পোস্ট বার দেখা হয়েছে বন্ধু
সুকুমার রুজ
আজকের দিনটা আসার অপেক্ষায় আমি ক'দিন
ধরেই ওয়েট করছি। আজ যে আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার দিন। আজ তো একুশে ফেব্রুয়ারি। বন্ধু বলেছেন, আজকের দিনটা হলো 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। কবিগুরু পার্কে আজ মাতৃভাষা
দিবসের অনুষ্ঠানে, বন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম
দেখা হবে। টেলিফোনে
বন্ধুর সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা হয়। কিন্তু দেখা হবে আজ প্রথম।
টেলিফোনেই তো আমরা
বন্ধু পাতিয়েছি। আসলে আমার তো কোনো বন্ধু নেই! মাম্মি, ড্যাডি দুজনেই তো অফিসে চলে যান। আমি ঘরে একা থাকি। না না, একটা ভুল হল, আমাকে দেখাশোনা করার জন্য
মিনুদিদি থাকে। কিন্তু ও তো সারাক্ষণ টিভিতে
ভি চ্যানেল দেখে। আমাকে
কার্টুন চ্যানেল দেখতেই দেয় না। তাই আমি খুব একা। আমার কোনো ফ্রেন্ড নেই। একদিন স্কুলে বাংলা ম্যাম বলেছিলেন 'মিত্র' মানে হলো ফ্রেন্ড।
তাই আমি ফ্রেন্ড করার জন্য 'টেলিফোন গাইড বুক' থেকে 'মিত্র' খুঁজে খুঁজে ফোন করছিলাম।
কয়েকটা ফোন করার পরেই এই বন্ধুকে পেয়ে গেলাম। কী সুন্দর গম্ভীর গলা! আমাকে বললেন,
'তোমার নাম কী? কোন ক্লাসে পড়? কোথায় থাকো?'
সব বললাম। শেষে বললাম, 'আই হ্যাভ নো ফ্রেন্ড।
উড ইউ লাইক তো বি মাই ফ্রেন্ড?
উনি বললেন, 'ফ্রেন্ড হবো না। তবে বন্ধু হতে
পারি, যদি আমার সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বল।
আমি বললাম, 'বাংলা ভাষায় কথা বললে মাম্মি পানিশমেন্ট দেবেন
যে!'
সে কী! তোমার পদবী তো বললে 'মুখার্জি'। তুমি তো
বাঙালী!
তা হলে কী হবে! মাম্মি আমার বাংলা
বলা একদম লাইক করেন না। একদিন
মাম্মিকে 'মা' বলেছিলাম ব'লে আমাকে খুব বকেছিলেন। সেই থেকে 'মাম্মি' বলি, আর 'আপনি' বলি।
বন্ধু বলেছিলেন, 'তোমার মাতৃভাষা হল বাংলা।
বাংলাভাষাকে আগে ভালবাসতে হবে, তারপর অন্য ভাষা। মাতৃভাষাকে ভালো না বাসলে কোনও
ভাষাকেই ভালোবাসা যায় না।'
তারপর থেকে আমি আমার এই বন্ধুর সঙ্গে বাংলায়
কথা বলি। বন্ধু আমাকে একটা বাংলা পদ্য শিখিয়ে দিয়েছেন -- মোদের গরব মোদের আশা, আ
মরি বাংলা ভাষা... । পদ্যটা আমি খুব ভালো করে মুখস্ত করেছি।
জানো, আমার এই বন্ধুটা না ছবি আঁকে। ওর নাকি ছবির এক্সিবিশন
হয়। অনেক
দামে ছবি বিক্রি হয়। বন্ধু ওঁর আঁকা একখানা ছবি আমাকে গিফট
দেবে বলেছে। আমি যে বন্ধুকে কী গিফট দেবো ভেবেই পাচ্ছি
না! প্রথমে ভাবলাম, আমার এক বাক্স রং আছে। আমি তো ছবি
আঁকি না। ওটাই
বন্ধুকে দিয়ে দেবো। পরে ভাবলাম, এ রং ভালো নয়, এ দিয়ে ছবি আঁকলে ছবি খারাপ হবে। তার চেয়ে ছোট মামার দেওয়া
খেলনা-পুতুলটা দেবো। চাবি দিয়ে ছেড়ে দিলেই কেমন চোখ মটকে হাসে, আর ডিগবাজি খায়। তাই ওটা
মার্বেল পেপার
দিয়ে প্যাক করে নিয়েছি।
মিনুদিদি
আমাকে নিয়ে যাবে
কবিগুরু পার্কে।
অনেক বলেটলে
ওকে রাজি
করিয়েছি। বন্ধু
বলেছে, কবিগুরু
পার্কে কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে ঠিক বিকেল চারটেয় অপেক্ষা করতে। বন্ধু এসে আমাকে নিয়ে
যাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
দিবসের অনুষ্ঠানে। সেখানে গান হবে, কবিতা পাঠ হবে। বন্ধু বলেছে,
অনুষ্ঠানে 'মোদের
গরব মোদের আশা...' পদ্যটা আবৃত্তি করার জন্য।
সাড়ে তিনটে বাজতে না বাজতেই আমি আর মিনুদিদি
পৌঁছে গেছি।
দু'জনে দু'জনকে কীভাবে চিনবো বলতেই, বন্ধু বলেছেন, উনি গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে
আসবেন। মুখভর্তি পাকা দাড়ি। মোটেও চিনতে অসুবিধা হবে না। আর আমি বলেছি নীল ফ্রক
পরে যাবো।
তাহলে একে
অপরকে ঠিক খুঁজে পাবো।
চারটে বাজার আগেই দেখি, গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে একজন আসছেন। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, মুখভর্তি
পাকা দাড়ি। কাঁধে
একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। ঠিক আমার
দাদুর মতো দেখতে। আমাকে দেখেও বন্ধু ঠিক চিনে নিয়েছেন। আমার
কাছে এসে, আমার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে
থেকে, হাঁটু
গেড়ে বসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। আমি বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখেছি। তারপর দুজনে গিয়ে বসেছি
কাঠের বেঞ্চিতে।
বন্ধু ওর ঝোলা থেকে বের করলেন খবর-কাগজ মোড়া একটা বাঁধানো ছবি। সেটা
আমাকে দিলেন। আমিও মার্বেল পেপার মোড়া গিফট-প্যাক বন্ধুকে দিলাম। বন্ধু খুশি হয়ে আমার দেওয়া গিফট প্যাক খুলে খেলনাটা
দেখে বললেন, 'এটা তুমি আমাকে দিয়ে ভালোই করেছ! এটা তোমার কাছে না রাখাই
ভালো। এটা
দম দেওয়া পুতুল। এটা তোমার কাছে থাকলে তুমিও
দম দেওয়া পুতুলের মতো হয়ে যাবে। কখনো দম দেওয়া পুতুল হবে না, বুঝেছো!'
আমি ঘাড় হেলাই। বন্ধু বলেন, 'আমার দেওয়া ছবিটা
দেখো, তোমার
পছন্দ হল কিনা!'
মোড়ক খুলে ছবিটা দেখে আমি তো অবাক! এটা তো আমার মনের মধ্যে
জমিয়ে রাখা ছবি! একবার
দাদুর সঙ্গে নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। নৌকায় চড়েছিলাম। মাঝি গান গাইছিল। আমি আর দাদু নৌকোর মাঝখানে
দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেই
ছবিটা বন্ধু কী করে আঁকলো!
আমি বলি, 'এটা তো আমার দাদু!'
বন্ধু আমার কপালে চুমু খেয়ে বলেন, 'আমিই তো তোমার
দাদু। এখন শিগগির চলো। ওদিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। তুমি সেই পদ্যটা মুখস্ত করে এসেছ তো?'
আমি বলি, 'হ্যাঁ,
দাদু, তুমি শুনবে একবার?
দাদু বলেন, অনুষ্ঠানে একসাথে সবাই শুনবো। তোমার
ওই দিদিটাও শুনবে।
ও যদি মাম্মিকে বলে দেয়?
বললেই বা। দেখবে, তোমার মা বকবেন না। শুনলে খুশিই হবেন যে, তুমি মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে কবিতা বলেছ।
0 মন্তব্যসমূহ