শারদ সংখ্যা ২০২০ || নিবন্ধ || মঞ্জীরা সাহা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


দশাশ্বমেধ ঘাটের ওরা
মঞ্জীরা সাহা

হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা লাগছে। সামান্য সামান্য করে দিনের আলো কমে যাচ্ছে ভেজা ঘাট গুলোতে। সিঁড়িতে চাতালে বড় নৌকো ছোট নৌকোর চালকদের হাঁকডাক আরো বাড়ছে। একশ টাকা... একশ টাকা। বজ্রায় বসলে একশ টাকা। চলে আসুন। 
ফোকাস লাইট গুলো জ্বলে উঠছে একে একে। সিঁড়িগুলিতে ঠাসা ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। আরো একটু ঝকঝকে আলো বাড়ার সাথে সেই মেদহীন চেহারার তরুন যুবকেরা আসতে শুরু করেছে। গরদের ধুতি। ঘিয়ে সিল্কের বেনিয়ান। ঘাড়ে চাদর ঝোলানো । মঞ্চের মতো উঁচু সিঁড়িগুলিতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সবে সন্ধে লেগেছে। কালো জলের উপর প্রদীপ ভাসছে অসংখ্য। দীর্ঘাঙ্গী প্রদীপদানিতে অসংখ্য প্রদীপ জ্বলছে। তামার বৃহদাকার সাপের মাথার নীচ দিয়ে কর্পুরে দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে আগুন। বলিষ্ঠ হাতগুলিতে বদলে বদলে উঠছে আরতির সামগ্রী। সেই নানা শিখার আগুনের আলোয় আরতিরত যুবকদের মুখগুলো লাল হয়ে যাচ্ছে। 
বেনারসের দশাশ্বমেধ ঘাটে এ আরতির দৃশ্য দেখতে বিকেল থেকেই বসে পড়তাম। যতটা কাছাকাছি থেকে দেখতে পারি। একদিন দুপুর থেকে ঘাটে ঘোরাঘুরি করতে করতে সেই চেনা আরতির সামগ্রী গুলো অন্য ভাবে দেখতে পেলাম। 
দেখলাম যে প্রদীপদানি ধুনুচির আলোয় ঝলমল করে ওঠে সন্ধের দশাশ্বমেধ ঘাট, সেগুলি সিঁড়ির উপর ডাই করে পড়া। আগের দিনের কালি ঘষে ঘষে তুলছেন এক মহিলা। প্রায় দেড় ঘন্টা... দু ঘন্টা....। ছাই মাটি দিয়ে ঘষে ঘষে তুলেই যাচ্ছে ওই তেল আর ঘন পরতের কালি। মশায় ছেঁকে ধরছে ওঁকে। ঘষেই চলেছে । শক্ত শক্ত হাতের পেশীগুলো ফুলে উঠছে। মশা আরো বাড়ছে। ছাইমাটি মাখা হাত দিয়ে থাপ্পড় দিচ্ছে কখনো সখনো। বাকি কামড়ে ধড়ছে ওর শাড়ি উঠে যাওয়া হাঁটু অবধি পা দুটোতে ফাটা ব্লাউজের উপরের খোলা পিঠে। 
তারপর রোজ দেখেছি ওনাকে একই ভাবে একই সময়ে। মহিলা বিধবা। চার ছেলেমেয়ে। আরতির বাসনের দিকে চোখ রেখেই আমাকে বলছিলেন, মরদটা বহৎ যাদা করে পি তো তাই মরে গেছে। যব মর গেয়া ছোটি বেটিকি উমর তিন মাহিনা।
ঘাটের থেকে একটু দূরেই বাড়ি ভাড়া করে থাকে। বড় ছেলের বয়স এখন বারো। হকারি করে। ঘাটের পাশে সিঁদুর চুলের কার ফিতে বেচে। মেজ ছেলে ঘাটে শিব সাজে। দেখেছি তাকে বারবার ঘাটে। কখনো রঙ মেখে কখনো রঙ ছাড়া। ভোরে অন্ধকার থাকতে ঘাটের পাশে একটা ব্যাগ থেকে রঙের শিশিগুলি বার করে। ছোট্ট প্লাস্টিকের ফ্রেমে বাঁধানো আয়না বার করে আর মাথায় গার্টার মারা তুলি। ঘষে ঘষে রঙ মাখে মুখে। লাল উস্কোখুস্কো জটা পরে নেয় মাথায়। সেফটিপিন দিয়ে হলুদ কালো ছাপার কাপড় জড়িয়ে নেয় হাফ প্যান্টের উপরে। এক দু'ঘন্টা ভিক্ষে করার পর কাচের গ্লাসে চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে ঘাটে বসে খায়। ঠোঁটের লাল রঙ লেগে যায় গ্লাসের কানায়। রঙের ভেতর থেকে ফ্যাকাশে ঠোঁট বেরিয়ে আসে। ঘামে শরীরের ভাঁজে ভাঁজে বেরিয়ে আসে শরীরের আসল রঙ। 
ওদের রাতের দিকে একসাথে ফিরতে দেখেছিলাম ঘাট থেকে। সারাদিনের কথা বলতে বলতে চলেছে ওদের ভাষায়। বাঙালী টোলার গলির ভিতর দশকর্মার দোকানের পাশ দিয়ে একখানা চিলতে গলি দিয়ে ঢুকে গেছিল ওদের ভাড়া করা ঘরের দিকে। 
মহিলার জোরালো হাতের ঘষায় তেল কালি উঠে গিয়ে আবার ঝকঝক করে ওঠে ধুনুচি প্রদীপদানি।
সন্ধ্যা হয়ে যায়। গঙ্গা দেবীর আরতি শুরু হয়। আবার ঝলমল করে ওঠে ঘাট। আরতির আগুনে ঝলমল করে ওঠে ওই তরুন যুবকদের মুখ। ছেলেদের পায়ে পড়ে প্রণাম করে দর্শনার্থীরা। প্রদীপের আলোয় বড় বড় চড়া পাওয়ারের হ্যালোজিনের আলোয় ভিড়ের ভেতর কোথায় যেন মিশে থাকে ওরা। চারিদিকে জয় জয়কার রব ওঠে। সমস্ত দেব দেবীর জয় ঘোষণা হয়....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ



  1. ঝলমলে বাহ্যিক আবরণের ভেতরে দৈনন্দিন জীবনের ছাপ
    অনবদ্য প্রকাশ

    শুভ শারদীয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা

    উত্তরমুছুন