জয় গোস্বামী (নভেম্বর ১০, ১৯৫৪)




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
ছবি : সংগৃহীত


জয় গোস্বামী (নভেম্বর ১০, ১৯৫৪) 

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আবির্ভূত একজন আধুনিক বাঙ্গালী কবি। ভারতীয় পশ্চিম বাংলার এই কবি বাংলা ভাষার উত্তর-জীবনানন্দ পর্বের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হিসাবে পরিগণিত। তার কবিতা চমৎকার চিত্রকল্পে, উপমা এবং উৎপ্রেক্ষায় ঋদ্ধ। তিনি দুবার আনন্দ পুরস্কার লাভ করেছেন। বজ্রবিদ্যুৎ-ভর্তি খাতা কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি পুরস্কার  অর্জন করেন। তার কবিতার একটি বিখ্যাত পংক্তি ‘‘অতল তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে / হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে'’’।

।। কবিতা। ।


প্রাক্তন – 

ঠিক সময়ে অফিসে যায়?
ঠিক মতো খায় সকালবেলা?
টিফিনবাক্স সঙ্গে নেয় কি?
না ক্যান্টিনেই টিফিন করে?
জামা কাপড় কে কেচে দেয়?
চা করে কে আগের মতো?
দুগগার মা ক’টায় আসে?
আমায় ভোরে উঠতে হত
সেই শার্টটা পরে এখন?
ক্যাটকেটে সেই নীল রঙ টা?
নিজের তো সব ওই পছন্দ
আমি অলিভ দিয়েছিলাম
কোন রাস্তায় বাড়ি ফেরে?
দোকানঘরের বাঁ পাশ দিয়ে
শিবমন্দির, জানলা থেকে
দেখতে পেতাম রিক্সা থামল
অফিস থেকে বাড়িই আসে?
নাকি সোজা আড্ডাতে যায়?
তাসের বন্ধু, ছাইপাঁশেরও
বন্ধুরা সব আসে এখন?
টেবিলঢাকা মেঝের ওপর
সমস্ত ঘর ছাই ছড়ানো
গেলাস গড়ায় বোতল গড়ায়
টলতে টলতে শুতে যাচ্ছে
কিন্তু বোতল ভেঙ্গে আবার
পায়ে ঢুকলে রক্তারক্তি
তখন তো আর হুঁশ থাকে না
রাতবিরেতে কে আর দেখবে।
কেন, ওই যে সেই মেয়েটা।
যার সঙ্গে ঘুরত তখন।
কোন মেয়েটা? সেই মেয়েটা?
সে তো কবেই সরে এসেছে!
বেশ হয়েছে, উচিত শাস্তি
অত কান্ড সামলাবে কে!
মেয়েটা যে গণ্ডগোলের
প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম
কে তাহলে সঙ্গে আছে?
দাদা বৌদি? মা ভাইবোন!
তিন কূলে তো কেউ ছিল না
এক্কেবারে একলা এখন।
কে তাহলে ভাত বেড়ে দেয়?
কে ডেকে দেয় সকাল সকাল?
রাত্তিরে কে দরজা খোলে?
ঝক্কি পোহায় হাজার রকম?
কার বিছানায় ঘুমোয় তবে
কার গায়ে হাত তোলে এখন
কার গায়ে হাত তোলে এখন?

===

ছবি :সংগৃহীত 



কলঙ্ক, আমি কাজলের 

কলঙ্ক, আমি কাজলের ঘরে থাকি
কাজল আমাকে বলে সমস্ত কথা
কলঙ্ক, আমি চোট লেগে যাওয়া পাখি—
বুঝি না অবৈধতা।
কলঙ্ক, আমি বন্ধুর বিশ্বাসে
রাখি একমুঠো ছাই, নিরুপায় ছাই
আমি অন্যের নিঃশ্বাস চুরি ক’রে
সে-নিঃশ্বাসে কি নিজেকে বাঁচাতে চাই?
কলঙ্ক, আমি রামধনু জুড়ে জুড়ে
দিন কাটাতাম, তাই রাত কাটতো না
আজ দিন রাত একাকার মিশে গিয়ে
চিরজ্বলন্ত সোনা
কলঙ্ক, তুমি প্রদীপ দেখেছো? আর প্রদীপের বাটি?
জানো টলটল করে সে আমার বন্ধুর দুই চোখে?
আমি ও কাজল সন্তান তার, বন্ধুরা জল মাটি
ফিরেও দেখি না পথে পড়ে থাকা
বৈধ-অবৈধকে—
যে যার মতন রোদবৃষ্টিতে হাঁটি…

===

স্বপ্নে

স্বপ্নে তোকে বাড়ির দিকে এগিয়ে দিতে যাই
স্বপ্নে এসে দাঁড়াই পাড়ার মোড়ে।
কখন তুই ফিরবি ভেবে চারিদিকে তাকাই
টান লাগাই তোর বিনুনি ধরে।

স্বপ্নে আমি ভিক্টোরিয়ায় তোর পাশে দাঁড়াই
স্বপ্নে বসি ট্যাক্সিতে তোর পাশে
স্বপ্নে আমি তোর হাত থেকে বাদাম ভাজা খাই
কাঁধ থেকে তোর ওড়না লুটোয় ঘাসে।
তুলতে গেলি – কনুই ছুঁলো হাত
তুলতে গেলি – কাঁধে লাগলো কাঁধ
সরে বসব? আকাশভরা ছাতে
মেঘের পাশে সরে বসল চাঁদ।

ক’টা বাজলো? উঠে পড়লি তুই
সব ঘড়িকে বন্ধ করল কে?
রাগ করবি? হাতটা একটু ছুঁই?
বাড়ির দিকে এগিয়ে দিচ্ছি তোকে।

স্বপ্নে তোকে এগিয়ে দিই যদি
তোর বরের তাতে কি যায় আসে?
সত্যি বলছি, বিশ্বাস করবি না
স্বপ্নে আমার চোখেও জল আসে!

====
ছবি : সংগৃহীত 


সময়তীরে

এলাম সময়তীরে, কার পাশে শুয়েছ নিশীথ?
বায়ু এসে তুলে নেয় তাকে, জল ধুয়ে নিয়ে যায়

সীমায়, সময়তীরে, যার পাশে ঘুমোও নিশীথ
তার পাশে একরাত্রি না হয় আমিও ঘুমোলাম

রইলাম কেনা হয়ে একশো একশো রাত্রি পার
যমুনা হঠাৎ বন্ধ হলো দাস যায় ভূলুন্ঠনে

ভূ-মধ্যে ফুটন্ত জল যায় দাস ঘুমিয়ে সাঁতার
কাটে জল, কাটে জল, অকস্মাৎ সমস্ত স্ফটিক

একপাত্রে স্তব্ধ হয়, হাড়পাঁজরা হাড় বাঁকাচোরা
সেও তো স্ফটিকমধ্যে ধৃত আজ, শুধু তার শ্বাস

নেই থেমে নেই এই উত্তিষ্ঠত জাগ্রত উত্থান
ভেদশক্তি নিয়ে ওঠো সবটুকু কাঠিন্য স্ফটিক

কাটিয়ে সময়তীরে ওঠো হে নিশীথ, যার পাশে
শুয়ে ছিলে তুমি, আজ তার পাশে ঘুমোক পথিক

===

সানন্দা পৃথিবী, তার নামে

আমার দুহাতে পাপী, পাপ রাখো,
হে অবৈধ সম্পর্ক তোমার
দিনরাত্রি ব্যাপী অগ্নি আমার দুহাতে
রেখে যাও... ও কুঁদুলে মোড়ল মশাই
তোমার যা নিন্দামন্দ আমার দুহাতে রাখো
ও গো অনিদ্রিত ময়ে, যে ছেলের কারণে তোমার
না-ঘুম সমস্ত রাত, তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি
রাখো এই দুহাতে...প্রণাম হই পরুতঠাকুর, ঝোলা কই
কলাটা মুলোটা রাখো, ভিক্ষুক ভিক্ষের চাল থেকে
দাও একমুষ্টি ভিক্ষা, মিলমিশ না হওয়া দম্পতি
তোমাদের লাগাতার ঝগড়াঝাঁটি থেকে
দু-একটি কলহ দাও, শতদল স্কুলের মেয়েরা
দাও ইউনিফর্ম থেকে রং আর ছেলেদের দেখে মুখচাপা
সদ্য শেখা হাসি দাও, আমার মেয়ের
বড়ো হতে বেশি দেরি নেই, তার ভবিষ্যৎ প্রেমিককে
যদি খুঁজে পাই
ওদের একসঙ্গে নিয়ে সানন্দা পৃথিবী, তার নামে
সব অশান্তির বাইরে একটি প্রেমের কাব্য উনুনে চড়াই।

====
ছবি : সংগৃহীত 


দুঃখ

রিকশাচালকের দুঃখ মদ খেলে বউ রাগ করে
বাড়িওয়ালাটির দুঃখ ভাড়াটে উঠতে চাইছে না
স্ত্রীর দুঃখ স্বামী অমানুষ
পার্টির ছেলের দুঃখ আমার আগে এই চাকরি ও কী করে পায়
দূর্গা প্রতিমার দুঃখ যত্ন করে চোখ আঁকল না কারিগর
আমার দুঃখটি হল কাক। পাঁচিলে বসার জায়গা, ভোরে----
পাশের দোতলা ঘরে নাইট ডিউটি করে এসে
যে শুয়েছে, তার ঘুমের দফারফা করে তারস্বরে।
আমার দুঃখটি সেই ছেই-ছেই হেট-হেট কাক।
কাল সারারাত বৃষ্টি। আজকে সকালে দেখি বৃষ্টিভেজা ঘাসের ওপরে
আমার দুঃখটি মরে পড়ে আছে ডানা ছেতরে, ঠোঁট ফাঁক করে।

====

হৃদি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে

অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
করো আনন্দ আয়োজন করে পড়ো
লিপি চিত্রিত লিপি আঁকাবাঁকা পাহাড়ের সানুতলে
যে একা ঘুরছে, তাকে খুঁজে বার করো
করেছো, অতল; করেছিলে; পড়ে হাত থেকে লিপিখানি
ভেসে যাচ্ছিল–ভেসে তো যেতই, মনে না করিয়ে দিলে;
–’পড়ে রইল যে!’ পড়েই থাকত–সে-লেখা তুলবে বলে
কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে।।

====

দুখানি হাতের সরোবরে

দূরত্ব জানো, তোমার দুখানি হাতের তীর্থে
মৃত্যু আমার
দূরত্ব জানো, সারাদিন ধরে
খেটে আাসা দুটি হাতের তীর্থে
মৃত্যু আমার
এতদিন পরে একটার পর একটা বাঁধন
ছিঁড়তে ছিঁড়তে
দূরত্ব জানো তোমার হাতের পান্থতীর্থে
মৃত্যু আমার
ধুলোয় ধুলোয় ঘাসে ঘাসে এই
মৃত্যু এখন
প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন মৃত্যু এখন দুখানি হাতের
সরোবরে, ভরা সরোবরে, ওই
সরোবরে মুখ ডুবিয়ে দিলাম
তলিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে,
তলিয়ে যাক সে----
একবার যদি পথে নেমে গেছ,
আজ কিছুতেই পারো না ফিরতে
ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুম ঝাঁপ দিয়ে পড়ো
ধুয়ে মুছে যাও সত্যি মিথ্যে...

====

মেঘ বালিকার জন্য রুপ কথা 

আমি যখন ছোট ছিলাম
খেলতে যেতেম মেঘের দলে, একদিন এক
মেঘবালিকা, প্রশ্ন করলো কৌতুহলে-
"এই ছেলেটা নাম কি রে তোর??"
আমি বললেম, "ফুসমন্তর"
মেঘবালিকা রেগেই আগুন-
"মিথ্যে কথা, নাম কি ওমন হয় কখনো??"
আমি বললেম, "নিশ্চই হয়, আগে আমার গল্প
শোন!!"
সে বললো, "শুনব না যা-"
"সেই তো রাণী, সেই তো রাজা-" "সেই
তো একি ঢাল-তলোয়ার"
"সেই তো একি রাজার কুমার
পক্ষীরাজে"
"শুনব না যা ওসব বাজে"
আমি বললেম, "উম্ তোমার জন্যে নতুন
করে লিখব তবে!"
সে বললো, "সত্যি লিখবি??"
"বেশ! তাহলে মস্ত করে লিখতে হবে!"
"মনে থাকবে? লিখে কিন্তু আমায়
দিবি"
আমি বললেম, "তোমার জন্য
লিখতে পারি এক পৃথিবী"।
লিখতে লিখতে লেখা যখন সবে মাত্র
দু'চার পাতা
হঠাৎ তখন ভূত চাপলো আমার মাথায়
খুঁজতে খুঁজতে চলে গেলাম ছোটবেলার
মেঘের মাঠে
গিয়ে দেখি চেনা মুখ তো একটিও নেই
এই তল্লাটে।
একজনকে মনে হল ওরি মধ্যে অন্যরকম
এগিয়ে গিয়ে বললেম তাকে,
"তুমি কি সেই?? মেঘবালিকা,
তুমি কি সেই??"
সে বললো, "মনে তো নেই, আমার ওসব
মনে তো নেই"
আমি বললেম, "তুমি আমায় লেখার
কথা বলেছিলে"
সে বললো, "সঙ্গে আছে?
ভাসিয়ে দাও গাঙের ঝিলে-"
"আর হ্যাঁ শোন..এখন আমি মেঘ নই আর.."
"সবাই এখন বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়.."।
বলেই হঠাৎ, এক পশলায়
চুল থেকে নখ আমায়
পুরো ভিজিয়ে দিয়ে
অন্য অন্য বৃষ্টি বাদল
সঙ্গে নিয়ে মিলিয়ে গেলো খরস্রোতায়,
মিলিয়ে গেল
দূরে কোথায়, দূরে, দূরে..
"বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়..বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়"
আপন মনে বলতে বলতে আমি কেবল বসেই
রইলাম
ভিজে একশা কাপড় জামায়
গাছের তলায় বসেই রইলাম,
বৃষ্টি নাকি মেঘের জন্য?? এমন সময় অন্য
একটি বৃষ্টি আমায় চিনতে পেরে বললো,
"তাতে মন খারাপের কি হয়েছে??"
"যাও ফিরে যাও, লেখো আবার" "এখন
পুরো বর্ষা চলছে"
"তাই আমরা সবাই এখন নানান
দেশে ভীষণ ব্যস্ত"
"তুমি-ও যাও মন দাও গে তোমার কাজে"
"বর্ষা থেকে ফিরে আমরা নিজেই
যাবো তোমার কাছে"।
এক পৃথিবী লিখবো আমি
এক পৃথিবী লিখবো বলে ঘর ছেড়ে সেই
বেড়িয়ে গেলাম।
ঘর ছেড়ে সেই ঘর বাঁধলাম গহন
বনে সঙ্গী শুধু কাগজ কলম
একাই থাকবো, একাই
দুটো ফুটিয়ে খাবো
দু এক মুঠো ধুলোবালি
যখন যারা আসবে মনে তাদের লিখবো,
লিখেই যাবো
এক পৃথিবীর একশো রকম স্বপ্ন দেখার সাধ্য
থাকবে যেই রূপকথার সেই রূপকথা
আমার একার।
ঘাড় গুঁজে দিন লিখতে লিখতে ঘাড়
গুঁজে রাত লিখতে লিখতে মুছেছে দিন
মুছেছে রাত
যখন আমার লেখবার হাত অসাড়
হলো মনে পরলো সাল কি তারিখ
বছর কি মাস সেসব হিসেব আর ধরিনি।
লেখার দিকে তাকিয়ে দেখি
এক পৃথিবী লিখবো বলে একটা খাতাও
শেষ করিনি।
সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল, খাতার
উপর
আজীবনের লেখার উপর
বৃষ্টি এল এই অরণ্যে।
বাইরে তখন গাছের নীচে নাচছে ময়ূর
আনন্দিত
এ-গাছ ও-গাছ উড়ছে পাখি
বলছে পাখি, "এই অরণ্যে কবির জন্য
আমরা থাকি"
বলছে ওরা, "কবির জন্য, আমরা কোথাও,
আমরা কোথাও, আমরা কোথাও হার
মানিনি"
কবি তখন কুটির থেকে
থাকিয়ে আছে অনেক দূরে
বনের 'পরে, মাঠের 'পরে, নদীর 'পরে সেই
যেখানে সারাজীবন
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে
সেই যেখানে কেও যায়নি
কেও যায়না কোনদিনি
আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে
সেই দেশে সেই ঝর্ণাতলায় এদিক ওদিক
ছুটে বেড়ায়
সোনায় মোড়া মেঘ হরিণী
কিশোর বেলার সেই হরিণী।

===







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. ভীষন প্রিয় ভীষন ভালোলাগা মানুষের কবিতা ... 🙏🌹❤️

    উত্তরমুছুন
  2. পাঠকের ভাবনার জগতে আলোড়ন তোলেন তিনি । অসাধারণ শব্দ চয়নে মোহিত করে রাখেন কবিতায়। বাঙালির হৃদয়ে চির অমর হয়ে থাকবেন কবি জয় গোস্বামী ।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ লেখনী আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন। আমার শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি।

    উত্তরমুছুন