দর্পণ || কবিতাগুচ্ছ || প্রোজ্জ্বল রায় চৌধুরী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

ইলিশ কথা


আমাকে দেখুন আপনারা, শুনুন আমার কথা।

হ্যাঁ, আমিই সেই গর্ভবতী নারী, হতভাগ্য মা,

যাকে নিয়ে আপনারা,কাব্যে গল্পে কতো আদিখ্যেতা করেন,

কিন্তু রাখেন জনতার চরিত্রে,

আর খাবার পাতে,

যে আপনাদের,স্বপ্নের ভোগ্য পণ্য,

যেন উর্বশীর মতো কামনার শ্রেষ্ঠ ভোগ্যা নারী---

হ্যাঁ, আমি সেই নারী, সেই হতভাগ্য মা - ইলিশ।

যার স্বাদ যেন ষোড়শীর  যৌবন।

আমাকেই ভালোবেসে বলেন -জলের রাণী। 

হ্যাঁ, রাণীই বটে,

মানুষের  রাণীর মতোই রাজার ভোগ্যপণ্য।

যুবরাজ উৎপাদনের উর্বর ক্ষেত্র।

আর কন্যা  হলে?

সুয়ো থেকে দুয়ো , সতীন কাঁটা রাণী।

রাজ্যের অধিকার নেই,রাজত্বে অধিকার নেই,

এমন কী নিজের স্বামী- রাজার ওপরও নেই অধিকার।

শুধুই রাণী।শুধুই ভোগ্যপণ্য।

আমি বা আমরা তেমনই--

রাজারূপী জনতা- আপনাদের ভোগ্যা নারী।

 ভাগ্য বদলের অধিকার হীনা

অসহায় গর্ভবতী   নারী,

এমন অভাগী মা,যে না পারে  নিজেকে বাঁচাতে,

না পারে নিজ ভ্রূণ বা সন্তানকে রক্ষা করতে।

ঠিক আপনাদের কিছু ভ্রূণ কন্যার মায়েদের মতো।

না না রাণী নয়, আমি অবিকল ওদের মতো সাধারণ নারী।

তবে ওদের থেকে আমি স্বাধীন।

আমি বাধাহীন সাগরের নীল ঢেউয়ে ভেসে,

আমার পুরুষের পাশে পাখা মেলি।

কিন্তু যখনই গর্ভে প্রাণ আসে,

যখন মা হওয়ার আনন্দ

জল চুঁইয়ে আসা রোদের মতো,

বুক আলোয় ভরিয়ে  দেয়,

তখন মাতৃত্বের টানে সাগস বাস ছেড়ে,

নোনা ঢেউয়ের আঘাত থেকে 

সন্তানকে বাঁচাব বলে,

চলে আসি পুণ্যতোয়া নদীতে।

স্বপ্ন আমার --

বাছা মোর জন্ম  নিক । বাঁচুক।

ওদের পিতা এঁকে দিক ওদের মুখে,

জীবনের চুম্বন, খাদ্যের আড়ালে।

আর  আপনারা, শিকারীর মতো

জালে তুলে, গর্ভের ভ্রূণসহ,

হত্যা করেন আমায়।

ঠিক যেমন, বহু কন্যাভ্রূণের  মাকে,

আজও ভ্রূণসহ হত্যা করেন,চরম নিষ্ঠুরতায়।

যেমন কচি মেয়েকে বিয়ে দিয়ে,

কোনো পুরুষের ভোগ্য করে

জীবন শেষ করেন হতভাগীগুলোর।

তেমনই

আমার নবজাতকেরাও হয় আপনাদের  লোভের শিকার ।

খোকা ইলিশ- কম দামে বিকোয় আপনাদের বাজারে,

আমাদের ভবিষ্যৎ।

আবার আপনারা যেমন নিষিদ্ধ বাজারে,

নারীকে উলঙ্গ করে বেচেন,

লোভাতুর চোখ,নিষ্ঠুর ভাবে

শরীরের গড়ন দেখে, শরীর টিপে,

নারীর দাম ঠিক করে

মেয়েগুলো যেমন বাঁচার জন্য ছটফট করে,

ঠিক তেমনই আমরাও জালে ওঠার পর,

বাঁচার জন্য ছটফট  করি।

তার পর মরে যাই।

বহু হাত ঘুরে বাজারে আসে,

আমার  লাশ, যার ওপর আমার কোনো অধিকার নেই।

আবার সেই লোভাতুর চোখের ভিড় জমে,

আমার ওজন দেখে, কানকো দেখে পেট টিপে,

আমার লাশের দাম হাঁকা হয়।


আর  আপনাদের   নিষিদ্ধ পল্লীতে যেমন চলে 

ভোগের বাজার,

নারী শরীরের বিনিময়,

ঠিক তেমনই আমার মরা শরীর নিয়ে চলে,

ভদ্রসমাজের ভোগের বাজার।

মেছো হাঁকে-,কেজি হাজার , কেজি আটশো।

অথচ আমার জীবনে ওর কোনো অধিকার ছিল না।

এমনকী আমার পেটের ভ্রূণ,

আমার হবু সন্তান,

ওরাও পোয়াতি মায়ের লাশের সাথে কেজি দরে বিকোয়।

আপনাদের সর্বগ্রাসী জিভ,

তাদের ডিম বলে খায়।

আমার নিয়তির  সাথেই,

ওদের কপালও  লেখা হয়ে যায়।

যেমন বারবনিতার মেয়েকেও

বারবনিতার ভাগ্যলিপি দেওয়ার চেষ্টা করে আপনাদের সমাজ।

আর এভাবেই  নারীর  সত্তা জুড়ে চলে,

আপনাদের ভোগের মোচ্ছব।

আমিও নারী ,তার ওপর মাছ নারী,

আমারো সত্তা জুড়ে চলে ভোগের   ঘনঘটা।

আমার শরীর কেটে, ঘরে ঘরে,

রান্নার  ধুম পড়ে যায়।

আমার  সত্তা নিয়ে  শুরু হয় উৎসব।

আপনারা গাল ভরা নাম দিয়েছেন-

ইলিশ ফেস্টিভ্যাল। আমার প্রাণের মূল্যে।

আর আমায় খাওয়ার শেষে,

আঁশ  কাঁটা সব আস্তাকুড়ে ফেলে,

বেমালুম ভুলে যান আমায়।

ঠিক যেমন ভোগের পর,

ওই নারীকে আর মনেও রাখেন না।


হ্যাঁ সমাজ,আমিই সেই

আবহমানের ভোগ্যা নারী,

যাকে ভোগ করে গড়ে উঠেছে,

আপনাদের সুখের সভ্যতা।

আমিই  সেই নারী,

আমার কথা শুনুন আপনারা।

=====

 ভোট পাখি


 ভোট পাখি উড়ে আসে 

ভোট মরসুমে।

ভোট দাও গান ধরে

ফুল ভলিউমে।।


রাস্তা আটকে পাখি

করে সমাবেশ।

যানজটে পাবলিক 

নাকালের শেষ।।


মাইকেতে বলে পাখি,

চেনা সেই কথা।

রাত দিন চিৎকারে 

ধরে যায় মাথা।।

বলে পাখি --"আমি আছি

অত কেন ভাবো?

কী কী চাই জাস্ট বলো,

সব এনে দেবো।

আকাশের চাঁদ-তারা 

তাও যদি চাও।

তাও দেব ,

শুধু এসে ভোট দিয়ে যাও।।

আপদে -বিপদে বা সব দরকারে।

আছি আমি!

আমাকেই ভোট দিস ওরে!!!

আমাকে যদি পারো

এইবার জেতাতে।

স্বর্গটা এনে দেব 

তোমাদের পাড়াতে।।""


প্রতিশ্রুতির যত  

গালভরা কথা -

আওড়ায় পাখি -

শোনে --

বুড়ো থেকে  খোকা।।


"ওরে পাখি

তোদেরকে চিনি হাড়ে হাড়ে।

ভোটের বেলায় শুধু 

আসিস যে উড়ে।।

মিটে গেলে ভোট,

তোর   টিকিটি পাবো না।

তখন ধরবি পাখি,

অন্য গাওনা।।

আমাদেরই ধান পাখি,

টুপিটি  পরিয়ে

পকেটেতে পরো  পাখি --

কলা টি দেখিয়ে।। 

এ ঝাঁকে ও ঝাঁকে পাখি,

নেক্সাস করে,

আমাদেরই ধান লোটে,

গোলা  ভরে ভরে

আমরা হা-ভাতে  রই

সকাল  কি সাঁঝ।

পাখির আঙুলটি ফুলে 

হয় কলাগাছ।।

পাখি ----------   

 তোমাদের ঠোঁট নখ

একই রয়ে যায়।

পালকের রঙ টাই 

শুধু বদলায়।।


বারে বারে পাখি  শুধু খেয়ে যাবে ধান?

এবারে আমরা তব

বধিব পরান।।""


পাল্টা এ গান যদি

পারতাম শোনাতে, --

মাঠ ছেড়ে ভোট পাখি,

চাইত যে পালাতে।।


কিন্তু,,,


আমরা সুবিধাবাদী,

করি না তো প্রতিবাদ -

সব শুধু দেখি--

রেখে হাতের ওপরে হাত।।

মনে ভাবি --

ধ্যাত্তেরি, 

                 প্রতিবাদে কী হবে?


আমার কথায় কী এ সিস্টেম, পাল্টাবে?

তার থেকে চুপ থাকি

ঝামেলায় কাজ নেই।

যে ভাবে চলছে যা,

চলুক না সেভাবেই।।


আর

  শিরদাঁড়াহীন এই 

প্রতিবাদ হীনতায়।

"লুটে খাও" পাখিদের 

সাহসটা বেড়ে যায়।।

আমাদের "চুপ থাকা"র সুযোগ টি নিয়ে।।

পাখি

আমাদেরই ঠোকরায়  

বেপরোয়া হয়ে।


ভীতুর ডিমটি তাই

সব সই মুখ বুজে।

চাঁটি মারে ওরা।

মার খাই ঘাড় গুঁজে।


এমনটা  আসছে চলে।

যুগ যুগ ধরে,

ছিলাম যে তিমিরে 

তাই  রবো সে তিমিরে।।

=====

 সেই চেনা গল্প আবার বলব


 গনগনে সময়, নাকে মুখে  কিছু  গোঁজা,

পশুর মতো খাটনি,  টানাটানির  রজনামচা,

 এলোমেলো কথা, কম দামী কিছু স্বপ্ন,

আর, এক ফুসফুস  ধোঁয়া,

আর তো কিছুই ছিলনা,

তবু সব থেমে গেলো।


সকালের সাইরেন থেমে গেলো,

মেশিনের ঘর্ঘর , ঘামে ভেজা শরীরের  ছোটাছুটি,টিফিন, আর, বেঁচে থাকার ন্যূনতম  দরকার,

সব থেমে  গেলো।

আর হাঁড়িতে ভাত চড়বে কী না 

জানা নেই,

নিজেদের  জীবন তো মা  গঙ্গা,

নতুন প্রাণ গুলোর ভবিষ্যৎ - লোডশেডিং।

কী হবে কী না হবে কিচ্ছু জানা নেই।

শুধু জানা গেছে হঠাৎ,

যেখানে, ওদের রক্ত জল, জ্বাল হয়ে চিমনি দিয়ে  

ধোঁয়া উঠত, 

যেখানে, মেশিনে নিজেদের  পিষে ফ্যানে ভাতে জুটতো,

কলুর বলদের মতো খাটলেও

যে  জায়গাকে নিজের মনে হতো,

সেই চিমনিওয়ালা  মেসিন ভরা ঘরের দরজায়,

ছোট্টো কাগজ সাঁটা, লেখা - লক আউট।

হঠাৎ করে সব  বুঝলো  তারা বেকার।

না  খেটেই ঘামে ভিজল জামা,

হাত পা গেলো ঠান্ডা হয়ে।।

মৃদু বিক্ষোভ হলো,

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইউনিয়ন লিডার এলো,

 যদিও মালিক পক্ষের থেকে পাওয়া,

তিনটে ব্রিফকেস, তখনও পার্টি অফিসের আলমারিতে।

তবু লিডার এলো ,

মিটিং হলো।

কিছুটা আশা পেলো অসহায় চোখগুলো।

কিন্তু ................


মিডিয়ার লোক এলো, 

এতগুলো লোকের পেট চুরি, ব্রেকিং নিউজ হলো।

শ্রম মন্ত্রী  বললেন,  - বিষয়টি তিনি দেখছেন,।

কিন্তু সমস্যা হলো - ওনাদের দেখার  সময়ের কোনো  সীমা নেই।

অন্তত পরবর্তী  ইলেকশনের আগে অবধি তো বটেই।

আর

আর  একটা কারখানা বন্ধ হলো, এ দেশের কিছু হবে না, বলে,

মধ্যবিত্ত  বাঙালী গেলো  বাজারে  

মাছ  কিনতে।।

সময় চলে গেলো--গেরোস্তর  বাড়ি,

দু এক দল হকার এল,

ব্যাগে ধূপ বা অন্য কোনো প্রোডাক্ট নিয়ে,

আর  সঙ্গে আনল- কারখানা বন্ধের  ইতিকথা।

কেউ নিল, কেউ নিল না।

কয়েকদিন পরে একটু ছিনতাই কেস বাড়ল,

 একটা দুটো কে ধরে  জানা গেল-

ওরা  সদ্য ছিনতাইবাজ হয়েছে,আগে লেবার ছিল।

পুলিশ বখরা নিয়ে  ছেড়ে দিল।

আরো  কয়েক দিন পরে নিউজ এল--

অভাবের তাড়নায় গলায় দড়ি দিয়েছে বেকার শ্রমিক।।

আবার মিডিয়া  কভারেজ হলো -

মন্ত্রী বললেন - বিষয়টি দেখছেন।

দেখা যে কবে শেষ হবে, তা চোখও জানে না।

ইউনিয়ন লিডার বললেন --  আর ছাড়া যাবে না।

জোরদার আন্দোলন চলবে।

এ চলার শেষ কোথায় কেউ জানে না।

  কী ভয়ঙ্কর, ভাবা যায়,!

বলে, 

চ্যানেল পাল্টে গেলো  ড্রইং রুমে।

ভাত পাতে মাটনটা  সিদ্ধ হয়নি বলে কত্তা আক্ষেপ করল,

গিন্নি মাংসের ঘাড়ে দোষ   দিল,

মাংস টা নাকি ভালো না।

 

এদিকে প্রশাসনে হুড়োহুড়ি পড়ল।

প্রসাধনে লাগলো ঢেউ।

সরকার শুরু করল বাণিজ্য সম্মেলন।

কোটি টাকা নষ্ট করে  এক রাশ প্রতিশ্রুতি এলো।

ব্যস ওটুকুই।


এ দিকে, অচিরেই -

কারখানার জমিতে আকাশ ঝাড়ু বহুতল উঠল।

সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল ও মল।

 যে মন্ত্রী সব কিছু দেখছিলেন,

দেখা গেলো - ,উনিইই করলেন বিল্ডিং এর উদ্বোধন।

লড়াকু  লিডারকে দেখাগেল, হাসিমুখে ফোটোশুটে।

আবার  মিডিয়া এলো,

ব্রেকিং নিউজ হলো।

সবাই ভুলেই গেলো, এ সেই বন্ধ কারখানার জমির ওপর গড়া।

যেখানে, পার্টি ক্যাডারদের কাজ জুটলেও 

কাজ জোটেনি, ওই শ্রমিকদের কারুর।

যাই হোক, রাজ্যের বিকাশের খবর দেখে,

ওইতো হচ্ছে, বলে,

বাঙালী ব্যাগ হাতে বাজারে গেল।

এদিকে, বেশ কিছু ছেলে মেয়ে,

সরকারি প্রকল্পকে কলা দেখিয়ে,

স্কুল ছেড়ে শিশু শ্রমিক হলো,

কোনো কোনো মেয়ে বৌ,

রাতে অন্ধকারে লাইট পোস্টের আলোর তলায়

কোথায় হারিয়ে গেলো, আর খোঁজ  পাওয়া গেলো না।

স্থানীয় পার্টি অফিসে নতুন কিছু কেডার এলো।

পার্টির তোলাবাজি  বাড়ল,

ইভ টিজ বাড়ল।

ক্রমে দুষ্কৃতীর দাপটে এলাকার শান্তি নষ্ট হল।

আবার নিউজ চ্যানেলে খবর হল।

আবার দলগুলোর  দোষ দেওয়ার চাপান উতোর চলল।

পুলিশ এলো, শান্তি এলো না।

 বাঙালী আবার - দেশ টা  রসাতলে গেলো বলে ,

বৌ বাচ্ছা নিয়ে শপিং এ গেলো।


এ দিকে আবার অন্য কোনো মালিকপক্ষ, পার্টি অফিসে ব্রিফকেস নিয়ে গেলো।

আবার একই গল্পের  ইতিকথা তৈরির ছক কষা হলো।

আবার এ দেশের কিছু হবে না

বলার অবকাশ তৈরি হলো।

আর নব নবজাতকের  বাঁচার অধিকার কে বিকিয়ে

একটা গোটা জাতি  হলো -

তিমির বিলাসী , তিমির বিনাশী নয়।

তাই শাশ্বত রাতের বুকে হলোনা কোনো সূর্যোদয়।

পৃথিবীর গভীরে অসুখ ইই রয়ে গেল,

জীবনের ঋণ রইল চির মৌন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ