পোস্ট বার দেখা হয়েছে
।। গল্প।।
অপয়া
শিবাজী সান্যাল
মিনতি প্রথম থেকেই ঝুমাকে মেনে নিতে পারেনি। নিজের ছেলেকে নিয়ে, ওর বিয়ে নিয়ে অনেক কিছু ভেবে রেখেছিলেন। কয়েক জায়গায় যোগাযোগ করেছিলেন, একটি মেয়ে, যার খবর লোপা দিয়েছিল, বেশ পছন্দও হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে আদিত্যর সঙ্গে কথা বলার ঠিক আগেই ও নিজের এক পছন্দের কথা বলাতে মিনতির এতদিনের সমস্ত পরিকল্পনা ধূলোয় মিশে গেল। তারপর যেদিন আদিত্য ঝুমাকে দেখাতে নিয়ে এল মিনতির মাথায় যেন বজ্রপাত হল। এমন সুদর্শন ছেলের পাশে এই মেয়ে ! দেখতে , উচ্চতায় , পরিবার পরিচয়ে কোন বিষয়েই কাছাকাছি পর্যন্ত নয়। তাই এই সম্পর্ক বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হলেও মিনতি মন থেকে কখনই ঝুমাকে গ্রহণ করতে পারেনি। তার ওপর এই বিয়ের পর থেকে পরপর এক একটি ঘটনা, যেমন হঠাৎ করে আমেরিকাতে ভাসুরের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু, ননদের ছেলের অ্যাকসিডেন্ট, বাড়ির ঐতিহ্যপূর্ণ বৃটিশ আমলের উপহার পাওয়া একটি বিশাল দেওয়াল ঘড়ি হঠাৎ পড়ে গিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়া এই সব কিছুর জন্য মিনতি ঝুমাকে দায়ী করে অপয়া সাব্যস্ত করল।
প্রতিপদে শাশুড়ীর কাছ থেকে নানা অভিযোগ , কাজের সমালোচনা , নানাভাবে অপমান সয়েও ঝুমা কোনদিন কিছু বলে নি। আদিত্য সবই বুঝত কিন্তু মায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস ওর ছিল না। ঝুমাকে বোঝাতে গেলে ঝুমা বলেছে এসব নিয়ে ওর ভাবতে হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
সেবার আদিত্য একটি ট্রেনিংএ জার্মানি গেছে। ওর বাবাও ওদের চা বাগানের কিছু কাজে উত্তরবঙ্গে গেছে, এমন সময় এক রাতে মিনতির শরীর খুব খারাপ হল। বুকে হাল্কা ব্যথা , ভীষণ ঘাম আর সারা শরীরে অস্থিরতা । ফোনে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ঝুমা তৎক্ষণাৎ অ্যাম্বুলেন্স ডেকে মিনতিকে নিয়ে হাসপাতাল গেল। এরপর কদিন বেশ সঙ্কট ছিল, আইসিইউতে রাখা হল, খবর পেয়ে শশধর শিলিগুড়ি থেকে চলে এল, ঝুমা আদিত্যকে ফোনে সব জানিয়ে আশ্বস্ত করল যে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে , মা ঠিক আছে, ও যেন ট্রেনিং শেষ করেই আসে।
ডাক্তার বললেন, ” আপনার এই বউমার জন্যই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেল। যেভাবে ও সময়মত নিয়ে এসেছে , আপনার রাতদিন সেবা করেছে তা এক কথায় অতুলনীয় । ” ঝুমা একটি ওষুধ দিয়ে বলল, “ মা, এটা খেয়ে নিন। আজ আমরা বাড়ি ফিরে যাব। ” মিনতির চোখে জল ছলছল করছিল, বলল, “ আমি তোমাকে কত কষ্ট দিয়েছি , কত অপমান করেছি, আমি শুধু তোমার বাইরেটাই দেখেছি আর হীরে চিনতে ভুল করেছি। তুমি আমাকে - - -। ” ঝুমা মিনতির হাত চেপে ধরে বলল, “ মা , প্লিজ , এমন বলবেন না।
======
।। গল্প -২ ।।
দৃষ্টি
শিবাজী সান্যাল
রবিনের ফোন এল , “ ভাল টাকা জমা পড়ছে । এভাবে চললে আমাদের লক্ষ্য পূর্ণ হবে। ” জেনে অমিত একটা আশার আলো দেখতে পেল । এই সমস্ত প্রচেষ্টা রবিনের। ওই সোশাল প্লাটফর্মে আপিল করার কথা ভেবেছিল এবং সব ব্যবস্থা করেছিল ।
ছবি দৃষ্টিহীন । একটি অনুষ্ঠানে ওর গান শুনে অমিত মোহিত হয়ে গিয়েছিল । কিছু খোঁজ নিয়ে ও সোজা ওদের বাড়িতে গিয়ে ওকে বিয়ের প্রস্তাব করে । ওর বাবা মা প্রথমে খুব আশ্চর্য , আর পরে সব জেনে আর ছবির মত নিয়ে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিল । ছবি ওর জীবনে এক সুন্দর সুখের ডালি নিয়ে এল । ওকে নানা জায়গায় গান গাইতে নিয়ে যেত । সেখানে মানুষের প্রশংসায় ওর এক অনাবিল তৃপ্তি আর গর্ব হত । প্রথম দিকে বাড়িতে কিছু দ্বিধা ছিল । কিন্তু ছবির ব্যবহার একসময় সবার মন জয় করে নিয়েছিল ।
ওয়েব খুঁজে , নানা খবর নিয়ে ও জানল , যে ছবির যা চিকিৎসার প্রয়োজন , যাতে ও আবার দৃষ্টি ফিরে পেতে পারে , তা শুধু আমেরিকায় সম্ভব । কিন্তু খরচ এক বিরাট অংক । সব শুনে রবিন বলেছিল ও পরিচয় গোপন রেখে শুধু বিবরণ দিয়ে আবেদন জানাবে ।
রবিনের তিনদিন পর ফোন এল , “ অমিত মিশন সাকসেসফুল । তুই এবার যাবার ব্যবস্থা কর ।”
আমেরিকার একটি হাসপাতাল । তিনদিন আগে ছবির চোখের অপারেশন হয়েছে । আজ ওর ব্যান্ডেজ খুলবে । সকাল থেকে অমিত অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল । ব্যান্ডেজ খোলা হল । আস্তে আস্তে ছবি চোখ খুলল । এই প্রথম অমিতকে দেখে হাসল । অমিত খুশিতে আপ্লুত হয়ে ওর হাতে একটি পুষ্পস্তবক দিল । ছবি এত রঙ কখনত্ত দেখেনি । লাল , নীল , হলুদ ফুল আর সঙ্গে সবুজ পাতা । ও নিজের গালে চেপে ধরল । অমিত ওর কাছে এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলল , “ এবার আমি তোমাকে পাহাড় , সমুদ্র সব সব দেখাব । ”
===============
।। গল্প -৩ ।।
ঘাটবাবা
শিবাজী সান্যাল
রোজকার মত আজও বসে আছে ঘাটবাবা ব্যস্ত ঘাটের সিঁড়ির এক কোনে। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি , মাথার একরাশ রুক্ষশুস্কো চুল , পরনে একটি ফতুয়ার মত জামা , হাঁটু অবধি ধুতি , ঘাড়ে একটি পুরোনো চাদর আর একটি গামছা । ওর নাম বিজন দাস , তবে কেউই সে নাম জানে না , দীর্ঘদিন এই ঘাটে লোকে রোজ একইভাবে দেখে ওর নাম হয়ে গেছে ঘাটবাবা। আশেপাশে অনেক গ্রাম , কোথায় থাকে তাও কেউ তা জানেনা। প্রতিদিন একইভাবে এসে সিঁড়ির একই জায়গায় বসে ও নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে , যখনই কোনো নৌকো এসে ঘাটে লাগে ও উঠে দাঁড়ায় , যারা নামে তাদের মধ্যে যেন কারকে খোঁজে, তারপর আবার নিরাশ হয়ে বসে পড়ে।
পাশে এক মন্দির , সেখান থেকে ভক্তরা পূজো সেরে এসে ওকে প্রসাদ দেয় , অনেকে ভক্তিভরে প্রণাম করে। চারদিকে ছোটখাট একটি বাজার , সেখান থেকেও অনেকে এসে খাওয়ার দিয়ে যায়। বিজন তাকিয়েও দেখে না , কখনও সে খাওয়া গুলো অন্য গরীবদের হাতে তুলে দেয়। দুপুরে কোনো হোটেলের সামনে দাঁড়ালে তারা ওকে খাবারের প্যাকেট হাতে দেয় , ওদের ধারণা বিজনকে খাওয়ালে পুণ্য হয় , বিক্রি বেড়ে যায়। তাই ওকে দেখলে অনেকেই ডাকে , “ ঘাটবাবা , এস আমাদের এখানে এস । ” কিন্তু ও কোন হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে তার কিছু ঠিক নেই। কখনও দু তিন জায়গায় খাবার নেয় , তারপর ঘাটে ফিরতি পথে অভুক্তদের নিজে বসে খাওয়ায়। আজ পর্যন্ত কারও সঙ্গে ও কথা বলেনি , কোন রকম ঝগড়া চেঁচামেচির মাঝে দেখা যায় নি , মনে হয় যেন কারকে ও চেনেও না কিন্তু সবাই ওকে ভালবাসে , ওর এই একাগ্রতাকে নিয়ে নানারকম অনুমান করে , ওর রোজ এই ঘাটে বসে থাকার কি কারণ হতে পারে তাই নিয়ে আলোচনা করে , তবে ওরা কোনো হদিশ খুঁজে পায় না। মাঝিরা সকালে নৌকো নিয়ে বেরুবার আগে ওকে শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রণাম করে তবে নৌকোর দিকে যায়।
একদিন সন্ধ্যাবেলা বিজন ঠিক তেমনই ঘাটে বসেছিল। খেয়াগুলো একে একে ফিরে আসছে তারপর নোঙর করছে। আজকের মত পারাপার শেষ হতে চলেছে। মোহিতের শেষ খেয়া এসে ঘাটে লাগল , বিজন উঠে দাঁড়িয়ে আশাভরা চোখ নিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ ও চিৎকার করে উঠল , “ এসেছে , ঐ দেখ আমার সুবল এসেছে । ” বিজন আনন্দে দু হাত তুলে সবাইকে বলতে লাগল , “ আমার সুবল এসেছে , এতদিনে সুবল আবার আমার কাছে ফিরে এসেছে - - -। ” চারদিকে লোক অবাক হয়ে এই প্রথম ওর কথা শুনে নিচে তাকাল। যাত্রীরা নেমে আসছে , বিজন “ সুবল , ওরে আমার সুবল - - - ” বলে ছুটে ওদের কাছে গিয়ে পৌঁছতেই নিজের ভুল বুঝতে পারল। ওর এতক্ষণের উন্মাদনা সব স্তব্ধ হয়ে গেল , যাকে সুবল ভেবেছিল সেই ছেলেটি নিজের বাচ্চা কোলে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে পাশ দিয়ে যেতে যেতে একবার বিজনকে দেখল , তারপর এগিয়ে গেল। বিজন এত বছর পর যা সামান্য আশার আলো দেখেছিল তাও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ও দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
0 মন্তব্যসমূহ