শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || নার্গিস পারভিন




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


তারকারলির খেলাঘর 
নার্গিস পারভিন 

                      ।১।
       সাহানার দিনগুলো বেশ চিন্তায় কাটছে! অগাস্ট মাস হতে চলল, অথচ এখনও সে এবারের বড়দিনের ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যাবে, তা ঠিক করে উঠতে পারেনি। কোথায় যাবে ঠিক হলে, তবে টিকিট বুক,  রিসোর্ট বুক, আরো কত কিছু। এদিকে সাহানার মেয়ে তিন্নি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়। কবে তার মা বলবে, এবারের বড়দিনের ছুটিতে আমরা অমুক জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছি। আসলে সারাবছর অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও সাহানা প্রতিবছর এই বড়দিনের ছুটিতে দশটা দিন ই.এল নিয়ে নেয়। মেয়ের সঙ্গে কাটায়। কোথাও বেরিয়ে পড়ে কয়েক দিনের জন্য। কখনো অফিসের গ্রুপের সঙ্গে, কখনো পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে, কখনো মা মেয়ে। এখন তিন্নি সাত ছুঁই ছুঁই, তার ইচ্ছা অনিচ্ছা বেশ তীব্র। হুট করে এবছর কোথাও যেতে পারছেনা বললে সে বেশ দুঃখ পাবে। তাছাড়া সাহানা নিজেও চাইছে দুই তিন দিনের জন্য কোথাও বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু ভেবে পাচ্ছেনা কোথায়! 

       ডিসেম্বরের অর্ধেক মাস শেষ হয়ে গেছে! আর এক সপ্তাহ পর ওদের ছুটি পড়বে। মাম্মি বেড়াতে যাওয়ার জন্য কোনো জায়গা ঠিক করে উঠতে পারেনি শেষ পর্যন্ত! তিন্নি খুব মনমরা হয়ে আছে কয়েকদিন থেকে। সে জানে, আগে থেকেই সব বুক করে রাখতে হয়। সুতরাং এবছর তিন্নির আর বেড়াতে যাওয়া হচ্ছেনা! সেদিন সন্ধায় সাহানা অফিস থেকে ফিরে এসে খুব উৎসাহের সঙ্গে তিন্নিকে বলল, লেটস্ প্যাক্ আওয়ার লাগেজ্! মুহুর্তে তিন্নির মুখে খুশির আলো ছড়িয়ে গেল! আমরা যাচ্ছি!
সাহানা বলল, অবশ্যই, বড়দিনের ছুটিতে তিন্নি বেড়াতে যাবে না মায়ের সঙ্গে তা কি হয়? 
ছোট্ট তিন্নি আরো ছোট হয়ে যায়। ইয়ে-এ-এ…, বলে কিছুক্ষণ  লাফিয়ে নেয়, তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে, লাভ ইউ মিম্মি! কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোথায় যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি বল?
তারকারলি।
তারকারলি! সেটা কোথায়! কোন দিকে? কিভাবে যাব? তিন্নির বিস্ময় আর প্রশ্নরা অস্থির।

       মহারাষ্ট্রের এক ছোট্ট গ্রাম তারকারলি।  কঙ্কন সমুদ্রতটের  রানী এই তারকারলি সমুদ্রতট। 
নিরিবিলি, ঝকঝকে সাদা বালির শান্ত সমুদ্র সৈকত তারকারলি। শহর থেকে, ভিড়ভাট্টা থেকে দূরে, মারাঠা গ্রাম পরিবেষ্টিত এই অপরূপ তারকারলির বুকে বয়ে চলেছে ছায়া সুনিবীড় এক মিষ্টি নদী। কারলি। এই কারলি নদীর নামেই স্থানটির নাম তারকারলি। অগাস্ট মাসে সাহানা যখন কোথায় যাবে কোথায় যাবে ভাবছে, তখন ওর  অফিস কলিগ আদ্যা তাকে তারকারলির খবরটা দেয়। তার দেশের  বাড়ি ওদিকেই, রত্নাগিরি। মুম্বাই থেকে ট্রেনে মাত্র নয়-দশ ঘন্টা। খবরটা পেয়ে সাহানা আর অপেক্ষা করেনি। ঝটপট ট্রেনের টিকিট বুক, রিসোর্ট বুক, সব কাজ সেরে রেখেছিল গোপনে, যাতে সে সঠিক সময়ে তিন্নিকে একটা সারপ্রাইজ দিতে পারে।
 রাত প্রায় সাড়ে-এগারটা। তিন্নি মায়ের পাশে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। সাহানা এতক্ষণ বই পড়ছিল। শোয়ার আগে একটা কিছু না পড়লে তার ভালো লাগেনা। তিন্নি, সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ, অফিসের কাজ, সবকিছু সেরে একটা ঘন্টা সে নিজের পড়াশোনার জন্য রাখে। সেই সময়টা তার নিখাদ সাহিত্য পাঠের সময়। ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। সে বলে, এহল মনের গোড়ায় সার জল দেওয়া। মনকে সতেজ ও সচল রাখা। সাহানা,"রিডিং ললিতা ইন তেহরান" বইটা পড়ছিল। পাশের টেবিলে বইটা রেখে দিয়ে তিন্নিকে দেখতে থাকে সে। সাহনার জীবনে তিন্নি এক বড় চ্যালেঞ্জ। তার এই একলা জীবনে  তিন্নিকে একজন সত্যিকারের মানুষ গড়ে তুলতে চায় সাহানা। রূপম সাহানাকে ছেড়ে চলে গেছে। রূপমের কাছে তার নিজের ক্যেরিয়ার, প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি এইসবই অনেক  বড় হয়ে উঠেছিল। এতটাই যে সাহানার অস্তিত্বকেও সে ছোট করে ফেলেছিল। যেন রূপমের জন্যই সাহানার সবকিছু বিসর্জন দেওয়া প্রয়োজন। সাহানা দেয়নি। দেয়নি বলেই রূপম তাকে পিছনে ছেড়ে চলে গেছে। এমনকি সাহানার পরিবারও সাহানার সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত হতে পারেনি! যেন রূপমের সঙ্গে তার যাওয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত হত। এখনো সাহানার পরিবার তাকে নানাভাবে খোঁটা দেয় সেসব প্রসঙ্গ তুলে। এখন রূপমের জীবনে সাহানার স্থান দখল করেছে গ্রেটা। জার্মান। দুজনেই একই ইনস্টিটিউটে, একই ল্যাবে। মসৃণ এক জীবন যাপন করছে রূপম আর গ্রেটা এখন। সাহানা  সব ভুলে, তিন্নিকে আশ্রয় করেই বাকি জীবনটা যাপন করতে চায়। নিজের কর্মজগৎ, তিন্নি তো আছেই, তারপরও নানাভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখে সে। তবু কি রূপমকে ভুলতে পেরেছে সে? সাহানা জানে তা কোনোদিনই সম্ভব নয়। প্রথমদিকে খুব কষ্ট পেলেও  মনে রাগ পুষে  রাখেনি সাহানা। রূপমের মন যেটাতে সায় দিয়েছে সে সেটাই  করেছে। এমনকি সাহানাও। তাছাড়া সাহানা মনে করে, তাদের সম্পর্কের সীমা শুধুমাত্র ঐ তিনবছরের বিবাহিত জীবনের মধ্যেই আবদ্ধ নয়, তার বাইরেও তাদের অনেক কিছু ছিল, যা আজও মুছে যাওয়ার নয়। সেই কলেজ বেলা থেকে বন্ধুত্ব। কত আনন্দের স্মৃতিই তো ছড়িয়ে রয়েছে সেইসব দিনগুলোকে ঘিরে। আর ছিল এক গভীর ক্ষত। রূপম, সাহানা দুজনের বুকেই। তাদের আর এক বন্ধুর চলে যাওয়ার ক্ষত। আজ রূপমও নেই। আছে কেবল তাদের সুখস্মৃতি। সেই সঙ্গে রূপম কিছু তিক্ততাও দিয়ে গেছে! রূপমের চলে যাওয়ার পর প্রথমদিকে সেই তিক্ততাই সাহানার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। কাঁটার মত বিদ্ধ করত সাহানাকে। প্রথমটায় তাই রূপমকে সে ক্ষমা করতে পারেনি কিছুতেই। তারপর সময়ের সাথে সাথে কষ্টের তীব্রতা কমতে থাকলে, সাহানা রূপমের দিক থেকেও  যুক্তিগুলো বুঝতে চেষ্টা করেছে। তাতে অন্তত সে নিজে কষ্ট পাওয়া থেকে মুক্তি পেয়েছে। এখন তিন্নিকে নিয়ে  সাহানা নিজের মত করেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চায়। যদিও সাহানার পরিবারের তাতে সম্মতি নেই। তারা চায় সাহানা আবার নতুন করে জীবন শুরু করুক। যেমন রূপম করেছে। সাহানা জানে, কিছুতেই তা সম্ভব নয়। সেই কলেজ বেলা থেকে যে রূপমকে সে চিনত, সেই রূপমই যখন তাকে ছেড়ে গেল, তখন এইবয়সে এসে, আর কার সঙ্গেই বা সে সম্পর্ক গড়বে!  তার চেনা সম্পর্কগুলোই কেমন এক এক করে শিথিল হয়ে যাচ্ছে! সে জানে তার এই যুক্তি অন্যরা মানবে না, মানেওনি। সাহানা তবুও আর একটা নতুন সম্পর্কে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবতে পারে না। হয়তো এটাই তার সীমাবদ্ধতা। সেই সীমাবদ্ধতা নিয়েই সাহানা ভালো আছে। ভালো তাকে থাকতেই হবে। কারণ, জীবনে  ঝড়-ঝাপটার মুখোমুখি হলে আবেগের থেকে বাস্তবতার উপরেই সে বেশি ভর করে। তাই সে আজ আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে তার অফিস, রিসার্চ, স্টুড্ন্ট, কাজকর্ম এবং তিন্নি এই তার  জীবন। তিন্নিকে মানুষ করা, স্বনির্ভর করে তোলা তার জীবনের এক বিশেষ লক্ষ্য। 
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন উষসী রায়)
                               ।২।
       বাইশে ডিসেম্বরের  সকালে স্বল্প লাগেজ নিয়ে কুডাল স্টেশনে নেমে পড়ল সাহানা আর তিন্নি।  তখন সবেমাত্র কুয়াশা ছেঁড়া নরম সূর্যের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে কুডালের গায়ে গায়ে। শান্ত, ঘুমন্ত স্টেশনটা সবে একটু জেগেছে। চায়ের স্টল খুলে গেছে, তবে তেমন ভিড় তখনও জমেনি। উষ্ণ চায়ের পেপার গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে দু-একজন। সাহানাও দুটো চা বলল। ব্যাগ থেকে বিস্কিট বার করল তিন্নির জন্য। চা শেষ করে, মিনিট দশের মধ্যে তারা স্টেশন থেকে বেরিয়ে, একটা ট্যাক্সিতে চড়ে গাছপালা মোড়া গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে ছুটে চলল তারকালির পথে। তিন্নি এখন ভীষণ উৎসাহিত আর অধীর! কখন পৌঁছবে সে সমুদ্রতটে, কখন তারকারলির বালিতে সে ক্যাসেল গড়ে তুলবে, কখন জলে নামবে এই সবই সে ভাবছে কেবল। সকাল ন'টা নাগাদ, ওরা আগে থেকে বুক করে রাখা রিসোর্ট সি-হেভেনে পৌঁছে গেল। সি-হেভেন রিসোর্টটা মন্দ না। রিসোর্ট থেকে সামান্য কয়েক পা হেঁটে গেলেই সমুদ্র। সমুদ্রের তীর জুড়ে সারি সারি ঝাউয়ের লম্বা লাইন বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সি-হেভেন থেকে সমুদ্রে যাওয়ার পথে একটা চটান পড়ে, দেখে মনেহয়, যেন সূর্যের তাপে সে একটু পিঠ সেঁকে নিচ্ছে। ওইটুকু পার হলেই সাদা বালির প্রশস্ত তট। সামনেটায় কোনো গাছ নেই, যেন তারকারলির সমুদ্রতটের ওটাই প্রবেশপথ। প্রবেশপথটুকু ছেড়ে তীর জুড়ে কেবল ঝাউ এর সারি। সমুদ্র এখন শান্ত। তীরে এসে লাগছে হালকা ঢেউ, জোয়ার আসতে হয়তো তখনও বেশ খানিকটা সময় বাকি। তেমন ভিড় নেই, তবে যতটা নিরিবিলি সাহানা ভেবেছিল, ততটাও নয়।  জলে নেমে  সাহানার হাত ধরে তিন্নি খেলতে শুরু করল। বেশ কিছুক্ষণ জলে ছোটাছুটির পর তিন্নি বলল সে স্যান্ড ক্যাসেল বানাবে। সাহানা এখন খালি পায়ে  সমুদ্রতট ধরে সাদা বালির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বালিটা সামান্য গরম। পায়ে আরাম  লাগছে। সাহানার বাঁদিকে সবুজ ঝাউয়ের ঘন সারি, ডান দিকে  স্বচ্ছ, হালকা সবুজ জলের সীমাহীন সমুদ্র। আর সামনে বিছিয়ে রয়েছে নরম বালির মখমলি পথ! যতদূর দৃষ্টি যায়, এ পথের যেন শেষ নেই। সাহানা হাঁটতে হাঁটতে তিন্নির থেকে বেশ একটু দুরে চলে এসেছে। তবুও সাহানার মনে কোনো অহেতুক দুশ্চিন্তা নেই।  সে জানে তিন্নি কিছু ভুল করবে না। তাছাড়া এভাবেই সে তিন্নিকে কখনো কখনো একা ছেড়ে দেয়। এভাবেই সাহানা, তিন্নির মনে সাহস বুনে দিতে চায়, খুব ছোট থেকেই। তিন্নিও জানে, মা দূরে গেলেও ঠিক ফিরে আসবে। সে নিবিষ্ট মনে ক্যাসেল বানাতে থাকে। মা ফিরলে আবার তারা জলে নেমে স্নান করবে। সাহানা বালির ওপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যেতে যেতে, সামনের দিক থেকে তার খুব চেনা একজনকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। কয়েক মুহুর্ত সময় নেয় সাহানা। ওইটুকুই, কয়েকটা মুহূর্তমাত্র, তারপর আর ভুল হয়না সাহানার। ওই মুখ তার খুব চেনা! কেবল কতগুলো বছরের ফারাকে স্মৃতির ওপর হালকা ধুলো জমে ছিল মাত্র। সাহানা থেমে যায়, কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা। সে কি শিশুর মত দৌড়ে গিয়ে আবির কে জাপ্টে ধরবে? সে হাসবে না কাঁদবে? আবির অবিচলভাবে তার দিকে এগিয়ে আসছে। দৃষ্টি সাহানার ওপরেই নিবদ্ধ। দুজনে কাছাকাছি হতেই সাহানা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, আবির তুই এখানে! 
আবির তুলনায় সংযত, বলল, তারকারলিতে তুই একাই আসবি? বলে হেসে উঠল। কত বছর পর সাহানার মুখোমুখি আবির! সে সাহানাকে দেখতেই থাকে। মনের ভিতরে তখন হাজার কথা আর ঘটনার পর্যায়ক্রম! আবির সাহানাকে শেষ দেখেছিল সেই এম.এস.সি র সময়। পরীক্ষা শেষে একদিন  মোহনবাগানের মাঠে তারা তিনজন মিট করেছিল। সেই শেষ। তারপর আর কোনোদিন রূপম আর সাহানার সামনে আসেনি ও। নিজেকে ওদের থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। তারপর এই আজ! বলে, কেমন আছিস?
সাহানা বলে, ভালো। কিন্তু আমিতো ভাবতেই পারছিনা, এইভাবে তোর সঙ্গে দেখা হবে! সাহানার সম্বিত ফেরে, সে এদিক ওদিক দেখতে থাকে, তোর ফ্যামিলি কই? চল চল তোর বৌয়ের সঙ্গে আলাপ করি।
আবির বলে,একা এসেছি। তোর? আবির ওকে মাপতে চেষ্টা করে। 
চল দেখাব, বলে আবিরের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে সাহানা।
আবির অবাক হয়! সে জানে, সাহানা একা। বছর দুয়েক আগে, জাপানে একটা ইন্টারন্যাশনাল সিম্পোজিয়ামে যোগ দিতে গিয়ে রূপমের সঙ্গে দেখা হয় আবিরের। আবির প্রস্তুত ছিলনা। তবে রূপমকে সে এড়িয়ে যেতেও পারেনি। রূপমও আবিরের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ দেখায়। রূপম আবিরকে রাতে তার হোটেলের ঘরে আসতে বলে। অনেকদিন পর সেদিন রূপম আর আবির মুখোমুখি হয়। আবির সাহানার প্রসঙ্গ তুললে, রূপম তাদের ডিভোর্সের কথা জানায়। জাপান থেকে দেশে ফিরে, আবির অনেকবার চেষ্টা করেছে মুম্বাই এসে সাহানার সামনে দাঁড়াতে, সাহস করে উঠতে পারেনি। কেবল ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়েছে।  বছরখানেক হলো আবির,  সাহানার ব্যাপারে নিয়মিত খবর রাখতে শুরু করেছে। এক বন্ধুর মাধ্যমে। আবির-সাহানা সম্পর্কে সেই বন্ধু  পুরোটাই জানে। সে ই সাহানার তারকারলি যাওয়ার খবর দেয়। তারই ওয়াইফ আদ্যা,সাহানার বন্ধু। কিন্তু সাহানার ফ্যামিলির ব্যাপারে আদ্যা কিছু বলেনি তো! আবির চলতে চলতে সাহানাকে  জিজ্ঞেস করে, এখানে কোথায় উঠেছিস?
আমিতো সি-হেভেনে উঠেছি। ওই তো, দেখা যাচ্ছে।  সাহানা অঙ্গুলি নির্দেশ করে। তুই? 
আমি এখানে হোমস্টে তে আছি। খুব ভালো,ঘরোয়া। তারকারলির প্রকৃত জীবন-যাপনের একটা আঁচ পাওয়া যায়। তবুও খামতি থেকে যাচ্ছে, মারাঠি ভাষাটা তো জানিনা!
শিখে নিতে পারিস। সাহানা প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়, তুই তারকারলি কিভাবে উদয় হলি? সেই যে খড়গপুরে পি.এইচ.ডি করতে চলে গেলি তারপর আর তোর পাত্তা নেই। আমি আর রূপম তোকে খুব  মিস করেছি। সবসময় তোর কথা বলতাম আমরা।আমাদের ব্যাচের সীমন্তিনীর মুখে শুনেছিলাম তুই পোস্ট ডক করছিলিস কোরিয়ায়।
 হ্যাঁ। দু বছর কোরিয়ায় কাটিয়ে, আরো দু'বছর ইউ এস এ তে। 
তারপর?
এখন এই বছর পাঁচেক হলো দেশে ফিরেছি। তারমধ্যে বছর দুয়েক হল এন.সি. এল-এ। 
কি বললি! এন.সি.এল-এ ! পরক্ষণেই হইহই করে উঠে সাহানা ওকে এলোপাতাড়ি মারতে মারতে বলে, তুই আমার এত কাছে আছিস পাঁচ বছর ধরে, আর তুই এখন সেটা বলছিস! ওরা তিন্নির খুব কাছে চলে এসেছে। তিন্নি অবাক দৃষ্টিতে মাকে দেখছে। মায়ের এইরকম চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার সে আগে দেখেনি! তিন্নির চোখে মা যে বোরিং তা নয়, কিন্তু এখন যেন একদম অন্যরকম! ঠিক তিন্নির মতই চাইল্ডিশ।মাকে এভাবে দেখতে তিন্নির খুব ভালো লাগছে! সে উজ্জ্বল চোখে ওদের দেখছে, বোঝার চেষ্টা করছে ব্যাপারটা কি।
ওরা ততক্ষণে একদম তিন্নির কাছে চলে এসেছে। নিজেদের কথা থামিয়ে সাহানা তিন্নির হাত ধরে  আবিরকে বলে, এই আমার জগৎ সংসার। আমার ফ্যামিলি। আমার মেয়ে। তিন্নি।
কয়েক মুহুর্তের জন্য পরিবেশটা যেনো হঠাৎই খুব শান্ত হয়ে যায়। সমুদ্রের গর্জন কিংবা স্নানরত মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি কিছুই আবিরের কানে যায় না। আবির তিন্নির চোখে চোখ রেখে হাত প্রসারিত করে তিন্নির দিকে। তিন্নি সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সাহানা তিন্নিকে এগিয়ে দেয়। আবির তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। সাহানার মেয়ে যে তারও খুব আপন! আবির ভিতরে ভিতরে ভাবতে থাকে, রূপম  একবারও মেয়ের প্রসঙ্গ তুলেছিল কিনা। তারপর সিদ্ধান্তে আসে, না তার আর সাহানার যে একটা মেয়ে আছে, সে কথা কিছু বলেনি রূপম। আবির খুব অবাক হয়। কেন বলেনি রুপম! রূপমকি এতটাই স্বার্থপর হয়ে যেতে পারে, যে সে গ্রেটার সঙ্গে  জীবন বেঁধে নিয়েছে বলে নিজের মেয়েকেও ভুলে যাবে! রূপমকে মনে মনে দুষতে থাকে আবির। তিন্নি আবিরের আলিঙ্গনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে আশ্রয় অনুভব করে। খুব আপন মনে হয় তার আবিরকে। আসলে তিন্নির যত ভরসা সব তার মায়ের উপর, সেই মা যখন এই মানুষটাকে দেখে তিন্নির মত বাচ্ছা হয়ে যেতে পারে, তখন নিশ্চয়ই এই মানুষটা খুব কাছের কেউ হবে। তিন্নি নিজের মত করে ভেবে নেয়। 
আবির তিন্নিকে আলিঙ্গন মুক্ত করে বলে, সে কি তুমি এখনো জলে নামনি! 
না ক্যাসেল বানাচ্ছিলাম।আর মায়ের ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।  
এখন মা এসে গেছে, আমিও এসে গেছি। আর অপেক্ষা কেন চলো চলো সমুদ্রস্নানে যাই। 
তিন্নির এখন দ্বিগুণ আনন্দ! সে বলে চলো চলো। বলে, সে নিজেই আগে আগে ছুটতে থাকে। ওরা দুজনে তিন্নির পিছনে পিছনে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে ওঠে, আসতে চলো পড়ে যাবে।

       আবিরের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে সাহানা আজ বারবার ফিরে যাচ্ছে তার ফেলে আসা অতীতে। সেই কলেজ বেলা থেকেই বন্ধু ছিল তারা। সব সময় তারা তিনজন একসঙ্গে থাকত। রূপম,আবির আর সাহানা। কলেজ, টিউশন, সায়েন্সের প্রাক্টিক্যাল রুম কিংবা লাইব্রেরী, সব জায়গায় তিন মাথা একসাথে। সাহানা কখনোই খুব একটা এক্সট্রোভার্ট ছিল না। বন্ধু বলতে ওরা দুজন। আবির আর রুপম। কলেজ চত্বরের বাইরেও অনেক ঘুরেছে ওরা তিনজন। টিউশন থেকে ফেরার পথে মাঝে মাঝে তিনজনে সাইকেল নিয়ে চলে যেত বর্ধমানের কোনো অজানা রাস্তায়। আবির আর রূপম দুজনেই বর্ধমানের বাইরের, মেসে থাকত। সাহানা ওদের নাম বলে বলে চিনিয়ে দিত জায়গাগুলো। কখনো কখনো মোহনবাগান মাঠের চত্বরে,  কখনও তারা বাগের গাছের ছায়া বিছানো রাস্তায় তিনজনে সাইকেল চালিয়ে গল্প করতে করতে চলে যেত। কখনও ছোটনীলপুরের দিকে, কখনও দেওয়ান দীঘির দিকে। এভাবেই বর্ধমানের কত অচেনা জায়গাও চেনা হয়েছে সাহানারও। কতটুকুই বা চিনত সাহানা নিজেও।  সেসব আজও ভোলেনি সাহানা। এমন অনেকদিন হয়েছে, দেরি করে বাড়ি ফেরার জন্য সাহানার কপালে জুটেছে  মায়ের  বকুনি। ওদের তিনজনের মধ্যে রুপম ছিল সবচাইতে চটপটে। যত প্ল্যান- প্রোগ্রাম সব ওর মাথা থেকে বেরোত। কলেজ পালিয়ে সিনেমা যাওয়া, কলকাতা বইমেলা যাওয়া আরো  কত কি!  রুপম  ছিল  ভীষন  স্মার্ট। যেকোন সময় যেকোন মানুষকে ইমপ্রেস  করার মত ব্যক্তিত্ব ছিল তার। তুলনায় আবির  অনেক  শান্ত,  ধীর স্থির।  এম এস সি র  শেষের দিকে  রুপম এর সঙ্গে  সাহানার  সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকল। আবির  ভিতরে ভিতরে কবে থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তখন বুঝতে পারেনি রূপম বা সাহানা। ইউনিভার্সিটির পাট চুকলে ওরা  তিনজনে একসাথে  শেষ দেখা করেছিল মোহনবাগানের মাঠে। তারপর কতগুলো বছর কেটে যায়! আবির তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ  রাখেনি। অনেক খুঁজেছিল ওরা আবিরকে। সাহানা কোনদিন কোন সোশ্যাল মিডিয়াতেও আবিরকে পায়নি। আসলে যে ইচ্ছাকৃতভাবে হারিয়ে যায় তাকে পাওয়া মুশকিল। তবে  সাহানা-রুপম  আবিরকে কখনো ভোলেনি।  দু'জনের কথার মাঝে সব সময় আবির থাকত। রুপম যখন  সাহানাকে ছেড়ে চলে গেল, সেই দুর্দিনেও আবিরকে খুব মনে পড়েছে সাহানার,  কিন্তু যোগাযোগ করার ইচ্ছে জাগে নি।  রুপম যখন মেইল করে গ্রেটার সঙ্গে তার বিয়ের কথা জানাল, তখন সাহানার জীবনে তিন্নি এসে গেছে।  তিন্নিকে আঁকড়ে নিজেকে বাঁচাতে শিখিয়েছে সাহানা।  তারপর হঠাৎ, এতগুলো বছর পর, তারকারলিতে আবির কে আবিষ্কার করে যখন সাহানা দেখে, আবির  আজও  একলা, ব্যাচেলর জীবন যাপন করছে, তখন সব যেন কেমন গরমিল  লাগে  সাহানার!


দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন উষসী রায়)

                            ।৩।
       সি হেভেন থেকে চেক আউট করতে সাহানার অসুবিধা হল না। সি হেভেন এর চাহিদা সবসময়ই। তাই ওদের কোন আপত্তি নেই। কেবল সামান্য একটা ফাইন দিতেই হবে নিয়মমাফিক। বিকেলের দিকে আবির গাড়ি নিয়ে এসে লাগেজসহ তিন্নি আর সাহানাকে হোমস্টে তে নিয়ে এল। 
তিন্নি বলে,সেই পুনা থেকে গাড়ি নিয়ে একা একা চলে এলে তুমি! 
আবির বলে, তিন্নিও একা একা গাড়ি নিয়ে চলে আসবে একদিন।  
আবির আগে থেকেই আর একটা রুম বুক করে রেখেছিল। সাহানার মুখোমুখি হতেই তারকারলি এসেছে সে এত বছর পরে। তাই আবির  ভেবেচিন্তেই এটা করছে। আবির যে সাহানাকে কতটা ভালোবাসে তা সাহানাও জানেনা। সাহানা জানবে কিভাবে,  কখনো যে সে বলেই উঠতে পারেনি সাহানাকে, বোঝাতেও পারেনি। আবির যে কখনো নিজের কথাটা মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেনা!
ওরা পৌঁছাতেই বাড়ির কর্ত্রী ম্যাডামকে আপ্যায়ন করে তার নির্দিষ্ট রুমে পৌছে দিলেন। যেন আগে থেকেই জানতেন। সাহানা ঘুরে ঘুরে বাথরুম, কিচেন  সব  দেখল। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। পছন্দ হল। বেশ ঘরোয়া এবং আন্তরিক। রাতে আলু ভাজা, ক্যাপসিকামের সবজি, ডাল ফ্রাই আর বড় সাইজের পমফ্রেট মাছের মারাঠি প্রিপারেশন। আর সেইসঙ্গে সুজির কোট দেওয়া মাছ ভাজা। তৃপ্তির সঙ্গে ডিনার শেষ করল ওরা। দুপুরে  ঘুমিয়ে তিন্নি আর ততটা ক্লান্ত নয়। ডিনার শেষে ওরা হাঁটতে বেরোল। ডিসেম্বর মাসের আবহাওয়া একটু ঠান্ডা। তিন্নিকে একটা হালকা হুডি পরিয়ে দিল সাহানা। নিজেও একটা স্ট্রোল নিয়েছে। রাস্তাঘাট বেশ শান্ত নিরিবিলি। এখন রাত্রি সাড়ে নটা। তারকারলি মুম্বাইয়ের মত ব্যস্ত কিংবা গোয়ার মত জমজমাট নয়, যে সারা রাত্রি জুড়ে লোকজনের ভিড় কিংবা কোলাহল থাকবে।  মহারাষ্ট্রের কোন ছোট শহরতলীর মতই এর বৈশিষ্ট্য। অল্পসংখ্যক টুরিস্ট আসে এই ধরনের সমুদ্রতটে। যারা নিরিবিলিতে, অত্যন্ত ব্যক্তিগত ভাবে সমুদ্রতট কিংবা অবসরের সময় উপভোগ করতে চান তাদের জন্য তারকারলি উপযুক্ত। এই রাতের অন্ধকারে তারকারলির রাস্তাঘাট আর পাঁচটা মারাঠি গ্রামের মতোই । অবশ্য মাঝে মাঝে রাস্তায় পাওয়া যাচ্ছে কিছু টুরিস্ট। তিন্নিকে মাঝে রেখে পাশাপাশি হেঁটে চলেছে ওরা। তিন্নি আবিরের হাত ধরে গল গল করে কথা বলে যাচ্ছে। তার স্কুলের গল্প, ক্রেশের গল্প,  বেস্ট ফ্রেন্ডের গল্প। ওরা সমুদ্রের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। দূর থেকে সমুদ্রের গর্জন কানে আসছে। চারদিকের এই নিশ্চুপ পরিবেশে ঘন আঁধারের মাঝে, আবছা আলোয় সমুদ্রের গর্জন; অদ্ভুত এক আবেশ যোগ করে দিচ্ছে তারকারলির রাতের পরিবেশে।  গর্জন ক্রমশ তীব্র হল। ওরা বালি স্পর্শ করল। সমুদ্রের বুকে এখন ভরা জোয়ার। উত্তাল ঢেউয়ে উথাল-পাতাল সমুদ্র। জল অনেকটা এগিয়ে এসেছে, বালির উপর দিয়ে ওরা হাঁটছে। মাঝে মাঝে জল এসে ওদের পা ভিজিয়ে দিচ্ছে। এইসময় নানা রকমের ছোটখাটো সামুদ্রিক জীব বালিতে উঠে আসে। ঝিনুক, কাঁকড়া, তারা মাছ। তিন্নি খুব আনন্দিত ওসব দেখে। ধরতে গেলেই কাঁকড়া গুলো জলে সিক্ত নরম বালির ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। ওরা কচ্ছপও দেখতে পেল। এই সময় ডিম পাড়তে ডাঙায় উঠে আসে কচ্ছপগুলো।

       তিন্নি ঘুমিয়ে পড়লে, আবির তার নিজের রুমে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে সাহানা কথা তোলে, বিয়ে করলি না কেন?
হল কই? তারপর পরিবেশ হালকা করতে আবির বলে,  আসলে সময় করে উঠতে পারলাম না।
সাহানা জানে, এটা আবিরের বাহানা। 
হঠাৎ আবির সাহানাকে বলে, তুই গ্রেটার কথা জানিস? একটু ধাক্কা খায় সাহানা। ছোট করে বলে, হ্যাঁ। মেইল করেছিল রুপম, খবরটা দিতে।
আবির প্রশ্ন করে, রুপম তিন্নির খোঁজ নেয় না? মেয়ের দায়িত্ব? তিন্নিও তো ওর বাবার কথা বলল না একবারও! জাপানে আমার সঙ্গে যখন দেখা হল, রুপম তিন্নির কথা কিছুই বলেনি। ইনফ্যাক্ট,  আমিতো জানতামই না! 
সাহানা এতোক্ষণ চুপ ছিল। এবার বলে, রুপম তিন্নির কথা জানেনা। বলিনি। তিন্নি রুপমের মেয়ে নয়। আই অ্যাডাপটেড হার। শী ইজ্ ওনলি মাই চাইল্ড। 
আবির মনে মনে রুপমকে ক্ষমা করে দেয়।
সাহানা বলতে থাকে, রুপম চলে যাওয়ার পর খুব ভেঙে পড়েছিলাম। আমাদের অফিসের উল্টো দিকে, কিছুটা দূরে একটা অরফানেজ আছে।  আগে আসা যাওয়ার পথে দেখতাম। ওখানেই যোগ দিলাম কাজের অবসরে। ওদের সঙ্গে সময় কাটাতাম। ওখানেই তিন্নিকে পাই। 
আবির শাহানার কাছে সরে আসে, পিঠে হাত রাখে আলত করে। খুব টাফ্ টাইম এর মধ্যে দিয়ে গেছিস!
হ্যাঁ, তোকেও খুব মিস করেছি। জানিস ঐ সময় আমার পাশে কেউ ছিল না। আমার পরিবারও না।
সরি, আমিও তোর অসময়ে তোর পাশে থাকতে পারিনি! আমি যে জানতাম না, না হলে ঠিক আসতাম।  রুপম কে বোঝাতাম। আমার কথা  রুপম ফেলত না। 
সাহানার গলা ধরে যায়, বলে, কেন আসিস নি তুই? কেন এতটা দূরে চলে গেলি? যে ফিরতেই পারলি না!  
আবির চুপ করে বসে থাকে। 
সাহানা নিজেকে সামলে নিতে কয়েক মুহুর্ত সময় নেয়, তারপর বলে, অনেকটা রাত হয়ে গেল, তুই গিয়ে শুয়ে পড়। কাল আবার সকালে বেরোতে হবে।
আবির ওঠার আগে তিন্নির কপালে হাত বুলিয়ে দেয়, সাহানাকে বলে, তিন্নি জানে অ্যাডাপ্টের কথাটা? 
এখনো বলে উঠতে পারিনি, ভয় করে। এত ছোট! যদি ঠিকঠাক বুঝতে না পারে! কষ্ট পায়! আমি আর ওকে হারাতে চাইনা! তাই এখনও পেরে উঠিনি।
আবির বলে, কিন্ত বলতে তো হবেই। দেখ আমার মনে হয়,ছোট থাকতে বলে দেওয়াই ভালো। সত্যটা  যত ছোট বয়সে ওর সামনে আসবে ও তত সহজে গ্রহণ করতে পারবে।
সেটা আমিও ভাবি। অনেকবার বলব বলব ভেবেও থেমে গেছি। সাহস করতে পারিনি!

       সকালে তিন্নির মুডটা একদম অন্যরকম। মনে তার এক আকাশ মেঘ। সাহানা আগে কখনো তিন্নিকে এরকম দেখেনি! 
সাহানা জানতে চায়, কি হয়েছে তিন্নি? 
সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, খিদে পেয়েছে! ততক্ষণে আবিরও সাহানাদের রুমে এসে গেছে। আবির বলে দেখি, চা, ব্রেকফাস্ট করল কি না। সাহানাও তাড়াতাড়ি নিজের ব্যাগ থেকে কিনে রাখা কেক বার করে। আবির চলে যেতেই, তিন্নি শাহানাকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুমিই আমার মাম্মি। তুমি ছাড়া আর কেউ আমার মাম্মি হতেই পারে না! মাম্মি, তুমি একদম চিন্তা করো না, আমি তোমাকে ছেড়ে কোত্থাও যাব না। আমি তোমারই বেবি।
 সাহানা তিন্নিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, হ্যাঁ তো, আমিই তো তোমার মা। যে যাই বলুক তিন্নি, তুমি আমারই বেবি। 
সাহানার বুকের ভেতর থেকে  তিন্নি বলে, কাল আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল যে। শুনে প্রথমে খুব কান্না পাচ্ছিল! তারপর আমি ভাবলাম তুমি ছাড়া অন্য কেউ আমার মাম্মি কিভাবে হবে?
সাহানা বলে, ঠিকই তো। এসব তুমি একদম ভেবনা। আর বিশেষ কিছু বলেনা সাহানা। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। সাহানা ভাবে, তিন্নি জেনে গেছে, ভালোই হয়েছে; এখন সময়ের সাথে, সত্যিটা তিন্নির নিজের মত করে বুঝে নেওয়ায় ভালো।  তারজন্য  হয়ত তিন্নির কিছুটা সময় লাগবে। তা লাগুক।   
ওদের কথার মাঝখানে আবিরও ফিরে এসেছে। তিন্নির মনের ভার লাঘব করতে আবির অন্য কথা পাড়ে। সে তিন্নিকে বলে, আজ আমরা কোথায় যাব বলত?
তিন্নি মায়ের কোল ঘেঁষে বসে আছে, সামান্য উৎসাহ দেখিয়ে বলে, কোথায়? 
সে একটা খুব সুন্দর আইল্যান্ড! চারিদিক সমুদ্রের জল দিয়ে ঘেরা! সেখানে পৌঁছাতে গেলে আমাদের বোটে চড়তে হবে। একটা নদী ও পেরোতে হবে। সেই নদীর নাম কারলি। আমরা সেই আইল্যান্ডে গিয়ে সমুদ্রের জলে অনেক রাইডিং করব। 
সে খুব মজা হবে! তিন্নির উৎসাহ ফিরে আসে। সে বলে, কি নাম ঐ আইল্যান্ডের? কোথায় যাচ্ছি আমরা? 
আবির বলে, সুনামি আইল্যান্ড।
তিন্নি অবাক, বলে, সুনামি আইল্যান্ড!
আবির বলে, লোকে ওর নাম দিয়েছে সুনামি আইল্যান্ড।
তিন্নি বলে, সুনামি কি হয় মাম্মি? 
সুনামি হল সমুদ্রের বন্যা! কখনো যদি সমুদ্রের তলদেশে ভূমিকম্প হয়, সেই ভূমিকম্পের ফলে সমুদ্রের জলও কাঁপতে থাকে। সমুদ্রের জল তখন চলকে ডাঙ্গায় চলে আসে। তাকেই বলে সুনামি।   

       চারিদিক জলে ঘেরা, ছোট্ট দ্বীপ সুনামি আইল্যান্ড। দিব্যি পায়ে হেঁটে একচক্কর দেওয়া যাবে। এখানেই কারলি নদী আরব সাগরে মিশেছে। অপূর্ব সুন্দর সেই সঙ্গমস্থল। নদীর তীর ধরে নারকেলগাছের সাজানো সারি। কোথাও তেঁতুল, তালের কিংবা নাম না জানা নানা গাছের ঘন জঙ্গল। এই দ্বীপ থেকেই  নানা রকমের ওয়াটার স্পোর্টসের ব্যবস্থা। বোট রাইড, প্যারাসেইলিং, স্পিডবোট আরো কত কি! এইসব আকর্ষণের জন্য ভিড়টাও কম নয়। ওরা তিনজন বেশ কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে দিল ওখানে। বেশ কিছু রাইডও করল। ওদের জামা কাপড়ও বেশ ভিজে গেছে! তিন্নির জন্য সাহানা একটা বাড়তি জামা এনেছিল, সেটা পরিয়ে দিল। তিন্নি আনন্দে আত্মহারা! সকালের সব মেঘ ভেসে গেছে তার মন থেকে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখান থেকে শেষ বোট রওনা দেবে। ওদের হাতে আরো কিছুটা সময় আছে। ওরা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মেখে, সুনামি দ্বীপের নরম মাটিতে একটু হাঁটবে বলে এগিয়ে গেল। এই মনোরম পরিবেশে ওদের মন যেন সম্পৃক্ত হয়ে উঠেছে আপনা থেকেই! সাহানা কিংবা আবির কোনো কথা বলছে না, অনুভব করছে। আর মাঝে মাঝে তিন্নির প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে মাত্র। একটা সময় ওরা ফেরার জন্য বোটে উঠে বসল। তারকারলির রূপসী দ্বীপ সুনামি আইল্যান্ডকে পিছনে ফেলে, কারলি নদীর বুকে ভেসে যাচ্ছে ওদের বোট। নদীর দুই তীরের নারকেল, তাল, তেঁতুল কিংবা নাম না জানা নানা গাছের ছায়া সুনিবিড় শীতলতা বয়ে যাচ্ছে ওদের মনে! সমুদ্রের জলে তখন শেষ সূর্যের রশ্মি পড়ে, জল হয়ে উঠেছে যেন গলিত সোনা! সাহানার কোলে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত তিন্নি, আবিরের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্রামের ঘুমে নিশ্চিন্ত সাহানাও। সুনামির দ্বীপের মতই তখন আবিরের বুকেও  জেগে উঠেছে এক আশ্রয় দ্বীপ। যে দ্বীপের খোঁজে এতগুলো বছর ছুটে বেরিয়েছে আবির!

                              *****

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ