দর্পণ || গণতন্ত্র সংখ্যা ২০২১ || ঘোড়ার আড়াই চাল ~ অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

ঘোড়ার আড়াই চাল

অলিপা পাল


টেবিলের কাচে সশব্দে জলের গ্লাসটা রাখল টরেটক্কা নিউজ চ্যানেলের সম্পাদক অভিরূপ ৷

রোগা খয়াটে চেহারা ৷সাফারি পড়লে বেশ স্বাস্থ্যবান মনে হয়৷ নাকের ডগায় ঝুলে থাকা গোল্ডেন ফ্রেমের চশমার উপর দিয়ে ধূর্তামি চোখে  জিৎ এর দিকে তাকিয়ে বলল একটা এক্সক্লুসিভ স্টোরি আছে কভার করো ৷ তাচ্ছিল্যের চাউনিতে জিৎ কে আপাদমস্তক মেপে নিলো ঠোঁটের ফাঁকে মুচকি হাসিতে ,বলল হাতে হাতে প্রমোশন লেটার ৷হঠাৎ একটা ফোন আসাতে,জিৎকে বসিয়ে উঠে গেলো পাশের চেম্বারে  ৷


চিটফান্ড কেলেঙ্কারি,মধুচক্র এ জড়িত নেতা মন্ত্রীদের নাম প্রথম জনগণের সামনে আনার কৃতিত্ব সম্পাদক অভিরূপ ব্যানার্জীর ৷এই ধরণের খবরে টরেটক্কার ভাগ্য খুলে যায় ৷ টরেটক্কার পুরনো স্টাফদের মতে পদন্নতির সাথে মানসিক পরিবর্তন হয়েছে অভিরূপের ৷ মরিয়া হয়ে মানুষকে সত্যের সন্ধান দিতে গিয়ে অসৎ পথ অবলম্বন করছে সে ৷ অভিরূপের মতে খবরের চ্যানেল চালাতে গেলে আর পাবলিককে আকৃষ্ট করতে হলে শুধু সত্য ঘটনা দিয়ে হবে না ৷ পাবলিক মুখরোচক ঘটনা চায় ,গল্পে জল মেশাতে তো হবেই ৷

 পাশের চেম্বার থেকেই অভিরূপ বলতে বলতে আসে,হ্যাঁ দেবজিৎ এই মারকাটারি নিউজটা যদি তুমি কভার করতে পারো আমাদের চ্যানেল সর্বভারতীয় স্তরে পৌছে যাবে ৷ নিশ্চই কাল থেকে বিভিন্ন চ্যানেলে শুনেছ দুটো অনাথ আশ্রম থেকে চারটে বাচ্চা গায়েব ৷

হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার খুব মর্মান্তিক ঘটনা !

হুম, বাচ্চা গুলো অসমে আছে ৷

সেকি!স্যার ! আমরা কি বাচ্চা গুলো কে রেসকিউ করবো ?

বিরক্তের সাথে অভিরূপ বলল, না রে বাবা ! 

আসল ব্যাপার সামনে বিধানসভা নির্বাচন আমাদের রাজ্যে,তো শাসক দলের হেবি ওয়েট প্রার্থী অর্জুন চ্যাটার্জীকে বিখ্যাত তান্ত্রিক বলেছে ভোটে শাসক দলের জিততে হলে রুদ্রকালী মাকে মানুষের হৃৎপিন্ড দিয়ে পুজো দিতে হবে ৷এই অপারেশন টা হবে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর ওপারে উমানন্দ মন্দিরের পিছনের জঙ্গলে ৷ আগামী কাল রাতে ৷কিন্তু স্যার  এমন ঘটনা যে ঘটতে চলেছে তার প্রমাণ দেবো কি করে ৷স্যার বাচ্চা গুলোকে আমাদের যে বাঁচানো দরকার স্যার ৷ খুব সেনসিটিভ ইস্যু স্যার ৷

রিভোলবিং চেয়ার ঠেলে সরিয়ে উত্তেজিত অভিরূপ বলল কে বলেছে প্রমাণ নেই ৷অসমের জঙ্গলে গিয়ে তুমি প্রমাণ নিয়ে আসবে ৷

আর এই পুরো ঘটনাটা কভার করাই আমার চ্যানেলের কৃতিত্ব ৷ আর এটাই তোমার কাজ ৷ কয়েকটা ছবি আর ভিডিও ৷সামান্য তো ক'টা থ্যালাসেমিয়ার বাচ্চার হার্ট ৷ যে হার্টের কোন নিশ্চয়তা নেই ৷

শুনে চমকে উঠলো জিৎ ৷আঁতকে উঠে বলল কি বলছেন স্যার !আমরা বাচ্চা গুলো কে বাঁচাবো না?

এই তোমাদের মধ্যবিত্ত ন্যাকামি ৷

বাঁচাতে গেলে টরেটক্কা লাটে উঠবে যে ভায়া !তার চেয়ে ছবি ভিডিও আনো পাবলিসিটি হবে চ্যানেলের,সাথে হাতে গরম 

প্রমোশন ৷

আপনার কোন বিবেক নেই! বোধশক্তি নেই! চ্যানেলের পাবলিসিটির জন্য নিরীহ শিশুদের মেরে ফেলবেন ৷ জিৎ এর গলা থেকে ঘৃণা উঠে এলো ৷যেনো মনে হল নিজের মেরুদণ্ড বেচে দিচ্ছে ৷ ঘারের পিছন,কানের লতি,চোখের কোণ জ্বালা করছে ৷ এসির মধ্যেও দরদর করে ঘামছে ৷নিজেকে সামলে জড়সড় ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আঙুলের নখ খুঁটতে খুঁটতে জিৎ বলল ,স্যার আমার কোভিড টেস্ট করাবো কাল ৷ক'দিন জ্বর-জ্বর সাথে সর্দি মাথা ধরা ৷ রিপোর্ট হাতে পেয়ে তারপর যাওয়া যাবে স্যার ?

কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙে অভিরূপ বলল আমি কভার করব নিউজ ৷১৫ দিনের মধ্যে অন্য কোন এক্সক্লুসিভ নিউজ না পেলে মাইনে নিয়ে কেটে পড়বে ৷এখন যাও !

অফিস থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালো জিৎ ৷সার্দানএভিনিউ থেকে কালীঘাট মেট্রোর দিকে যেতে যেতে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছিল সে ৷ মাস ছয়েক হল জার্নালিস্ট হয়ে বাংলার প্রথম সারির চ্যানেল টরেটক্কায় জয়েন করেছে ৷কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন এক্সক্লুসিভ স্টোরি তুলে আনতে পারেনি ৷সে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না ৷বরং নিজের পুরোটা দিয়েও কেরিয়ারটাকে ঠিক মত দাঁড় করাতে পারছে না ৷ ভিতরে ভিতরে অস্থিরতায় ঘেমে উঠছে ফাঁকা মেট্রোর এসি কম্পার্টমেন্টে বসে ৷কি হবে যদি ১৫দিনে ভাল খবর জোগাড় করে চ্যানেল কে দিতে না পারে ৷ চাকরি চলে গেলে এই বাজারে আরেকটা চাকরি পাওয়া খুব কঠিন ৷ ঠিক পনেরো দিন সময় হাতে আছে জিৎ এর ৷ এর মধ্যে তেমন কোন স্টোরি দিতে না পারলে মাসের শেষে মাইনে নিয়ে চাকরি ছাড়তে হবে ৷  এখন তার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা করছে না ৷কিন্তু বাড়ি ফিরতে হবে ৷ সল্টলেকে সরকারী আবাসন ৷ মেট্রো করে শোভাবাজার নেমে অটো বা বাস ৷ সকালে অফিসে আসার আগে মা বলেছে জিৎ তাড়াতাড়ি ফিরিস ৷ তোর বাবার তো ফেরার উপায় নেই হস্পিটালে চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি, যে ভাবে করোনা রুগীর সংখ্যা বাড়ছে ৷

শুধুমাত্র ভোট প্রচার,নেতা মন্ত্রীদের মিটিং মিছিল রোড শো এর জন্য করোনা আক্রান্তের সংখ্যা  বিপদ সীমা অতিক্রম করছে ৷ এক মুখ বিরক্তি নিয়ে রান্না ঘর থেকে মা বলছিল ৷

পিসি পিসেমশাই আসবে ৷ আসতে সন্ধ্যা হবে ৷ কলকাতায় ডাক্তার দেখাবে ৷ সম্ভবত জিৎ এর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে ৷ জিৎ মনে মনে নিজেকে বিদ্রুপ করল—চাকরির নিশ্চয়তা নেই যার তার আবার বিয়ে! 

জিৎকে দেখে মা বলে উঠলো ,সেই তুই দশটা বাজালি! দেখ তোর পিসিমণি কখন থেকে এসে বসে আছে ৷

পিসিমণি বলল হ্যাঁ রে, জিৎ! তোকে যেনো খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে !মুখটা কেমন শুকনো ৷শরীর খারাপ নাকি বাবু ?

পিসা, জিৎ এর মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন ওর নিশ্চই খিদে পেয়েছে বৌদি,তুমি রাতের খাবার দিয়ে দাও৷ জিৎ ফ্রেস হয়ে চলে আয় খেতে ৷

জিৎ বুঝল লুকিয়ে কোন লাভ নেই ৷

সম্পাদক অভিরূপের সমস্ত কথা জানিয়ে জিৎ ফ্রেস হতে গেলো ৷

জিৎ বাথরুম থেকেই শুনতে পাচ্ছে মা বলছে ,আমি আগে কি বলেছিলাম তোকে ? এই কাজ তোর জন্য নয় ৷ শুনলি আমার কথা ! ছিঃছিঃ এরা মানুষ ! আমরা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক ! চারটে ফুটফুটে শিশু! থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত৷ তাদের হার্ট  মাকালীর কাছে নিবেদন হবে! এই অনিষ্ট ভগবান সহ্য করবে না ৷

জিৎ চুপচাপ খেয়ে চলেছে ৷ ওর বাবা ডক্টর রায়ও টিভির দিকে তাকিয়ে খেয়ে যাচ্ছে ৷ সেই থ্যালাসেমিয়ার বাচ্চা কিডন্যাপের খবর চলছে ৷

জলপাইগুড়ির এডিএম পিসামশাই পাবদা মাছের ঝাল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন,আচ্ছা এবার জিৎ এর ব্যাপারটা নিয়ে কথা হোক, নাকি? ডাক্তার বাবা,ছেলের কাজ কর্ম নিয়ে সে ভাবে খবর রাখেন না ৷অবাক হয়ে বলল,

জিৎ এর আবার কি ব্যাপার!

এইথিং রং ?

পিসিমণি এবারে বলল দাদা তোর সব জানা দরকার ৷সব শুনে চিন্তিত মুখে জিৎ এর বাবা বলল

 তাহলে এবার তুমি কি করবে ভেবেছ কিছু ?

জিৎ মাথা নাড়িয়ে বোঝালো কিছু ভাবেনি ৷ তবে কোভিড টেস্ট হবে 

এই অজুহাতে কিছু দিন অফিস যেতে হবে না ৷ 

বাবা জিৎএর পিঠ চাপড়ে বলল এই তো ব্রেভো ৷

তবে আর দেরি কেনো লেগে যাও কাজে !ডিএম আর সাংবাদিক মিলে শিশু উদ্ধারে ৷ জিৎ এর বাবা এও বলল এখনি অনলাইনে অসমের ফ্লাইটের টিকিট বুক করো তোমাদের দুজনের ৷তার পর আলোচনা ৷

আধ ঘণ্টার মধ্যেই জিৎ টিকিট কেটে নিলো সকাল আটটায় ফ্লাইট ৷ অসম যেতে এক ঘণ্টা ৷ 

জিৎ এর মা,পিসিমণি অলোচনা শুনতে শুনতেই দুজনের সামান্য লাগেজ গোছাতে থাকলো ৷ পিসা আর বাবা জিৎকে সাহস জুগিয়ে বলছেন,কিচ্ছু চিন্তা করিস না ৷ তোর চাকরি যাবে না ৷ মন বলছে তুই নিজেকে ঠিক প্রুভ করতে পারবি ৷শুধু কনফিডেন্টটা ধরে রাখ৷ এই সুযোগ কেউ ছাড়ে নাকি ?তা ছাড়া তোর এখন আর নতুন করে কিছু হারানোর নেই ৷অফিস তোকে নতুন কোনও এসাইনমেন্ট দেয়নি ৷ জিৎ এতক্ষণে নিজের ভিতরে একটা যেনো জোর পাচ্ছে ৷


       এক নির্মম ঘটনা ঘটার আগেই গ্রেপ্তার হয়েছে শাসক দলের জনপ্রিয় নেতা অর্জুন চ্যাটার্জী !উত্তরবঙ্গ রাজ্য পুলিশ ও অসম পুলিশের তৎপরতায় ৷সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ক্লিপিং এর মাধ্যমে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে ৷তবে কে বা কারা স্যোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে তা এখনো জানা যায়নি ৷ভিডিওর সত্যতা যাচাই চলছে ৷ শাসক দলের জনপ্রিয় নেতার এমন নিশংস কর্মকাণ্ডে বাকরূদ্ধ বাংলা ৷এক মুহূর্তে গোটা রাজ্য তোলপাড় ৷শিউরে উঠেছে দেশবাসী ৷রাগের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ ভাঙচুর হচ্ছে শাসক দলের একাধিক পার্টি অফিস ৷অর্জুন চ্যাটার্জীর বিলাসবহুল গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে ক্ষিপ্ত জনতা ৷টরেটক্বার সম্পাদক অভিরূপ ব্যানার্জীর বাড়ির সামনে কুশপুতুল পোড়ানো হচ্ছে ৷খোঁজ চলছে অভিরূপের ৷ আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে কমেন্টের ঝড় বয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ৷ বিক্ষোভ মিছিল হিংসাত্মক রূপ নিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলো ৷ ভাঙচুর চলছে টরেটক্কার অফিসে ৷ জনতার রোষের মুখে টরেটক্কার সমস্ত কর্মী ৷অভিরূপ সব জানত,প্লান মাফিক শুধু নিজের চ্যানেলের উন্নতির জন্য এই মর্মান্তিক ঘটনার ছবি তুলতে তার বিবেকে বাঁধেনি ৷কোন বাঁধা দিলো না এই জঘন্য কাজের ৷ জানা  যাচ্ছে যে চার থ্যালাসেমিয়া শিশুকে অপহরণ করা হয়েছিল, তাদের অসমের নির্জন এলাকার একটি বাড়িতে আটকে রেখে ছিলো শাসক দলের প্রার্থী অর্জুন  চ্যাটার্জী৷

সম্ভবত একটা বড় চক্র ৷তাদের কাজ হার্ট কিডনি শরীর থেকে বের করে বিক্রি করা ৷সিবিআই তদন্তের দাবি করেছে বিরোধীপক্ষ ৷ গ্রেপ্তার হয়েছে অর্জুন চ্যাটার্জীর সহ পুরো টিম ৷ রহস্য আরও দানা বেঁধেছে বাংলার প্রথম শ্রেণীর চ্যানেল টরেটক্কার  সম্পাদককে স্যোশাল মিডিয়ার ভিডিও ক্লিপিং এ দেখা যাচ্ছে,তিনি বাচ্চাগুলো কে বাঁচানোর চেষ্টা না করে ঘটনার ভিডিও করছেন ৷তবে বাচ্চাগুলো এখন পুরােপুরি সুস্থ ৷ কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের  আশ্রমে পাঠানো হবে৷


সারাদিন আজ এই খবর চলছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে, জার্নালিস্ট স্টোরিটেলার জিৎ আজ সময়ের একটু আগেই  টরেটক্কার অফিসে ঢুকে গেছে৷ অফিসের পরিবেশ থমথমে ৷ কানাঘুষো ফিসফাস আলোচনা ৷

 জিৎ রিভোলবিং চেয়ারে হেলান দিয়ে মনে-মনে মুচকি হাসছে আর পেপারওয়েট হাতে নিয়ে উপরের দিকে ছুঁড়ছে আবার লুফে নিচ্ছে ৷

 বস অভিরূপের পিছনে ক্যামেরা নিয়ে সমস্ত ঘটনার ভিডিও করেছে  দেবজিৎ স্বয়ং ৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. বাহ্ বেশ জমাটি গল্প! গণতন্ত্রের আড্ডায় এমন গল্প বিরল! তবে শাসক দলের নেতা আজকের গণতন্ত্রে গ্রেপ্তার হয়না! এটা ঠিক মানা যাচ্ছে না। যাইহোক গল্পটায় একটা চিত্র নাট্য হওয়ার মতো রসদ আছে।

    উত্তরমুছুন
  2. গল্প হলেও ছবির মত এক ঘটমান বর্তমানের ছবি। ছোটগল্পের নীতি মেনেই যেন হঠাৎ পরিণতি। অন্তরে অতৃপ্তি র’বে সাঙ্গ করি’ মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ।

    উত্তরমুছুন