শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || অম্লান রায় চৌধুরী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


অন্ধকারের উৎস হতে  
অম্লান রায় চৌধুরী

আজ একটা হেস্ত নেস্ত করেই ছাড়বে । সোজা বাড়ী থেকে বেড়িয়ে পড়ল প্রায় ঘরে পড়ার পোষাকে । কীর্তকা একটু এমনই প্রকৃতির। হঠাতই ওর মাথাটা গরম হয়ে যায়। তাছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে বাড়ীতে সবাই মিলে ওকে যে ভাবে বিরক্ত করছে ওর পক্ষে বাড়ীতে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে । এমন কি সেদিন এক পিসী যে কিনা ন’ মাসে ছ’ মাসে বাড়ীতে আসে , এসেই বলল , টুম্পা, কীর্তকার  ডাক নাম , মা এবার তো তোমায় একটা ব্যবস্থা করতেই হবে । আর কতদিন এরকম কুমারী হয়ে থাকবে । তাছাড়া বাবা মায়েরও তো বয়স হয়েছে। তুমি এখন উপযুক্ত , নিজে রোজগার করো , নিজের ঘর সংসার করতে মন চায়না । কীর্তিকা চুপ করে শুনল , বলে উঠল , আচ্ছা আমি যেভাবে আছি তাতে তোমাদের কি অসুবিধা হচ্ছে বলতো । আমি তো আর বাচ্চা মেয়ে নেই যে মাকে প্রতিনিয়ত বিরক্ত করছি , বায়না করছি । আমার নিজের জীবনটা কিভাবে গড়ব সেটা  আমি যদি নিজেই ভাবি কারুর তো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয় । 
পিসী বলে উঠল তাকি হয় , আমাদের সমস্ত ঘরের মেয়েদের একটা বয়সের পর নিজেদের ঘর সংসার করে চলে যেতে হয় – এটাই স্বাভাবিক , সামাজিক প্রথা , এর বাইরে আমারা যাই কি করে বলতো । 
কীর্তিকা  এবার খানিকটা রেগে গিয়ে বলল আচ্ছা পিসী বলতো আমি একটা মেয়ে এতদিন ধরে  নানান রকমের বিধি নিষেধের বেড়াজালে বেড়ে উঠেছি । এখন আমার এই বয়সে আমার ভবিষ্যত টাও যদি সমাজ বা অন্য কারুর উপর ছেড়ে দিতে হয় তাহলে আমার এই বেড়ে ওঠাটার তো কোনো মানেই হয়না ।
পিসী আর না ঘাটিয়ে চলে গেলো ।
কীর্তিকা  ভাবতে বসল, আচ্ছা প্রেম কি এমনি ভাবে হয় নাকি যে যাব আর একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে আসবো , বলব বিয়ে করব এর সাথে । জানা শুনো হওয়া , বোঝা,  নিজের মতন করে তার মনের খবর জানা – এগুলো তো একটা সম্পর্কের বিশেষ অঙ্গ । 
দর্পণ শারদ সংখ্যা (অঙ্কন :  উষসী রায়)


যাই হোক শেষ পর্যন্ত কীর্তিকার  বিয়ে হল । নিজের পছন্দেই । একটু অকস্মাত হলেও ব্যাপারটাতে বেশ রোমাঞ্চ আছে ।ঘটনাটা ঘটেছিল ওই অফিস থেকে বাড়ী ফেরার পথে। রাস্তায় অসম্ভব জ্যাম। বাস থেকে নেমে হেঁটে এগোচ্ছিল যত দূর পারা যায় । মাঝে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে একটু চা খাচ্ছিল । সেখানেই ছিল নির্ঝর , সেও  চা খাচ্ছিল ।আচমকা একটা ধাক্কাতে কীর্তিকার ভাঁড়াটা ছিটকে গিয়ে পড়ল নির্ঝরের গায়ে, একেবারে জামার উপর । কীর্তিকা  বুঝতে পারলনা , ঘটনাটা ঘটে গেল । নির্ঝর  চমকে উঠল । তার সদ্য কাঁচা জামাটাতে গিয়ে পড়ল। বেশ রেগে উঠল । কীর্তিকা  নিজেকে সামলাতে না পেরে নিজে থেকেই নির্ঝরের কাছে গিয়ে মাফ চাইল । নির্ঝর এই প্রথম কীর্তিকার দিকে তাকাল । এতক্ষুণ ও হাতে একটা ছোট ম্যাগাজিনের মধ্যে আটকে ছিল । চোখ তুলেই কীর্তিকাকে  দেখতে পেয়ে নিজেও বেশ  অপ্রস্তুত হয়ে গেল ।একে তো কীর্তিকা  বেশ সুন্দরী, দ্বীতিয়ত ওর এমন ভাবে মাফ চাওয়া-সব মিলিয়ে এক চরম অবস্থা । কোনো রকমে সামলে নিয়ে – যা হয় আর কি , চোখে দেখা , মনে কিছু বলে, দুজনে সামলে নিল । যার গেল তার গেল ঠিকই কিন্তু এর ফলে যেটা হল  নির্ঝরের যেন এক নতুন কিছু দেখা হল –যা একদমই ভাবেনি কখনো । দেখেই ঠিক করল আলাপ করা যেতে পারে । কীর্তিকাও  একটু আশ্চর্যই হল নির্ঝরের কাছ থেকে কোনও রকমের রাগ না দেখে। নিজে আস্বস্ত হল । তাকাল নির্ঝরের দিকে , বেশ স্মার্ট একটা ছেলে , খুব শার্প চেহারা , বুদ্ধিদীপ্ত , আলাদা একটা মার্জিত রুচি আছে বোঝা যায় দেখলেই। 
আলাপ হতে সময় নিলোনা । 
নির্ঝর অর্থনীতি নিয়ে পিএইচ ডি করছে – একটা কলেজে পড়ায় , পার্ট টাইম , ইচ্ছা আছে বাইরে গিয়ে পোষ্ট ডক করার । 
প্রাথমিক  পরিচয়ের পরে সে দিন আর বেশী দূর এগোয়নি ওদের এক সাথে চলাটা। বোঝা গেল বেশ  ব্যবহারিক বুদ্ধি সম্পন্ন ওরা, তাছাড়া মাচিওরড তো বটেই । দুজনের চাওয়াতেই প্রকাশ পেল ওরা আবার কোথাও দেখা করবে , এবং খুবই শীগগিরি।  
প্রায় ছমাস ওরা এভাবে কাটাল । চিনল বলে মনে হতে থাকল ধীরে ধীরে, হয়ত চেনাও  হল। বিয়ের প্রস্তাব আসতেই পারে যে কারুর কাছ থেকে  । 
এক শনিবারের রাতে ওরা ডিনারে গেল এক ভালো রেষ্টুরেন্টে । খাওয়া দাওয়া হল । অফিসিয়াল প্রোপোজাল এল নির্ঝরের দিক থেকে , কীর্তিকা মোটামুটি প্রস্তুত ছিল ।  
বিয়ে হয়ে গেল  ওদের। হানিমুন হলোনা দুজনেরই ছুটি নেওয়ার অসুবিধার জন্য । বেশ কাটছিল  ওদের নতুন ফ্ল্যাটে। নির্ঝরের বাড়ি বলতে কেবল মা , সে ও থাকে এক মফস্বল শহরে , বেশ দূর কলকাতা থেকে। কলকাতাতেই মানুষ নির্ঝর  । হোষ্টেল আর পরবর্তীতে  মেসে। সংসারের ব্যাপারে বেশ উদাসীন । অলসও বটে। কাজের ধরণটাতেও সেই গতানুগতিক , ছাত্র পড়ানো আর নিজের রিসার্চ পেপার তৈরি করা। আলস্যতা ওকে মানিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে নির্ঝরের  কাজটা এখন আর নেই । খালি রিসার্চ নিয়েই ওর ব্যস্ততা।সর্বক্ষুন বাড়ীতেই ।কীর্তিকার চাকরীতে উন্নতি হল । আরো চাপ বাড়ল । প্রচন্ড ব্যস্ততা অফিস নিয়ে। মাঝে মাঝেই অফিস ট্যুর । 
দর্পণ শারদ সংখ্যা (অঙ্কন :  উষসী রায়)



কীর্তিকা হঠাতই ট্রান্সফারের অর্ডার পেল মুম্বাইতে। নির্ঝরও চেষ্টা করে মুম্বাইয়ের একটা কলেজে পার্ট টাইম লেকচারের কাজ জোটালো কোনও মতে । ছাড়ল কলকাতা দুজনেই। 
সুন্দর ফ্ল্যাট কিন্তু বেশ আউটস্কার্টে । কীর্তিকার যাতায়াত অবশ্য কোম্পানীর গাড়ীতে। নির্ঝর পাব্লিক ট্রান্সপোর্টে। নির্ঝরের রোজ যাতায়াত নেই শুধু ক্লাসের দিন ছাড়া , সেটা ও সপ্তাহে তিন দিন মাত্র। , বাকী দিন বাড়ীতেই , নিজের রিসার্চ পেপার দেখা।  
এখন বর্ষাকাল। মুম্বাইয়ের বর্ষাকাল খুবই মারাত্মক ।বৃষ্টি শুরু হলে কয়েকদিন থামেনা । রাস্তা ঘাট একেবারে জলময় । সব কিছু বন্ধ হয়ে যায় । এরই মাঝে ওদের হাউসিং কমপ্লেক্সে নোটিস এলো , অত্যধিক বৃষ্টির কারণে বিদ্যুত লাইন খারাপ হয়ে গেছে । বেশ কয়েক দিনের কাজ । সংস্থা ঠিক করেছে , সকাল থেকে বিদ্যুত থাকবে  সন্ধ্যে আটটা অবধি । কাজ  চলবে দশটা অবধি , আবার আসবে দশটার পর। এটা চলবে প্রায় আগামী সাতদিন । সকালের দিকে ওরা কাজটা করবেনা সকলের কাজের অসুবিধার জন্য। রাতে দু ঘন্টা করে কাজটা  করবে ।
বিকালে  জিম থেকে ফিরেছে কীর্তিকা । শুধু ঠোঁটের চারপাশে লিপস্টিকের আভা তখনো আছে। কাজলটা  লেপ্টে আছে সারা চোখে। পার্টির শেষে বা সারা রাত হৈ হুল্লোড়ে  কাটানর পরে নির্ঝর  কীর্তিকাকে এরকম অবস্থায়  দেখেছে। তখন চেহারাটায় এতটাই ক্লান্তি থাকত যে ছুটে এসে নির্ঝরের বুকের উপর পরে যেত , নিশ্চিন্ত হয়ে । আলিঙ্গনে আটকে থাকত। 
কীর্তিকা   হাউসিঙের নোটিসটা নির্ঝরকে পড়ে শোনাল । ব্যাপারটা যে আগে থেকে জানিয়েছে সেটাই যথেষ্ট । ঢুকেই , জামা কাপড় ছেড়ে রান্না ঘরে গিয়ে মাংসের  ডেচকিটা ফ্রিজ থেকে নামিয়ে রাখল , আজকে ওটাই হবে । গত কয়েক মাস থেকে নির্ঝর বাড়িতেই থাকে । ওর পার্ট টাইমটা এখন নেই । রিসার্চের লেখা লেখি চলছে – শেষ পর্ব । ও নিজের কাজ নিয়েই থাকে নয়ত বা কোনও গল্পের বই কিংবা বিছানায় শুয়ে কানে হেড ফোন লাগিয়ে গান শোনা।   
গত কয়েকদিন ধরে বাড়ী থেকে  বেরই হয়নি নির্ঝর । কীর্তিকা যত বেশি অফিসের কাজে ব্যস্ত হচ্ছে , নির্ঝর যেন তত বেশী  ঘরকুনো হচ্ছে । এমনকি চিঠিপত্র আনতে বাড়ির নীচে কেয়ার টেকারের কাছে যাওয়া , টুক টাক  জিনিষ পত্র আনতে নীচের দোকানে যাওয়াও– প্রায়  বন্ধ করে দিয়েছে।
মুম্বাইতে ওরা প্রায় বছর দুয়েক হল এসেছে। একটা  শহরকে চেনার পক্ষে যথেষ্ট । কিন্তু নির্ঝরের কাছে পুরোটাই অচেনা আজও। কারন ওর তো যাওয়ার জায়গা সীমিত , প্রথম কয়েক মাস যেতে হত কলেজে , তারপর  থেকে তো সেটাও বন্ধ , শুধু বাড়ি আর বিছানা । 
মুম্বাই আসার মাস দশেক পরে  নির্ঝর জাপানে একটা কনফারেন্সের ডাক পায় । কীর্তিকার তখন ভরা মাস । ওকে একা ফেলে যাওয়াটা ঠিক কিনা ভাবছিল । ও কীর্তকা কে এ অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে চায়নি । কীর্তিকাই জোড় করে পাঠিয়েছিল কারন তার এখন যোগাযোগটা খুবই জরুরী , এই সুযোগ গুলোতে যোগাযোগ বারে , কারন সামনের বছর থেকেই তাকে কর্মজীবনে ঢুকতে হবে – তখন কাজে লাগবে। যদিও কীর্তিকা ওর ফ্লাইট ডিটেইলস , হোটেল , সবার কনটাক্ট জেনে নিয়েছিল ।তাছাড়া সেরকম কিছু হলে পাশের ফ্ল্যটের সোমা আছে , সেইই সব ব্যবস্থা করতে পারবে। চিন্তার কোনও কারন নেই । ক্যাবে করে বিমানবন্দরের দিকে রওনা দেওয়ার সময় কীর্তিকা হাত তুলে বিদায় জানিয়েছে। সেই সকালেও বিদায়ের মুহূর্তে তার এক হাত ছিল কীর্তিকার স্ফীত হওয়া পেটের ওপর। যেন সেটাও তার শরীরের স্বাভাবিক অংশ। ক্যাবে যেতে যেতে ভাবছিল কীর্তিকার আর ভবিষ্যত বাচ্চাদের কথা। তাদের আর ছোটো গাড়িতে হবেনা। বেশ বড় গাড়ী , ও যেন চালাচ্ছে , কীর্তিকা পেছনে বাচ্চাদের খেলনা সাপ্লাই দিচ্ছে। প্রায় সাঁয়ত্রিশ বছরেও ছাত্র থাকার কষ্টের বোঝাটা এর আগে আরো ভারী লাগতো পিতৃত্বের এ-রকমের কাল্পনিক দৃশ্যে। কিন্তু বর্ষার আগমনীতে আকাশের রঙ্গের নানান কায়দায় - সেই সকালেও ও  প্রথমবারের মতো সে-দৃশ্যকে স্বাগত জানাল। । সেই সকালে যেন সমস্ত গাছ তাকিয়ে আছে ওর দিকে – এক বিষ্ময়ের মধ্যে রেখে দিচ্ছে ওকে। 
দর্পণ শারদ সংখ্যা (অঙ্কন :  উষসী রায়)

কনফারেন্সের কর্মকর্তাদের একজন তাকে খুঁজে পেল কনফারেন্স চলাকালীন অবস্থায় । তাকে ওই এক কাগজে লেখা একটিমাত্র টেলিফোন নাম্বার দিল যেটা নির্ঝর বুঝলো হাসপাতালের। ও যখন মুম্বাই তে ফিরল - ততক্ষণে সবশেষ। মৃত শিশু জন্ম দিয়েছিল কীর্তিকা। 
হাসপাতালের বেডে শোয়া কীর্তিকা তখন ঘুমে অচেতন।  রুমটা ছোট ছিল খুব কাছেই কীর্তিকার পাশে দাঁড়াবার জায়গা ছিলনা । 
কীর্তিকার জরায়ুতে কোনও একটা সমস্যা থকায়  ডাক্তাররা  অপারেশনের করেছিলেন । কিন্তু দেরি হয়ে গেছিল। ডাক্তার নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে এক পেশাদারি হাসিতে জানাল , এমনটা অনেক সময় হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কীর্তিকা হাঁটতে পারবে। কিন্তু তার কথায় এমন কোনও ইঙ্গিত ছিল না যে, ভবিষ্যতে কীর্তিকা আর মা হতে পারবে না। 
এখন নির্ঝর বিছানা ছাড়ার আগেই কীর্তিকা বেরিয়ে যায়। চোখ খুলেই চোখে পরে বালিশের উপর কীর্তিকার লম্বা চুলের সারি । কল্পনায় দেখতে পায় -  সাজাগোজা কীর্তিকা শহরতলির এক অফিসে । এরই মধ্যে তিন কাপ কফি নিঃশেষ করেছে। টেক্সট বইয়ের এডিট করাই তার কাজ । শনাক্ত করে নানান রঙ্গে কমপিউটারে । ওর  গবেষণাপত্রটিও দেখে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কীর্তিকা। কাজের এই সুনির্দিষ্টতার কারণে কীর্তিকার  প্রতি এক ধরনের হিংসা অনুভব করত নির্ঝর। কারণ সে জানত যে সে এক মাঝারি মানের ছাত্র, তাই কৌতুহলের গণ্ডীটা ছিল বেশ বাঁধা। কিন্তু  হজম করার শক্তি প্রচুর । এখন কেমন যেন আলস্যতায় নিজেকে আঁকরে রাখে আর যতক্ষুন পারে নিজেকে বিছানাতে ধরে রাখাটাই প্রধান কাজ। 
নির্ঝর সবসময়ই কীর্তিকার খোলা রাখা আলমারি থেকে নিজের জামা কাপড় বের করে নেয় । এই মুহুর্তে সেগুলর প্রয়োজন খুব শিগগিরি নেই , কারন যে ভাবে এগোচ্ছে তাতে করে ওর আগামী বছরের শেষ দিক ছাড়া তেমন ভাবে কিছুই হবেনা । এই অলসতাই ওকে  মানাতে হবে – সাময়িক অবসাদ তো আছেই , ও সেটাকে এই ভাবেই কাটাতে চায় । থিসিস লেখা ও পাব্লিশ হওয়াটা  বড় কথা নয় , কর্মজীবনের সাথে যুক্ত হতে পারাটাই  ওকে  সব সময় হার্প করছে। তাই এখন আর কোনো কিছুতেই উৎসাহ পায়না নির্ঝর । এর বদলে সে যেন ভাবে কীভাবে এই তিন কামরার বাসায় সে আর কীর্তিকা পরস্পরকে এড়িয়ে চলতে শিখেছে। তারা যথাসম্ভব চেষ্টা করে আলাদা ঘরে  থাকার। সে ভাবে, এখন আর সে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করে না সাপ্তাহিক ছুটির দিনের জন্য। 
ছুটির দিনেও এখন কীর্তিকা – কমপিউটার নিয়ে বসে – নানা প্রুফ  রিডিঙের কাজ চলে ঘন্টার পর ঘন্টা। এক সময় নির্ঝর বেশ ভয় পেতো সেই সময় কোনও গান চালাতে । কারন কীর্তিকা নিতে পারতনা এই ডিসটারবেন্সটা । সে ভাবে , কতদিন আগে সর্বশেষ কীর্তিকা তার চোখের দিকে তাকিয়েছিল আর হেসেছিল। ঘুমানোর আগে এখনো তারা মাঝেমধ্যে মিলিত হয়। নির্ঝরের মনে নেই, এ-রকম মুহূর্তে সর্বশেষ কবে কীর্তিকা  ফিসফিসিয়ে তার নাম ধরে জড়িয়ে  ধরেছিল ।
প্রথমদিকে সে বিশ্বাস করত, এ-অবস্থার অবসান ঘটবে। এসব কাটিয়ে তারা আবার ফিরতে পারবে স্বাভাবিক সম্পর্কে। কীর্তিকার  বয়স মাত্র তেত্রিশ। আবার সে এখন ধকল কাটিয়ে উঠে বেশ শক্ত ভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে । কিন্তু সেটা ওর কাছে সান্তনা নয়। 
অবশেষে নির্ঝর যখন বিছানা ছাড়ল তখন লাঞ্চের সময়। বিছানা ছেড়ে সে সোজা গেল টি পটের  দিকে। কীর্তিকার রেখে যাওয়া বাড়তি চা টুকু  সে ঢেলে নেয় খালি মগে।
কিছু কিছু রান্না করা নির্ঝর শিখে নিয়েছে কীর্তিকার কাছ থেকে। ফ্রিজ থেকে মাংস বার করল । মাংস কে মাখল । ছুড়ি দিয়ে কেটে কুটে বেশ ভালো করে মাংসটা রান্নাও করে ফেলল । ও দুপুরেও খাবে আর থাকবে রাতের জন্য । এরই মাঝে কিছুটা বিশ্রামও করল । জানলা দিয়ে দেখছে ঘন বসতির ছায়া। কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়ার খেলা। পাশেই একটা বস্তী আছে । তবুও সন্ধ্যার দিকে আকাশ টাকে বেশ নরম লাগছে দেখতে । এখন বৃষ্টি নেই । রাত আটটার মধ্যেই মাংস টাকে আবার গরম করে রাখবে। কীর্তিকা এসেই পরল এর মধ্যে। আটটার আগেই খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে , নইলে তো আলো চলে যাবে , আসবে সেই রাত দশটার পরে । অত তাড়াহুড়োর কি আছে , আমরা তো মোমবাতিতেও খেতে পারি, চুল খুলতে খুলতে বলে উঠল কীর্তিকা। বাড়ী ফিরে ও সাধারনত চুল খোলাই রাখে। জুতো জোড়া খুলে সিঁড়ির দিকে ছুড়ে দিল । স্নান করতে গেলো আলো চলে যাওয়ার আগেই ।
নির্ঝর কীর্তিকার ব্যাগ ও জুতো জোড়া ঘরের কোনায় যেখানে অন্য জুতোও থাকে সেখানে সড়িয়ে রাখল । কীর্তিকা আগে এরকম ছিলোনা । বাড়ীতে এসেই জামা জুতো , অন্তর্বাস রাখত জায়গা মতন । যে-কোনো বিল আসার সঙ্গে সঙ্গে তাকে পেমেন্ট করার ব্যবস্থা করত ।কিন্তু আজকাল ওকে দেখলে মনে হয় ও যেন বেড়াতে এসেছে হোটেলে ।
মনে আছে এই ফ্ল্যাটে ঢোকার পরেই এই বাড়ীর কার্পেট নিয়ে কি অশান্তি , স্রেফ ম্যাচিঙের জন্য -- সেটা সেই ভাবেই পরে আছে , বারান্দার একটা নড়বড়ে চেয়ারের গায়ে খোলস লাগান নিয়ে কি ব্যস্ততা ছিল , সেই  খালি গায়ে সেটাও পরে আছে -  কোনও খেয়ালই নেই কীর্তিকারে ।
কীর্তিকা অবশ্য একটু এরকমই । ধরণটাই বেশ অবাক করার মতন। যদি কখনো তার কোনো স্কার্ট বা পার্স পছন্দ হয়ে যায় সে কেনে দুটো। নির্ঝরের  অবশ্য এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা পড়েছিলেন অকূল পাথারে। যে-দেশের বাড়ীতে ও বড় হয়েছে তা বিক্রি করে মাকে নিয়ে চলে আসতে হয়েছিল কলকাতায় ভাড়া বাড়ীতে । নির্ঝরকে ওই  বাড়ি বিক্রির টাকায়  পড়াশোনা, থাকা-খাওয়ার খরচ সব চালাতে হয়েছিল। 
কীর্তিকা তার নিজের মায়ের মতন অগোছালো নয়–সেটা নির্ঝরের একটা সোয়াস্তি। নির্ঝর বাহবা দিত কীর্তিকাকে ওর এই রকম সাংসারিক আগাম ভাবনার কায়দা দেখে। সারা মাসের রান্নার একটা চার্ট থাকত ওর কাছে ।সেই মতন বাজার করা ও সেই ভাবেই সব গুলোকে তারিখ লিখে গুছিয়ে রাখা । তাজ্জব হয়ে যেত ওর এই টেকনিকে।প্রতি শনিবার নির্ঝরকে নিয়ে বাজারে যাওয়া,একের পর এক জিনিষ কিনে আনা। আশ্চর্য নির্ঝর দেখত ওকে প্রায় সব দোকানদারই চিনে গেছে, ও গেলেই ওকে জিনিষ পত্র তুলে দিত ওর কিছু বলবার আগেই । নির্ঝর ছিল বাহক,ওর পেছন পেছন ঘুরত,আর বয়ে নিয়ে আসত। এত জিনিষ যে ও কিনত , কিন্তু এক ফোঁটাও নষ্ট হতোনা ।ওর রান্না করার কায়দাতে প্রচুর ভারাইটি ছিল ফলে সব জিনিষই কাজে  লাগত  পরিমান মতন। এছাড়া  ছিল ওর বন্ধু প্রীতি ও পার্টি ।বন্ধুরা বেড়াতে এলেই কীর্তিকা  খাওয়াত। তার আয়োজন চলত পুরো আধাবেলা জুড়ে। ফ্রিজে ও বোতলে রাখা নানান খাবার বেরিয়ে আসত তখন। ওটা ছিল ওর প্যাসন । 
রান্না করাটা এখন নির্ঝর উপভোগ করে। রান্না করে সে কাজের কাজ কিছু একটা করার অনুভূতি পায় যেন ।সে জানে, তার নিজের জন্য রান্না না করলে কীর্তিকা  শুধু কেলগস দুধ দিয়ে  খেয়েই ডিনার সেরে ফেলবে। রান্না করতে চাইবেনা । 
আলোবিহীন অবস্থাতেই আজকে ওদের কে ডিনার করতে হবে । অথচ  নিজেদের খাবারটা স্টোভ থেকে তুলে নিজেদের মতো খেয়ে মাসের পর মাস কাটিয়েছে তারা। নির্ঝর খাবার থালা  নিয়ে সোজা চলে যায় পড়ার টেবিলে। ডেস্কে রেখে অপেক্ষা করে ঠান্ডা হওয়ার জন্য। তারপর পটাপট মুখে তোলে। আর কীর্তিকা  নিয়ে যায় লিভিংরুমে। গেম শো দেখতে দেখতে কিংবা রঙিন পেনসিল হাতে  প্রুফ রিড করতে করতে সে ডিনার শেষ করে।
কোনও কোনও সন্ধ্যায় কীর্তিকা যায় নির্ঝরের সাথে দেখা করতে । নির্ঝর নিজেকে কনসেনট্রেট করে ওর থিসিসে লেখাতে,  কিছুক্ষণ দেখে কীর্তিকা মন্তব্য করে , খুব বেশি পরিশ্রম করো না। তারপর ও চলে যায় বিছানায়। সারাদিনে কেবল এটুকু সময়ই ও নির্ঝরের  খোঁজ নেয় । অথচ নির্ঝর বুঝতে পারে  কীর্তিকার  এ-খোঁজ নেওয়াটাও  যেন ইচ্ছের বিরুদ্ধে।  
কীর্তিকা নিজের পছন্দ  মতন ওদের গেস্ট রুম টাকে সাজিয়েছিল ওর ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে। কীর্তিকা কে  হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার আগেই নির্ঝর  ঘরটাকে পাল্টায় একেবারে অন্য রকম ভাবে। এখন এ রুমে  ঢুকলেই কীর্তিকার কেমন যেন ভয় ভয় করে। নির্ঝরের  অবশ্য তা করে না। কিছুদিন আগে থেকেই ওর বাইরের  কাজ বন্ধের পর সে পরিকল্পিতভাবে এ-রুমেই বসায় একটা পড়ার টেবিল। এর একটা কারণ ঘরটিতে ওর স্বাচ্ছন্দ্য আছে , অন্য কারণটা হলো কীর্তিকা ঘরটা এড়িয়ে চলে।
মুম্বাই আসার কিছুদিনের মধ্যেই ওদের প্রথম অতিথি কীর্তিকার মা। কলকাতা থেকেই এসে ছিলেন । মা থাকেন ওর ভাইয়ের কাছে। কীর্তিকা হাসপাতাল থেকে ফেরার পর দু-মাস তিনি ছিলেন। প্রতিরাতে ডিনার তৈরি, সুপার মার্কেটে যাওয়া, কাপড় ধোয়া – সব কাজ সে-সময় তিনিই করতেন। ধার্মিক ছিলেন। বন্ধুসুলভ না হয়েও নির্ঝরের  সঙ্গে নরম ব্যবহার করতেন। বাচ্চার প্রসঙ্গ তিনি একবারই তুলেছিলেন। বুননের কাজ থামিয়ে তিনি বলেছিলেন, তুমি তো সেই সময় তখন কীর্তিকার পাশে ছিলে না।
তখন ই কীর্তিকার জন্মদিনের সময় ওরা বেশ আনন্দ করেছিল । ওর মা-ই  রান্না করেছিলেন ওর জন্য বিশেষ খাবার । ওর মনে পড়ে এ-টেবিলে দুজনের সে দিনের ডিনার । 
কী ব্যাপার, এসব কী? কীর্তিকা পাশের ঘর থেকে চলে এল ।পাতলা সাদা একটি তোয়ালেতে তার চুল পেঁচানো। তোয়ালেটা খুলে চেয়ারে রাখে। ভেজা কালো চুল ছড়িয়ে পড়ে তার কাঁধে। স্টোভের দিকে আনমনে এগিয়ে যাওয়ার সময় তার আঙুলে জড়িয়ে থাকে চুলের জট। পরনে পরিচ্ছন্ন একটা সর্টস, গায়ে  টি-শার্ট । এখন তার পেট সমান, নিতম্ব শুরুর আগে সরু কোমর । 
প্রায় আটটা বাজে। ভাতের থালা টেবিলে রেখে গত রাতে মাইক্রোওয়েভে রাখা ডাল গরম করতে টাইমার ঠিক করে নির্ঝর । চকচকে লালমরিচের ঝোল দেখে কীর্তিকা  বলে ওঠে, তুমি তো রগান জোশ বানিয়ে ফেলেছ। নির্ঝর গরম এক টুকরো মাংসে দ্রুত  আঙুল চালিয়ে দেয়। চামচ দিয়ে আরেকটা বড় টুকরো তুলে নিশ্চিত হয় হাড় থেকে মাংস ছাড়ানোর মতো নরম হয়েছে কিনা। তারপর ঘোষণা করে, মাংস রেডি।
লাইট নিভে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বিপ করে ওঠে মাইক্রোওয়েভ। তারপরই থেমে যায় এর মিউজিক। চমৎকার টাইমিং, কীর্তিকা বলে ওঠে। ডিভানের পাশে রাখা মোমবাতিগুলো জ্বালাতে জ্বালাতে নির্ঝর বলে, জন্মদিনের মোমবাতিগুলোই খুঁজে পেয়েছি। বাদবাকির কোনও খোঁজ নেই।
খাওয়ার টেবিলে বেশ গুছিয়ে বসল কীর্তিকা, মনে পড়ল যেন কলকাতায় আছে। বলল, এক সময় কলকাতায় এরকম প্রায়ই লোডশেডিং হত , বেশ কয়েক ঘন্টার , মাঝে মাঝে আগে জানিয়ে দিত । ওর মনে পড়ল একবার এক অন্নপ্রাশনের বাড়িতে গিয়ে সেই লোডশেডিং এর মধ্যে পরেছিল । যে-শিশুর মুখে ভাত দেওয়া হবে গরমে নাজেহাল বেচারা শুধুই কাঁদছিল। যা গরম পড়েছিল সেদিন। কিন্তু খাওয়া দাওয়া সবই চলেছিল তারই মধ্যে,কেবল কিছু হ্যাজাকের সাহায্যে।  দারুন অভিজ্ঞতা । 
নির্ঝর  ভাবে, তাদের বাচ্চা কখনো কাঁদেনি। তাদের বাচ্চার অন্নপ্রাসন উৎসবও হয়নি। কীর্তিকা কিন্তু অন্নপ্রাসন উৎসবে কাদের নিমন্ত্রণ করবে তার একটা তালিকাও করে রেখেছিল।
খাবার কি খুব গরম? নির্ঝর  কীর্তিকার  কাছে জানতে চায়। মোমদানিটাকে একটু সড়িয়ে দিল ছায়া পরছিল বলে । স্তুপ  করা বইপত্র আর চিঠিপত্রের দেয়ালে আলো আটকে যাওয়ায় দুজনের চাওয়া-চাওয়ি আরো কঠিন হয়ে পড়ে। পাশের ঘরে  গিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসতে না-পারায় নির্ঝরের  মেজাজটা একটু তেতে যায় । 
দর্পণ শারদ সংখ্যা (অঙ্কন :  উষসী রায়)

খেতে বেশ লাগছে, কীর্তিকা উত্তর দেয়। হাত চেটে বলে , সত্যিই সুস্বাদু।
আগে ওদের এরকম দেখা যেতনা । কীর্তিকা আগ্রহ নিয়ে শুনবে এমন কিছু বলতে এখন নির্ঝরকে রীতিমতো লড়াই করতে হয়– এমন কিছু কথা যা শুনে সে খাবার প্লেট রেখে  অথবা প্রুফ রিডিং ফাইল থেকে চোখ তুলে তাকাবে ভাবতে বেশ কষ্ট হয় এখন।  আসলে আনন্দদায়ক কিছু করার চেষ্টাই নির্ঝর ছেড়ে দিয়েছে।
কীর্তিকা গম্ভীর ভাবে বলে ওঠে,আমার মনে পড়ছে, মামাবাড়িতে,আলো না থাকলে আমাদের সবাইকে কিছু না কিছু বলতে হতো। নির্ঝর  চেষ্টা করেও তার মুখ দেখতে পায় না। কিন্তু কথা বলার ভঙ্গিতে সে অনুমান করছে শব্দ উচ্চারণের সময় কীর্তিকার চোখ ছোট হয়ে আসছে। যেন অনেক দূরের কোনোকিছুতে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। এটা তার অভ্যাস।
সেটা কেমন? আমি জানি না। ছোট কোনো চুটকি। পৃথিবীর বাস্তবতায় অকপট কোনো সত্যকথন। যে যে ভাবে বলতে পারে। তবে কোনও ভেবে বলার সুযোগ থাকেনা, যেহেতু অকপট তাই স্বতস্ফুর্ত্তাকে জোড় দেওয়া হয়। 
নির্ঝরের অবশ্য এরকম কোনও অভিজ্ঞতা নেই ওর জীবনে , কারন ওর জীবনটাই কেটেছে শুধু সংগ্রাম  আর কিভাবে  জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় , কাজেই এগুলো ওর কাছে ছিল বিলাসিতা । ওর ছোটো বেলাটা একটু অন্য রকম ভাবেই কেটেছে,আর পাঁচটা সাধারন বাচ্চাদের মতন নয়।
এসো আমরাও সে-রকম করি, হঠাৎ কীর্তিকা  বলে ওঠে।
কী করব?
এই অন্ধকারে পরস্পরকে কিছু বলা।
কী বলব? আমি চুটকি-ফুটকি কিছু জানি না।
না, না, কোনো চুটকি না। মিনিটখানেক ভেবে কীর্তিকা  বলল, আগে বলিনি বা বলব বলে ভাবিনি এমন কিছু যদি পরস্পরকে জানাই, কেমন হয়।
কলেজের প্রথম দিকে  ছাত্রাবস্থায় মাতাল হলে আমি এরকম খেলায় অংশ নিতাম, নির্ঝর  মন্তব্য করে।
তুমি সত্যি কথা বলার সাহসিকতার সঙ্গে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলছ। ব্যাপারটা তা নয়।
 ঠিক আছে, আমিই শুরু করছি। একটু জল গলায় ঢেলে কীর্তিকা বলল, তোমার সেই আগের  অ্যাপার্টমেন্টে প্রথম একা হওয়ার সুযোগ পেয়েই আমি তোমার অ্যাড্রেস বুক ঘেঁটেছিলাম। ভেবেছিলাম, তুমি আমার ঠিকানা লিখে রেখেছ। যতদূর মনে পড়ে ওটা আমাদের পরিচয়ের দু-সপ্তাহ পরের ঘটনা।’
তখন আমি কোথায় ছিলাম?
টেলিফোন ধরতে অন্য ঘরে গিয়েছিলে। তোমার মায়ের ফোন ছিল। বুঝতে পেরেছিলাম কলটা লং ডিস্ট্যান্সের। 
ঠিকানা ঘেঁটে আমি বুঝতে চেয়েছিলাম তুমি আমাকে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছ।
তা কি বুঝলে ?
না, তবে তখনো আমি তোমার ব্যাপারে হাল ছাড়িনি। এবার তোমার বলার পালা।
নির্ঝর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। অথচ কীর্তিকা প্রতীক্ষা করছে। বিগত মাসগুলোতে কোনো ব্যাপারেই এতোটা প্রত্যয়ী ভাব কীর্তিকার মধ্যে আর দেখা যায়নি। নির্ঝরের তাকে কিই বা বলার আছে? প্রথম দেখা হওয়ার কথা মনে পড়ল তার। এক সাহিত্য সভায় । যেখানে  কবিরা সব কবিতা আবৃত্তি করছিল। কাঠের ফোল্ডিং চেয়ারে তারা পাশাপাশি বসা। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্ঝরের  বিরক্ত বোধ হল। । কবিতার মর্মকথা সে কিছুতেই ধরতে পারছিল না। ফলে অন্য দর্শকরা যেমন আবৃত্তির সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে বা কোনো আবৃত্তাংশ শুনে আবেগে মাথা নুইয়ে ফেলছে, সে-রকমটা তার হচ্ছে না। কোলে থাকা সংবাদপত্রে ছাপা বিভিন্ন শহরের তাপমাত্রার ওপর সে চোখ বুলায়। গতকাল শ্রীনিকেতনে  চল্লিশ ডিগ্রী , পাটনাতে  - ৪৭ ডিগ্রী এই সব আর কি । মাথা ঘুরিয়ে বাঁয়ে তাকিয়ে সে অবাক হলো। পাশে বসা সুন্দরী মেয়েটা ফোল্ডারের পেছনে মুদির দোকানের খরচের তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত।  বেশ, স্মৃতি ঘেঁটে নির্ঝর বলতে শুরু করল। পার্ক স্ট্রীট  এলাকায় একসঙ্গে আমাদের প্রথম ডিনার সারার পর আমাকে ওরা ভুল করে বেশী টাকা ফেরত দিয়ে দেয় , আমি  ফেরত দিতে ভুলে যাই । মনে আছে আমার সাথে দেখা হয়েছিল আমারই এক পুরানো বান্ধবীর ,আমরা এক সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি । অনেক্ষুণ কথাও হয়েছিল  দেওয়ালের কোণায় দাঁড়িয়ে । পরের দিন আবার বিকালে আমি টাকা টা ফেরত দিতে যাই । 
শুধু টাকাটা  ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্যেই  তুমি যাদবপুর থেকে পার্ক স্ট্রীট গেলে – এতটা পথ গেলে ক্যাব ভাড়া করে ।
বেড়িয়েই তো দিতে পারতে , তুমি ভুলে গিয়েছিলে কেন?’এতদিন বাদে বান্ধবীর সাথে দেখা হওয়ার সুখ স্মৃতিতে নয়তো । 
জন্মদিনের মোমবাতিগুলো নিঃশেষ হয়ে গেছে। কীর্তিকার  মুখাবয়ব তারপরও নির্ঝরের কাছে স্পষ্ট – প্রশস্ত জ্বলজ্বলে চোখ, তবে কেমন যেন কঠিন লাগছিল ।ও সুন্দর খুবই । এক সময় নির্ঝর বলত যে তোমার সৌন্দর্যের কাছে কসমেটিকস গুলো বড়ই বাড়াবাড়ি।  এই সৌন্দর্যই একদিন তাকে আকর্ষন করেছিল। তবে এখন নয় , মোটামুটি এখন সেই আদলে দাঁড় করাতে কসমেটিক্স অপরিহার্য।
সেদিনের ডিনারের পর নির্ঝর একধরনের মজা অনুভব করেছিল। মনে হচ্ছিল, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারি । প্রথমবারের মতো নির্ঝর  এ-ঘটনা নিজের কাছে, একই সঙ্গে কীর্তিকার সামনে প্রকাশ করল। সে বলল, এ-অনুভূতির কারণে হয়তো আমি ভুলে গিয়েছিলাম টাকাটা ফেরত দিতে । 
কীর্তিকা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল । 
পরের রাতে কীর্তিকা ফিরল একটু আগে। সন্ধ্যায় করা মাছের ঝোল রয়েই গেছে। নির্ঝর সেটাকে গরম করেছে এমন ভাবে যাতে রাতে আটটার মধ্যে  খাওয়া যায় । ডিনারের পর কীর্তিকা তার খাবারের থালার  ওপর নির্ঝরের  থালা  রেখে নিয়ে যায় সিঙ্কে। নির্ঝর একটু  বিস্মিত হয়। তার ধারণা ছিল, ডিনার শেষে কীর্তিকা  চলে যাবে পাশের ঘরে  আর ব্যস্ত হয়ে পড়বে প্রুফ রিডিংয়ের ফাইল নিয়ে।
থালা  নিয়ে ভেবনা, কীর্তিকার  হাত থেকে সেগুলো নিতে নিতে নির্ঝর  বলে।
স্পঞ্জে সামান্য ডিটারজেন্ট ফেলে কীর্তিকা উত্তর দেয়, না ভাবাটা ঠিক হবে না। প্রায় আটটা বাজে।
নির্ঝরের  হৃৎস্পন্দন বাড়ে। সারাদিন ধরে সে অপেক্ষা করছে কখন আলো যাবে। গত রাতে কীর্তিকা  ঠিকানা দেখা নিয়ে যা বলেছে তা নিয়ে ভেবেছে সে। সে-সময়েরর কীর্তিকা সম্পর্কে ভাবতেই তার ভালো লাগছিল। প্রথম দেখার সময় কত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অথচ নার্ভাস, একইসঙ্গে আশাবাদী মনে হয়েছিল কীর্তিকাকে। সিঙ্কের সামনে তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। যেন জানালার ফ্রেম ধরে রেখেছে মুহূর্তটা।  নির্ঝর  লজ্জা পায়। আয়নার সামনে প্রথম যেদিন তারা দুজনে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছিল সেদিনও এরকম লজ্জা পেয়েছিল সে। শেষ কবে একসঙ্গে ছবি তুলেছে, তার মনে নেই। পার্টিতে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। কোথাও এখন তারা একসঙ্গে যায় না। অন্তঃস্বত্বা অবস্থায় আগের বাড়ির  ব্যালকনিতে তোলা কীর্তিকার  ছবিটা এখনো আছে ।
থালা ধোওয়া  শেষ করার পর খানিকটা মাথা নুইয়ে কাউন্টারে রাখা তোয়ালেতে হাত  মুছল দুজনে। ঠিক আটটার সময় আঁধার নেমে এলো। নির্ঝর  জ্বালালো মোমবাতি। 
বাইরেই বসি। আমার মনে হয় সন্ধের এখনো ঢের বাকি, কীর্তিকা প্রস্তাব দিলো।
দুজনের হাতে মোমবাতি। সিঁড়িতে বসল তারা। বাইরে তখনো তেমন ভাবে অন্ধকার আসেনি। মুম্বাই তে সাধারনত সন্ধ্যা একটু দেরীতে হয় । অনেকেই বেড়াতে বেড়িয়েছে। পাশের প্রতিবেশী  কেলকাররা স্বামী স্ত্রীতে বেড়িয়ে পড়ল , হয়ত সিনামাতে যাবে। ওদেরও বলল যাবে নাকি । ওরা যেতে রাজী হলোনা । 
অন্ধকারে কীর্তিকা আজ  কী বলতে পারে ভেবে নির্ঝর রোমাঞ্চিত হচ্ছে। সবচেয়ে কঠিন কী বলতে পারে সে মোটামুটি ভেবে রেখেছে।  কীর্তিকা হয়তো বলবে তার আরেকটা সম্পর্ক রয়েছে। সাঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও ছাত্র নির্ঝরের  প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধা বোধ নেই। শাশুড়ির সেই  দুর্ঘটনার সময় কলকাতার বাইরে  থাকার জন্য হয়তো তাকে দুষবে কীর্তিকা।  তবে নির্ঝর  জানে বাস্তবে এসবের কিছুই ঘটবে না। কীর্তিকা কখনো প্রতারণা করবে না, অবিশ্বাসী হবে না। যা তার ক্ষেত্রেও সত্য। কীর্তিকা তাকে বিশ্বাস করে। সে-ই তাকে সেসময় কলকাতার বাইরে ওই সেমিনারে যেতে  উৎসাহিত করেছিল। তারা পরস্পরের  সম্বন্ধে সব জানে না কি ?
দর্পণ শারদ সংখ্যা (অঙ্কন :  উষসী রায়)

ঘুমানোর সময় আঙুল বাঁকিয়ে শক্ত করে রাখে কীর্তিকা, সে তা জানে। ঘুমের মধ্যে দাঁত কিড়মিড় করা কীর্তিকার একটা অভ্যাস , আরো জানে, দুঃস্বপ্ন দেখলে ঘুমের ঘোরেই তার শরীর মুচড়ে ওঠে , পাশের লোককে জড়িয়ে ধরে । সে জানে, মুড়ি দিয়ে , চানাচুর দিয়ে , সাথে লংকা মেখে বেশ ঝাল ঝাল ও খেতে ভাল বাসে ।  হাসপাতাল থেকে ফিরে বাসায় ঢুকেই শেলফ থেকে বই, দেয়াল থেকে পেইন্টিং, টেবিল থেকে ফটো, দেওয়ালে টাঙ্গানো কিছু জামা কাপড় সরিয়ে হলঘরে চালান করল । নির্ঝর সরে গিয়েছিল সামনে থেকে। সে দেখছিল, কীর্তিকা ভীষণ হিসাব করে একঘর থেকে অন্যঘরে যাচ্ছে। একসময় জমা করা জিনিসের স্তুপের সামনে দাঁড়িয়ে  যেন একটা সন্তুষ্টি বোধ করে কীর্তিকা। ঠোঁট ওলটানো কীর্তিকাকে দেখে মনে হয় বিস্বাদে ভরা মুখ থেকে থুথু বেরিয়ে আসবে এক্ষুনি। এমন অবস্থায় কাঁদতে শুরু করে সে।
সিঁড়িতে বসে নির্ঝরের বেশ ভাল লাগছে। প্রথম কথাটা কীর্তিকার  মুখ থেকেই বেরোনো দরকার। তাহলে সেও কথা বলতে পারবে । অবশেষে কীর্তিকা বলল, তোমার মা এখানে যখন বেড়াতে এসেছিল, অফিস থেকে ফিরতে দেরি হবে বলে আমি জানিয়েছিলাম। সেদিন আসলে আমি একটা অফিস পার্টিতে গিয়েছিলাম।।
কীর্তিকার দিকে সে তাকায়। সরু নাক, চোয়াল অনেকটা পুরুষালি। তার মনে পড়ে যায় সে-রাতের কথা। পরপর দুটো ক্লাস নিয়ে ফিরে নির্ঝর ক্লান্ত অবস্থায় মায়ের সঙ্গে খেতে বসেছিল। ভেবেছিল শোভা থাকবে এবং কথাবার্তা দিয়ে মাতিয়ে রাখবে খাবার টেবিল। সে এ-কাজে আনাড়ি। বারো বছর আগে তার বাবা মারা গিয়েছে। তিনি এসেছিলেন তাদের সঙ্গে দু-সপ্তাহ থাকতে। সবাই মিলে বাবার স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল সে-সময়। প্রতি রাতেই বাবার পছন্দের কোনো তরকারি রান্না করতেন মা। কিন্তু এতো মন খারাপ থাকত যে, সেই তরকারি মুখেই তুলতে পারতেন না তিনি। বিষণ্ণ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে কীর্তিকা তার হাত ধরত এবং সহানুভূতি প্রকাশ করে বলত, বিষয়টি খুবই মর্মস্পর্শী। 
এখন সে স্পষ্ট দেখছে কীর্তিকা ও স্নেহাংশ  বারের এক কোণে  সোফায় বসে। স্নেহাংশ  সিগারেট অফার করছে। সিনেমা দেখে এই বারে যেত সে আর কীর্তিকা। সে কল্পনা করে, হয় তার ব্যাপারে কীর্তিকা অনুযোগ করছে স্নেহাংশের কাছে , স্নেহাংশ ওর বেশ ক্লোজড, আর ওর বসও বটে, এই স্নেহাংশই তাকে মাঝে মাঝেই অফিস থেকে গাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেয় । 
‘তোমার পালা’, নির্ঝরের   কল্পনার রথ থামিয়ে কীর্তিকা বলে।
রাস্তা থেকে নানা মেশিনের  শব্দ কানে বাজছে। সে সঙ্গে ইলেকট্রিশিয়ানদের চিৎকার। রাস্তা বরাবর এক লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর অন্ধকার মুখ দেখছে সে। এক বাড়ির জানালায় মোমবাতির আলো। এই উষ্ণ আবহাওয়ায়ও বাড়ির চিমনি থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সেমিস্টারে আমি একটা অসদুপায় অবলম্বন করেছিলাম , একটা ইকনোমেট্রিক্সের – প্রশ্ন , যেটা কিছুতেই ধরতে পারছিলামনা , পাশের ছেলেটার কাছ থেকে আমি দেখে নেই , ওটা না করলে আমার ফার্শট ক্লাসটা হতোনা । আসলে  এর কয়েক মাস আগে বাবা মারা গিয়েছিল , প্রিপারেশনটা তেমন ভাবে করতে পারিনি । 
পনেরো বছরের বেশি সময় আগের ঘটনা। কীর্তিকাকে  বলতে পেরে সে হালকা বোধ করছে।
কীর্তিকা তার দিকে তাকাল। মুখের দিকে নয়, তার জামার দিকে , বেশ  পুরনো একটা জামা কিন্তু ও এখনও ব্যবহার করে চলেছে । যা বলল তাতে কি কীর্তিকা  বিব্রত বোধ করছে, নির্ঝর ভাবে।  কীর্তিকা তার হাত টেনে নিয়ে চাপ দেয়। তার কাছে সরে আসতে আসতে সে বলে, কেন করেছিলে তা আমাকে বলার দরকার নেই।
প্রায় সারে নটা থেকে দশটা পর্যন্ত তারা এই ভাবে বসে থাকে ।  বিদ্যুৎ এলে রাস্তার অপর পারের বাড়ির বারান্দা থেকে হাততালির শব্দ আসে। টেলিভিশন অন হওয়ারও শব্দ বোঝা যায়। । এরপর উঠে দাঁড়ায় এবং ভেতরে যায়। তখনো কীর্তিকা নির্ঝরের  হাত ধরে থাকে।
ব্যাপারটা নিঃশব্দে এরকম রূপই নেয় শেষ পর্যন্ত। অনুশোচনা, ছোটখাটো কষ্ট অথবা পরস্পরের অজানা হতাশাগুলোর বিনিময়। এরপর কী বলবে তা নিয়ে পরদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাবে নির্ঝর। নির্ঝর নিয়মিত নানান ফ্যাসন ম্যাগাজিনের এক এক  মডেলের ছবি ছিঁড়ে সপ্তাহখানেক বইয়ের মধ্যে রেখে দিত। তাদের বিবাহবার্ষিকীতে কীর্তিকার উপহার দেওয়া টাই টা যে সে হারিয়ে ফেলেনি , বেচে দিয়েছিল , পয়সার অভাবে ,বন্ধুদের সাথে মদ খাওয়ার জন্য । প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে কীর্তিকা তার জন্য রাতে রান্না করেছিল দশ পদের তরকারি – ও মাতাল হয়ে ফিরাছিল । কিছুই খেতে পারেনি  । সে তুলনায় এ বিবাহবার্ষিকীতে শুধু টাই পেয়ে ওর দুঃখ পেয়েছিল ।  এই ঘটনা গুলোর  কোনটা আজ বলবে তা নিয়ে দ্বন্দ্বে ভোগে নির্ঝর।
মডেলদের  ছবি কেন রেখেছিল তার উত্তর সে জানে না। সেই মডেল কীর্তিকার  মতো সুন্দরী নয়। পরনে ছিল নানান ফ্যাসনের পোষাক , চেহারা শক্ত এবং গড়নে কিছুটা যৌন উত্তেজনা । ড্রেসের  বিজ্ঞাপন ছিল এটি। শোভার পেটে তখন বাচ্চা। হঠাৎ করে বেশ ফুলে উঠেছে তার পেট। এ-অবস্থায় নির্ঝর  আর তাকে ছুঁতে চায় না। বিছানায় শুতে যাবার আগে ওই ছবিগুলো ও দেখত নিয়ম করে । মডেল গুলোর প্রতি  প্রচন্ড  কাম বোধ হত সেই সময় ।  এক বা দু-মিনিট পরেই এই কামনা বিরক্তিতে পরিণত হতো। কীর্তিকার  প্রতি তার অবিশ্বাসী হওয়া এটুকুই।
তৃতীয় রাতে সে কীর্তিকাকে টাই  বিক্রির ঘটনাটা বলে। চতুর্থ রাতে ছবিটার কথা। এসব শুনতে গিয়ে কীর্তিকা প্রতিবাদ বা ক্ষোভ কিছুই প্রকাশ করেনি। শুধু শুনে গেছে। তারপর হাতটা টেনে নিয়ে আগের রাতের মতো চাপ দিয়েছে। 
তৃতীয় রাতে কীর্তিকা  বলেছে, একবার নির্ঝরের  বিশ্ববিদ্যালয়ের  ডিপার্টমেন্টাল হেডের  সঙ্গে দেখা করার সময়  নির্ঝরের জামার মাঝের বোতামগুলো খোলা ছিল বিশ্রী ভাবে – নির্ঝর খেয়াল করেনি – কীর্তিকা দেখেও কিছু বলেনি। কারণ, কোনো একটা বিষয়ে সে তখন মহাবিরক্ত ছিল নির্ঝরের উপর, যদিও  চেয়ারম্যানের সঙ্গে নির্ঝর পরবর্তী সেমেস্টারে ফেলোশিপ পাওয়ার উপায় নিয়ে আলাপ করতে গিয়েছিল। কীর্তিকা নির্লিপ্ত ছিল –ওর উন্নতির কথা সাফল্যের কথা একটুও ভাবেনি ।
 চতুর্থ রাতে কীর্তিকা  বলেছে, সারাজীবনে নির্ঝরের লেখা একমাত্র প্রকাশিত কবিতাটা তার ভালো লাগেনি। সাহিত্য পত্রিকাতে  প্রকাশিত কবিতাটা নির্ঝর লিখেছিল কীর্তিকার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের পর। কীর্তিকার  মতে, কবিতাটি আবেগের আতিশয্যের কারণে কবিতা হয়ে ওঠেনি।
বাড়ীতে আলো না থাকা মানেই কিছু ঘটনা । কীর্তিকা ও নির্ঝর  আবার নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করতে পেরেছে। তৃতীয় রাতে খাওয়ার পর দুজনে সোফায় বসে। বিদ্যুৎ চলে গেলে নির্ঝর কীর্তিকার  কপালে, গালে চুমু খেতে শুরু করে। অন্ধকার সত্ত্বেও তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল। সে জানে, কীর্তিকাও চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। চতুর্থ রাতে তারা ওপরতলার বিছানায় যায় একসঙ্গে। বিছানায় শরীর এলানোর ঠিক আগের পদক্ষেপেই তারা একাত্মতা অনুভব করে। তারপর ভুলতে বসা উন্মত্ততায় মিলিত হয়। নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে কীর্তিকা । ফিসফিসিয়ে নির্ঝরের  নাম নেয় আর আঙুল দিয়ে খুঁজে ফেরে তার নিম্নদেশ। ভালোবাসতে বাসতে নির্ঝর ভাবে পরের রাতে কী বলবে, কীর্তিকাই  বা তাকে কী শোনাবে। এই ভাবনায় শিহরণ অনুভব করে সে। আমাকে ধরো, নির্ঝর  ফিসফিসিয়ে বলে, আমাকে জড়িয়ে থাকো। যখন বিদ্যুৎ এলো, গভীর ঘুমে অচেতন দুজনে।
পঞ্চম রাতের সকালবেলা জানা গেল যে ওদের কাজ প্রায় সম্পুর্ণ , হয়ত কাল থেকেই আলোর সমস্যা মিটে যাবে। নিয়মিত হয়ে যাবে। হতাশ হলো নির্ঝর ,কীর্তিকার জন্য আজ সে চিংড়ির মালাই কারী  রাঁধার পরিকল্পনা করেছে। 
এই আলোর অভাবটা আর ওদের কাছাকাছি সময় কাটানোটাকে নির্ঝর কেমন যেন ভালোবাসতে আরম্ভ করছিল , ওদের কে যেন ওরা আবার নতুন করে দেখতে পাচ্ছিল । সেই দেখার আলো কৃত্রিম আলোর উপস্থিতিতে বন্ধ হয়ে যাবে - ঠিক  যেন মানতে পারছিলনা নির্ঝর ।
কীর্তিকা ফিরল সাড়ে সাতটায়। আলোর কথা বলল কীর্তিকা কে , বলে উঠল, মনে হচ্ছে, আমাদর খেলা আজ এখানেই শেষ।
তুমি চাইলে এখনো মোমবাতি জ্বালাতে পারো, কীর্তিকা বলল। আজ রাতে কীর্তিকা জিমে যায়নি। নতুন একটা চুড়িদার পরেছে, সম্প্রতি তার মেকআপেও পরিবর্তন এসেছে।
কাপড় পাল্টে কীর্তিকা ওপরে গেলে নির্ঝর  নিজের জন্য কিছুটা ওয়াইন ঢালে। তারপর চালু করে কীর্তিকার প্রিয় রবীন্দ্র সংগীতের অ্যালবামটা।
কীর্তিকা নেমে আসার পর দুজনে একসঙ্গে ডিনার সারে। রান্নার জন্য কোনো ধন্যবাদ বা সৌজন্যমূলক কোনো কথাবার্তা বলল না কীর্তিকা। মোমের আলোয় আধো আঁধারে নীরবে ডিনার শেষ করে। একেকদিন এ-মুহূর্তটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। চিংড়ি সাবাড় করে দুজনে এক বোতল ওয়াইন পান করে ফেলে। তারপর খোলে দ্বিতীয় বোতলটা। মোমবাতিটা প্রায় নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত দুজনে একসঙ্গে বসে থাকে। তারপর কীর্তিকা বসে চেয়ারে। নির্ঝর ভাবে, হয়তো কিছু বলতে চাইছে কীর্তিকা। তার বদলে সে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় মোমবাতিটা। তারপর লাইট অন করে বসে পড়ে।
আমরা কি লাইট অফ রাখতে পারি না? নির্ঝর জানতে চায়।
গ্লাসটা সরিয়ে বেশ জাঁকিয়ে টেবিলে বসে চেয়ারের পিছনে  হাত রাখে কীর্তিকা। তারপর শান্তভাবে বলে, আমি চাই, এখন যা বলব তা শোনার সময় যেন আমার মুখ দেখতে পাও তুমি।
নির্ঝরের  হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। তার মনে পড়ে, একই ভঙ্গিতে একই উচ্চারণে কীর্তিকা তাকে দিয়েছিল পেটে বাচ্চা আসার খবর। নির্ঝর তখন টিভিতে ফুটবল খেলা দেখছিল। টিভিটা বন্ধ করে খবরটা দেয় কীর্তিকা। তখন তা শোনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তবে আজ সে প্রস্তুত। কীর্তিকার পেটে বাচ্চা আসুক এখন তা সে চায়নি মোটেই সেই সময় । সুখী হওয়ার অভিনয়ও আর সে করতে চায় না।
আমি একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছিলাম এখানেই , পেয়ে গেছি, মনে হচ্ছে নির্ঝরের  ডান কাঁধের পেছনে থাকা কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে দু-চোখ কুঁচকে কথাগুলো বলছে কীর্তিকা।
 সে বলতে থাকে, ভুলটা দুজনের কারোরই নয়। সম্পর্ক যথেষ্ট গড়িয়েছে। এখন একা থাকার জন্য তার কিছুটা সময় দরকার। কিছু ডিপোজিট তার আছে । অ্যাপার্টমেন্টটা একটু ভিতরের দিকে । অফিসের কাছে হওয়ায় সে হেঁটেই যাতায়াত করতে পারবে। আজ রাতে বাড়ি ফেরার আগে সে লিজের কাগজে স্বাক্ষর করে এসেছে।
কীর্তিকা নির্ঝরের  দিকে তাকায় না। কিন্তু নির্ঝর তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে। কথাগুলো বলার আগে কীর্তিকা অনেকবার  রিহার্সেল দিয়েছে – এ-ব্যাপারে নির্ঝর নিশ্চিত। আর এরই ফাঁকে অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজেছে, বাসায় বাসায় ট্যাপ খুলে জলের চাপ পরীক্ষা করেছে। ভাড়ার মধ্যে গরম ও ঠান্ডা দু-ধরনের জল সরবরাহের খরচ ধরা হয়েছে কিনা রিয়েলটারের কাছে তা জানতে চেয়েছে। এগুলো কিন্তু করেছে কীর্তিকা পরিকল্পনা মাফিক । 
কাজেই গত কয়েকদিনে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সন্ধ্যা কাটানোর সময়ই সে তাকে ছাড়া যে জীবনযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল – এটা বোঝার পর নির্ঝরের মনে বিতৃষ্ণা ভর করে। কীর্তিকার কথা তাকে স্বস্তি  দিয়েছে। আবার একই সঙ্গে মনটা তেতেও উঠেছে। তাহলে গত চার সন্ধ্যা ধরে এ-কথাই তাকে বলতে চেয়েছে কীর্তিকা। খেলা চালানোর উদ্দেশ্য তাহলে এই।
দর্পণ শারদ সংখ্যা (অঙ্কন :  উষসী রায়)

এবার নির্ঝরের বলার পালা । সে প্রতিজ্ঞা করেছিল বিষয়টা কীর্তিকাকে কোনোদিন জানাবে না। মন থেকে বিষয়টা যেন বেরিয়ে না আসে সে-ব্যাপারে সতর্ক ছিল সে। আলট্রাসাউন্ড করার আগে কীর্তিকা ডাক্তারকে বলেছিল সন্তানের লৈঙ্গিক পরিচয় ফাঁস না করতে। নির্ঝরেরও  সম্মতি ছিল তাতে। কীর্তিকা সারপ্রাইজ হিসেবেই দেখতে চেয়েছিল বিষয়টিকে।
তারপর সামান্য যে-কয়বার বিষয়টা নিয়ে কথা হয়েছে, কীর্তিকা বলেছে, অন্তত এ-বিষয়টা আমরা জানি না। বলার ধরনটা দেখে নির্ঝরের মনে হয়েছে সে তার সিদ্ধান্তের কারণে গর্ববোধ করে। আসলে বাচ্চার লৈঙ্গিক পরিচয়ের মধ্যে থাকা রহস্যের মধ্যে সে ভুলতে চায় বাচ্চা হারানোর দুঃখ। নির্ঝর  জানে, কীর্তিকার ধারণা তার কাছেও ব্যাপারটা সমান রহস্যময়। 
সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর সে ফিরেছিল কনফারেন্স থেকে । কীর্তিকা তখন হাসপাতালে। কিন্তু নির্ঝর তো সুস্থ। শেষকৃত্যের আগে বাচ্চাটিকে একনজর দেখার মতো পর্যাপ্ত সময় সে পেয়েছিল। কীর্তিকার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানাতে প্রথমে বাচ্চাটিকে দেখতে চায়নি ও। কিন্তু ডাক্তারের নির্দেশে ও বাচ্চাকে ধরল। কীর্তিকা ঘুমে অচেতন। বাচ্চার শরীর পরিষ্কার করা হয়েছে কিন্তু  পৃথিবীর আলো দেখা বারন  বলেই  যেন শিশুটির চোখের পাতা শক্ত করে বন্ধ। 
নির্ঝর  বলে, আমাদের ছেলে হয়েছিল। খুব সুন্দর চেহারার। বেশ ফর্সা ছিল গায়ের রঙ্গ। মাথায় কালো চুল। ওজন ছিল প্রায় পাঁচ পাউন্ড। রাতে ঘুমানোর সময় তোমার আঙুল যেমন কুন্ডলী পাকানো থাকে, তেমনি পাকানো ছিল বাচ্চার আঙুল। তোমার যে আর মা হওয়ার সম্ভাবনা নেই তাও আমি জেনেছি ডাক্তারের কাছে থেকে। 
কীর্তিকা এখন তাকিয়ে আছে  তার দিকে। কীর্তিকার মুখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। 
কলেজের এক পরীক্ষায় সে  নকল করেছে, ম্যাগাজিন থেকে ছিঁড়ে রেখেছে এক মডেলের ছবি, টাই বেচার টাকায়  মদ খেয়ে ভরদুপুরে মাতলামো করেছে। এসব কাহিনি সে কীর্তিকাকে বলেছে। সে তার ছেলেকে কোলে নিয়েছিল। মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যে ছেলের শরীরে স্পন্দন ছিল। হাসপাতালের অজানা এক অন্ধকার ঘরে সে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকে নার্স বাচ্চাটিকে নিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নির্ঝর জড়িয়ে রেখেছিল তাকে। কীর্তিকাকে ঘটনাটা জানাবে না বলে সেদিনই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল। কারণ তখনো কীর্তিকাকে ভালোবাসত সে। তাছাড়া কীর্তিকা বিষয়টাকে ‘সারপ্রাইজ’ হিসেবে রাখতে চেয়েছিল।
নির্ঝর উঠে দাঁড়ায়। কীর্তিকার খাবারের থালার উপর নিজের থালা রাখে -  সেগুলো সিঙ্ক পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর ট্যাপটা না ছেড়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। বাইরে তখনো সন্ধের ঢের বাকি।  ঘুরে দাঁড়ায় সে। কীর্তিকা  লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর টেবিলে ফিরে বসে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত পর নির্ঝরও  যোগ দেয় তার সঙ্গে। 
একটু আগে জেনে যাওয়া বিষয়গুলো কাঁদাতে থাকে দুজনকেই ।

                    --শেষ---

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ