দর্পণ | ধারাবাহিক কলম | কংসাবতী { পর্ব - ১৪} মহুয়া




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


 কংসাবতী (পর্ব --১৪)

উপস্থাপনায় ~ মহুয়া 


কলকাতা শহরের লেক গার্ডেনসের পশ এরিয়ার একটি বড়ো তিনতলা বাড়ি । 

বাড়ির সামনেটায় বেশ সুন্দর বাগান আছে খানিকটা । বোঝাই যায় এই বাড়ি যিনি তৈরি করেছেন তিনি যেমন শৌখিন তেমন বিত্তবান । বাড়ির নামখানাও বেশ মিষ্টি ,"গুলমোহর"।গুলমোহরের আর এক নাম কৃষ্ণচূড়া । বাড়ির বাউন্ডারির এক কোনায় একটি গুলমোহর বা কৃষ্ণচূড়ার গাছও ডালপালা মেলে প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে । বাড়ির গেটে দারোয়ান রামদিন , এ বাড়ির বহু পুরনো লোক । প্রতুলের ঠাকুরদার আমলের । রাত প্রায় দশটা নাগাদ প্রতুল একটি ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরে শরীরে আঘাত নিয়ে অসুস্থ অবস্থায় ।

------ আর এ বাবুয়া , তুমহারা অ্যায়সা হাল ক্যায়সে হুয়া ? কৌন আক্সিডেন তো নেহি হুয়া না ? মুঝে পাকড়ো, তুম চল নেহি পা রহে হো । আই বাপ , তুমার তো বুখার হয়ে গেছে । ডাগদার বাবুকো ফুন করনা পড়েগা । মা জী , ও মাজী , দরওয়াজা খোলিয়ে , বাবুয়া কা তবিয়ত খারাব আছে । জলদি খোলিয়ে । 

----- একি !!! টুবলু ,কি হয়েছে তোর ? এই অবস্থা হোলো কি করে ? কি হয়েছে ? একি জ্বরে যে গা পুড়ে যাচ্ছে । রামদিন শিগগির ডাক্তার বাবুকে খবর দাও । হে ভগবান আমি কি করবো এখন ? তোর বাবাও নেই যে --- 

----- মাজি ডাগডার সাব আধা ঘন্টা মে এসে যাবে । আপনি বাবুয়া কা ডিরেস ছোড়োয়াইয়ে । এধার উধার খুন কা ধাব্বা আউর গন্ধা ভি হো গয়া । আপনি কাপড়া লিয়ে আসেন । আভি পুছাতাছি মত কিজিয়ে । ©️

------ রামদিন ওষুধের দোকান খোলা থাকবে এত রাতে ? 

----- আপ চিন্তা মত কীজিয়ে , ডাগদার সাব কো আনে দিজিয়ে পহলে। আভি হম গেট কে পাস যাতে হ্যায় । ডাগদার সাব আয়েঙ্গে । 

কলকাতার বেশ নামকরা মেডিসিনের ডাক্তার তরুণ চ্যাটার্জি । প্রতুলের বাবার সাথে বেশ জানাশোনা আছে । বলা যায় উনিই ওদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান । ডাক্তারের গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেলো ।

------ আসুন ডক্টর চ্যাটার্জি , এই দেখুন ছেলেটার এমন অবস্থা কি করে হোলো বুঝতে পারছি না । একটাও কথা বলছে না , গায়েও খুব জ্বর । 

------ কোথাও পড়েটরে গিয়েছিলে নাকি টুবলু ? মাথায় কি স্টিচ পড়েছে ? পায়ের আঘাত টাও তো বুঝতে পারছি না ,ব্যান্ডেজ করা । কোথায় কোথায় স্টিচ পড়েছে ? 

----- মা আমার প্যান্টের পকেটে একটা কাগজ আছে মনে হয় , ওটা আঙ্কেলকে দাও ।

----- এই নিন । 

------ আর এ , এতো এন আর এসের প্রেসক্রিপশন । হুমম , মাথায় , পায়ে স্টিচ আছে । আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি , আশাকরি জ্বরটা রাতেই ছেড়ে যাবে । খেয়েছ কিছু ? 

------ না , এই তো আধাঘন্টা আগে এই অবস্থায় এলো । 

------ আচ্ছা , কিছু খাইয়ে দিন , ওষুধগুলো খেতে হবে । রামদিন কে বলুন আমার সাথে আমার গাড়িতে করে ওষুধের দোকানে গিয়ে ওষুধ গুলো নিয়ে আসতে । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওষুধ পড়া প্রয়োজন । পরমেশ কবে ফিরবে দিল্লী থেকে ? 

------ এই তো তিনদিন আগেই গেলো , একটা কনফারেন্স আছে। ঠিক জানিনা কবে ফিরবে ? কাল ফোন করে বললো আগামীকাল থেকে কনফারেন্স শুরু হবে তিনদিনের ।

রাতেই ওর বাবাকে ফোন করে বলি সব , তারপর দেখি কি হয় ? এই নিন আপনার ফিস টা । 

----- ওকে তাহলে আসি , দরকার পড়লে ফোন করবেন অবশ্যই । ।

ডাক্তার চলে যায় , প্রতুলের মা সবিতা দেবী খাবারের ব্যবস্থা করতে গেলেন । এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো । সবিতা দেবী দৌড়ে এসে ফোন টা তুললেন , কিন্তু কেটে গেলো । ©️

তারপর আর লাগলো না ফোনটা । যদিও সবিতা দেবী জানতেনই যে ফোনটা পরমেশ বাবুই করেছেন । রোজ রাতে পরমেশবাবু খোঁজখবর নেন ফোন করে । আজ এত দরকার অথচ ফোনটাই লাগছে না । খুব অসহায় লাগলো সবিতা দেবীর নিজেকে । প্ৰতুলের মাথার কাছে বসে থাকতে থাকতে রাত ভোর হয়ে এলো । চোখটা তন্দ্রায় বুজে আসতেই হঠাৎ ফোনের আওয়াজে সবিতা দেবী ধড়মড় করে উঠে ফোনটা ধরলেন । ঘড়িতে প্রায় বেলা ন টা । 

------ হ্যালো , কাল রাতে আর ফোনটা কিছুতেই লাগলো না , এত দরকার ছিল তোমাকে । অথচ ফোনটা কেটে যাবার পর আর লাগলই না । টুবলু কাল খুব অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে অনেক রাতে। রোজদিন আটটার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যায় ,কাল রাত প্রায় দশটার সময় উন্ডেড অবস্থায় বাড়ি ফেরে । কিভাবে এমন হোলো এখনও জানি না জানো । প্রচণ্ড জ্বর আর সারা গায়ে আঘাত নিয়ে ফিরেছে । কিচ্ছু বলেনি আর বলার মত ক্ষমতাও ওর ছিল না । আমি রামদিন কে দিয়ে ডক্টর চ্যাটার্জী কে কল দিয়ে এনেছিলাম । উনি ওষুধপত্র দিয়ে গেছেন । এখন ঘুমোচ্ছে । উঠলে জিজ্ঞেস করবো । একনাগাড়ে কথাগুলো বলে সবিতা দেবী থামলেন 

------ ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে হবে না , আমিই বলে দিচ্ছি । কাল ওর কলেজে ডিগ্রি কোর্সের পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভেতর ঝামেলা হয়েছে । তোমার ছেলে সেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে একটি আদিবাসী মেয়ের জন্যে । সেই মেয়েটির সাথে নাকি ওর ঘনিষ্ঠতা আছে । 

------ তুমি কি করে জানলে এতো কথা ?

------ আনন্দবাজার পেপারটা পড় , তাহলেই জানতে পারবে । প্রথম পাতাতেই আছে তোমার সুপুত্রের কীর্তিকাহিনী ।

---- সেকি ,কি বলছ তুমি ? এসব তো কিছুই বলেনি । থানাপুলিশ হবে নাতো আবার ? 

----- না সেসব হবে না হয়তো । কলেজের প্রিন্সিপাল অতি সজ্জন মানুষ ,তিনি ব্যাপারটা সামলে নিয়েছেন । মেয়েটির অবস্থা ভালো নয় । অনেক বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে ।

----- টুবলু নিশ্চয় মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে ঝামেলায় পড়েছে । ওসব পেপারওলারা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে । আসলে এসব আজেবাজে কথা দিয়ে স্টোরি বড় করা আর কি !! আদিবাসী মেয়েটার সাথে টুবলুর কেনো সম্পর্ক হবে ? যত্তসব উল্টোপাল্টা কথা । আমি প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলবো কাল । তুমি ব্রেকফাস্ট করেছো ? চিন্তা কোরো না । তুমি ধীরেসুস্থে তোমার কাজ করে ফিরে এসো । রাখছি , বলে ফোনটা ক্রেডেলে রেখে দিলেন সবিতা দেবী । 

হালকা গোঙানির আওয়াজে ছেলের কাছে ছুটে গেলেন সবিতা দেবী । মাথায় হাত রেখে দেখলেন জ্বর আছে কিনা ? তারপর আলতো করে মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন । আস্তে আস্তে ডাকলেন ছেলেকে ।©️

----- টুবলু , টুবলু ওঠ এখন , কিছু খেয়ে নে । ওষুধ খেতে হবে । ওঠ আস্তে আস্তে । আমি চা করে আনছি । এক্ষুনি আলো চলে আসবে রান্না করতে ।

----- মা , আমার পিঠের দিকে দুটো বালিশ দিয়ে দাও , আমি হেলান দিয়ে বসবো । আর তোমার সাথে কথা আছে । তুমি বোস । আলো দি আসুক । চা জলখাবার করে দেবে । 

----- তুই কি ভেবেছিস আমি কিছু জানি না ? 

এই দ্যাখ , বলে আনন্দবাজার পত্রিকা টা ছেলের সামনে দেয় । প্রতুল একটু চমকে ওঠে । কিন্তু পরক্ষণেই বিমর্ষ হয়ে যায় । 

------ কলেজে এত বড় একটা ঘটনা ঘটলো তুই আমাকে কিছুই জানালি না কাল ? তোর বাবা ফোন করে না জানালে আর ও দেরি হোত জানতে । কে একটা আদিবাসী মেয়ে , তার জন্যে তুই কিনা মার খেলি ? কেনো ওই ঝামেলার মধ্যে না গেলে কি হোত ? 

------ মা , ছোট থেকে তুমিই বলেছ কেউ বিপদে পড়লে তার পাশে দাঁড়াতে । সেই তুমি কিনা আজ এমন বললে শুধু আমার কটা কাঁটাচেরা দেখে ? আর যে মেয়েটা মৃত্যুর সাথে লড়ছে তার মায়ের অবস্থাটা একবার ভেবেছ ? নাকি তুমিও আজ থেকে স্বার্থপর হবার শিক্ষা দেবে ? 

------ দ্যাখ নিজে সুস্থ থাকলে , ভালো থাকলে তখন অন্যের পাশে দাঁড়ানো অনেক সহজ হয়ে যায় সেটা তো বুঝতে হবে । 

------ কিন্তু ওরা যে এমনভাবে তেড়েফুঁড়ে মারবে সেটা তো বুঝিনি । ওরা তো আমাদেরই সতীর্থ । কি করে বুঝবো একটি পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর মেয়ের ভালো রেজাল্ট ওদের এমন হিংস্র করে তুলবে ? আমি তো থামাতেই চেয়েছিলাম কিন্তু ওরা এমন অপমান জনক কথা বললো যে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারিনি । কিন্তু একটা দুশ্চিন্তা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে ।©️

----- কিসের দুশ্চিন্তা ? তাছাড়া পেপারে দেখলাম লিখেছে ওই মেয়েটা র সাথে তোর ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে ? শেষে কিনা আদিবাসী মেয়ে ? তোর রুচিতে বাঁধলো না ? 

------ মা ,আর্তনাদ করে উঠলো প্রতুল । প্লিজ তুমি সুচি কে নিয়ে কিছু বোল না । অত্যন্ত ভালো মেয়ে ও , ভীষন মেরিটোরিয়াস । এইচ এসে স্টার পাওয়া মেয়ে । আদিবাসী বলে ও কোনো অংশে কম নয় আমাদের থেকে । আর তাছাড়া আমি যখন প্রথমবার বাঁকুড়ায় গিয়েছিলাম প্রজেক্টের কাজে তখন ওদের বাড়িতেই ছিলাম । আমি কখনো বুঝতেই পারিনি ওরা আর আমরা আলাদা । প্লিজ মা , তুমি তো সব সময় মানুষের কথা বলো তবে আজ কেনো এসব বলছ ? সুচি দের আর্থিক অবস্থা একদম ভালো নয় । কাল শুনে এসেছিলাম ওর অপারেশন করতে প্রায় লাখ খানেক টাকা লাগবে । কোথায় পাবে ওরা ? ওর বাবাও খবর পেলো কিনা জানিনা । আমাকে আজ একটিবার হাসপাতাল যেতে দেবে মা ? 

------ টুবলু , সবিতা দেবী চিৎকার করে ওঠেন । তুই কি পাগল হয়ে গেলি ? শরীরের এই অবস্থায় তুই ঠিক করে হাঁটতে পর্যন্ত পারছিস না , আর তুই হাসপাতাল যাবি ????

------ প্লিজ মা , তুমি ওদের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করো । তুমিও তো গরীব ঘরেরই মেয়ে , সুন্দরী বলে দাদু তোমাকে বউ করে নিয়ে আসে । তুমি ভাব , আজ তুমি অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক সুবিধাজনক জায়গায় আছো বলে এমন বলতে পারছ কিন্তু ওরা ?? প্লিজ মা হেল্প করো যেভাবেই হোক । বাবাকে কিছু বোল না । 

------ কিন্তু এত টাকা কিভাবে দেবো তোর বাবাকে না জানিয়ে ? 

------ কেনো মা দাদু তো তোমার নামে টাকা রেখে দিয়েছে আলাদা অ্যাকাউন্টে । ওই টাকা তো তুমি কখনোই তোলো নি । তাছাড়া বাবা তো তোমার কাছে কখনো হিসেব চায় বলে দেখিনি । তুমি পঞ্চাশ হাজার দাও , আমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে স্কলারশিপের যে টাকাটা জমেছে সেটা থেকে পঞ্চাশ হাজার দেবো । ওই টাকা তো আমার জমছে তবুও একটা ভালো কাজে লাগলে অসুবিধা কোথায় ? প্লিজ মা তুমি রাজি হয়ে যাও , নইলে যে ওকে বাঁচানো যাবে না । 

প্লিজ মা, প্লিজ প্লিজ ।

------- তা তুই টাকা পৌঁছবি কি করে ? ©️

------- তুমি রামদিন কাকা কে দিয়ে তুলিয়ে নিয়ে এসো । আমি আমার ক্লাসমেট পল্টু আর দেবেশ কে ফোন করে দেবো । ওরা গিয়ে হাসপাতালে টাকাটা দিয়ে আসবে ।

 ------ এতগুলো টাকা ওদের হাতে দিয়ে দিবি ? ওরা যদি হাসপাতালে জমা না করায় তখন? যদি অস্বীকার করে ? 

------ তাহলে রামদিন কাকা যাবে ওদের সঙ্গে । বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। ওরা টাকা জমা দিয়ে আসবে । প্লিজ মা তুমি না কোরো না , প্লিজ 

------ তুই কি জানিস তোর বাবা যদি শোনে আদিবাসী মেয়ে র সাথে তোর সম্পর্ক আছে তাহলে বাড়িতে প্রলয় ঘটে যাবে ।  

----- ঠিক আছে বাবা তো এখন নেই , তুমি না বললে বাবা কিছুই জানতে পারবে না । তুমি যদি সুচি কে দেখো তাহলে সত্যিই আর এই কথাগুলো বলতে পারবে না ।দেরি হচ্ছে মা । তুমি রামদিন কাকা কে ব্যাংকে পাঠাও উইথড্রল স্লিপ লিখে । আমি ওদের ফোন করি । 

----- রামদিন , রামদিন ওপরে এসো , দরকার আছে । ব্যাংকে যেতে হবে , সবিতা দেবী ডাকেন 

----- হ্যালো পল্টু , তুই আর দেবেশ একবার আমার বাড়ি আসবি এক্ষুনি ? খুব দরকার ।


একঘন্টার মধ্যে রামদিন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ঢোকে । রামদিনের থেকে টাকাটা নিতে গিয়ে সবিতা দেবীর মুখটা শক্ত হয়ে যায় । রামদিন বেরিয়ে গেলে সবিতা দেবী প্রতুল কে বলেন , আজ আমার ভূতপূর্ব দারিদ্র্যতার উদাহরণ টেনে তুই আমাকে আমার জায়গাটা দেখিয়ে দিলেও টাকাটা আমার নিজস্ব আয় নয় তাই এই টাকাটা তোর হাতে তুলে দেবার আগে আমার একটা শর্ত আছে ।


 (চলবে)

আগের পর্ব পড়ুন ...


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ