শারদ সংখ্যা ২০২০ || নিবন্ধ || ভাস্কর পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

শাশ্বত মানবিক সংবেদনশীল রবীন্দ্রনাথ একটি বিশ্লেষণ 
ভাস্কর পাল

সকাল বেলা দেখি Whatsapp এর পিওন বাক্সে বৈদ্যুতিন চিঠি এসে হাজির - "রবীন্দ্র পূজার জন্য একটা কবিতা রচনা করে পোস্ট করে দাও।"
আজ রবি ঠাকুরের জন্মদিন। আমরা সবাই মেতে উঠব। তাঁর ছবির সামনে দুটি থেকে তিনটি ধুপকাঠি জ্বালাবো দুই চারটি ফুল রেখে  মোবাইল অন করে একটি গান গেয়ে আমার রবীন্দ্র অঞ্জলী শেষ করে এর পর দেখতে থাকবো পুজোর প্রসাদ খেতে এলো কত জন । 
এদিকে বাঙালী ঘরে ঘরে রবীন্দ্র জন্ম জয়ন্তী পালন করছে ওদিকে কাঠ ফাটা রোদে  ট্রাফিক সিগনালে বেজে চলেছে রবীন্দ্রনাথ আমার রবীন্দ্রনাথ !!

স্থিতধা মনীষী, তাঁকে কতটুকু চিনেছে বাঙালী? গান আর কবিতার মোড়ক এর বাইরে যে রবীন্দ্রনাথ সেই মহান মানুষটিকে বোঝার মত পরিণত শীল হয়েছে বাঙালী ?
ফ্রান্সিস কর্নফোর্ড উইলিয়াম রবীন্দ্রনাথকে দেখে রোদেনস্টাইনকে বললেন: ‘I can now imagine a powerful and gentle Christ, which I never could before.’ এই হল আমাদের রবীন্দ্রনাথ ।
যাঁকে আমরা আমাদের ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছি তার রেখে যাওয়া অমূল্য রতন নির্য্যাস থেকে আমাদের চরিত্র গঠনে কতটুকু নিয়েছি ?
রবীন্দ্রনাথ “মরমি”, ‘আধ্যাত্মবাদী’ ও “প্রতি-আধুনিক” পুরুষ। তাঁর এই ভাবমূর্তির কাছে সমস্ত কিছুই কেমন নিষ্প্রভ হয়ে যায় ।বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর মত দুহাত উজাড় করে বাংলা সাহিত্যে এত রত্নভাণ্ডার বোধহয় আর কেউ উপহার দিতে পারে নি। তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসভায় সগৌরবে উচ্চ আসনে বসিয়েছেন।

তিনি  একাধারে কবি,  ঔপন্যাসিক,  নাট্যকার, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, সঙ্গীতস্রষ্টা , কি নন তিনি, এমনকি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ছবি আঁকা শুরু করে ভারতীয় চিত্রকলাকে দিয়ে গেছেন নতুন পথের দিশা ।

তাঁর প্রবন্ধের বিষয় হিসেবে জাতীয় ও বিশ্ব রাজনীতি,  সংস্কৃতি,  সমাজনীতি,  ধর্ম, দার্শনিক বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে তিনি তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র ইত্যাদি তাঁর সৃষ্টিশীলতার পূর্ণ প্রকাশ নয়। তাঁর দু’ হাজারের বেশি গান এবং আড়াই হাজারের মতো ছবি রয়েছে যা তার সৃষ্টিশীলতার অনন্যমাত্রা তুলে ধরে।
বাঙালি তথা বিশ্ববরেণ্য আরও একজন নোবেল সম্মানে ভূষিত মানুষ  অমর্ত্য সেন  তাঁর লেখা বই “Rabindranath Tagore: The Myriad-Minded Man”  এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে  “ রেনেসাঁ-পুরুষ”- হিসেবে উল্লেখ করেছেন । 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যে ভারতবর্ষের পুরনো ঐতিহ্যের ভাবরাশিকেই  নতুন আঙ্গিকে, মাধুর্যের শ্রেষ্ঠত্বে উপস্থাপনা করেছেন ।  শুধুমাত্র দার্শনিক হলে তাঁর এই দ্বৈতসত্ত্বার প্রয়োজন ছিল না। যদিও তিনি প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিক ভাবরাশিতেই অভিস্নান করেছেন, তবুও সত্য ও প্রেমের সাধনায় মনোজগতের পথ ধরে যে অভূতপূর্ব উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতা ঘিরে, তা তাঁর কবিপ্রতিভার স্নিগ্ধতায়, মাধুর্যে,  গভীরতায়, ব্যাপকতায়, অভিনবত্বে নির্বিশেষের হয়ে বিশ্বের দরবারে, বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্রে চির প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ভাব চিরকাল একই থেকে যায় কিন্তু তার বিকাশ ঘটে নিত্য নতুন হয়ে। পৃথিবীর সমগ্র জীবনধারাই অতি পুরাতন জীবনধারারই প্রবাহমানতা। কেবল তা নতুন জীবনলাভের জন্য প্রকাশের ভিন্নতায় নতুন হয়ে ওঠে। তাই তো তিনি বলে ওঠেন – 

‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই বারে বারে
হে আমার ভালোবাসার ধন ।'

রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষগণ আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের খুলনা জেলার অন্তর্গত পিঠাভোগ গ্রামের বাসিন্দা এবং অন্ত্যজ শ্রেণির ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ।  তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ও পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের অগ্রণী।  কলকাতায় জোড়াসাঁকোর প্রবল প্রতাপশালী জমিদার ও ব্রাহ্মধর্ম-প্রচারক দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোদ্দ ছেলে-মেয়ের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছোট থেকেই তাঁকে প্রথাগত বিদ্যার ধার ধারতে হয় নি। স্কুল-পালানো রবীন্দ্রনাথের নানা বিষয়ে গৃহ-শিক্ষার কোন অভাব হয় নি। তিনি কুস্তি করেছেন, বিজ্ঞান-শিক্ষা করেছেন, চর্চা করেছেন পৃথিবীর নানান ভাষা, ওস্তাদের কাছে শিখেছেন প্রাচ্য সঙ্গীত, আর পাশ্চাত্য সঙ্গীত-শিক্ষকের কাছে শিখেছেন ক্লাসিকাল মিউজিক, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের  কাছে ভারতীয় বেদ-উপনিষদ পড়ে তা হৃদয়ঙ্গম ও ব্যখ্যা করতে শিখেছেন, অন্য দিকে পড়েছেন পৃথিবীর ইতিহাস, সাহিত্য। অন্যভাবে বলতে গেলে যে কোন মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য যা সমন্বয় প্রয়োজনীয় বালক-যুবক রবীন্দ্রনাথের শিক্ষায় তার কোন অভাব হয় নি।
তাঁর মানস গঠনে শিক্ষা, সর্বধর্ম, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। একটি পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিফলন তাঁর সামগ্রিক জীবনাচারের মধ্যে ছিল।

রবীন্দ্রনাথকে জানতে শুধু তার লেখা,আঁকা বা শিল্প কর্মের ভেতর তাঁকে খুঁজলে চলবে না। তাঁর শিক্ষা  ব্যবহারিক ভাবনা ও তাঁর গভীর মানবিক মূল্যবোধের ভেতর থেকে বুঝতে হবে । 
তাঁর বংশের তিনি সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হলেও জমিদারী পরিচালনা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করেছিলেন  । পূর্ব বাংলার বিশাল জমিদারির তত্ত্বাবধান, নিয়মিত খাজনা আদায়  প্রজাদের দেখ-ভাল করা, জমিদারি কি করে বাড়ানো যায়, তা দেখা সিদ্ধান্ত নেওয়া সব কিছুতেই তিনি সফল ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে রবীন্দ্রনাথ জমিদারী করেন প্রায় পঞ্চাশ বছর, তার মধ্যে ১৮৮৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩১ বছর ঠাকুর এস্টেটের বেতনভোগী কর্মচারী হিসাবেই।পূর্ব বাংলার তাঁদের জমিদারির নিজে মালিকানা পেয়েছেন ১৯২০ সালে।

হিন্দু-মুসলমান প্রজাদের মধ্যে সম্প্রীতি এনে, তাদের শোষণ না করে, তাদের উন্নতির দিকে নজর দিলে জমিদারির স্বাস্থ্য ভালোই থাকে এটি উনি দেখিয়েছিলেন ।

জমিদারের প্রতিনিধি হয়ে এসে প্রথমেই  হিন্দু ও মুসলমান প্রজাদের আলাদা হুঁকোর ব্যবস্থা তুলে দেন তিনি। পাশাপাশি কাছারিতে সবাইকে একসাথে বসানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। ভারতবর্ষের বুকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার এমন দৃঢ় পদক্ষেপ তার চারিত্রিক দৃঢ়তারই প্রকাশ।

তিনি জমিদারের প্রতিনিধি হয়ে খাজনা তোলা বা রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়ে চালু  করলেন পুণ্যাহ।এবং সেই পুণ্যাহ সম্বন্ধে জমিদারের হাব-ভাব তিনি নিজেই লিখেছেন ‘সৌন্দর্যের সম্বন্ধ’ নামক এক প্রবন্ধে ।

কর ছাড়াও, রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে শুরু করলেন পুষ্করিণী-সম্মার্জনীর কাজ, দাতব্য হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা, যার চিকিৎসক জমিদার-তনয় নিজে। তাছাড়া, স্ত্রী-শিক্ষার জন্য পাঠশালা, ধান চাষের জন্য প্রজাদের সহজে দাদন প্রদানের জন্য গ্রামীণ ব্যাঙ্ক। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ  টাকার বেশ বড় অঙ্ক সেই পতিসর গ্রামীণ ব্যাঙ্কে লগ্নী করেন, যাতে প্রজারা অল্প সুদে দাদন পেতে পারে।

বর্তমান সময়ে যখন আমরা ধর্মের নামে ভেদভেদের রাজনীতিতে মেতে নিজেদের ব্যাস্ত রেখেছি রক্তক্ষয়ী সন্ত্রাসে সেই বাংলার মাটিতে এই রবীন্দ্রনাথই দেখিয়েছিল পরম মৈত্রীর বন্ধন কিন্তু আমরা তা নিতে পারিনি। 
একটি আদর্শ সমাজ গড়তে গেলে প্রয়োজন হয় বিশেষ রাজনৈতিক কুশলতার । বর্তমান সময়ের লোভাতুর ভ্রষ্ট  মিথ্যাচার সর্বস্য মানুষের রবীন্দ্র প্রণাম আসলে ভণ্ডামির পরিচায়ক।

যদিও সরাসরি রাজনৈতিক ছিলেন না তবু রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ছিল মিশ্র ধারার প্রকাশ। তিনি সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেন ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন করেন। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত "মানসী" কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়।হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র মামলার তথ্যপ্রমাণ ও পরবর্তীকালের বিভিন্ন বিবরণী থেকে জানা যায় যে রবীন্দ্রনাথ গদর ষড়যন্ত্রের কথা শুধু জানতেনই না, বরং এই ষড়যন্ত্রে জাপানি প্রধানমন্ত্রী তেরাউচি মাসাতাকি ও প্রাক্তন প্রিমিয়ার ওকুমা শিগেনোবুর সাহায্যও প্রার্থনা করেছিলেন। অন্যদিকে ১৯২৫ সালের একটি প্রবন্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে "চরকা-সংস্কৃতি" বলে বিদ্রুপ করে রবীন্দ্রনাথ কঠোর ভাষায় তার বিরোধিতা করেন।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার চোখে ছিল "আমাদের সামাজিক সমস্যাগুলির রাজনৈতিক উপসর্গ"। এই কারণে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তিনি বৃহত্তর জনসাধারণের স্বনির্ভরতা ও বৌদ্ধিক উন্নতির ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারতবাসীকে অন্ধ ভাবে বিপ্লবের পন্থা ত্যাগ করে বাস্তবসম্মত উপযোগমূলক শিক্ষার পন্থাটিকে গ্রহণ করার আহ্বান জানান।
তাঁর সমকালের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলার জাতীয়তাবাদী মনীষীদের ভাবাবেগ এবং কার্যপদ্ধতি; সেইসঙ্গে বাক্-স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসকের দমননীতি এবং দেশবাসীর সার্বিক ক্ষুব্ধ ভাবাবেগ—এই সব কিছুর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। 
“তোমার প্রার্থনা আজি
বিধাতা কি শুনেছেন। তাই উঠে বাজি
জয়শঙ্খ তাঁর? তোমার দক্ষিণ করে
তাই কি দিলেন আজই কঠোর আদরে
দুঃখের দারুণ দীপ আলোক যাহার
জ্বলিয়াছে বিদ্ধ করি দেশের আঁধার
ধ্রুবতারার মতো”।
রবীন্দ্রনাথ শুধু যে রাজনীতি সচেতন ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন এক নতুন ধরনের রাজনীতির ভারতীয় প্রবক্তা। ১৯১৭ সালে জাপানে দেওয়া এক বক্তৃতায় তীক্ষ্ণ ভাষায় সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে,” feeds upon their dead flesh and grows fat upon it, so long as the carcasses remain fresh, but they are sure to rot at last, and the dead will take their revenge by spreading pollution far and wide and poisoning the vitality of the reader. ” এই কঠোর সমালোচনার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা নানা ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে গেলেও  তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মানসিকতা কখনও পাল্টায়নি।
রবীন্দ্রনাথ বেনিতো মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে Manchester Guardian-এ একটি চিঠি লিখলে তাঁর ভাই প্রত্যুত্তরে Popolo d’Italia তে লিখেছিলেন: ‘Who cares? Italy laughs at Tagore and those who brought this unctuous and insupportable fellow in our midst.’

 রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগের প্রশংসা করেছিলেন। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি টেনেছিল সেখানকার মৌলিক শিক্ষা বিস্তার কর্মসূচি। ‘রাশিয়ার চিঠি’তে তিনি ভারতে বৃটিশ রাজ কর্তৃক নিরক্ষরতা লালনের সাথে রাশিয়ার শিক্ষাবিস্তারের তুলনামূলক চিত্রটি তুলে ধরেন।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাই বিশ্বযুদ্ধ সহ সকল রাজনৈতিক সংঘর্ষের মূল কারণ।এটি রবীন্দ্র দর্শনের এক সীমাবদ্ধতা বলেও অনেকে মনে করেন। কারণ রবীন্দ্রনাথ পুঁজির বাড়বাড়ন্ত, শ্রেণি সংঘাত ইত্যাদি মার্কসীয় তত্ত্ব ও নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন, কিন্তু মূল উৎস হিসেবে সেই জাতীয়তাবাদী আবেগকেই প্রাধান্য দিয়েছেন ।
 
ধর্ম, বর্ণ, জাত ও জাতীয়তাবাদের নামে মানুষকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে দেওয়ার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি ছিল তাঁর, তিনি মনে করতেন কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ মনুষ্যত্বের উন্নতি ঘটাতে পারে। তাঁর সংশয় যে অমূলক ছিল না, তার প্রমাণ দু দুটি বিশ্বযুদ্ধ। তাঁর এই মনোভাবের সর্বোৎকৃষ্ট বহিঃপ্রকাশ ‘ গোরা ‘ উপন্যাস, যেখানে মূল চরিত্র গোরা নিজে এক গোঁড়া হিন্দু ও চরম ভারতীয় হিসেবে বড়ো হয়, কিন্তু সে যে স্কটিশ দম্পতির সন্তান। উপন্যাসের শেষ লগ্নে যে নিজের জন্মরহস্য জানতে পারে এবং বোঝে তার পালিতা মা ই ভারতীয়ত্ত্বের মূর্ত প্রতীক,যিনি নিজে ধর্মপরায়ণ হিন্দু পরিবারের সদস্য হলেও খ্রিষ্টান ইউরোপীয় দম্পতির অনাথ সন্তানের দায়িত্ব নেন নির্দ্বিধায়, মানবিকতার খাতিরে। তাই তো গোরা অস্ফুটে স্বীকার করে নিতে পারে,- " মা, তুমিই ভারতবর্ষ '

"আমরা ও তোমরা"- এই বিভাজন রাজনীতি থেকে ধর্ম সর্বত্র আজ ছড়িয়ে গিয়েছে, এর বিপদ বহু আগেই বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পঁচিশে বৈশাখ ঘিরে তাঁর সাহিত্য-শিল্প নিয়ে যতই মাতামাতি আমরা করি  তুলনায় তাঁর এই সমাজ-ভাবনা আমাদের ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ধর্ম এবং তার সূত্রধরে যে অসহিষ্ণুতার আবহ আজ গোটা দেশ জুড়ে প্রসারিত তার উল্টো দিকে দাঁড়ানো রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনার  বোধহয় এটাই প্রাসঙ্গিক সময়।

২১ জৈষ্ঠ্য ১৩৩৮, রবীন্দ্রনাথ হেমন্তবালা দেবীকে লিখছেন, ‘বৈষ্ণব যেখানে বোষ্টম নয় সেখানে আমিও বৈষ্ণব, খৃষ্টান যেখানে খেষ্টান্‌ নয় সেখানে আমিও খৃষ্টান’।

বিশ্বের সেই অন্তর্নিহিত শক্তি, যাঁর থেকে এই রূপময় পৃথিবী এবং সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি, সেই অন্তর্নিহিত শক্তিই হলো সমস্ত সৃষ্টির মূল সত্য। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছিল আধুনিক ইউরোপের গতিবাদ। বিশ্বের কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। সমস্তই বিপুল পরিবর্তন, পরিবর্ধনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত। এই যে অনির্বাণ ছুটে চলা, অনন্ত জীবনপ্রবাহ এটাই হলো বিশ্বসৃষ্টির মূল তত্ত্ব। বেদ উপনিষদের গতিবাদ সহস্র সহস্র বছর পূর্বে এই অমোঘ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বসত্য সম্পর্কে সাধনার লব্ধ অভিজ্ঞতায়।

 আয়ান জ্যাক  খুব যথার্থ বলেছেন যে, এখন সময় এসেছে রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি ছিলেন এই কথাটা ভুলে যাওয়ার। দেশ-কাল-সমাজ-জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়-শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর আলোকিত ভাবনার জগতটিকে সবার সামনে তুলে ধরা ভীষণ জরুরি।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় জীবন, মৃত্যু ও স্রষ্টার সাথে নির্ভীক এক সম্পর্ক প্রকাশ পেয়েছে। ‘গীতাঞ্জলি’র অনেক কবিতায় তার প্রকাশ দেখা যায়। এক ধরন অস্পষ্ট ধর্মীয় অভিজ্ঞতা তাঁর কবিতার মর্মবাণী যা সব ধর্মের মানুষের মনের ওপর প্রভাব ফেলে।

তিনি বুঝেছিলেন তাঁর রচিত সঙ্গীতকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে একটা নির্দিষ্ট মান বজায় রাখতে হবে। ব্যাক্তিগতভাবে সেই মান রক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই বিশ্বভারতীর হাতে সঙ্গীতের মান বাঁচিয়ে রাখার ভার অর্পণ করেন। প্রায় প্রত্যেকটি গানের স্বরলিপি নিজে লিখে বা লিখিয়ে নিয়ে স্বরবিতান নামে বিভিন্ন খণ্ডে প্রকাশ করে সঙ্গীতকে শতাব্দী ধরে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ যদি নিজের গানের ওপরে এই স্ব আরোপিত শর্ত আরোপ না করতেন, তবে যে কোন শিল্পী তাঁর নিজের ইচ্ছামত সঙ্গীত গাইতেন এবং স্বরলিপির বিশেষ কোন প্রয়োজন হতো না। ফলে ধীরে ধীরে সঙ্গীতের স্বকীয়তা হারিয়ে যেতো।  অন্য কোন সঙ্গীতের সাথে কোন তফাত বিশেষ পাওয়া যেত না। শতাধিক বছর পর রবীন্দ্রসঙ্গীত বেঁচে থাকতো কিনা সে সম্বন্ধে আশঙ্কা থেকে যেত।

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি প্রজন্মর পর প্রজন্ম যেন বেঁচে থাকে। তিনি বুঝেছিলেন যে তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি প্রয়োজন, আর সেই প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখতে গেলে সমান ভাবে প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বয়ং সম্পূর্ণতা, যা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সাথে করেছেন। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী কয়েক হাজার ব্যক্তি, সংগঠন, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় রবীন্দ্রসঙ্গীত ও তার আনুষঙ্গিক কলা শেখানোয় ব্রতী রয়েছে। এটা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত বিস্তার চিন্তা এবং সফল বাণিজ্যিক চিন্তার ফসল। 

আজ শিক্ষাঙ্গনের দিকে তাকালে বিভেদকামী শক্তি ও সাম্প্রদায়িক শক্তির পারস্পরিক দ্বৈরথে শিক্ষা ব্যবস্থাটাই ভঙ্গুরমান হচ্ছে তা সহজেই উপলব্ধি হয়। দুর্বৃত্তায়ন আর অনুকরণশীল শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার কুলষিত শেকড় প্রসারিত করে চলেছে অথচ এই ঋষি তুল্য মানুষের ভাবনায় শিক্ষা ছিল শিশিরের মত নির্মল, সূর্যের কিরণে তা হীরক দ্যুতির মত উজ্জ্বল ।

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন  সাম্প্রদায়িকতামুক্ত একটি একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন  যেখানে চর্চা হবে ভারতীয় সংস্কৃতি অন্যদিকে থাকবে ভারতের শিক্ষার সাথে একটি আধুনিক বৈশ্বিক যোগ স্থাপন। শান্তিনিকেতনকে কখনও তিনি তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনা বা কর্মকাণ্ডের সাথে জড়াননি। এই বিষয়ে জানা যায়  "কি স্বদেশী যুগের জাতীয় শিক্ষা পরিষদ আন্দোলনপর্বে  কী হোমরুল লীগ যূগের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন; এমনকি গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন, এইসব তীব্র উত্তেজনার মধ্যে- শান্তিনিকেতনকে তিনি বাহিরের উত্তাপ হইতে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন"।

তিনি চাইতেন বাংলা ভাষা হবে শিক্ষার মাধ্যম। এই বিষয়ে তার মতামত ছিল চূড়ান্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন হয়েছিল। এই উপলক্ষে তার সভাপতি স্যার মাইকেল স্যাডলার কয়েকজনকে নিয়ে শান্তিনিকেতন পরিদর্শনে আসেন। সে সময় স্যাডলার ইংল্যান্ডের লীডস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং শিক্ষাশাস্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে শিক্ষাচিন্তা নিয়ে তাঁর যে আলোচনা হয় তা কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশিত হয়। এত আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কথা বলে গেছেন তা সারাবিশ্বেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার জন্য উপযুক্ত আদর্শ হয়ে উঠতে পারতো। তিনি সেদিন বলেছিলেন, "ইংরেজি ভাল করিয়া শিখিতেই হইবে- তবে বিদ্যালয় ও কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে সকল জ্ঞান বিজ্ঞান শিখাইতে হইবে"। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপকগন তাদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক এবং অধ্যাপকদের সাথে মালিক শ্রমিক সম্পর্ক থাকবে না বরং একে অন্যের সহযোগী হয়ে কাজ করবেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- 

"এই বিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণকে আমি আমার অধীনস্ত বলিয়া মনে করি না। তাঁহারা স্বাধীন শুভবুদ্ধির দ্বারা কর্তব্য সম্পাদন করিয়া যাইবেন ইহাই আমি আশা করি এবং ইহার জন্যই আমি সর্বদা প্রতীক্ষা করিয়া থাকি। কোনো অনুশাসনের কৃত্রিমশক্তির দ্বারা আমি তাহাদিগকে পূণ্যকর্মে বাহ্যিকভাবে প্রবৃত্ত করিতে ইচ্ছা করি না। তাহাদিগকে আমার বন্ধু বলিয়া সহযোগী বলিয়াই জানি। বিদ্যালয়ের কর্ম যেমন আমার, তেমনি তাহাদেরও কর্ম- এ যদি না হয় তাহলে এ বিদ্যালয়ের বৃথা প্রতিষ্ঠা"।

ন্যায়, কল্যাণ, শুভবুদ্ধির উদ্বোধনের জন্য শান্তিনিকেতনের কর্মপ্রচেষ্টাকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন এই প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেছেন, আত্মসংযম, শরীর মনের নির্মলতা, একাগ্রতা, গুরুভক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে মনুষ্যত্বকে দুর্লভ ধনের মত শিষ্য বা ছাত্ররা গুরুর কাছ থেকে অর্জন করবে। মনুষ্যত্ব অর্জনই হবে দেশসেবার পথ বা উপায়।
 

এখন প্রশ্ন আমাদের বাঙালিদের রবীন্দ্রচর্চা কী শুধুই পঁচিশে বৈশাখ, বাইশে শ্রাবণ পালনের মাঝে সীমিত থাকবে ? এই দুটি দিন বাঙালি তার রোজনামচার জীবন থেকে বের হয় , রবিকিরণে নিজেকে একটু উষ্ণ করে , নিজের আধ্যাত্মিক মান উন্নয়নের চেষ্টা করবে?অনেক বাঙালিই রবীন্দ্রনাথকে প্রায় দেবতার আসনে বসিয়ে ফেলেছেন। তাঁকে নিয়ে ভক্তি গদগদ হয়ে পূজোর আসর বসিয়েছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের সামান্যতম সমালোচনা, ক্ষীণতম ত্রুটি-বিচ্যুতি্র উল্লেখ ক্ষিপ্ত করে তাঁদের।  তাঁর বহুমুখী ভাবনার সঙ্গে পরিচিতির ক্ষেত্রে বাঙালির অনেক ফাঁক থেকে গেছে৷  ‘‘রবীন্দ্রনাথের একদিকে সৃষ্টির ব্যাপার আছে৷ অন্যদিকে তাঁর যে সমাজ ভাবনা, শিক্ষা ভাবনা, তাঁর পরিবেশ ভাবনা, পল্লি পুনর্গঠন ভাবনা৷ রবীন্দ্রনাথ তো শুধুই একটি নাম বা চেতনা নয়৷ তিনি একটি প্রতিষ্ঠান৷ যে প্রতিস্থানের নাম বহন করেই  একজন বাঙালি বাঙালি হয়ে ওঠার সাধনায় মগ্ন থাকে সে দান ওই রবীন্দ্রনাথেরই৷সাহিত্যে বা কাব্যে  গোটা বিশ্বের সাহিত্য থেকে প্রায় সার বস্তু সংগ্রহ করে আনতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ যা কিছু উৎকৃষ্ট, যা কিছু গ্রহণযোগ্য, সবই তাঁর দেওয়া উপহার৷ রবীন্দ্রনাথ এমনই এক ভাণ্ডার যা অসীম ।গুটিকয়েক গান আর সীমিত প্রাতিষ্ঠানিক পঠনপাঠনের মাঝে তাঁকে বেঁধে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে তাঁর সৃষ্টি অব্যবহৃত থেকে যাবে।  প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পেরিয়ে গেলেও এই রবি ঠাকুরের প্রতি একটি প্রাণের প্রণাম তাই রাখবো।

তথ্যনির্দেশঃ-
"সংক্ষিপ্ত রবীন্দ্র-বর্ষপঞ্জি", রবীন্দ্রজীবনকথা, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
সর্বজনের রবীন্দ্রনাথ, অধ্যাপক শুভঙ্কর চক্রবর্তী সম্পাদিত, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
বঙ্গসাহিত্যাভিধান, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
"ব্রাহ্মধর্ম, ব্রাহ্মসমাজ", প্রভাত বসু, ভারতকোষ
"দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর", রবিজীবনী, প্রথম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি (অধ্যায়: "ভৃত্যরাজক তন্ত্র"), বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ
সর্বজনের রবীন্দ্রনাথ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ