শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || সোনালী দাস সরকার




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

মা উমা
সোনালী দাস সরকার

মিষ্টি চঞ্চল মেয়েটা আমার হাসপাতালের বেডে ছটপট করছে! এ কি সহ্য করা যায়? এই ভালো ছিল এই কি  যে হলো ! হা, কপাল!

ডাক্তার তখনো আসেননি।বিপিন বাবু তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ভোর বেলা একা বসে আছেন হাসপাতালে। ধনীব্যক্তি তাই টাকা দিয়ে ভালো ব্যবস্থার আয়োজন করে নিয়েছেন তৎপরতা সাথে। কিন্তু ডাক্তার সে তো কল করা হয়েছে।এখন কতক্ষণ  পর আসবেন তা নির্ভর করছে ঈশ্বরের উপর।

এমন শুভ দিনে মানুষ কোথায় আনন্দে করে পূজো আসছে বলে।আর আমার মেয়েটা সেখানে মেয়েটা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

বিপিন বাবু অস্থির হয়ে পায়চারী করছেন আর বিড়বিড় করে চলেছেন।

আজ মহালয়া, সকালের গঙ্গাস্নান পূজা কিছুই করে উঠতে পারেন নি।

তার একমাত্র সন্তান বাবলির এই কষ্ট টা শুরু হয়ে যায় ভোর রাতে।

- পূবের। আকাশটা গত রাতের কালো ঝড় কাটিয়ে দিব্যি লাল রঙে নব প্রভাতের সূচনা করছে।

- কাশ ফুলের একটা ঝাড় ঠিক হাসপাতালের পিছন দিকে লকলকিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে থেকে থেকে।

- প্রকৃতির আর কি এসে যায়।ও তো নিয়মেই আসে সাজায় মূর্ছা যায়।আবার একই ভাবে ফোটে।

- আর আমাদের জীবনে কত ঘাতপ্রতিঘাত! এই আছি এই নেই।কখন কি দুর্ঘটনা ঘটে কে জানে।

- প্রকৃতি কি আমাদের খোঁজ রাখে?

আমরা পূজো আসছে বলে প্রকৃতির শোভা আনন্দ মনে মেখে উৎফুল্ল হয়ে গায়ে হাওয়া লাগাই।আজ কিচ্ছু টি ভালো লাগছে না।

--চারদিক শুধু পায়চারী করে চলেন। কখনো মাঠটায় ঘাসের শিশিরে  পা ভিজিয়ে নেন কখনো হাসপাতালের ঠাকুর ঘরে হাটু গেড়ে প্রার্থণা করে জান।

-অনেক ক্ষণ পাগলিটা বিপিন বাবুর চারপাশে ঘুরে ঘুরে কি জেন অনুসন্ধান করে চলে।তারপর সটাং সামনে এসে

হাত পেতে বলে-

- বাবু গো! তুমি বড় ভালো মানুষ, দয়ালু লোক।আমায় একটু খাবার টাকা দাও না গো।

- কাল বিকেল থেকে কিচ্ছু ভিক্ষে পাইনি।মিথ্যা বলছি না বাবু।

- ওই দেখো ফুটপাথে দুটো অনাথ শিশু সারা রাত ওদের কিচ্ছু খেতে দিতে পারিনি সকাল হচ্ছে কি করি বাবু!

- রাত হয় দিন হয়।সব হয় কিন্তু আমাদের কিছু হয় না।আমরা রোজ খাওয়ার চাই এই একই ভাবে

-  কেনো গো বাবু আমরা রোজ খাই?

- নোংরা কাপড়ে মুখ টা মুছে নেয়! চোখের জল টাও রঙ বদলে দিয়েছে যেন ওদের।

--  আমার কিচ্ছু কাজ নেই কেন বাবু ? বিক্রি করে খেতে দিবো কি? ওদের ফেলে যেতেও তো পারিনা।চুরি করে নেবে।  বাচ্ছা গুলো কে নিয়ে মুশকিলে পড়েগেছি! মন ভালো হলে হয় না বাবু গো টাকা চাই টাকা!

-- এইটা আমার কোলের বাচ্ছা বাবু এর জ্বর আছে। একেও খেতে দিতে পারিনি রাত থেকে।

বাবু আমার মরদটা, শয়তান পালিয়ে গেছে।

- অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন কারণ মনে মনে আদ্যামায়ের পাঠ জপ করছিলেন!

-একটু বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেন-"দেখো ভাই এখন সরে যাও।মাথার ঠিক নেই পরে দিচ্ছি আগে আমার মেয়েটার ডাক্তার আসুক।

-- ভয়ে ভয়ে সে সরে  যায় এমন ধমক দি।

- একে  ঠিক পাগলি বলা ভুল হবে।

-  এ হত দরিদ্র গরিব ভিক্ষারি। তা বোঝা গেলো  কিন্তু কত  যে বোঝদার!  কথা বলার পর অবাক হয়ে গেলাম।

-- ডাক্তার এসেছেন ওয়ার্ডবয় জানাতে ছুটে এলেন বিপিন বাবুর কাছে।

- ওকে আগেই টাকা দিয়ে ফিট করে রাখা।

- এগিয়ে গেলেন মেয়েকে দেখার জন্যে।

-- অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষার পর প্রকাশ্যে এলো রিপোর্ট

- বাবলির কিডনি এক্ষুনি দরকার।

-- তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা।

- হাসপাতালের বাহিরে এসে বিপিন বাবু সবার সাথে ফোনে কথা বলে মেয়ের জন্য ডোনারের ব্যবস্থায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।  পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছেন এমন সময়  হঠাৎ চোখ যেতে ই দেখেন ভিখারিনীর দুটো পালিত বাচ্ছা মাঠিতে নেতিয়ে পড়ে আছে।আর ভিখারি দৌড়ে দৌড়ে গাড়ী গুলোর কাছে গিয়ে হাত পেতে ভিক্ষা চেয়ে চলেছে।

- মনে হলো শহরটা খুব ই ব্যস্ত সার্কাস দেখাতে। তাই দর্শকের কান্না কোলাহল কে হাসির মনে করছেন।

- শুধু খারাপ চোখেই দেখে আপাতত দৃষ্টিতে। ভাবে নয় মিত্যা বলছে নয় অভিনয় করে পয়সা চাইছে। দুটো টাকা দিলে কি ভিখারি সেই মানুষের সমান বড় লোক হয়ে যাবে? এতো চুলচেরা বিচার আমরা কোথা থেকে শিখেছি ভগবান?

- অথচ কত বড় বড় যায়গায় আচ্ছা ঠকান ঠকে যাই।

কোনো কিছুর মধ্যে মীমাংসা করার মত মন কারো মধ্যে নেই।

-- নিজেকে ধিক্কার দিয়ে মনে মনে রাগ করেন  বিপিন বাবু।

-রাস্তা পার হতেই ভিখারিনী ছুট্টে আসেন কাঁদতে কাঁদতে।বাবু গো কিছু দিন না!  বলে হা হয়ে দেখে!

- আমার মুখ দেখে ভয় পেলি? বিপিন বাবু বলেন!

- না রে বকা দেবো না।

মাথা ঠিক নেই রে।

- নে ওদের জন্য খাওয়ার কিনে খাওয়া।এতো বেলা হয়ে গেছে।আমি নিজেও আর পারছিনা।সেখানে দুধের শিশু গুলো আহা! যা যা খাবার খাওয়া।

-- টাকা দেখে পাগলের মত বাচ্ছা গুলো লাফিয়ে উঠল।

- হতবাক হয়ে দেখি! আহা সারাদিন এমন করে কি করে ওরা যে কাটায়! এরাও মানুষ ?

- আজ আমার মেয়েটাও যন্ত্রণায় বেহুশ। সারাদিন  জল টুকুও পড়েনি পেটে। কি কষ্টটা না হচ্ছে ওর!

- বাবু তুমি ভালো মানুষ গো।

- বাবু ভগবান আছেন। তোমার কষ্ট হচ্ছে তো ? ওটা ঠিক করে দেবে।

- বাবু তোমায় ভগবান সব দেবে।তুমি দেখো?

- চিন্তা করতে করতে রেগে ওঠেন বিপিন বাবু।

- কি ভালো কি  ভালো!  আর বলিস না তো?

-- ভগবান কিডনি দেবে কি?

আমি তো সবার ভালো করে আসছি। আমায় কেন এতো বড় কষ্ট দিল তবে?

- কান্নায় ভেঙে পড়েন শক্তসমর্থ মানুষ টি।

- না বাবু তুমি  কেঁদো না। বড় লোক তুম তোমায় আরো দেবে দেখবে? যে গরিবের কষ্ট বোঝে তাকে ভগবান সব দেয়।

- ভিক্ষার্থিনী চলে গেছে পাশের দোকানে খাবার কিনতে।বাচ্ছা গুলো চোখের সামনে কেঁদেই চলেছে অনর্গল মা মা করে।

- দেহটা অথর্বের মত ফুটপাথে বসে যায় বিপিন বাবুর।আর শরীরের জোড় নেই, চিন্তায় ভাবনায় না খাওয়ায়।

- চোখ যায়নি এতো দিন কোনো ফুটপাথ বাসীর ঘরে।

- আজ চোখের সামনে জ্বলজ্বলন্ত দর্পণের ছায়া

-ভাঙা কাঠের ঠেকনা দিয়ে মাথায় প্লাস্টিক বেঁধে ছেঁড়া কাপর চাপিয়ে ঘরটা।ভেতরে আবার পোষা কাক।সে দিব্বি বিপিন বাবুকে লক্ষ করে চলেছে।

আবার নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছে। মুখের সামনে কি সব দানা দেওয়া কাক টার।

- কারো জীবন পূর্ণ সাজানো কারো কত অভাব।

- হায় ঈশ্বর, বিপিন বাবু উঠে দাঁড়াতে যাবেন এমন সময় রাস্তা পার করতে গিয়ে চোখের সামনে সিগনালে একটা গাড়ী ধাক্কা দিতেই ধরাশায়ী প্রায়  বুভুক্ষু জ্বালার উন্মাদ ভিখারিনী।

- চোখ কে ওবিশ্বাস করা যায় না।

- মনে হচ্ছে ভুল দেখছি।

- বাচ্ছা গুলো ধরতে যাবে বলে পাগলের মত দৌড়ে যায়।

- ভীষণ অসহায়ের মত লাগছিল।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কি হয়ে গেলো এ?

- দৌড়ে গিয়ে বাচ্ছা গুলোর নোংরা হাত গুলো চেপে ধরলাম। আরো গাড়ীর পর পর এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে দেখে।

- ওর মধ্যে ভিক্ষারিটি খাবার গুলোএগিয়ে দিচ্ছে বাচ্ছা গুলোর দিকে। কি অসহনীয় এই দৃশ্য।

যে ধাক্কা দিয়েছে সেই ভদ্রলোক পাবলিক মারের ভয়ে তুলে নিয়ে আসে ঐ হাসপাতালে।

- সামনে দিয়ে বেডে নিয়ে যাওয়ার সময় পাগলি আমার হাত টা ধরে বলে

- বাবু ভগবান আপনার কথা শুনেছেন। দেখেছেন ভগবান কেমন আছেন?

- আমার কিননি নিন বাবু। এটা লিয়ে আমার বাচ্ছাদের বাঁচান। ওদের ভগবান আপনি বাবু।কিছু খেতে দিলেই হবে ওদের।

- ওর কিছু হয়েছে কিনা আপাতত বোঝা গেল না কিন্তু পেটে পায়ে জোড় লেগেছে বোঝা যাচ্ছে। পেটে অপারেশন কিছু তো করতেই হবে। কি তা জানিনা কিন্তু ব্লিডিং হচ্ছে।

- দালাল তখনো বিপিন বাবুকে কোনো সঠিক ডোনার এনে দিতে পারলেন না। শুধু ফোন আর ফোন।

হাসপাতালের মন্দিরের একটু প্রসাদ খেয়ে কেঁদে ফেলেন তিনি।

আমরা শরীর চর্চার জন্য খাই না।হায় রে। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়।

-ডাক্তার অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এসে, যে ভদ্রলোক অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন তার কাছে না গিয়ে সোজা বিপিন বাবুর কাছে জান।

- দেখুন আপনার মেয়ের A+ পজিটিভ এই মহিলার টাও তাই রক্ত।

-  " উনি নাছোড়বান্দা আপনার মেয়েকে কিডনি দেবে দেখুন কি করবেন।তাহলে আমি সে ভাবে এগোবো।"

- বেছাড়ির নাভিতে লেগেছে আঘাত।একটু সময় লাগবে বেঁচে হয়তো যাবে।"

- বাকি আপনারা আলোচনা করে জানান।ফর্মালিটি যা আছে তা  দেখে নেবেন একবার।আমি লোক পাঠাচ্ছি আপনার কাছে।"

ডাক্তার চলে যাওয়ার পথে চেয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ এই ভাবে সময় কেটে যায়।

-- আকাশের দিকে চেয়ে ঈশ্বর কে জিগ্যেস করেন

- " হে ঈশ্বর মেয়ের জন্য তুমিই কি আগন্তুক পাঠালে? কত লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে বসে আছি দেবো বলে।চারদিকে লোক ছুটছে।

আর এক ভিখারি শুধু দুবেলা খাবারের জন্য তাও তার বাচ্ছা আর দুটো অনাথ শিশুকে বাঁচাতে এই বলিদান দিতে চায়!

আমার অপরাধ হবে না তো?

আমি ওই বাচ্ছাগুলোর অভিভাবক ছিনিয়ে নি কি করে?

কোনো  সম্পর্ক পরিচিত না  হওয়া স্বত্তেও  আমরা একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে গেছি?

কারো ক্ষতি আমার দিয়ে করিয়ো না প্রভু।আমার আপনজন কেউ এগিয়ে এলো না।কি ভাবছে সবাই আমি কিডনি চাইবো? সহানুভূতির জন্যও কেউ এখনো এলো না।এদের আমি আবার নিমন্ত্রণ করে খাওয়াই।জিনিষ দি।

ছি:! মনে মনে ধিক্কার দেন।
পরের দিন শুভ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলো।মেয়েটা কে জীবনদান দিলেন  স্বয়ং জেন মা উমা
-এদিকে ভিখারি টাও বেঁচে গেলো এ যাত্রায়।

তবে একটা সৎ মানুষের জবানী দিয়েছি খিলাফ করবো না ওকে আশ্বাস দি।

--ভিখারির নাম দিলাম ডিসচার্জ খাতায় উমা।
মা দূর্গা?  তুমি বলিহারি লীলা জানো মা।
কারণ এর সাথে অকারণ জুড়ে মা ভালোই সাহায্য করে দাও তোমার সন্তানদের অথচ আমরা তোমায় চিনতে পারিনা।

                            সমাপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ