শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || মেখলা ঘোষদস্তিদার




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


প্রায়শ্চিত্ত 
মেখলা ঘোষদস্তিদার

আকাশে শুভ্র মেঘের দল স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো ভাসমান স্বচ্ছন্দে ,সোনার মতো ঝলমলে হাসিতে পূর্ণ  চারিধার,,,,,,সারা মাঠ নতুন ফসলে সবুজ ,,গাছের ডালগুলো ছেয়ে গেছে পাতায় পাতায়,,,
স্রোতস্বিনীর বুকে প্রস্ফুটিত কমল অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়  থাকে মা দুর্গার নিক্কণ ধ্বনি শোনার জন্য,,,,,,  কাশের দোলায় জাগে খুশি র বেহাগ,,,, 
শারদ - লগ্নার অমল মহিমা দেখে কবি গেয়ে ওঠেন,
" আজি কি তোমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে
হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে",,

শিউলি সুবাসে ম ম করে বাতাস,,,,,,সান্ধ্য - ইমনে নামে সাঁঝ, ঝিকিমিকি নীলার চমকে রাত বাড়তে থাকে,বিমর্ষতায় ডুবে যাওয়া মুহূর্তকে আঁকড়ে ধরে সবুজ,,,,হতাশায়,অবসাদে কোনো কূল - কিনারা খুঁজে পায় না,,হাতড়ে বেড়ায় তীর,,,,,স্নেহের আঁচল,আদরের পরশ,মায়ের মুখ,,,,,,,,, কোত্থাও তাঁকে পায়না,,,,ব্যথার দলদল টেনে নেয় সবুজকে ক্রমশ পাঁকের গভীরে,,
ঊষা চোখ মেলে সূর্যের দ্বার খুলে দেয়,,মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকে কাঠি পড়ে,,,,ঢমনা ঢম ঢম আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে,,,,,
এতো আনন্দোৎসবের মাঝে একা পড়ে থাকে সবুজ নিঃসঙ্গতার আঁধারে,,,,,গুমরে ওঠা অন্তর ডুকরে কেঁদে ওঠে থেকে থেকে,,,
সে কি করবে ভেবে পায়না,,,,,মাকে না পাওয়ার অভাববোধ করে,,,, 

বাবাও পাল্টে যায় সময়ের সাথে,,,,,ধস নামে বাবার জীবনে,,,,ক্ষত - বিক্ষত হৃদয়ে ঘুরে বেড়ায় অন্যমনস্ক ভাবে,,,,,,সবুজের প্রতিও দিন দিন উদাসীন হয়ে ওঠেন,,,,
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়
সবুজ দেখতে পায় তার বন্ধু - বান্ধবের পরিবারকে,,,,,,সুস্থ - সুন্দর,,,,একসঙ্গে মিলেমিশে তাদের আনন্দ- মুখর যাপন,,,,,সবুজ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় আর পাঁচজনের কাছ থেকে এই ভেবে যে,যদি কেউ তাকে তার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে তাহলে সে কি বলবে তাই আড়ালেই থাকতে চায় সে,,,,,,,,,, নরক যন্ত্রণা য় তার দিন কেটে যায়,,,,,,

সাত - পাঁচ ভাবনার মধ্যে কলিং বেল বেজেই চলে,,,,,সবুজ ধীর গতিতে গিয়ে দরজা খোলে,,,,দেখে জেঠী মা এসেছে,,,,
জেঠীমা ঘরে ঢুকে সবুজের হাতে নতুন পাজামা- পাঞ্জাবী দিয়ে বলে স্নান করে পরে নিতে,,,,,সবুজকে সঙ্গে নিয়ে মহাষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাবে মা দুর্গার চরণে,,,,,
সবুজ শুনে বলে" জেঠীমা তুমি যাও,আমি যাবো নাগো,আমার জীবনে মায়ের কোনো অস্তিত্ব নেই," মা" শব্দটা আমার কাছে অর্থহীন,,,,তুমি চলে যাও জেঠীমা",,,,,, 
জেঠীমা সবুজের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো," তুই আমার পুত্রতুল্য,,,, আমাকে তুই ফিরিয়ে দিস না রে বাবু আমি খুব কষ্ট পাবো,,,,,",
বলতে বলতে জেঠীমার গলা ধরে আসে,চোখ ছলছল করে ওঠে,,,সবুজের নজর এড়ায় না তা,,সে মনে মনে ভাবে যে, সে তো নিজে কষ্ট পাচ্ছেই,,,,তার উপর জেঠীমাকে সে কষ্টের ভাগীদার করছে,,,,,,তা হতে পারেনা, সে জেঠীমাকে আঘাত দিতে পারবে না,নিজের দুঃখের দায়ভার সে একাই বহন করবে,,,,সবুজ জেঠীমাকে বলে তুমি বসো আমি এখনি রেডি হয়ে আসছি,,,,,"

অষ্টমী কেটে যায়,,,নবমীর দিন জেঠীমার সঙ্গে কয়েকটি ঠাকুর দর্শন করে ফিরে আসে  রাত আটটার মধ্যে,,,,,,, জেঠীমা নিজের হাতে রাতের খাবার বানিয়ে রেখে নিজের বাড়ি ফিরে যায়,,,,
সবুজ খাওয়া - দাওয়া সেরে রাত এগারোটায় শুয়ে পড়ে, স্বপ্নের মধ্যে সে দেখতে পায় তার মায়ের হাসিভরা মুখ,কোমল স্পর্শ অনুভবে,মমতা মাখা কোল,,,,,তারপর কখন যেন সে মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে গভীর নিদ্রায়,,,,,
পর দিন মানে দশমীর ভোরে সবুজের ঘুম ভাঙে কলিং বেলের শব্দে,ঘড়িতে তখন দশটা বাজে, সে দরজা খুলতেই দেখে জেঠীমা কিছু বলার জন্য ছটফট করছে,
সবুজ বলে," কি হয়েছে জেঠীমা,আমাকে সব খুলে বলো",
জেঠীমা এক নাগাড়ে বলে চলে," সবুজ বাবু তোর মনের কথা মা দুর্গা শুনেছেন রে,এতোদিন মনে যে ব্যথা,বঞ্চনা, কষ্ট পুষে রেখেছিলি তার অবসান হলো অবশেষে,
তোর মা পেরেছে রে তোর মা পেরেছে,,,,,ঐ নর- পিশাচটাকে একেবারে শেষ করে দিতে",,,
সবুজ দেখে নিরঞ্জনের ছায়ায় কোন বিষাদের সুর নয়,,,,প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বিজয়ধ্বনি,,,,,,,দশমীর প্রাতে মহিষাসুর বধ হয়েছে,,,,,,,,,, চারিদিকে রক্ত আর রক্ত,,,,,,
সবুজ এক সেকেন্ড দেরি না করে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছোটে জন্মদাত্রীর উদ্দেশ্যে, দেড় ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যায় মায়ের বর্তমান ঠিকানায়,,,গিয়ে দেখে লোকজনের ভীড়,,,ঘটনাস্থলে পুলিশ,,,,,সবুজ ভীড় ঠেলে সামনে যায়,দেখে আলুথালু বেশে মা বসে আছে,পাশে রক্তমাখা ত্রিশূল, সবুজ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে," মা,তোমার কিচ্ছু হবেনা, এতোদিন পরে তুমি পরিত্রাণ পেয়েছো ঐ নর- খাদকটার হাত থেকে,আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো তোমার নিজের বাড়িতে,আজ দশমীর দিনেই তো তুমি শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাবে",,,,,, 
সবুজকে বুকের মাঝে নিয়ে বলে ওঠে আর্ত স্বরে সবুজের মা," সবুজ বাবা আমার, মিথ্যা বন্ধনে যে পাপের অভিষেক হয়েছিলো আমার তার থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র  উপায় প্রায়শ্চিত্ত,,,,,,,,, তবেই আমি মুক্ত হবো,,,,,,ঐ দানবটাকে মারার জন্যই আমি সুখী গৃহকোণ ছেড়েছিলাম,,,তোদের ত্যাগ করেছিলাম,,বুঝতে দিইনি কারোকে,
সবুজ সোনা তুই বাড়ি ফিরে যা,বাবাকে দেখিস,ভালো থাকিস,"

সবুজ বললো," মা আমরা অপেক্ষায় থাকবো,,,,"।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ