শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || দেবব্রত সান্যাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


পেনসিল
দেবব্রত সান্যাল

আজকাল রোজ সকালে বিদেশ বাবুর বাড়িতে একটা প্রতিযোগিতা চলে; যে সকালে উঠবে সে ঘর ঝাঁট দেবে ৷ জীবনে জিলিপি খাওয়া দৌড়েও পঞ্চম হওয়া বিদেশ বাবু এই দৌড়ে গত আড়াই মাস ধরে জয়ী হয়ে রেকর্ড স্থাপন করেছেন৷ 
প্রথমেই খেয়াল হলো ঝাঁটাটার ফুল কিছু ঝরতে শুরু করেছে৷ তখনই টং করে ডোর বেলটা বাজলো! 'ঝরা ফুল দলে কে অতিথি?' আজকাল দরজার ঘন্টা করোনার আগমন ধ্বনি বলে বোধ হয় ৷ জাদু চোখে উঁকি মেরে দেখলেন সাফাই যুবক জিয়া৷ গায়ে ফতুয়া, মুখে মুখোশ পরে, হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে সশস্ত্র হয়ে দরজা খুলে, প্রথমেই মেহের আলির মতো আনসোসাল অভ্যর্থনা করলেন ৷ 'তফাৎ যাও !' 
ওনার স্ত্রী বলেন, ওনার চেহারাটা নাকি পাগল মেহের আলির মতোই হয়ে এসেছে৷
যাহোক, এই শ্রমসাধ্য বিপদজনক কাজটি সম্পন্ন করে উনি নিত্য কর্মে মন দিলেন ৷  শুরুতেই দেখলেন, মেঝেতে কালো রঙের একটা পেনসিল পড়ে আছে৷ উনি ফেলেন নি, কিন্তু তুলে রাখার দায় অবশ্যই ওনার৷ ওটাকে টেবিলের ওপর তুলে রেখে, মা কে স্মরণ করে কোমর সোজা করতে করতেই পেনসিলটা আবার মেঝেতে গড়িয়ে পড়লো৷ একবার মনে হলো একটা সুইপ শট (ঝাঁটা দিয়ে তো আর লেট কাট হয় না) লাগিয়ে দি৷ কিন্তু তুলতে হলো, দেখলেন শিশটি অক্ষত আছে ৷ টেবিলে রাখলেন, হাতে ঝাঁটা নিয়ে গার্ড নেবার আগেই পেনসিলটা আবার মেঝেতে ৷ এবার পেনসিলটা তুলে দেখলেন গায়ে  রূপালী অক্ষরে লেখা আছে ম্যারিয়ট৷ বিদেশ বাবু যেমন বিদেশ যাননি, তেমন ম্যারিয়টেও যান নি৷ পেনসিলটাকে টেবিলস্থ করে, শুরু করার আগেই আবার পেনসিলের পতন৷ ভাবলেন, যে অধঃপাতে যাবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাকে আটকাবে কে? তুলতে হলো, কিন্তু পেনসিলটা একই কায়দায় একই রকম শব্দ করে মেঝেতে পড়লো৷ বিদেশ বাবু এটা ধরেই রেখেছিলেন ৷ পেনসিলটাকে তুলে টেবিলের একই জায়গায় রেখে, অপেক্ষা করলেন, পেনসিলটা কখন পড়ে৷ পেনসিলটা পড়লো না ৷ কিছু অপেক্ষা করে বিদেশ বাবু ওনার দুই 'বি', ছোট  'এইচ' ও তার থেকে ছোট 'কে' ঝাঁড় দিয়ে ঘুরে এলেন৷ হাত ধুতে গিয়ে ঘষে ঘষে এতটা ফেনা করে ফেললেন, যে সমুদ্রের কথা মনে হলো ৷ কতদিন পুরী যাওয়া হয় না ৷ এখন তো আর ... বুক খালি করে নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো৷
গতবছর ম্যারিয়টে একটা কনফারেন্স ছিল, কিন্তু অফিস থেকে ওনাকে হতাশ করে ত্রিদিবকে পাঠালো৷ তাহলে পেনসিলটা ?
ইনডাকশন কুকটপটাকে তিন চাঁটিতে সচল করে চায়ের জল চাপালেন বিদেশবাবু ৷ চাঁটিটা লাগিয়ে সাফল্য পেতে বিদেশ বাবুর ভালো লাগে ৷ কানটা সজাগ রইলো পেনসিল পড়ার শব্দ পাওয়ার জন্য ৷ সেটা এলো না ৷ ফোনে পাওয়া সুপ্রভাত মার্কা উদোর ছবি বুধোকে পাঠাতে পাঠাতে খেয়াল রাখলেন ৷ পেনসিলটা যথাস্থানে এমন ভাব করে বসে রইলো, যেন ওর চোদ্দ গুষ্টিতে কেউ মেঝেতে পড়ে নি৷ এমন চিটিং বিদেশ বাবুর সহ্য হচ্ছিল না ৷ উনিও 'আমার কিছু যায় আসেনা' ভাব করে করোনার স্কোরের দিকে মন দেবার ভান করলেন ৷ বিদেশ বাবুর নিজের নামের প্রভাবেই হোক বিদেশি জিনিস বেশ পছন্দ ৷ এই করোনাটা বাদে৷ যা দেখলেন তাতে মন ভালো হওয়ার মতো কিছু নেই ৷ ভারত একে ওকে টপকে তালিকায় উপরে উঠে আসছে৷ এই গৌরবটা প্রার্থিত ছিল না ৷ ওদিকে পেনসিলটা ত্যাঁদোড়ের মতো টেবিলে বসে থাকলো, যেন ওর পৈত্রিক টেবিল৷ বিদেশ বাবুর খুব ইচ্ছে করছিল, পেনসিলটাকে টোকা মেরে ফেলে দি৷ কিন্তু সেটা করাটা উচিত হবে না মনে করে পেনসিলের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিলেন৷ না নো হিল্ডুল, নট কিচ্ছু৷ এবার একটা কিছু করতেই হয়, যেমন জোরে ফ্যান চালানো, অন্যমনস্ক ভাবে টেবিলটাকে ধাক্কা দেওয়া ইত্যাদি ৷ 
এইসব প্ল্যান এক্সিকিউট করার আগেই শোবার ঘরের দরজা খুলে ওনার শ্রীমতীর প্রবেশ, ও প্রসন্ন মুখে 'আমার চা টা আবার করতে গেলে কেন' বলে টুথব্রাশের খোঁজে গেলেন ৷ বিদেশ বাবু অপেক্ষা করে রইলেন, ওনার স্ত্রীকে দেখিয়ে দেখিয়ে পেনসিলটা কোনও চালাকি করে কিনা৷ কিচ্ছু না, একটা অস্বস্তিকর, যুদ্ধ বিরতি৷ 
'তোমাকে সকাল সকাল, এমন টেনসড লাগছে কেন?' 
'পেনসিলটা, পেনসিলটা শয়তানি করে আর পড়ছে না৷'
'কোন পেনসিলটা?'
'ওই তো, টেবিলের ওপর!'
'কোন টেবিল?'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ