ছোটগল্প || অপেক্ষা ~ শ্রীময়ী গুহ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


          খবরের কাগজটা কোনও বাড়িতে গেটের ফাঁকে, কোনো কোনো বাড়িতে বারান্দায়, কোনও বাড়িতে আবার সাইকেল চালাতে চালাতেই রোল বানিয়ে ছুঁড়ে দেওয়ার পর পরেই তুষার কাকার দোকানে এক ভাঁড়
চা য়ে চুমুক।

আবার সাইকেলের প্যাডালে পা, শনশন শনশন বাতাস কেটে কেটে যেন পক্ষীরাজ উড়িয়ে উড়ে যাওয়া  তরুণ ছেলেটা মানে টুটুনের দু চোখে কত্ত স্বপ্ন ভীড় করে রোজ।

দোতলা হলুদ আর হালকা সবুজ কার্নিশ ওলা বাড়িটায় রোল করে খবরের কাগজ দেওয়ার পর একটু সাইকেল থামে, কার যেন অপেক্ষা, এলোমেলো চুলের সদ্য ঘুম ভাঙা চোখের শ্যামলা রঙের ছিপছিপে মেয়েটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কাগজটা তুলে নিয়ে একবার তাকায় সাইকেল-চালকের দিকে, ব্যাস! ঐটুকুই! 
সাথে সাথেই ঘরে  ঢুকে যায় মেয়েটা।
চোখে চোখ পড়ে রোজই, কত কথা বলতে চায় খবরের কাগজ দিতে আসা ছেলেটা, কিন্তু বলা আর হয় না।
কে জানে কী ভাববে? 
কে জানে বিরক্ত হবে কিনা? 
কে জানে মুখ ঘুরিয়ে নেবে কিনা? 
কে জানে হয়ত আর কখনও চোখে চোখও রাখবে না! 
তার থেকে এই চুপকথাতেই কথা হোক যতদিন পারা যায়।

তরুণের মনে বেশ একটা আনন্দের তরঙ্গ খেলে যায় মেয়েটার গভীর চোখের দৃষ্টি দেখেই, একগাল হাসি না থাকলেও, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখতে পায় ও, আর বুঝতে পারে লাজুক লাজুক হরিণীর মতো  কিছু একটা অনুভূতির কাছে নিজেরই ধরা পড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত, ঝট করে ঘরে ঢুকে যাওয়ার পদক্ষেপে।

তুষার কাকার চায়ের দোকানে খুব ভীড়ের মধ্যেই, দু ভাঁড় চা খেয়ে নেয় খবরের কাগজের বাণ্ডিল সাইকেলে রেখে নাইট কলেজে পড়া তরুণ। অপেক্ষা করে বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু দোতলা বাড়ির বারান্দায় কেউ আসে না তো!
দুদিন তিনদিন কেটে যায়, ঝুপড়ির ভিতরের অন্ধকারে চৌকিতে বসে অসুস্থ বিধবা মাকে ওষুধ খাওয়াতে খাওয়াতেও মনে পড়ে গেল ঐ চোখ দুটো।
কতদিন দেখা হয় নি! কী হল মেয়েটার? নামটাও তো জানা হয় নি আজ অবধি!
মা কিছু একটা টের পেয়ে ছেলের হাতে হাত রাখেন, কথা তো কবেই বন্ধ তাঁর। 

মায়ের চোখে জল আসে হঠাৎ হঠাৎই এখন, চিটচিটে বালিশ ভিজে যায়... ছেলে পরম মমতায় চোখ মুছিয়ে দেয় পঙ্গু মায়ের, গলা ভাতটুকু মুখে দেয় আস্তে আস্তে চামচে করে, তারপর কাঁথা বদল করে, সুন্দর করে চাদর দিয়ে দেয় মায়ের আরোও আরোও রোগা হতে থাকা শরীরের ওপরে।
মনে পড়ে যায় ডাক্তার জ্যেঠুর কথাগুলো, 
-"টুটুন রে! তোর বাবা যে অসুখে গেলেন, ঐ একই রোগ রে তোর মায়েরও।তবে এটা ভেবে বসিস না যে তোর বাবার চরিত্র খারাপ ছিলোই। তা নয় রে। এ রোগ অনেক ভাবেই শরীরে আসতে পারে। 
যতটা পারিস দেখাশোনা কর বাবা, কীইইই আর বলব বল! আমাদের সমাজে এ রোগ এখনও ভয়ের আর একঘরে করে দেওয়ার। মন শক্ত কর টুটুন। তোর মা কিন্তু আর... মানে, 
আর কোনও মিরাকেল বা অলৌকিক কিছু হলেও সারবার নয় এই স্টেজে। তোর বাবাও কষ্ট পেয়ে গেলেন  আর এখন তোর মাও ভুগছেন। যাই হোক বেশিদিন বোধহয় আর....! "

টুটুনের কারখানায় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
সাইকেলের প্যাডালে পা রাখে টুটুন আবার।

খবরের কাগজের হেড লাইন পড়াটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ পরীক্ষার শেষ দিন, এর পরেই গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাচ্ছে টুটুন। তারপর যদি কোথাও একটা চাকরি বাকরি ছোটখাটো হলেও পাওয়া যায়, আর তারপরেই বলবে টুটুন ওকে, ঐ দোতলা বাড়ির মেয়েকে,
কিন্তু কিভাবে বলবি রে টুটুন? 
যদি প্রত্যাখ্যান করে গরীব বলে?
যদি ফিরিয়ে দেয় এইডসে মৃত বাবা আর এইডসে মৃত্যুর অপেক্ষায় মায়ের ছেলে বলে?
থাক! কিচ্ছু বলবে না টুটুন।
সাইকেল থেকেই দেখবে বরং। অপমানিত হতে পারবে না টুটুন! অসম্ভব।

সবগুলো হেড লাইন দেখা হল না আজ, যদি দেখত টুটুন, দেখতে পেত হলুদ সবুজ দোতলা বাড়ি আজ খবরের হেড লাইনে আছে।

এত ভীড় কেন? পুলিশ কেন? 
কিছু হয়েছে এখানে?

ঠিকে কাজের মাসি ফরফর করে বলে উঠল, 
-"ওম্মা জানো নে বুজি! কাল রেতে তো এ বাড়ির বাবু কাজের মেয়েটাকে পুরো পেড়ে ফেলেছিল আর কি! এই সময় বাড়ির অন্য ঘরে  ছেল ঐ চাকা ওলা চেয়ারে পা লিকপিকে বুড়োর আধা পঙ্গু ছেলেটা ।বুড়ি তো কবেই মরে বেঁচেছে। তো সেই ল্যাংড়া ছেলে... সে নাকি কবে মিলিটারিতে ছেল... সে ছেলেই নাকি বুড়োর মাতায় দমাস করে মারে হাতের লাটি দে আর বুড়ো তাতেই এক্কেরে চিত্তির!"

-" আরে লাঠি না গো মাসি, ক্রাচ! ক্রাচ।"
-" ঐ হল আরকি! কীইইই ছেলে গো বাপু, বাপকে খুন করে দেল তাও কিনা কাজের নোকের জন্যি! লিচ্চয় কিচু ছেল সম্পর্ক! হাজার হোক ঘি আর আগুন তো! সে ঝ্যাতোই ল্যাংড়া খোঁড়া হোগ্গে বাপু! মেয়েটার সাতে কী কিচ্চুটি ছেল নি গা? তাই তো অমনধারা মেরে দেচে বাপটাকেও! "

ফিসফাস চলছে কৌতুহলী ভীড়ের মধ্যে,
আধা পঙ্গু ছেলে আর ডবকা মেয়ে, কিছু তো ছিলই! এমনি এমনি কী আর...

কাজের মেয়েটার চোখ ভর্তি জল, দাদাকে হুইলচেয়ারেই তুলে নিয়ে গেল পুলিশের গাড়ি, ওষুধ পত্র সব সাথেই দিয়ে দিয়েছে, থানায় তো ওকেও যেতে হবেই। বলে গেলেন বড়োবাবু মানে ঐ পুলিশ অফিসার, কিন্তু... লোকজন কীইইই সব বলছে যে!
ছিঃ! দাদার সাথে ওর...
আসলে অনেক অনেক পড়াশোনা করেও, অনেক পয়সাওলা হয়েও, মানুষ ঐ "ঘি আর আগুন" ছাড়া কিছুই ভাবতে পারেনা।
দাদা তো দাদাই! তাঁর সাথে নিজেকে অন্য কোনো ভাবে ভাবতেই তো গা গুলিয়ে উঠছে,... কিন্তু দাদার সব কাজ তো ও ই করত এতদিন,
কই! তখন তো কোনও অস্বস্তি হয় নি!
কেন যে লোকজন এই সব অদ্ভুত ধারণা থেকে বেরোতে পারে না?
একজন ছেলে আর একজন মেয়ে...
ব্যাস আগুন আর ঘি?
অন্য কোনো সম্পর্ক হতে পারেই না?
শ্রদ্ধার বা বন্ধুত্বের? ভালোবাসারও তো কত নাম আছে!

হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে তুষার কাকার দোকানে টুটুন, ছোট্ট একটা চাকরি পেয়েছে সে, মা নেই বেশ ক'মাস হল, বড্ড একলা লাগে ঘরে ফিরে তার, আর ফিরে ফিরে আসে সময় পেলেই এখানে এই দোতলা বাড়ির হলুদ সবুজ রঙের বারান্দায় চোখ পাততে।
মেয়েটা বেরিয়ে আসে কাপড় মেলে তারে, আরোও কী কী সব কাজ সারে, টবের গাছে জল দেয়, আবার ঘরে ঢুকে পড়ে ঝট করে।

আজ থমকে তাকাল। 
হাত নেড়ে ইশারা করল টুটুনকে
দাঁড়ানোর জন্য।

এই প্রথম বার সামনাসামনি এতটা দুজনে।
দুজনের বুকের ঘরেই তুমুল ঝড়। কিন্তু শান্ত চোখের দৃষ্টিতে আশ্বস্ত করার আশা, আরেকটু অপেক্ষাও হয়ত।

চুপকথার প্রাচীর ভেঙে প্রথম মুখের কথায় দুজন... 
-"যাবে আমার সাথে?" 
-"যাব তো! কিন্তু দাদা যে ফিরবেন জেল থেকে এ বাড়িতেই! আমাকে বাঁচাতেই তো এত কাণ্ড! তাঁকে না জানিয়ে তো...!"
-"অনেক দেরি হয়ে যাবে তো!"
-"বাহ রে তা বললে কী হয়? আর দাদা ফিরলেও তিনি তো একা কিছুই করতে পারেন না, আমাকে বা অন্য কোনো কাজের লোককে তো থাকতেই হবে। একটা উপায় কিছু হবেই দেখো। এতদিন অপেক্ষা করলে আর আর কিছুদিন পারবে না?"
-" ঠিক বলেছ! উপায় হবেই একটা, তাই না?অপেক্ষা করব আমি তোমার জন্য।"

খবরের কাগজে আরোও কত হেড লাইন রোজ আসছে, কত কত খবরের কাগজ ওলার সাইকেলের প্যাডালে পা পড়ছে চলছে থামছে, ঘুরছে সাইকেলের চাকা বনবন বনবন, হাওয়া কেটে কেটে সময় এগোচ্ছে শনশন শনশন, জীবনের অপেক্ষা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়ত বিয়ে বা শারিরীক বন্ধনে পরিণতি পায় না, কিন্তু শরীর মন আর চুপকথার ঝড় বইতেই থাকে আর থাকে ভালোবাসার মানুষটার অপেক্ষা, ভালোবেসেও আরোও ভালোবাসবার অপেক্ষা।

কথাটা না উল্লেখ করলেই নয় এখানে, ঐ যে বলে না!

 - "এ ও পুরুষ! সে ও পুরুষ! 
তফাৎ মেরুদণ্ডে!" 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ