দর্পণ || গল্প || পুতুল বাটি ~ শর্মিষ্ঠা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


 পুতুলবাটি

  শর্মিষ্ঠা 


জানলার ধারের বেঞ্চ থেকে ওপাশের পুকুরের জলে বিল্লুদাদাদের সাদা হাঁসদুটোকে দেখা যায়।যতই দ্যাখো, আশ মেটে না।পুকুরের কালো জলে লম্বা সাঁতার কাটে আর দুটো করে চারটে লম্বা জলের রেখা ক্রমশ ত্রিভুজের দুই বাহুর মতো দুপাশে দূরত্বে সরে যায়। ওদুটো একদম স্কুলের সরস্বতীর হাঁসটার মতই।কেমন চৈ চৈ করে ডাকে আর গুগলি খায়।টুপ করে একটা পাকুড়ের পাতা ঝরে পড়লো জানলার ওপাশে।

–শ্রাবনী, জানলা দিয়া কী দ্যাখোস?

বিনিতার ধাক্কায় হুঁশ এলো গুটি'র।উঠে দাঁড়ালো।

–কিছু না দিদিমণি।

–ভালা কইরা নামতাখান শিখ্যা লও।বড়স্কুলে জিগাইলে ঠিক কইরা উত্তর দিবা।নাইলে মাথা কাটা যাইবো।বাবারও,আমাগোরও।

–আচ্ছা।

–এহন বসো।


গুটির বাবার বদলি হয়েছে বড় শহরে।বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করেন।আগের ব্রাঞ্চে বাড়ি থেকে বাসে যাতায়াত করতেন।এখন নতুন ব্রাঞ্চের দূরত্ব অনেকটাই হবে।বাবার পক্ষে রোজ যাওয়া আসা সম্ভব হবে না।তাছাড়া ওটা জেলা সদর, বড় শহর।ভালো স্কুল আছে।সুযোগ সুবিধা অঢেল।তাই, বাবা ঠিক করেছেন ওরা তিনজনই ওখানে চলে যাবে।জেঠুদের বাড়িতেও সবার মনখারাপ।গুটি সবার নয়নের মণি যে ! কত নাম ! গুটলি, গুটু, গুটান ইত্যাদি।


গুটি অবশ্য বড় স্কুলে গিয়ে ভর্তির সময় নামতা নির্ভুল বলেছিলো।মাথা কাটা যায়নি বাবার বা দিদিমনিদের।ব্যাঙ্কের বদলিতে স্কুলের ভর্তি নিয়ে সমস্যা হয় না।বছরের যে কোনো সময়ই তা সম্ভব।সুতরাং, এ হেন পরিস্থিতিতে নামতা ভুল বা পার্সিভারেন্স বানান ভুল লিখলেও ভর্তি হয়েই যেত, কিন্তু সবটা নির্ভুল করে,শুরুতেই শ্রাবনী মেধাবী ছাত্রীর তালিকাভুক্তও হয়ে গেলো শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে।


–গুটি, জেম্মাদের ওখানে চলে যা তাড়াতাড়ি।ট্রাক চলে আসবে এখনি।সব জিনিস তুলবে।এদিকের কাজ মিটে গেলে আমি ডাকবো।

–আচ্ছা মা।


বাঁ হাতের তালুতে বিটনুন আর ডানহাতে দুটো ডাসা গোলকুল নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো গুটি।ডান পা'টা রাস্তায় একটু ঘষতেই খানিক ধুলো উড়লো বাতাসে।ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিক।এখনও পুকি,উমা কেউই স্কুল থেকে ফেরেনি।স্কুলের জন্য মনটা কেমন হু হু করে উঠলো ওর।প্রায় পাঁচদিন হতে চললো স্কুলে যায়নি।

'কেন যে ঠিক বলেছিলাম', বলেই খচ করে কুলে একটা কামড় বসালো।

জেম্মাবাড়ি যাবারও ইচ্ছা হলো না।জেম্মাও তো না করতে পারতো বাবাকে ! করলো না।উল্টে বললো ওখানে যেতেই হবে।ওখানেও নাকি পুকি, উমাদের মতো অনেক বন্ধু পাবো।তাই কখনো হয় ! পৃথিবীতে একটাই পুকি, একটাই উমা।বুক ফেঁটে কান্না বেরিয়ে এলো।দ্বিতীয় কুলের বিচিটা মুখ থেকে ছুঁড়ে ফেলে হাটদুটো টেপজামায় মুছে ফেললো।

তারপর একবার বাঁ দিকে একবার ডানদিকে হেলতে হেলতে এগিয়ে গেলো রানাদের বাড়ির গলিতে।বিশুকাকা মূর্তি বানাচ্ছে।

–আচ্ছা, কাকা সারাবছর কালীপূজা হয় ! কতগুলো কালী আছে গো ?

–অনেক।এই যেমন গুটি কালী।

–আবার বললে তো ! আমি কিন্তু আজকেই চলে যাচ্ছি।

–ও, আজই যাচ্ছোস, না !

বিশুকাকার দৃষ্টিতেও বিষণ্ণতা।

–তাতে কী হইছে? প্রতি হপ্তায় তো আসবি ! তোর বাপে কইছে আমারে।শনিবার কইরা আইবো।

পাশের খড়ের বান্ডিল থেকে একটা লম্বা খড় নিয়ে আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে খুব অভিমান হলো গুটির।কেউই কী বুঝবে না !

–আচ্ছা আমি যাই।তুমি ঠিক করে থাকো।

বেরিয়ে এলো গুটি।আরেকটু পরেই ওরা ফিরবে স্কুল থেকে।হাঁটতে হাঁটতে দশটা বাড়ি পেরিয়ে উমাদের বাড়ির কাছে এলো।

–ওমা তুই ! চলে এসেছিস ! ছুটি হয়ে গেলো !

–হ্যাঁ।ছুটি হয়ে গেছে আজকে।

–কেন রে ?

–তুই শুনে কী করবি !

গুটি বুঝতে পারলো উমার রাগ হয়েছে।কারণটাও বোধগম্য, কালকে খেলতে আসতে পারেনি।মাকে সাহায্য করে দিচ্ছিলো ও।

–রাগ করেছিস !

–কেন ?বয়েই গেছে।তুই এখন ভালো স্কুলে পড়বি।কত ঘ্যাম হবে তোর।

–উমা, কালকে মাকে জিনিসগুলো গুছিয়ে দিচ্ছিলাম।ওই জন্য আসতেই পারিনি।

–ও,বলে গেলে পারতিস।কালকে আমাদের পুকির বাড়িতে বউ-বর নিয়ে বেড়াতে যাবার কথা ছিলো।

–জানি তো।কিন্তু কাল বাড়ি থেকে বেরোলে মা মারবে বলছিলো রে।তারপর অত কাজ করতে করতে ভুলেই গিয়েছিলাম।

–তার আগের দিন ?

–ওমা, আগেরদিন তো মুকুন্দপুরে গেছিলাম।স্কুলে ভর্তি ছিলো।

–সে তো বিকেলের আগেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিস।

–না।আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো।

দুজনেই চুপ।আর ঝগড়া করার কারণ কেউই খুঁজে পাচ্ছে না।দুপাশে দুজনের চোখের কোণে চিকচিক করছে জলের বিন্দু।

দুজন দুদিকে ঘুরে ঝটপট চোখ মুছে ফেললো দুহাতে।যেন কেউ কারোটা বোঝেনি।হায় রে শৈশব !

–দাঁড়া আমি আসছি এখনই।

–কোথায় যাচ্ছিস ?

গুটি চপ্পল পড়ে দৌঁড়াতে গিয়ে হোঁচট খেলো।হুড়মুড়িয়ে সামনে পড়েনি ঠিকই কিন্তু চটির ফিতে গেলো ছিঁড়ে।তাতে কী ! ছেঁড়া চপ্পল হাতে নিয়ে খালি পায়ে দৌড়, দৌড়।বাড়ির গেটে এসে দাঁড়ালো।হাঁপাচ্ছে ও।

ট্রাকে মালপত্র তোলা হচ্ছে।

–কী রে, চলে এলি কেন ?

গুটি কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে রান্নাঘরের গোছানো জিনিসগুলোর বস্তার কাছে এগিয়ে গেলো।হ্যাঁ, ওই তো আছে।এখনো তোলেনি ট্রাকে।সোজা টেনে বের করে আনলো পুতুলের সম্পত্তি।

–আবার কী টেনে বের করছো ?

–এগুলো,মা।

–এগুলো বের করছো কেন ? ওরা এখনই সব জিনিস তুলবে।এখন আবার ঘাঁটাঘাঁটি করো না যেন।

গুটি কোনো কথা না বলে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলো।

–মা।

বাবার গলা।

–হ্যাঁ।আসছি।

–আমি আজকে ট্রাকে ওখানে চলে যাবো।রাতে সব জিনিস ওই বাড়িতে সেট করে কাল এসে তোমাদের দু'জনকে নিয়ে যাবো।

–আমরা আজকে যাচ্ছি না !

–না মা।কালকে যাবে।

গুটি জোড়া পা তুলে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।যেন, সকাল থেকে জমা অভিমান এবার মুষলধারে বেরিয়ে আসবে।গত কয়েকদিন যাবৎ যে মেঘের পাহাড় জমে ছিল আজ তা ছিঁড়ে দ্বিপ্রহরের সূর্যের রশ্মি ঝলমল করে উঠলো।

'আজকে যাচ্ছি না'...এই মুহূর্তে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম সুখ এটা।দৌড়ে চললো উমার বাড়ি, খালি পায়েই।

'এগুলো দিয়ে আজকে ওর সাথে খেলে ওকেই দিয়ে দেবো।'...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ