কবিতার রূপ, ছন্দ ও রীতি ( পর্ব ২) - দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


         ★ পর্ব - ২ ★

 কবিতার রূপ, ছন্দ ও রীতি 

উপস্থাপনা - দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য

। |ছন্দের উপকরণ ||

      ছন্দের উপকরণ বলতে বোঝায় ধ্বনি, বর্ণ, দল, মাত্রা, যতি, পর্ব, পদ, মিল প্রভৃতি যাদের দিয়ে তৈরী হয় ছন্দের রীতি ও রূপ।

 ধ্বনি ও বর্ণ 

      ছন্দ কানে শোনার জিনিস। তাকে চিনতে গিয়ে শুনতে হয় শব্দের মধ্যবর্তী ধ্বনিদের, বুঝতে হয় তাদের গুণগত রূপ, এবং সেই বিচারে আশ্রিত ধ্বনির উচ্চারণকে জানা আবশ্যক। অনেক ক্ষুদ্র শব্দের উচ্চারণেও শোনা হয় ধ্বনিগুচ্ছ। তাদের বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় উচ্চারণ কার্যকর হচ্ছে এক ধ্বনির সাথে অন্য ধ্বনি জোড়া দিয়ে। আশ্রিত ধ্বনি বলা হয় প্রধান ধ্বনির সহযোগী ধ্বনিকে।
      ধ্বনির লিখিত রূপ বর্ণ বা হরফ। স্বরবর্ণ শোনায় স্বরধ্বনি। অ থেকে ঔ পর্যন্ত এগারটি স্বরবর্ণের নয়টি মৌলিক স্বরধ্বনি। বাকি দুই স্বরধ্বনি ঐ এবং ঔ যাদের উচ্চারণ হয় ধ্বনি মিশ্রণে। ঐ (অ+ই) এবং ঔ (ও+উ) কে যুগ্মস্বর (dipthong) বলে জানা হয়।

      ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণ হয় স্বরধ্বনির আশ্রয় নিয়ে। উচ্চারণে ‘ক’ হয় ক্+অ, ‘গ’ হয় গ্+অ, ইত্যাদি। অ-ধ্বনি ছাড়া ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ হয় দুভাবে। প্রথম উপায়, ব্যঞ্জনধ্বনির শেষে অধিক ঝোঁক বা চাপ দেয়া। ঝোঁকটা লক্ষ করান হয় শব্দ শেষের বা মাঝখানের ব্যঞ্জনবর্ণর নিচে হসন্ত চিহ্ন ্ দিয়ে। উচ্চারণে ্ চিহ্ন শোনায় ‘হসন্ত’ ধ্বনি। যেমন: ভাগ্, ধিক্, নক্‌শা, রাইম্ ইত্যাদি। দ্বিতীয় উপায়, অনেক শব্দর শেষ ব্যঞ্জনবর্ণর উচ্চারণে সহযোগী অ-ধ্বনিকে বাদ দেয়া। যেমন: কাজ, যে ‘কাজ+অ’ নয়; এবং তল, যে ‘তল+অ’ নয়।
      এক বর্ণ অন্য বর্ণের সাথে যুক্ত হলে আশ্রিত বর্ণের আকৃতি সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপকে বলা হয় ‘কার’, যেমন আ= া, ই = ি, উ = ু প্রভৃতি। নিয়মটির ব্যতিক্রম হল অ-স্বরবর্ণ, যার ‘কার’ চিহ্ন নেই। একাধিক ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে যুক্তবর্ণ, যার মধ্যে বর্ণেরা সংক্ষিপ্ত আকার নেয়। যুক্তবর্ণের নমুনা: ল্ক=[ল+ক], শ্ব=[শ+ব] ও ন্দ=[ন+দ]। ‘য’ ও ‘র’ অন্য ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত হয়ে যে সংক্ষিপ্ত রূপ নেয় তাকে বলা হয় ‘ফলা’। যেমন: ‘ন্য’ তে য-ফলা এবং ‘ম্র’ তে র-ফলা।
      বর্ণের যুক্ততায় ধ্বনির পরিবর্তন হয়। যুক্তবর্ণের ধ্বনি, হসন্ত ধ্বনি প্রভৃতির বিচারে স্থির হয় আশ্রিত ধ্বনির সঠিক উচ্চারণ।

 সিলেবল্ ও দল

      শব্দের উচ্চারণ ও বানান ভিন্ন ভাবে হয়। কোনো কথার উচ্চারণ সঠিক কিনা সেটার বিচার হয় চলিত উচ্চারণের ধারায়। কথিত হয়ে শব্দ যে আকৃতি নেয় তাকে দেখা হয় ফোনেটিকস্ (phonetics) এর পদ্ধতি অনুসারে, যে কাজে শব্দ-ধ্বনিদের ছোট ছোট টুকরোয় ভাগ করে অংশগুলিকে সিলেবল্ (Syllable) নাম দেয়া হয়। যেমন কোকিল শব্দর উচ্চারণ হয় দু-ভাগে, ‘কো’ এবং ‘কিল’। এরকম প্রতি শব্দ আমরা ভাগ-ভাগ করে উচ্চারণ করি, আর প্রতি ভাগ এক সিলেবল্। শব্দকোষ অনু্যায়ী- একটি শব্দকে কথিত করার সময়ে, জিহ্বা এক জায়গায় স্থির রেখে উচ্চারণের স্বল্পতম চেষ্টায়, শব্দর যে অংশটুকুর ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় তাকেই সিলেবল্ বলা হয়।

      শব্দ উচ্চারণের এই স্বল্পতম চেষ্টায় স্বরধ্বনির উপস্থিতিই লক্ষ্য করা যায়। উচ্চারণে কোকিল হয়ে যায় কো ৹ কিল। কো এবং কি শোনায় ‘ও’ আর ‘ই’ স্বরধ্বনি। এখানে বুদবুদ ৹ চিহ্ন দিয়ে সিলেবল্ দের দেখান হল। এক শব্দে যত সিলেবল্ আছে সে সংখ্যার হিসেব হয়, এই ৹ চিহ্নদের সংখ্যা গুণে ও সাথে এক যোগ দিয়ে। সেমত, কো ৹ কিল শব্দে আছে দুটি সিলেবল্।

      সিলেব‌য়ল্ বলতে যা বোঝায় বাংলায় দল কথাটি তাদের জানায়, সেহেতু সিলেব‌ ল্ আর দল সমার্থক। অ, আ, সে, এই, কিল ইত্যাদি এক দল। আমি, তুমি ও সখা শব্দ গুলিতে দুই দল। কবিতা (ক ৹ বি ৹ তা) দেখায় তিন দল। যুক্তবর্ণময় শব্দে দলের নমুনাঃ ছন্দ (ছন্ ৹ দ), শব্দ (শব্ ৹ দ) ও রবীন্দ্রনাথ (র৹ বীন্ ৹ দ্র ৹ নাথ)। ক্রমিক ভাবে এদের উচ্চারণ করলে শোনা হয় দুই, দুই ও চার দলকে।
দল দুই রকম, মুক্তদল ও রুদ্ধদল। যে দলের শেষে আশ্রিত ধ্বনি নেই, তাকে মুক্তদল (Open Syllable) বলা হয়। যেমন- অ, আ, ক, খ, সা, রে প্রভৃতি। মুক্তদলের উচ্চারণ হয় মুখ খুলে এবং মুক্ত কথাটি সে অবস্থা বোঝায়। মুক্তদলে থাকে মৌলিক স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ।
যে দলের শেষে আশ্রিত ধ্বনি থাকে সে রুদ্ধদল (Closed Syllable)। যেমন- এক, কাজ, গান, তল, এই, বউ, শক্, ধিক্, প্রভৃতি। আশ্রিত ধ্বনির উৎস ব্যঞ্জনবর্ণ বা স্বরবর্ণ হতে পারে। রুদ্ধদলের উচ্চারণ টেনে করা সম্ভব নয়, আশ্রিত ধ্বনিতে সে ফুরিয়ে যায়। উচ্চারণ শেষে মুখ বন্ধ হয়ে যায়, এবং ‘রুদ্ধ’ কথাটি সে অবস্থা বোঝায়।

 মাত্রা

      মাত্রা সময়ের এক একক (unit), যার মাপে গোনা হয় ধ্বনিগুচ্ছের উচ্চারণ কাল। কবিতায় এক সারির মধ্যকার যে ধ্বনিপ্রবাহ, তার ক্ষুদ্রতম অংশের উচ্চারণে যে সময় লাগে সেটা হল মাত্রা। সঙ্গীতেও মাত্রার সংজ্ঞা এক রকম, ধ্বনির ছোট্ট এককের প্রক্ষেপে যে সময় নেয়া হয় তার পরিমাপক। যদি বলা হয় এক ও দুই মাত্রার ধ্বনি, তখন প্রথম ধ্বনির উচ্চারণ হবে দ্বিতীয়টির অর্ধেক সময়ে। কবিতার ছন্দ হয় নানা ধাঁচে, এবং তাদেরকে মাত্রা সাজানোর এক-এক কাঠামো বলে মনে করা হয়।

      ইতিপূর্বে তাল ও ছন্দের পরিচয়ে বলা হয়েছে, কবিতায় যাকে বলা হয় ‘ছন্দ’ সেইই সঙ্গীতের ‘তাল’। একই রচনাকে কবিতা হিসেবে পড়ার ছন্দ আর গানে গাওয়ার তাল একেবারে আলাদা হতে পারে। কবিতাকে সঙ্গীতে রূপ দেয়া হয় তার শব্দদের উপর সুর বসিয়ে। তখন সুরের নমনীয়তায় কবিতার ছন্দ যায় বদলে। সুর-বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গীতরূপের তালকে বাঁধা হয়। বাংলায় বহু রচনা আছে যাদের প্রথম প্রকাশ কবিতায়, কিন্তু তাদের গীতরূপের পরিচয়ই প্রধান। দৃষ্টান্তঃ ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় স্তোত্র্র (‘বন্দে মাতরম্’), উপরোক্ত ‘পাল্কীর গান’, নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ ইত্যাদি। সবকটি নমুনায় গীতের তাল ও কবিতার ছন্দ-জনিত তাল ভিন্ন।

 দল ও মাত্রা

      একটি শব্দ যখন কথিত হয়, তার এক-এক দলকে উচ্চারণ করতে যে সময় লাগে, সেই সময়কে বলা হয় দলের মাত্রা। দলের মাত্রামূল্য ধার্য হয় তার আলাদা উচ্চারণে। শব্দের উচ্চারণ-কাল নির্ণয় করা হয় তার মধ্যবর্তী দলেদের মাত্রামূল্য যোগ দিয়ে। কোকিল শব্দের উচ্চারণে, দুটি দল ‘কো’ এবং ‘কিল’ চিহ্নিত হয়েছিল। যদি ধরা হয় দল দুটির মাত্রা ১, তাহলে বুঝতে হবে এদের উচ্চারণ-কাল সমান সমান এবং শব্দটি ২-মাত্রার।

      বলার ভঙ্গিতে ও উচ্চারণে ধরা পড়ে দলের সংকোচন ও প্রসার, এবং সেই গুণ অনুযায়ী তার মাত্রা নির্ধারিত হয়। মুক্ত বা রুদ্ধ দু’প্রকার দলই সংকুচিত ভাবে উচ্চারিত হতে পারে, এবং তখন তাদের বলা হয় হ্রস্বদল (short syllable)। উচ্চারণ সংকুচিত করার অর্থ তাকে হ্রস্ব (ছোট) মাপে প্রক্ষেপ করা। রুদ্ধদল প্রসারিত ভাবে উচ্চারিত হলে, তাকে দীর্ঘদল (long syllable) বলা হয়। দীর্ঘ নামটি উচ্চারণের প্রসারকে বোঝায়। সতর্ক হয়ে উচ্চারণ করলে বোঝা যায় দলের সংকোচন (হ্রস্বতা) ও প্রসারণ (দীর্ঘতা)।
মুক্তদলের উচ্চারণ সব সময় সংকুচিত, তাই এর মাত্রা এক। সংকুচিত রুদ্ধদলের ধ্বনিও এক মাত্রার এবং প্রসারিত রুদ্ধদলের ধ্বনি দুই মাত্রার। রুদ্ধদল কখন সংকুচিত বা কখন প্রসারিত হবে, সেটা নির্ভর করে শব্দের মাঝে তার স্থান অনুযায়ী।

( চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ