দর্পণ || সাপ্তাহিক ফেসবুক সেরা আলোচনা || কামাখ্যা মন্দিরের এক স্বর্গীয় দৃশ্য !! ~ অভিষেক দাস




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

কামাখ্যা মন্দিরের এক স্বর্গীয় দৃশ্য !!

অভিষেক দাস


"মা কামাখ্যা ও অম্বুবাচী " ...


"কামার্থমাগতকা যস্মান্ময়া সার্দ্ধং মহাগিরৌ৷

কামাখ্যা প্রোচ্যতে দেবী নীলকূটে রহোগতা ৷৷" ...


মহাদেবী অভিলাষ পূরণের জন্য এখানে এসেছেন বলে নাম "কামাখ্যা" ! তিনি কামদা, কামিনী , কামা, কান্তা , কামদায়িনী আবার কামনাশিনী।

নীলকূট পাহাড়ের উপর যেখানে দেবীর "যোনী" পড়েছিল সেই প্রস্তরই কামাখ্যা দেবী বা 'কুব্জিকা'।


লাল শালুতে ঢাকা। প্রতি মাসে দেবী রজঃস্বলা হন৷ ৫১ টি সতীপীঠের অন্যতম এখানে মাতৃ যোনি পরায় পাহাড়টি নীল রংয়ের হয়ে যায়। নাম হয় নীলকন্ঠ বা নীলাচল পর্বত। অসমের গুয়াহাটি শহর সংলগ্ন  ৷একে বলা হয় "তীর্থ চূড়ামনি"৷ প্রাচীন কাল থেকে একে জাদু টোনা,তন্ত্র-মন্ত্রের জায়গা বলা হয়৷ এখানে নাকি ভূত-পেত্নী, ডাকিনী ও যোগিনীদের রাজত্ব ৷ পুরুষদের নাকি এখানকার নারীরা "ভেড়া" করে দেয় ৷ আসলে তন্ত্র সম্বন্ধে না জানার ফল এগুলো৷ মা ,কৃপাময়ী৷

আমাদের পূর্বপুরুষরা দীর্ঘকাল গুয়াহাটিতে থেকেছেন। আত্মীয় এখনও প্রচুর৷ এসব কল্পকাহিনীতে কেউ বিশ্বাস করেনা৷ আমিও একাধিক বার পুজো দিয়েছি৷ বামত্তরীয় ব্রাহ্মণ আমাদের পান্ডা ঊমাশঙ্কর শর্মা খুব ভালো ভাবে ঘুরে দেখিয়েছেন৷ প্রসাদ দিয়েছেন।


কামাখ্যা মন্দিরের মূল উৎসব "অম্বুবাচী" ...


আষাঢ় মাসে মৃগ শিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে সুর্যদেব মিথুন রাশিতে গমন করেন৷ শেষ হয় আদ্র নক্ষত্রের প্রথম পাদে৷ এটাই  বাংলা প্রবাদ।

"কিসের বার কিসের তিথি, সাত তারিখ অম্বুবাচী"৷ এই সময় পৃথিবী ঋতুমতী হন৷ পালিত হয় " অম্বুবাচী" উৎসব ওড়িশাতে একে বলে রজঃউৎসব। এই সময় বিধবা মহিলারা গরম খাবার খান না ৷ব্রত পালন করেন৷ হল কর্ষন , গৃহপ্রবেশ , ও বিবাহ বন্ধ থাকে৷ সব মন্দিরের প্রবেশ দ্বার বন্ধ রাখা হয়৷ আমাদের এলাকায় মুসলমান চাষী ও মজুরেরাও খোঁড়াখুঁড়ি ও  হাল ধরা বন্ধ রাখেন৷ কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে লাল রংয়ের তরল ( ভক্তদের মতে মায়ের রজস্রাব) বের হয়৷ সারা ভারতবর্ষ থেকে লাখ লাখ ভক্ত এই সময় কামাখ্যা মন্দিরে উপস্থিত হন ৷ নাম গানে এলাকা মুখর হয়ে ওঠে৷ পান্ডারা ভক্তদের ওই রক্তভেজা কাপড়ের টুকরো দেন। যা পুরুষেরা ডান হাতে বা গলায় এবং মহিলারা বাঁ হাতে বা গলায় মাদুলি করে পরেন৷ মনে করা হয়, মায়ের আর্শীবাদে এতে সকল দুঃখ-বিপদ দূর হবে। 


অম্বুবাচী মেলা :


প্রতি বছর ২২শে জুন অসমের বিখ্যাত কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচী মেলা বসে।

পৌরাণিক এই কাহিনী সকলেরই জানা, যে সতী পার্বতীকে নিয়ে শিব তাণ্ডবনৃত্য করার সময় তাঁকে শান্ত করতে বিষ্ণু মতলব বার করেছিলেন। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের আঘাতে সতীর দেহ টুকরো টুকরো হয়ে মর্ত্যের নানা প্রান্তে ৫১ টি জায়গায় এসে পড়ে। এই ৫১ টি জায়গায় গড়ে ওঠে সতীপীঠ।তারই একটি হল কামাখ্যা মন্দির। আর ৫১ পীঠের মধ্যে আবার চারটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তিপীঠ হিসাবে গণ্য করা হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম পীঠস্থান এই কামাখ্যা। বিষ্ণুর চক্রের আঘাতে সতীর যোনি ছিন্ন হয়ে এই কামাখ্যায় এসে পড়েছিল। তাই দেশ তথা বিদেশ থেকে বহু ভক্ত বার্ষিক অম্বুবাচী  মেলায় এই সময় এই কামাখ্যায় এসে উপস্থিত হন।


বিশ্বের মাতৃশক্তির উৎস হিসাবে এই কামাখ্যাদেবীকে বিশ্বাস করা হয়। আর সেই শক্তির আরাধনাতেই মানুষ কামাখ্যায় আসেন। কামাখ্যার নানা উৎসবের মধ্যে অম্বুবাচী এক অন্যতম বৃহৎ উৎসব। বিবাহিতা নারী সন্তান কামনায় যেমন কামাখ্যার আরাধনা করেন , সেরকমই আবার কৃষক তাঁর ভূমি -মাতার গর্ভে ফসলের আশায় কামাখ্যা দেবীর আরাধনা করেন।দেশের মানুষ এভাবেই কামাখ্যা দেবীকে স্মরণ করেন এবং তাঁর পুজো করেন। 


এবারে এই কামাখ্যা পাহাড় নিয়ে কিছু তথ্য :


১) কামাখ্যা মন্দিরের আর এক নাম কামরূপ কামাক্ষ্যা।

২) মন্দিরটি নীলাচল পাহাড়ে অবস্থিত। 

৩) এই মন্দিরে শক্তির ১০টি রূপের পৃথক মন্দির আছে।

৪) ওই রূপগুলি হল : কালী ,তারা ,ষোড়শী ,ভুবনেশ্বরী ,ভৈরবী ,ছিন্নমস্তা ,ধূমাবতী ,বগলামুখী,মাতঙ্গী ,কমলা।

৫) মধ্যযুগে হুসেন শাহের অনুপ্রবেশের সময় কামাখ্যা মন্দির ধ্বংস হয়েছিল বলে কথিত আছে।

৬) সেটি ১৪৯৮ সালের ঘটনা।

৭)  ১৯৬৫ সালে মন্দিরটি পুনঃনির্মিত হয়। 

৮)  কোচ সাম্রাজ্যের রাজা নর নারায়ণ এটি সম্পূর্ণ করান।

৯)   অম্বুবাচি ছাড়া কামাখ্যা মন্দিরে বার্ষিক মনসা পুজো হয়।

১০) বর্তমানে বড়দেউরি সমাজ এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে।


🌺🌺🌺🌺🌺🌺


অসমের নীলাচল পাহাড়ে অবস্থিত কামরূপ কামাখ্যা ৫১ পীঠের অন্যতম এক পবিত্র পীঠস্থান। বিষ্ণুচক্রে এখানে দেবী সতীর যোনি পতিত হয়েছিল। কথিত আছে যোনিরূপ যে প্রস্তরখণ্ডে মা কামাক্ষা অবস্থান করছেন, সেই শিলা স্পর্শ করলে মানুষ মুক্তিলাভ করে।


🌺কামাখ্যা মায়ের প্রথম মন্দির নির্মাণ করেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। ভগবান শিবের নয়নাগ্নিতে কামদেব ভস্ম হয়ে বিকৃত চেহারা প্রাপ্ত হলে, এই স্থানে এসে তিনি পূর্ব রূপ ফিরে পাবার জন্য মা কামাখ্যার তপস্যা করেন। সেই থেকে এই পীঠ কামদেবতা পূজিত "কামাখ্যা পীঠ" নামে খ্যাত। 


🌺কামাখ্যা মায়ের বর্তমান মন্দির কোচরাজ বিশ্বসিংহ দ্বারা নির্মিত। কালিকাপুরাণে কামাখ্যাপীঠের বর্ণনা আছে। বলা হয় মা সতীর যোনিদেশ এই স্থানে পতিত হলে, মায়ের সেই অঙ্গ ত্রিদেব মিলেও ধারণ করতে পারেন নি। সেই স্থান রসাতলে যাচ্ছিল। তখন দেবতাদের প্রার্থনায় মা ভগবতী প্রকট হয়ে নিজেই নিজেই অঙ্গকে ধারণ করেছিলেন। 


🌺কামাখ্যা মায়ের ভৈরব উমানন্দ। ব্রহ্মপুত্রের মাঝে একটি পাহাড়ে অবস্থিত ভৈরবের মন্দির। বলা হয় দেবী উমার আনন্দের জন্য ভগবান শিব এখানে লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হন। তাই এনার নাম উমানন্দ। 


🌺দেবী কামাখ্যার পঞ্চ মূর্তি ও অষ্টযোগিনী আছে। পঞ্চ মূর্তি হল- কামাখ্যা, কামেশ্বরী, ত্রিপুরা, সারদা, মহোৎসহা। অষ্টযোগিনী রা হলেন- কটীশ্বরী, গুপ্তকাশী, শ্রীকামা, বিন্ধ্যবাসিনী, পাদদুর্গা, দীর্ঘেশ্বরী, ধনস্থা ও প্রজটা। 


🌺কামাখ্যা ধামে অম্বুবাচী কে কেন্দ্র করে বিশাল মেলা বসে। এই সময় বহু সাধু সন্তদের আগমন হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে আষাঢ় মাসে রবি মিথুন রাশিস্থ আর্দ্রা (৬) নক্ষত্রের প্রথমপাদে অর্থাৎ এক চতুর্থাংশ  (৩°|২০') স্থিতিকালে বসুমাতা অর্থাৎ পৃথিবী ঋতুমতী হন। এই সময়কে “অম্বুবাচী” বলে। 


🌺অম্বুবাচী সময় দেবী কামাখ্যা ঋতুমতী হন। সে জন্য কামাখ্যা মন্দিরের দরজা বন্ধ করে রাখা হয়৷ তখন শুরু হয় অম্বুবাচী প্রবৃত্তি। অম্বুবাচী কে কেন্দ্র করে মন্দির ঘিরে বিশাল মেলার আয়োজন করা হয়। প্রচুর ভক্তসমাগম হলেও সে সময় দেবী দর্শন নিষিদ্ধ। ঠিক তিন দিন পরে সেটা শেষ হয়, সেটা হল অম্বুবাচী নিবৃত্তি। উত্‍সবের চতুৰ্থ দিন মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীকে স্নান করিয়ে পূজা শেষ করা হয়। এর পর ভক্তদের দেবী দর্শনের জন্য মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয়। 


🌺কামাখ্যা মায়ের অম্বুবাচী চলাকালীন রক্তবস্ত্রের মাহাত্ম্য অনেক। এই বস্ত্র ধারণ করলে তান্ত্রিক কর্ম করলে তা সফল হয়। যোগিনী তন্ত্রে লিখিত আছে --

কামাখ্যাবস্ত্রমাদায় কপ- পূজাং সমাচরেৎ ।

পূর্ণকামং লভেদ্দেবী সত্যং সত্যং ন সংশয় ।।

(কুব্জিকা তন্ত্র/সপ্তম পটল) 

অর্থাৎ- উক্ত রক্তবস্ত্র শরীরে ধারণ করিলে অভীষ্ট ফল লাভ হয়, তদুপরি কামাখ্যার রক্তবস্ত্র শরীরে ধারণ করিয়া অন্যত্র জপ, পূজা করিলেও পূর্ণকাম হইয়া থাকেন। 


🌺🌺🌺আজ অম্বুবাচীর ঠিক আগের মুহূর্তে আপনাদের কাছে দিলাম মা কামাখ্যা ধ্যানমন্ত্র, স্তোত্রম্ ও প্রণাম মন্ত্র। ইহা সত্যি দুর্মূল্য ও দুর্লভ, পাঠ করুন মা এর কৃপায় মঙ্গল হবেই। একসময় এই সব গুপ্ত ছিল আজ মা এর কৃপায় তা তুলে দিলাম আপনাদের কাছে, সবার মঙ্গল হোক মা কামাখ্যা ও উমানন্দ ভৈরব এর রাতুল চরণের কাছে এই প্রার্থনা।


 🌺🌺🌺🌺🌺🌺🌺 

কৃপা করো মাগো🌹🌹🌹🌹


জয় মা কামাখ্যা !

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ