কবিতার রূপ, ছন্দ ও রীতি ( প্রথম পর্ব) - দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য




পোস্ট বার দেখা হয়েছে



         পর্ব - ১

।। কবিতার রূপ, ছন্দ ও রীতি ।।
বাংলা কবিতার এক প্রাথমিক পাঠ

ভাবনা ও উপস্থাপন - দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য


      কবিতা লেখা হয় দুই উপায়ে, ছন্দের সাথে অথবা ছন্দ ছাড়া। অধিকাংশ বাংলা কবিতা লেখা হয় ও হয়েছে ছন্দের ব্যবহারে, এবং বাংলার ভান্ডারে রয়েছে বিবিধ ছন্দ-রতন। উদাহরণ দিয়ে সেইসব ছন্দ ও তাদের রূপ ও রীতি পাঠকের কাছে পেশ করার উদ্দেশ্যে এই রচনার আয়োজন।
আশা করছি লেখাটি পড়তে গিয়ে, কিছু পাঠক ছন্দকে জানবার সু্যোগ পাবেন আর একবার।
জানিয়ে রাখি প্রথম পর্বে রয়েছে কবিতার ও ছন্দের সংজ্ঞা সম্পর্কিত কয়েক কথা। যে সব উপকরণ দিয়ে ছন্দের নির্মাণ হয় তাদের পরিচয় দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে। ছন্দের রীতি ও রূপ সম্পর্কিত মূল আলোচনা রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বে |

১। ছন্দের  সংজ্ঞা  

      কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে খোঁজ করলে জানা হয় কবিতা কল্পনামূলক, প্রকাশ করে লেখকের অনুভব ও আবেগ। সাহিত্যের অন্যান্য ধারার তুলনায় সে অনেক স্বাধীন, চরিত্র বা প্লটের বাঁধন থেকে মুক্ত। যে অনুভূতি ও কল্পনা প্রকাশ পায় কবিতায়, তাদের মনে করা হয় কবিতার মর্ম। বিমূর্ত সে চেতনার রূপ দেয়া হয় শব্দ চয়নে ও ধ্বনি বিন্যাসে, এক-এক পঙ্‌ক্তি লেখার মাধ্যমে। সে কাজের অন্যতম উদ্দেশ্য, কবিতায় শ্রুতিমধুরতা আনা। শব্দদের স্বর-সঙ্গতি কবিতায় সৃষ্টি করে শ্রুতিনির্ভর এক তরঙ্গ, যার নাম ছন্দ। তরঙ্গায়িত সে ধ্বনির আবেদন মনকে স্পর্শ করে, কবিতা পড়ার সময়ে যখন কান দিয়ে (শুনে) পড়াই প্রধান কাজ।
মনোরম ছন্দে বহু কবিতা লিখেছিলেন শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, এবং বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন ছন্দের যাদুকর নামে। তার লেখা কবিতা ‘পাল্কীর গান’। নিচে কবিতাটির অংশ বিশেষের উদ্ধৃতি করা হল তিনটি আলাদা কলামে।

পাল্কী চলে!
পাল্কী চলে!
গগন-তলে
আগুন জ্বলে!
ময়রা মুদি
চক্ষু মুদি
পাটায় বসে
ঢুলছে কষে!
আসছে কা’রা’
হন্ হনিয়ে?
হাটের শেষে
রুক্ষ বেশে
ঠিক দু’পুরে
 ধায় হাটুরে!

      অংশগুলি পড়তে পড়তে অনুভব হয় এক ধ্বনি-তরঙ্গের। সে কানে আনে এক আওয়াজ, যা পাল্কী কাঁধে চলতে গিয়ে বেহারারা করে শরীরে দোলা দিয়ে। কবিতার চিত্র, কোন গাঁয়ে এক রোদ জ্বলা দুপুরে প্রায় নিশ্চল জীবন। তাতে গতি আনে পাল্কী বাহক বেহারা আর হাটুরে, যাদের চলা হন্ হনিয়ে। আমাদের চেতনায় অনায়াসে জায়গা করে নেয় চলার সেই ধ্বনি।

কোন শিল্প প্রদর্শনে থাকে ভাব (content) আর গঠন (form)। কবিতার ক্ষেত্রে ভাব ও গঠন বোঝায় কি বলা হবে এবং কোন ভাবে বলা হবে। ছন্দ দেখায় বলার ধরন আর গঠনের পরিকল্পনা। যে নকশায় শব্দ ও সহযোগী ধ্বনি সাজান হয় এক-এক ছত্রে, তার ছাঁদ বা প্যাটারন্ (pattern) কে বলা হয় ছন্দ। ছন্দোবদ্ধ রচনায় প্যাটারন‌টির ব্যবহার হয় সমান ভাবে। ছন্দের লেখার বিপরীত রীতিতে তৈরী হয় মুক্তছন্দের বা ফ্রি ভার্সের কবিতা, যার গঠনে শৃঙ্খলা বা প্যাটারন্ মানা হয়না কিন্তু ধ্বনিমাধুর্য রাখা হয় বিশেষ যত্নে।
বাংলায় ‘শব্দ’ দুই অর্থ বোঝায়, কথা (word) ও ধ্বনি (sound)। এই লেখায় শব্দ কথাকে বুঝিয়েছে।

      সঙ্গীত ছন্দোবদ্ধ, যাতে থাকে সুর, তাল ও প্রয়োজন মতো কথা। সঙ্গীতে সুরের ছন্দ মুখ্য, কথার ছন্দ গৌণ। কবিতার ছন্দ, কথার উচ্চারণে। সঙ্গীতে ‘সুরধ্বনি সাজান হয় পরিমিত ও নির্দিষ্ট প্যাটার্নে্‌’, যার নাম তাল। কবিতায় ‘শব্দ সাজান হয় পরিমিত ও নির্দিষ্ট প্যাটার্নে্‌’, যার নাম ছন্দ। তাল এক নির্দিষ্ট জায়গা থেকে শুরু করে, এক সময় মাফিক চলন শেষ করে, আবার সেই জায়গায় ফিরে আসে। কবিতায় ছন্দের গতিও থাকে এক সময় মাফিক চলনে। দেখা যাচ্ছে তাল যে কাজ করে সঙ্গীতে, ছন্দ সে কাজ করে কবিতায়।

      ছন্দের উপযোগিতা বলতে বোঝায় শুনতে ভালো লাগা, সহজে মনে রাখা ইত্যাদি। এসব গুণের প্রমাণ মেলে, যখন দেখি শিশু বয়সের শোনা ছড়া ও নার্সারি রাইম্ মনে আসে স্বচ্ছন্দ সহজে মনে পড়ে ছোট বয়সে পড়া কিছু বাংলা কবিতা- শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’, উপরের ‘পাল্কী চলে’ প্রভৃতি। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, ছন্দের দৌলতেই এদের ধ্বনি মাধুর্য স্মৃতির মাঝে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

      ‘ছোট খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া’ দিয়ে যে বইটির শুরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সহজ পাঠ’, তার সহায়তায় শুরু হয়েছিল আমাদের অনেকের বাংলা শেখা। সে বইয়ের কবিতা “আমাদের ছোট নদী”। 

( চলবে.............................




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

8 মন্তব্যসমূহ

  1. এই কলম অনুসরণ করা প্রত্যেক কবির অবশ্যই করণীয় মনেকরি,এর মাঝে সার্থক কবি হওয়ার মূলমন্ত্র অবশ্যই গচ্ছিত আছে।শুভ কামনা ও ভালবাসা জানাই সার্জেন কবিভাইকে এরকম একটি সচেতন মূলক প্রয়াসের জন্য

    উত্তরমুছুন
  2. যথার্থ বলেছেন কবিবর, এই ছন্দ হলো মোহময়ী "কবিতা"র এক সুসজ্জিত অলংকার। যার দ্বারা কবিতারা আরো বেশী করে হয়ে ওঠে সুন্দরী, অপরূপা ।

    আন্তরিক ধন্যবাদ,
    শুভেচ্ছা ও শুভকামনায় আগামীর অপেক্ষা রাখি......
    অপেক্ষা রাখি আরো নতুন কিছু জানার....

    উত্তরমুছুন
  3. খুবই ভালো উদ্যোগ নিয়েছেন দাদা। অসংখ্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  4. সমৃদ্ধ ও শিক্ষণীয় আলোচনা .... প্রতিদিন আরো উন্নত করা যায় এই পর্যালোচনায় , ধন্যবাদ !

    উত্তরমুছুন
  5. খুব সুন্দর আলোচনা অনেক কিছু জানলাম ধন্যবাদ কলমে আলোচনা । চলুক

    উত্তরমুছুন
  6. সত্যি সার্জেন !!! চলুক কলম

    উত্তরমুছুন
  7. খুব সমৃদ্ধপূর্ণ আলোচনা, এটা খুবই প্রয়োজন জানার ও শেখার।

    উত্তরমুছুন
  8. সুন্দর এবং সমৃদ্ধ আলোচনা।
    খুব ভালো লাগলো। আশাকরি কবিরা এর সুফল উপভোগ করবেন।

    উত্তরমুছুন