতি অনুভব করেন। তেমনি বৌদ্ধ, খৃষ্টান এবং বিশ্বে বিরাজমান সকল ধর্ম বা বর্ণের মায়েরাও ঠিক একই রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। তবে সে প্রকাশের ভাষা এবং ভঙ্গিমা দেশ-কাল-অঞ্চল এবং জাতি ভেদে ভিন্ন হতে পারে বৈকি। এই যে মানুষের নিগূঢ় আবেগ এবং অনুভূতি তারই প্রতিভূ প্রকাশক হলেন একজন কবি। 


অনেক বিষয়ই অনেকে অনুভব করতে পারেন, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেন না সবাই। অথচ একজন কবি সেই অনুভবকে এত সুনিপুণভাবে প্রকাশ করতে পারেন যা কি না প্রত্যেকটি মানুষের কাছে নিজ নিজ অভিব্যক্তির প্রকাশ বলে মনে হয়। এই এখানেই একজন কবির স্বার্থকতা। তেমনি একজন স্বার্থক কবির নাম হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) যিনি বাংলা সাহিত্যে শুধু নয় সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যাকাশেই একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। অবলীলায় যিনি লক্ষ কোটি মানুষের আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন সমহিমায় তার অসংখ্য কবিতা এবং গানে। সারা বিশ্বমাঝে তিনিই একমাত্র কবি যার গীতিকবিতা পৃথিবীর তিন তিনটি দেশে তথা ১২৫ কোটি মানুষের ভারত, ৩ কোটি মানুষের শ্রীলঙ্কা এবং ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়। শুধু তাই নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষকেও নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে তার কবিতা; যার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরষ্কার  “নোবেল প্রাইজ” (১৯১৩)। 


রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন সমগ্র বিশ্বের সাহিত্য-প্রেমিক মানুষের কাছে, তাদের চিন্তা চেতনার প্রতিভূ হিসেবে। তিনি বেঁচে আছেন বিশ্ব-মানসের অনুভূতির সপ্রকাশক হিসেবে। তার চিরকালীন বৈশ্বয়িক চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে তার নানা কব্যে, নানা গানে। তার মধ্য থেকে দু’একটি কবিতার ছত্র কিঞ্চিত আলোকপাত না করলেই নয়। 


পৃথিবীর মানুষেরা স্ব-স্ব অবস্থানে কেউই সুখী নয়। মনে করা হয় - আমার চেয়ে আরেকজন বেশী সুখী। আবার সেও মনে করে তাই। মানুষের নিজ অবস্থানে অসুখী মনোবৃত্তি কত না সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার “মোহ” নামের কবিতার পয়ারে-   


নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস

ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস

নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে

কহে - যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে।


সর্বকালের প্রেমিক প্রেমিকারাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজের প্রেমকে তার প্রেমিক বা প্রেমিকার অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী বলে দাবি করে। ভালবাসা বঞ্চিত মনে কখনো বেজে উঠে সকরুন সুর। হতাশার ছায়া মনের আকাশে করে ভীড়। তাই তো চিরকালের প্রেমিক মনের আকুতি তার গানে ভেসে চলে বাতাসের ইথারে- 


“আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি তুমি অবসর মতো বাসিয়ো

আমি নিশিদিন হেথায় বসে আছি তুমি অবসর মতো আসিয়ো”


সব দেশে সব কালেই যারা একটু বড় তারা তাদের চেয়ে বড়দের আনুকল্য কামনা করে। আবার যারা তাদের চেয়ে ছোট তাদেরকে অবজ্ঞা করে। যেমন করে কেরোসিন শিখা তার চেয়ে বড় চাঁদের আলোর প্রতি মোসাহেবী প্রদর্শন করে অপর পক্ষে কেরোসিন শিখার চেয়ে কম আলোদায়ী মাটির প্রদীপকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে। কী অপরূপ বহিঃপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের কবিতায়-


কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে 

ভাই বলে ডাকো যদি দেব গলা টিপে

হেন কালে গগণেত উঠিলেন চাঁদা 

কেরোসিন শিখা বলে এসো মোর দাদা


এমনিভাবে জগতের আরেকটি অঘোষিত নিয়ম অনায়াসে তুলে ধরেছেন কবি তার “ক্ষুদ্রের দম্ভ” কবিতায়। যারা সমাজে বড়দের নিকট থেকে অনেক কিছু পেয়ে জীবন ধারন করে তারাই আবার তাদের সমাজে তাদের ক্ষুদ্র অবদানের জন্য দম্ভ করে। শ্রুতিমধুর বহিঃপ্রকাশ কবির কবিতায়ঃ


শৈবাল দিঘীরে বলে উচ্চ করি’ শির,

লিখে রাখো এক ফোটা দিলেম শিশির। 


যারা অনেক বড়, যাদের উদারতা আকাশের সমান তারা নীচুদেরকে অতি সহজেই বরণ করে নিতে পারেন। আর যাদের অন্তরে বিশালতা নেই তারা ছোটদের বরণ করে নিতে মনসিক ভাবে অক্ষম। জগতের এই চরিত কলমের তুলিতে এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ


প্রাচীরের ছিদ্রে এক নাম গোত্রহীন

ফুটিয়াছে ছোট ফুল অতিশয় দীন।

ধিক ধিক করে তারে কাননে সবাই-

সূর্য উঠি বলে তারে- “ভালো আছো ভাই”?


অতীত থেকে চিরদিনই মানুষেরা প্রেরণা নেয়। ভুলগুলোকে ধরে নিয়ে এবং অতীতের সুখের স্মৃতিগুলোকে প্রেরণার উৎস হিসেবে পুঁজি করে মানুষ সামনে এগিয়ে চলে। সেই ভাবেরই নিপুণতম উচ্চারণ রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ঃ 


অদৃষ্টেরে শুধালেম - ‘চিরদিন পিছে

অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে

সে কহিল- ফিরে দেখো। দেখিলাম আমি

সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি। 


জন্ম যেমন সত্য মৃত্যুও তেমন সত্য। জন্ম এবং মৃত্যু সকল জীবের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। মানুষ চলতে গেলে যেমন একবার পা তুলে আরেকবার ফেলে এবং এমনি করে মানুষের চলা সম্পন্ন হয়, ঠিক তেমনি করে জীবনের যে মৃত্যুর দিকে অগ্রসরতা তা যেন পা তোলা এবং পা ফেলারই সমান। প্রত্যেক মানুষই হাঁটি হাঁটি পা পা করে যাত্রা শুরু করে জীবনের চড়াই উৎড়াই পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলে জীবন সায়াহ্নের দিকে। কিন্তু কেউই এই হাঁটাকে, পা তোলাকে এবং পা ফেলাকে এমন সিরিয়াসলি ভাবে না। অথচ কবি-মন উন্মুখ চেয়ে থাকে সারাক্ষন। সহজ সরল উপমা দিয়ে গড়ে তোলে সাহিত্যের অমর বুননঃ


জন্ম মৃত্যু দোঁহে মিলে জীবনের খেলা

যেমন চলার অঙ্গ পা তোলা- পা ফেলা


পৃথিবীর বৃহৎ জনগোষ্ঠির একেশ্বরবাদী অনুভূতিও প্রকাশ পেয়েছে তার কবিতায় অতি সুুচারুভাবে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যে রথযাত্রার আয়োজন করে তাতে শুধুমাত্র এক ঈশ্বরের ভক্তির জন্যই তা হওয়া উচিৎ বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। তাই তো তার কবিতায় স্পষ্ট উচ্চারণঃ


রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম 

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম

পথ ভাবে ‘আমি দেব, রথ ভাবে আমি,

মূর্তি ভাবে আমি দেব - হাসেন অন্তর্যামী


নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্যসেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্বন্ধে বলেছেন - তিনি হলেন সারা বিশ্ব সাহিত্যে আলোকিত অর্ধচন্দ্র। 


কবিতা এবং গানে এরকম হাজারও উপমা তার কবিতাকে করে তুলেছে বৈশ্বয়িক (ইউনিভার্সাল)। তার ইউনিভার্সালিটির কারনেই তিনি এত জনপ্রিয়, সব ধর্মের এবং সব বর্ণের মানুষের কাছে এত পঠিত।


উপরের আলোচনা পর্যালোচনা থেকে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে, রবীন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট কোন যুগের রবীন্দ্র নাথ নন। তিনি সকল যুগের সকল সময়ের। তিনি একদিনের নন, তিনি চিরদিনের। তিনি ছিলেন তিনি আছেন, তিনি থাকবেন।  


[লেখকঃ এ কে আজাদ। কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক। বগুড়া, বাংলাদেশ।]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ