শ্রী রামকৃষ্ণদেবের নাট্যলীলা ও লোকশিক্ষা || ড: বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ (মজুমদার)




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 

শ্রী রামকৃষ্ণদেবের নাট্যলীলা ও  লোকশিক্ষা, লিখছেন ,ড: বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ (মজুমদার) 
ছবি সংগৃহীত 
উনিশ শতকের মাঝামাঝি এক লীলা পটু প্রাণ চঞ্চল বালকের নাটকে মেতে উঠেছিল সারা বাংলা।সুদূর নিভৃত নির্জন গ্রামের পথে কথামালার মুক্ত ছড়িয়ে সকলের মন জয় করেছিলো এই বালক।শিব ভাবনায় ডুবে নাটক করতে গিয়ে তাঁর সমাধি হয় বহু মানুষের সম্মুখে।আসলে তিনি নট ছিলেন না ছিলেন নটনাথ।সেই সময় কামার পুকুরে তিন দল যাত্রা,একদল বাউল এবং দু একটি কবিগানের দল ছিল।এই সব পালা, গান ,যাত্রা,পাঠ ও সংকীর্তন ই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।নিপুণ অনুকৃতি বা ভূমিকায়ন বা অনুকৃতি মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন পাঠ।আর এই ভূমিকা অভিনয়  বা role plyaing বা modeling বর্তমান শিক্ষণ পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
গদাধর পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করেছিলো। এই পাঠে ছিল প্রথমে হাতেখড়ি, তারপর তালপাতায় বর্ণমালা ও বানান শিক্ষা,এছাড়া ছিল কড়া ,গন্ডা,দশক নামতা শেখা।তালপাতায় অঙ্ক করা রপ্ত হলে কলা পাতায় জমা খরচ লেখা ও পুঁথি দেখে ও প্রতিলিপি লিখে পাঠশালার পাঠ মিটত। এর সময়কাল ছিল ৪-৫ বছর।কায়স্থরা যদিও আরো পাঠ নিতে পারতো কিন্তু ব্রাহ্মন গণ উপনয়নের পর আর পাঠ নিতে পারতেন না।কারণ গুরুমশাই গণ প্রায়শই কায়স্থ বর্ণের হতেন।মাত্র নয় বছরে উপনয়ন হয় গদাধরের ফলে ধরে নেওয়া হয় তাঁর প্রথাগত শিক্ষা সেখানেই সমাপ্ত হয়।
সেসময় প্রথা অনুযায়ী রামায়ণ, মহাভারত,পূরাণ ও ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও আবৃত্তি পূণ্য কর্ম রূপে বিবেচিত হতো।এগুলির অনুলিপি করাও ছিল পূণ্য কর্ম।পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করে গদাধর অনুলিপি করেছিলেন: রামকৃষ্ণনায়ন,হরিশচন্দ্র পালা,সুবাহুর পালা ,মহিরাবণ বধের পালা, যোগাদ্যার পালা প্রভৃতি পুঁথি যার শেষ পত্রে লিখিত আছে তাঁর নাম ও তারিখ এবং স্বাক্ষর।এর মধ্যে জোড়া আছে তাঁর নিজস্ব ভাব বোধ ও মৌলিক চেতনার স্পর্শ।
ছবি সংগৃহীত 
কিশোর বয়সেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যাত্রা পালা,পালা গান ও অভিনয় লোক শিক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।পরবর্তী কালে তিনি তার জীবন ব্যাপী নাট্য প্রিতি দেখিয়েছেন। দক্ষিণেশ্বরে কোনো উৎসব উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হতো নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় ও অন্যান্যদের পালা গান যা ছিল তার অত্যন্ত প্রিয়।এমনকি ভক্ত সমাবেশে যে কোনো শিক্ষামূলক বার্তা তিনি গান ও অভিনয়ের মাধ্যমে দিতেন।এক অপূর্ব ভাবাবেশে সমাহিত হয়ে স্বতফুর্ত উচ্ছসিত এক অনুভূতির মধ্য দিয়েই তিনি ঈশ্বরে মিলিত হতেন।তিনি আর কেউ নন পরমাত্মা।অর্থাৎ আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনে সম্পূর্ণ হতো শিক্ষা। কখনও কখনও ভক্ত গণ তাঁর সঙ্গে নৃত্য নাট্য সঙ্গীতে যোগদান করে লাভ করতেন পরমানন্দ।

আমরা যাকে বলি মেডিটেশন সেই ভাবে প্রমত্ত হওয়া যেতেন গীত ,বাদ্য ,নৃত্যের মাধ্যমে।পরমাত্মার ভাব উদ্দীপক এই কীর্তি কথন ই হলো কীর্ত্তন।এই ভাব ই দেহ মনকে উত্তাল করে।পরমহংস বলতেন :
"ঘর তোলপাড়।সে অবস্থায় আগে যেমন যন্ত্রণা পরে তেমনি গভীর আনন্দ।"
নকুড় আচার্য্য,বনোয়ারি দাস,মনোহর সাই, রাজনারায়ণ, বৈষ্ণবচরণ,নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শ্রেষ্ঠ কীর্তন কারীদের কীর্তন তিনি শুনেছেন। যাত্রাগান,কথকথা, কীর্ত্তন এ ব্যাবহৃত রাগ রাগীনি তাঁকে রাগ সঙ্গীতে নিপুণ করেছিলো।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নৃত্য সম্পর্কে বলেছিলেন:
"আমাদের দেহ বহন করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ভার,আর তাকে চলন করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গতিবেগ।এই দুই বিপরীত পদার্থ যখন পরস্পরের মিলনে লীলায়িত হয় তখন জাগে নাচ।" সুর ছন্দ ও লয়ের আত্ম প্রকাশে যখন নর্তনে কীর্তনে আনন্দ বৃত্ত সৃষ্টি হয় তার রূপ ও রসের অজস্র বৈচিত্র্য গণ চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে।তখনই শিক্ষা সম্ভব হয়।  
উনিশ শতকের শেষ দিকে স্টার থিয়েটার এ "চৈতন্য লীলা" নাটকের অভিনয় শুরু হয়।গৌরাঙ্গ জীবন উপলক্ষে রঙ্গ মঞ্চে এটি ছিল প্রথম নাট্যাভিনয়।যা বাংলার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলো।লোক শিক্ষার বিস্তার এ যে নাটকের গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা আছে তার প্রমাণ হয়েছিলো। এটি যে শুধু আমোদ প্রমোদ নয় তাই প্রমাণ করেছিলেন গিরিশচন্দ্র।আর তাঁর গুরুদেব পরমহংস ছিলেন উচ্চ কোটির ভাব শিল্পী। নট,নাট্যকার এবং নাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র এর ভাষায়:
"একটা বুড়ো মিনসে নাচিলে যে এত ভালো দেখায়,একথা আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনাই।"
এভাবেই গান, কথা ,অভিনয় ,ও নাচের মধ্যে দিয়ে পরমহংসের মধ্যে প্রকৃত চরিত্রটি ফুটে উঠত।যা এক অর্থে  আধুনিক শিক্ষার ভূমিকা অভিনয় বা Role Playing বা Modeling। ভন্তগণ নিমজ্জিত হতেন সেই ভাবাবেশ এ প্রকৃত শিক্ষা সম্পন্ন হতো।
ছবি সংগৃহীত 
"চৈতন্য লীলা" নাটকের শেষে 'চৈতন্য হোক' বলে পরমহংস আশীর্বাদ করেছিলেন বিনোদিনী কে।যা তাঁর জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তখন তথাকথিত ভদ্র সমাজের নারীগণ যাত্রা পালা করতেন না।প্রথমে পুরুষ র ও পরে পতিতা গণ তাই নারী চরিত্রে এ করতেন।ফলে থিয়েটার সমাজ পড়েছিল প্রবল সামাজিক আক্রমণের মুখে।তাই নটি বিনোদিনী বলেছিলেন:

'জগৎ যদি আমাকে ঘৃণার চক্ষে দেখেন,তাতেও আমি ক্ষতি বিবেচনা করিনা।কেননা,আমি জানি যে পরম আরাধ্য পরম পূজনীয় রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব আমায় কৃপা করিয়া ছিলেন।" প্রকৃত পক্ষে শিল্পীর স্বত্তাই প্রাধান্য পেয়েছিল পরমহংসের চেতনায়।
শ্রী রামকৃষ্ণের সংস্পর্শে আসার পর বহুবার গিরিশ চন্দ্র মঞ্চ ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন।কিন্তু প্রভুর মানায় পারেন নি।কারণ পরম হংস তাকে বলে ছিলেন এতে বহু লোকের উপকার হচ্ছে।কারণ এটি সে সময় লোক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম ছিল।কিন্তু এর আরো একটি বিশেষ দিকের কথা গিরিশ চন্দ্র উপলব্ধি করেছিলেন টা হলো দর্শক কূলের সঙ্গে তা অভিনেতা ও অভিনেত্রী দের সমভাবে আলোড়িত করছে।যা তাদের জীবন ধারা কেও  প্রভাবিত করছে।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাই তিনি গুরু আদেশ পালন করেছিলেন এবং নাটকের মাধ্যমে শিক্ষার বিস্তার করেছিলেন।
ছবি সংগৃহীত 
শ্রী রামকৃষ্ণের মুখের কথা "পড়ার চে শুনা ভালো- শুনার চে দেখা ভালো।" শাস্ত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন-"নিজে পড়ি নাই।কিন্তু ঢের সব শুনেছি গো।সে সব মনে আছে।অপরের কাছ থেকে,ভালো ভালো পণ্ডিতদের কাছ থেকে বেদ, বেদান্ত,দর্শন, পুরাণ সব শুনেছি।শুনে তার ভেতর কি আছে জেনে,তারপর সেগুলোকে দড়ি দিয়ে মালা গেঁথে গলায় পড়ে নিয়েছি।" আসল শিক্ষা হলো জ্ঞান অর্জন ও তাকে হৃদয়ঙ্গম করা।আর তার যথার্থ মাধ্যম হলো ভূমিকা অভিনয়।এটি তাঁর শিক্ষা ভাবনার সারমর্ম ছিল।আধুনিক শিক্ষার শিক্ষণ প্রণালীতে ভূমিকা অভিনয় এর মাধ্যমে শিক্ষণ তাই যথার্থই প্রাসঙ্গিক।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ