পর্ব -৩ ।। কবিতার রূপ, ছন্দ ও রীতি ।। উপস্থাপন - দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

পর্ব -৩

।। কবিতার রূপ, ছন্দ ও রীতি ।।

উপস্থাপন - দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য

 স্তবক

      স্তবক গঠিত হয় দুই বা আরো বেশি পঙ্‌ক্তি নিয়ে। স্তবক ছন্দের বৃহত্তম একক, বিপরীতে মাত্রা ছন্দের ক্ষুদ্রতম একক। একটি স্তবকে কবিতার মূল ভাবের এক অংশের প্রকাশ হয়, অন্য একটিতে পরিবেশিত হয় ভাবের আরেক অংশ, এবং সেই মত এগোয় কবিতার রচনা। পঙ্‌ক্তির সংখ্যা অনুসারে স্তবকের বিভিন্ন নাম হয়, যেমন- দ্বিক, ত্রিক, চতুষ্ক, ইত্যাদি। নিচের দুই দৃষ্টান্তে:

দ্বিক (Couplet) :

স্ফুলিঙ্গ তার | পাখায় পেল || ক্ষণ কালের | ছন্দ I
উড়ে গিয়ে | ফুরিয়ে গেল || সেই তারি | আনন্দ I (‘লেখন – ৭’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

চতুষ্ক (Quatrain) :

ফুলে ফুলে | ঢ’লে ঢ’লে || বহে কিবা | মৃদু বায়, 
তটিনী হিল্ | লোল তুলে || কল্ লোলে চ | লিয়া যায়। 
পিক কিবা | কুন্ জে কুন্ জে || কুহু কুহু | কুহু গায়, 
কি জানি কি | সের লাগি || প্রাণ করে | হায় - হায়।  (‘কাল মৃগয়া’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

 মিল

      ছন্দের আলোচনায় মিলের কথা ওঠে প্রথমে। মিল কবিতায় আনে গতি ও ‘শুনতে ভালো লাগা’ নামের কাঙ্ক্ষিত গুণ। দুই বা ততোধিক শব্দ সারি বা পঙ্‌ক্তি শেষে যখন একই ধবনির পুনরাবৃত্তি করে, তখন সেই মিলকে বলা হয় অন্ত্যমিল। কবিতায় অন্ত্যমিল থাকলে, তাদের মিত্রাক্ষরের কবিতা নামেও আখ্যা দেয়া হয়। মধ্যমিল সৃষ্টি হয় সারির ভিতরে, পর্বে বা পদে, যখন এক রকম ধ্বনির বা ধ্বনিগুচ্ছের ব্যবহার একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি করে। মধ্যমিলের ব্যবহারে ‘শুনতে ভালো লাগা’ গুণের বিশেষ বৃদ্ধি হয়।
মিল দেয়ার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রয়েছে উপরের চতুষ্কটিতে। এতে সুর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন সেই অতুলনীয় গান। চতুষ্ক গঠনের এক ধারা (AAAA) অনুসারে স্তবকটির তৈরী, যাতে একই ধ্বনির অন্ত্যমিল পড়ে প্রতি পঙ্‌ক্তির শেষে। এখানে সেটা আয়-তে। মধ্যমিল আছে পঙ্‌ক্তিগুলির পর্বে পর্বে, পদশেষের মিল প্রথম ও দ্বিতীয় পঙ্‌ক্তির প্রথম দুই পদে। ফলস্বরূপ, অনুপ্রাসের ছড়াছড়ি সর্বত্র।
এখনকার কালের কবিতায় মিলের ব্যবহার দেখানর উদ্দেশ্যে, এক উদাহরণ নেয়া হল তরুণ ও জনপ্রিয় এক কবির লেখা থেকে।

বিন্দুমাত্র ভয় নেই | ইন্দুমাত্র উঠেছে আকাশে ||
সিন্ধুমাত্র জল, তাতে | দিনদুয়েক চান করা যাবে I
তারপর রহস্য শেষ | রেশনের চাল মাসে মাসে... ||
সুরায় ফুরাবে ইচ্ছা | (সে নেহাত পাত্রের অভাবে) I

(‘রসদ’, শ্রীজাত)

      স্তবকটি দেখায় তিন জাতীয় মিলের - আদ্য, মধ্য ও অন্ত্য। যুক্তবর্ণের ধ্বনিগুচ্ছ ‘বিন্দু’ ও ‘ইন্দু’ আনে মধ্যমিল, প্রথম সারিতে। "সিন্ধু" (মাত্র)-র সঙ্গে "দিনদু" (য়েক) শোনায় আর এক মধ্যমিল, দ্বিতীয় সারিতে। ‘বিন্দু’ ও ‘সিন্ধু’ দেখায় আদ্যমিল, প্রথম ও দ্বিতীয় সারির গোড়ায়। অন্ত্যমিল পড়েছে প্রথম ও তৃতীয়, এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ সারিতে। সবের মাঝে মধ্যমিল বিশেষ চমৎকারিত্ব দেখায়।

 লয়

      ছন্দ-বিচারে, ধ্বনির গতিকে বলা হয় লয় (tempo)। কবিতার প্রথম স্তবক বা চার লাইন পড়লেই বোঝা যায় ধ্বনিদের কোন বেগে সাজান হয়েছে, এবং তার থেকে ঠিক করতে হয় কবিতাটির আবৃত্তি হবে ধীরে, দ্রুতভাবে বা মাঝামাঝিতে। গতির এই আপাত হিসেবে তিন লয়ের নাম দ্রুত, মধ্যম ও বিলম্বিত।

( চলবে ...........

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ