দর্পণ | ফেসবুক সাপ্তাহিক সেরা নির্বাচিত কলম | গল্প ও কবিতা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


 কবিতা


হাঁটছে মানুষটা

দেবাশিস বসু



হাঁটছে মানুষটা..

সন্ধ‍্যা নেমে আসা পাহাড়টার মতো হাঁটছে..

মরুঝোপ চিবোনো নিস্পৃহ উটের মতো হাঁটছে..

উবু হয়ে আসা কুয়াশার মতো হাঁটছে..

হাঁটতে হাঁটতে কালপুরুষ তরবারি হাতে দেখছে..


হাঁটতে হাঁটতেই সকাল দুপুর হয়- দুপুর সন্ধে..

গ্রহাণুর সংঘর্ষে উবে যায় বায়ুমণ্ডল..

লাভার সমুদ্রে ঢাকা পড়ে পৃথিবীর গোটা অঞ্চল..

নিরুপদ্রব শান্ত একশ' কোটি বছর শেষে

ভূপৃষ্ঠ ঢাকে বিশাল বরফের গোলা..

ক্রেটেশাস যুগ বুঝি জানান দেয়

বিশালকায় সরীসৃপের বিদায়বেলা..

হাঁটতে হাঁটতেই 

তামাম হিমালয় জন্ম নেয় টেথিস সাগরে..

হাঁটতে হাঁটতেই মহাকাল এগিয়ে চলে

জাম্বেজীর দক্ষিণ পাড়ে..

রথে চেপে লোহার অস্ত্রে শান দিয়ে

এগিয়ে আসে স্তেপাঞ্চলের শ্বেতাঙ্গ..

নগর সভ‍্যতার সমাধি মাড়িয়ে সুদূর শ্রীলঙ্কায় অন্তরঙ্গ..

কামানের গোলা মুখে নিয়ে আসে সমরখন্দের মোগল..

বাণিজ্য জাহাজের বন্দুক নেয় ভাগীরথী পাড়ের দখল..


হাঁটছে মানুষটা..

ঊরু বেয়ে নেমে আসা রক্তস্রোতের মতো হাঁটছে..

ফেরোমনের গন্ধে শর্করার খোঁজে পিঁপড়ের সারির মতো হাঁটছে..

বহুতলের ছাদ থেকে দেখা মিছিলের কালো কালো মাথার মতো হাঁটছে..

হাঁটতে হাঁটতে আকাশ হতে গঙ্গার ফিতে হওয়া দেখছে..


হাঁটতে হাঁটতেই পৃথিবীটা বন্দী হয় মুঠোফোনের খপ্পরে..

হাঁটতে হাঁটতেই এক সময় ঢেকে যাবে পলিথিনের চাদরে..


""""''''""""""""""""""""""""""""""

বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

মহাদেব নস্কর


এত হিংসার মাঝে

এত পদস্খলনের মাঝে

আমি তোমাকে হারাতে চাইনা।

তোমার কাঁধের উপর

আমার মাথা টুকু রাখতে চাই।

তুমি মোহন , তুমি প্রণম্য

তোমাকে ভালোবাসি তাই।


নিজের কাছে নিজের শান্তি

ভালো-মন্দ সবই তো প্রাপ্ত

কোন না কোন সূত্র থেকে।

কেন তবে দুঃখ, এত অশান্তি!

কেউ ভালোবাসলে তবেই ভালো থাকা যায়

না হলে জীবন বৃথা হয় বুঝি ?


পৃষ্ঠা উল্টে দেখো

কি লেখা আছে প্রকৃতির গায় ;

প্রকৃতি উচ্ছিষ্ট প্রদান করে না

প্রাপ্য টুকুই শুধুমাত্র দেয়।

তুমি তোমার ভালো টুকুই দিও

যে দাঁড়িয়ে রয়েছে নি -আহার।


""""''''""""""""""""""""""""""""""


"মানুষ " 

 কৌশিক গাঙ্গুলী 


আমার স্মৃতির উঠান ছাড়িয়ে 

তীব্র কোলাহল এসে পড়ে নিঃসঙ্গ জীবনে । 

 কোথাও কি আবার অধর্ম ঘটে গেছে নাকি ? 

 বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে আগুনের ছায়া , মৃত্যুর গন্ধ , অমানবিকতার চিহ্ন কাছে আসছে , ভয় পাচ্ছি , রাগ হচ্ছে , যন্ত্রনায় স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি । 

 ভালবাসা কি এতই কমদামী ? 

 বিশ্বাস কি এতই ঠুনকো নাকি ? 

 এটা কি কোন পরিকল্পিত শয়তানি ? ধর্মের রাজনীতিতে দুর্বলের শেষঘন্টা আর গৃহত্যাগের ইশারা , বাসভূমি পুড়ছে , ঘর - দোয়ার তছনছ , ইজ্জত নিয়ে খেলছে পিশাচেরা । 

 তবু ভালবাসার গান শোনাতে হবে , 

 ফেরাতে হবে বিশ্বাসের অটুট বন্ধন । 

 ঘৃণা দিয়ে ধার্মিক সাজা যায় না 

 রক্ত দিয়ে ওপরওলাকে খুশী করা যায় না । 

 হে প্রভু , হে দয়াময় মানুষকে সত্যিকারের "মানুষ " করে তোলো ।

""""''''""""""""""""""""""""""""""


আধখোলা জানলা

মুসাফির গৌতম 


তোমার আধখোলা জানলায় আঁকিবুকি কাটি একটি পূর্ণাঙ্গ অবয়বের,,,কিন্তু যে তোমার জৈবিক আস্তরণের চড়াই-উৎরাই 

ডিঙিয়ে এঁকে দেয় সিংহের পরাক্রমী থাবা-সে তবে কে ?


মায়াবী জাল বিছিয়ে বসে আছ তুমি 

আমি তোমাকে মুক্ত আকাশের স্বপ্ন দেখাতে পারি,,,ঘন ঘোর শ্রাবণী অমাবস্যার 

মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝলকানিতে তুমি উর্বশী হতে পারো,,,কিন্তু জানি তবুও তুমি আসতে পারবে না-কারণ তুমি যে বন্দি।


যে মাপকাঠিতে বিকিয়েছ তোমার সর্বস্ব 

যার স্বপ্ন দেখেছ,,,আজন্ম লালিত শিক্ষায়

তাকে কি সহজেই অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাবে ?


না পারবে না,,, তাই আমি কড়ি গুণে যাই

তোমার আধখোলা জানলায়।

""""''''""""""""""""""""""""""""""


স্বপ্নগড়ার গান

মাহফুজুর রহমান আখন্দ 



মনটা ঘোরে কলের চাকার মতো

স্বপ্নগুলো ভাঙে অবিরত

হৃদয়টাকে শক্ত করে বেঁধে

স্বপ্নবুনি দক্ষ চাষীর মতো


ভাঙা গড়ার নিয়ম খেলা মেনে

রাস্তা চলি পথের খবর জেনে

স্বচ্ছ কাঁচে সতর্কতা মেখে

ভালো স্বপন গড়বো ফুলের মতো


নদীর সাথে পাখির সাথে মিলে

স্বপনগুলো নেই সাজিয়ে 

স্বচ্ছ আকাশ নীলে


বুকের ভেতর লাল সবুজের দেশ

স্বপ্ন গড়ার বানাই পরিবেশ

শিশু কিশোর বৃদ্ধ যুবা সবাই

হাসবে সুখে জোসনা আলোর মতো।



""""''''""""""""""""""""""""""""""

গল্প



জেরা

অয়ন দাস


তারপর ওরা আমাকে ভবানীভবনের স্পেশাল সেলে নিয়ে এলো।আমাকে গ্রেপ্তারের পর প্রথম নিয়ে যাওয়া  হয়েছিল ব্যারাকপুর পুলিশ স্টেশন।সেখানে একঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পরও আমার মুখ থেকে কারো নাম বের করতে পারেনি পুলিশ।পরের দিন কোর্টের নির্দেশে আনা হয় ভবানী ভবনে।


জেল কাস্টডির প্রথম রাত টা ছিল আমার জীবনের এক দুর্বিষহ রাত।আমারই সঙ্গে সেই একই ঘরে ছিল দুজন বৃহন্নলা যাদের প্রতি আমার ছোটোবেলা থেকে এক আতংক আছে।জানিনা ওদের আদৌ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, নাকি আমার উপর নজর রাখবার জন্য ওদের রাখা হয়েছিল আমার সঙ্গে।ওরা আমার দিকে তাকিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করছিল,মাঝেমাঝে আমার শরীরে হাত দিচ্ছিল,আমার মনে হচ্ছিল এক্ষুনি ওরা দুজন আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।হয়ত আমাকে মানসিক ভাবে ভেঙে দেওয়াই  উদ্দেশ্য ছিল পুলিশের।আমার মনে হচ্ছিল এক ঘন দুর্যোগের রাতে আমি দাঁড়িয়ে আছি এক বুক নোংরা জলে।বৃষ্টির দাপট যেন ক্রমশ বাড়ছে।


তারও আগের রাত টা ছিল আরো ভয়াবহ। রাত তখন আড়াইটে।আমরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম।আমরা মানে আমি,আমার স্ত্রী অপা আর ছেলে রোরো।নিচের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন আমার বৃদ্ধ বাবা মা।

ঠিক তখনই প্রায় পনেরোটি টর্চ আমাদের সারা বাড়িকে ঘিরে ফেলে এবং ঘুম ভাঙার পর আমি বুঝতে পারি যে আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য এসেছে  পুলিশ।পুলিশ ভ্যানে ওঠার পর সত্যি বলতে কি বাবা মা রোরো ও অপা'র অসহায় মুখগুলো দেখে আমার নিজের উপর এক খুনে রাগ হচ্ছিল।অনেক আগেই আমার অ্যাবস্কন্ডেড হয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল।


ব্যারাকপুর পুলিশ কাস্টডিতে আমাকে  কতগুলো মামুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়।অর্থাৎ আমার নাম,পেশা,বাবার নাম, আমার চাকরি জীবন,আমার লেখক জীবন এবং সবশেষে এই নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে আমার জড়িয়ে যাওয়া।স্বাভাবিক ভাবেই আমি জানাই যে আমি নির্বিবাদী ভাল মানুষ এবং আমার সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের যোগাযোগ নেই।আমি বলি,আমি একজন ছাপোষা মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী মানুষ, অবসরে কবিতা লিখি এবং ছবি আঁকি।হয়ত ভুল করে আমাকে তুলে আনা হয়েছে।

যে অফিসার আমাকে জেরা করছিল, সে যেন ধরেই নিয়েছিল আমি কিছু বলব না এবং তার জিজ্ঞাসার মধ্যেই ঠিক সেরকম একটা দায়সারা ব্যাপার ছিল।অত মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যেও আমার মনে হচ্ছিল কাজে গাফিলতির অভিযোগে লোকটিকে বরখাস্ত করা উচিৎ।


ব্যস্ততম ভবানীভবনের ভিতরেও যে এমন একটা নির্জন স্থান আছে আমি ভাবতে পারিনি।এক সুদর্শন তরুণ অফিসারকে অনুসরণ করে আমি একটার পর একটা অন্ধকার  ঘর পেরিয়ে যেতে লাগলাম। 

একটা ঘরের মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একজন লোক।টেবিলের উপর ছড়ানো রয়েছে একটি কম্বল,লোকটি গোঙাচ্ছে।ঘরটির সামনে সাদা পোশাক পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুজন পুলিশ।

কাঁধে স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে লম্বা বারান্দা দিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে এপ্রন পরা একজন লোক,ইনি সম্ভবত ডাক্তার।তবে কি স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য লোকটির উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়েছে?লোকটি অসুস্থ হয়ে...


আমাকে পাশের অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে অফিসার ঘড়াং করে দরজা বন্ধ করে দিল।এই ঘর থেকেও পাশের ঘরের লোকটির গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে।


ঘরটি খুব সম্ভবত বৃটিশ আমলে তৈরি। 

 অনেক উঁচুতে একটি বড় ঘুলঘুলি, ঘরে আর কোনো জানলা নেই।ঘরে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার।

আমাকে অন্ধকারে বসিয়ে রেখে লোকটি হাওয়া হয়ে গেল।আমার মনে হতে লাগল সময় স্থির হয়ে আছে।এক অসম্ভব ভয় এবং কাঁপুনি শরীরের গভীর থেকে উঠে এসে আমাকে অস্থির করে তুলল।


আমার মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগের সন্ধ্যের কথা।আমি আর মা নৌকায় ফিরছি শ্রীরামপুর থেকে ব্যারাকপুর। সারা আকাশ ঢেকে গেছে ঘন কালো মেঘে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মুহুর্মুহু। আমি জোওওরে চেপে ধরে আছি মা কে।গঙ্গার জল ক্রুদ্ধ সাপের মত ফুঁসে উঠছে।ভয়ঙ্কর এক ঝড় উঠেছে দীগন্ত জুড়ে।আমাদের নৌকাটা দুলে উঠছে মোচার খোলার মত।আমি মা কে আঁকড়ে ধরে কাঁপছি থরথর করে।


 ঘড়াং করে খুলে গেল দরজা টা।ঘরে ঢুকল এক মধ্যবয়সী বেঁটেখাটো স্থুলকায় টাকমাথা লোমশ  অফিসার। 

ফাইল টা টেবিলের উপর রেখে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সে বলল,তাহলে কি ঠিক করলেন?


মানে?


মানে ভালয় ভালয় সবকিছু বলবেন নাকি...অন্য কিছু প্রয়োগ করতে হবে।


আমি তো আগেই বলেছি আমাকে মিথ্যে ধরে নিয়ে এসেছেন।আমি নেহাত  ছাপোষা লোক।


লোকটি এবার গড়গড় করে পড়ে যেতে লাগল।


রক্তিম চৌধুরী... জন্ম ১৯৭২....স্কুলিং আদর্শ বিদ্যাপীঠ... কলেজ সুরেন্দ্রনাথ...... ছাত্র জীবনে এস এফ আই এর লোকাল কমিটির মেম্বার...১৯৯৮ সালে দলবিরোধী কাজের জন্য পার্টি থেকে সাসপেন্ড... ২০০০ সালে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী র সঙ্গে যোগাযোগ... ২০০২ তে শ্রীকাকুলাম কনভেনশনে যোগদান ও জোনাল কমিটির কনভেনর...২০০৬ এ জঙ্গল মহলে নাশকতার মূল চক্রীদের অন্যতম .. 


লোকটা হয়ত এইবার বলতে শুরু করবে কবে আমার সঙ্গে অপা' র ঝগড়া হয়েছে,কবে আমরা শেষবার মিলিত হয়েছি।আমার খুব কাছের মানুষ বিশ্বাস না ভাঙলে এ হয়না।


লোকটা  সব সত্যি বলছে, তবু আমি নিখুঁত অভিনয় করে বললাম,কী সব বলে যাচ্ছেন, আমি এসব কিচ্ছু জানিনা,আমি কোনো পার্টি ফার্টি করিনা।আমি কবিতা লিখি,ছবি আঁকি,বাচ্চাদের নিয়ে থাকি।প্লিইজ বিলিভ মি।


আমার আচমকা মনে পড়ে গেল অপা'র মুখ।অপা হাঁপাচ্ছে...তার চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে...দরজার বাইরে থেকে অসহায় চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে মা...ঘরের কোণে বসে এক মনে ছবি আঁকছে আমার ছেলে।


তুমি অনেক, অনেক নিচে নেমে গেছো... বলো তুমি আমাকে মিথ্যে বলে তৃষার  সঙ্গে দেখা করোনি?তৃষা'র ফাঁকা ফ্ল্যাটে দিনের পর দিন....আমাকে দিনের পর দিন ঠকাতে তোমার বিবেকে এতটুকু...


আমি ভাবছিলাম,অপা এত নিখুঁত ভাবে জানলো কি করে...আমার মোবাইলের মেসেজ গুলো কি সবকটা ডিলিট হয়নি..কিভাবে.. কিভাবে জানল এই সত্যি!


আমার চোখের সামনে চকিতে ভেসে উঠছিল তৃষা'র মুখ।সেই গভীর কালো চোখ।যে চোখে আমি দেখতে পাই আমার প্রতি ওর প্রশ্নহীন,সীমাহীন আনুগত্য। এক অগাধ শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালবাসা যা আমি অপা'র কাছে কখনো পাইনি।আমার আলিঙ্গনে ধরা দেওয়া থরথর করে কাঁপা ওর তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের স্মৃতি সেই মুহূর্তেও আমাকে ব্যাকুল করে তুলেছিল।


আমি অপা'কে শান্ত করার জন্য হাসতে হাসতে বললাম তুমি একটা বদ্ধ উন্মাদ!তৃষা!...হায় ভগবান! তুমি আর লোক পেলেনা!

আমি জানি অপা আমাকে  ভালবাসে,সেই ভালবাসা থেকে জন্ম নিয়েছে অনিশ্চয়তা,অনিশ্চয়তা থেকে রাগ,রাগ থেকে কষ্ট, কষ্ট থেকে হিংসা...আর হিংসা থেকে ঘৃণা.... 


সম্প্রতি পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির সঙ্গে আপনার বনাবনি হচ্ছেনা,তাই তো।টাকমাথা সিগারেট ধরালো।

জঙ্গল মহলে মাইন বিস্ফারণের পরের দিন কমরেড অনিক অ্যবসকন্ডেড হয়ে যায়।আপনি তাকে আপনার কোনো এক চেনা ডেরায় পাঠিয়ে দেন,সেটা কোথায়? অনিক এখন কোথায়?


আমি অনিক নামে কাউকে চিনিনা।সরি।

আমি খুব সাবলীল ভাবে বলি।


তুই সিগারেট ধরেছিস?  ছি ছি...এখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোস নি,এর মধ্যে সিগারেট?

মা ঠাস করে আমার গালে একটা থাপ্পড় মারে।আমার গাল টা জ্বলতে থাকে।রাগে,অপমানে আমার চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।আমি বুঝতে পারি আমার জামার পকেটে একটা আধ খাওয়া সিগারেট রেখেছিলাম,মা জামা কাচতে গিয়ে....


টাকমাথা আমার কাঁধে হাত রাখে,মুখ নামিয়ে আনে আমার মুখের কাছে,খুব নরম সুরে বলে,কী করবেন মশাই বিপ্লব  করে,আমরাও কংগ্রেস আমলে ভাবতাম বিপ্লব করে সমাজ বদলাবো। ওসব হয়না মশাই। নেতারা আখের গোছাতে গোছাতেই আপনাদের বিপ্লবের পোঙা মেরে দেবে।বলুন অনিক কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?


বললাম তো অনিক বলে কাউকে আমি চিনিনা,আর কতবার কতভাবে বললে আপনি বিশ্বাস করবেন?আমি এবার খানিকটা গলা চড়াই।


চোপ শালা! শুয়োরের বাচ্চা! টাকমাথা ধমকে ওঠে।


চোপ! এক থাপ্পড় মেরে তোর সবকটি দাঁত ফেলে দেব।

পরীক্ষায় টুকতে গিয়ে আমি ধরা পড়ে যাওয়ার পর বাবাকে স্কুলে ডেকে পাঠানো হয়।যদিও বাবা'র কাছে আমি অস্বীকার করে যেতে থাকি ক্রমাগত।


বাবা'র চিৎকারে আমি গুটিয়ে যাই।আমি থরথর করে কাঁপতে থাকি।এক ভীষণ ভয় আমাকে গ্রাস করতে থাকে।

সেই বয়সে বাবা কে মনে হত পৃথিবীর সর্বশক্তিমান,এমনকি দেবতাদের থেকেও শক্তিমান।


নাঃ তুই ভাল মুখের মানুষ না....টাকমাথা আমার মুখে সজোরে এক ঘুঁসি মেরে দড়াম করে বেরিয়ে যায়।এক নিচু পদের পুলিশ কর্মি আমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিতে থাকে।

আমি বুঝতে পারি আমাকে কম্বল দিয়ে মুড়ে হয়ত লাঠি পেটা করবে।কম্বলের উপর দিয়ে মারলে দাগ থাকেনা।


আমি হাসতে থাকি,মনে মনে বলি,তোরা আর নতুন করে মেরে বা জেরা করে আমার মুখ থেকে কী স্বীকারোক্তি আদায় করবি!সারাটা জীবন মার খেতে খেতে...।


.... সারাটা জীবন.... একটা লাগাতার ইন্টারোগেশন...।


""""''''""""""""""""""""""""""""""



স্মৃতি টুকু থাক 

প্রণতি গোস্বামী


"তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবোনা" 

আজ অকপটে বলি, যখন তুমি নেই। আমার প্রথম প্রেম কিশোর মন তখন, প্রথম বসন্তের হাওয়া লাগছে সদ্য। মনটা উড়ছে শরতের মেঘের মতোন, ঠিক তখনই দেখা পেলাম আমার ফুল মাসীর। ফুল মাসীর মনটা ফুলের মতোই স্বচ্ছ, আনন্দের ডালা সাজানো। সবাইকে ভালো বাসতে জানেন, পাড়া প্রতিবেশী, পোষ্য,গাছগাছালি সবের সাথেই সখ্য ভাব। 

অপূর্ব গান গাইতেন, আবৃত্তি করতেন। হাতের কাজের তুলনা ছিলোনা, সুতোর কাজ, উলের সোয়েটার সব নিপুন হাতে করে যেতেন। 

ফুল মাসির একটাই ইতিহাস  ছিলো সেটা হলো মাসীর বিয়ের রাতে দূর্ভাগ্যবশত বরযাত্রী এসে খবর দিয়েছিলো যে বরকে সাপে কামড়েছে এবং বর বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছে। সবাই ১৬ বছরের মাসীকে লগ্নভ্রষ্টা বলে দুষলো। অমন সুন্দর আমার মাসীর এই হেনস্তা জীবন ভোর থাকলো সাথে। মাসী সব করে অথচ কোন শুভকাজে তাকে ডাকা হয়না, তাই মাসীও নানান মিষ্টি অজুহাতে শুভকাজ গুলো এড়িয়ে যান।

      আমার মামাবাড়ি যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ ফুল মাসী। সারাক্ষণ জোঁকের মতো আটকে থাকতাম মাসীর গায়ে। মাসী অনেকবার আমাকে বলেছেন তুই আমার পিছধরা কেনরে? যা সবার সাথে খেলবি যা। আমি কখনো বলতে পারিনি ফুলমাসী আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। মাসীর হাত নিয়ে নাকের কাছে ধরতাম, মাসী জিজ্ঞেস করতো কি শুঁকেছিস, এখনই মাছ ধুলাম এককাঁড়ি তাই হাতে আঁশটে গন্ধ। ছাড়তো ছাড় হাতে একটু সরষে তেল লাগিয়ে আাসি, আমি কিন্ত ছাড়িনা মাসীর হাত। বলতে পারিনা মাসী তোমার সবটুকুই আমার ভীষণ প্রিয়, তুমি ঠিক আমার মায়ের মতো। 

         আমার ভীষণ অপছন্দের রঙ সবুজ, সেই সবুজ রঙের মাসীর হাতে বোনা সোয়েটার আমার একমাত্র শীত বস্ত্র হয়ে গেলো। এই সোয়েটার হাতে পেয়ে ওনার সামনেই নাক সিটকেছিলাম "ধুস সবুজ, এ ভালো নয়।"

     ক্রমে বড় হলাম,সংসারের চাপ সব ভুলিয়ে দেয়।মামাবাড়ি আর যাওয়া হয়না তেমন। সবে চাকরিতে ঢুকেছি খবর এলো মাসীর শরীর খুব খারাপ। মা ও ভাই গেলো দেখতে ফেরত এলো সাথে দুঃসংবাদ নিয়ে, মাসী মারা গেছেন এনসেফালাইটিস রোগে। মা বলেন "ফুল মাসী খুব হতাশ হয়েছিলেন তুই না যাওয়ায়। বার বার বলেছিলেন আমার বুকুুন সোনা একবারটি এলোনা?"

মা আমার হাতে একটা ঘন নীল রঙের হাফ সোয়েটার দিয়ে জানান এটাই মাসীর শেষ হাতের কাজ তোর জন্য রেখে গেছে। সোয়েটারের পিছনে মাসী সুতো দিয়ে ছোটোকরে বুকুনসোনা লিখে দিয়েছিলেন।

       ডিসেম্বরের ঠান্ডায় সোয়েটারটা গায়ে দিলাম, বুকুনসোনা লেখাটা বুকে কাঁটা বেঁধাচ্ছিলো। সোয়েটার টা দিয়ে চোখ মুছে মাসীর উদ্দেশ্যে বলি "ফুলমাসী জন্মান্তর বলে যদি কিছু থাকে তবে তুমি আমার মেয়ে হয়ে এসো, আমি তোমাকে বুকে ধরে রাখবো"।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ