২২শে শ্রাবণ শ্রদ্ধার্ঘ্য ২০২২ || পর্ব -৮




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

২২শে শ্রাবণ

শিপ্রা দেবনাথ


২২ শে শ্রাবণ

এই আজকের মতোই 


সেদিনের আকাশ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন,


মৃত্যু! নাকি পেয়েছিলে নতুন করে জন্ম অন্য?


অঝোর ধারায় বারি ঝরিয়েছিল শ্রাবণ


আর ব্যথিত শোকার্ত কত অনুগত প্রাণ।


উদ্বেলিত বিহ্বল সহস্ত্র মন


পুষ্প বৃষ্টিতে সিক্ত করেছিল শেষ যাত্রায় তোমায়


সাদা থানে দেহখানি ঢাকা ছিল।


আজ হতে আশি বছর আগে 


আজকের দিনে,বাইশে শ্রাবণে


সত্যিই কি তুমি গিয়েছিলে চলে?


আজও কেন তবে বীনা হয়ে বাজো


সকল অন্তর জুড়ে রাত্রি দুপুরে?


নাহ্ গুরদেব নাহ্


তুমি পারোনি চলে যেতে,


মাঝে মাঝে তাই আনন্দ কিংবা দুঃখেতে


শান্তিতে-অশান্তিতে 


তোমার গান বেজে ওঠে


আপনা আপনি হৃদয় অন্তঃপুরে


নিজেরই অজান্তে।


তোমায় বর্ণনা করে এমন দুঃসাহস কার!


তুমিই মাত্র তোমার তুলনা 


বিশ্ব চরাচরে নেই যে কেহ আর


ভারত ভূমির ভাগ্য তুমি জন্মেছিলে


পুত্র হয়ে, ভারত মাতার কোলে


কত গাঁথা গেঁথে রেখে গেছো হেসে খেলে।


সেদিন তোমায় দেয়নি তো বিদায় কেহ,


এঁকে নিয়ে ছিল যে যার মনে


তোমার দেওয়া মায়া মমতা স্নেহ।


মৃত্যু হলে তবে তো হয় অন্তিম সংস্কার!


তুমি তো অমর 


তাই তোমায় চিরতরে 


বাঁধিয়ে নিয়েছে সবাকার অন্তর ।


কেউ ভুলে যায় নি তোমায়


ভুলতে পারেনা এ কাজ যে বড় দুষ্কর।

====

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান অমর সৃষ্টি 

( প্রবন্ধ)

মুরশাদ সুবহানী  


‘‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ

ও মোর ভালোবাসার ধন।………..।’

(কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

বাংলা সাহিত্যের বিশাল আঙ্গিনা জুড়ে  রয়েছেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক ধারার সূচনা করেছিলেন , ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যা সাগর,  কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যা  সমাপ্ত করেছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তাঁর হাতে সার্থক রূপায়ণ হয়েছে। বাংলা সাহিত্যকে নতুন অলংকারে ঐতিহ্যমন্ডিত করে তিনি নতুনের এক সার্থক মাত্রা যোগ করে সৌন্দর্য-সৌকর্য করে তুলেছেন। তাঁর হাতে উন্মোচিত হয়েছে মানব জীবনের নানা দিক নানা আঙ্গিকে। 

সাহিত্যের সাথে যাঁরা  কমবেশী জড়িত তাঁদের অনেকেই এই বিষয়টি জানেন যে, বিশ শতকের সাহিত্যে প্রধান দিক ছিল মানুষের নি:সঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা। প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে দ্যোতনা । কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দিকটি গভীরভাবে দেখেছেন। একজন মনোজগতের মানুষ হিসেবে । আজকের আলোচনা  তাঁর সঙ্গীত সৃষ্টি নিয়ে । কি আছে তাঁর সঙ্গীতে, যা আমাদের মনকে এখনো টানে। আমরা আপ্লুত  হই আবেগে ,  ভাব জগতে ডুবে যাই । 

‘‘ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘ আপনার বড় গুণ কি” তিনি উত্তর দিলেন, ‘ অসামঞ্জস্যতা। আপনার বড় দোষ কি? তিনি একই উত্তর দিলেন।’’ আসলেও তো তাই । একই সময়ে একই সাথে তিনি গল্প, উপন্যাস, গান রচনা করছেন, কোনোটির সাথে কোনোটির মিল নেই। এখানেই রবীন্দ্রনাথকে আমরা খুঁজে পাই । এই রকম প্রতিভা এই বিশ্ব জগতে খুব জনেরই আছে । এ এক বিরল প্রতিভা । এক গল্পের সাথে আর এক গল্পের মিল নেই, এক উপন্যাসের সাথে আর এক উপন্যাসের কোনো মিল নেই। এক গানের সাথে আর এক গানের মিল নেই। এক নাটক-নাটিকার সাথে অপরটির মিল নেই । এ এক বিস্ময় জাগানো প্রতিভা ।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গানের সংখ্যা ১৯১৫টি দ্বিমতে ২,২৩০টি । এই গান গুলোকে  কয়েক পর্যায়ের পূজা, প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ বিবিধ। আমরা বলতে চাই কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সঙ্গীতের প্রায় সব পর্যায়কে স্পর্শ করেছেন। রাগ সঙ্গীত, শ্যামা সঙ্গীত, ভক্তিমূলক গান, বাউল গান, মানব-মানবীর বিশুদ্ধ প্রেম আবার  ভগবান-ঈশ্বরের প্রতি গভীর ভালোবাসায় সনাতন হিন্দু শাস্ত্রের বাইরে এসে এক অপূর্ব প্রেম-ভালোবার গান। সব ক্ষেত্রকে তিনি ছুঁয়ে গেছেন ,তাঁর সারা জীবনে রচিত গানের মধ্যে। কোনো কোনো গান শুনলে মনে হবে তিনি মনে হয় কোনো  মানবীকে ভালোবেসে তার উদ্দেশ্যে গানটি লিখেছেন। কিন্তু আমরা যদি গভীরভাবে সেই গানকে উপলব্ধি করি তাহলে বুঝা যাবে, আসলে তা নয়, তিনি ভগবানের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করে গানটি রচনা করেছেন। তাঁর সব গান নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তারপরও আমরা চেষ্টা করবো। তার আগে বলে নেই, তিনি কয়েকটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচিয়তা । তাঁর গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে; ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে….।’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত।১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়।‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচনা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে  বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গানটির প্রথম ১০ লাইন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীতের রচিয়তাও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রিয় আনন্দ সামারাকুন  কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি গান লিখে দেওয়ার অনুরোধ করলে তিনি ‘নমো নমো শ্রীলঙ্কা মাতা….।’ গানটি লিখে 


সুর করে আনন্দকে দেন। অনেকের ধারণা এটি আনন্দ সামারাকুনের রচনা । আসলে তা নয়। গানটি লিখে সুর করে দিয়েছেন কবি গুরু। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটি ১৯৫১ সালের ২২ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। 

কবি গুরু নিজেই বলেছেন, ‘‘আমার সব রচনা হারিয়ে যাবে, লোকে ভুলে যাবে একদিন, কিন্তু আমার গান থাকবে চিরকাল।’’  

কি আছে এমন তাঁর গানের মধ্যে যা আমাদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। 

গানের কথা? তা তো বটেই | কিন্তু কথা দিয়ে তো কবিতাও লিখেছেন তিনি অজস্র |  সুর , তাল ? স্বসৃষ্ট কিছু তাল আছে   ঝম্পক, নবতাল, একাদশী, নব-পঞ্চতাল ইত্যাদি, কিন্তু... তারা মূলত: 'ফাঁক' বিহীন ও মুখ্যত: কর্নাটকী সঙ্গীত থেকে নেওয়া ।’’

রবীন্দ্রনাথের গানে রয়েছে জীবনের নানা উপাদান। যা চিরস্থায়ী রূপ লাভ করেছে বাঙালীদের মনে। শুধু বাঙালা-ভাষা-ভাষী নয়, তাঁর গানের অনুবাদ ইংরেজীতে হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সঙ্গীত পিপাসু মানুষের মনে রেখাপাত করে চলেছে।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী’র  লেখা ‘‘রবীন্দ্র-সঙ্গীতের ত্রিবেনী-সঙ্গম' . তাতে ছিল রবীন্দ্র-কৃত ভাঙ্গা গানের তালিকা | ভাঙ্গা অর্থে অন্য ভাষা বা জাতের 

সঙ্গীত থেকে সুরটুকু গ্রহণ করে তাতে নিজের কথা বসানো | অবাক হয়েছিলাম কি অনায়াস দক্ষতায় ইংরেজি ও আইরিশ গানগুলিকে ভেঙ্গে 'বাল্মীকি-প্রতিভা' ও 'কালমৃগয়া'র মত পৌরাণিক গীতিনাট্যে ব্যবহার করেছেন অথচ তা বাংলাভাষায় বেখাপ্পা তো লাগেইনি, উল্টো মনে হয়েছে যেন এর থেকে সার্থক প্রয়োগ এদের জন্যে আর সম্ভব ছিল না | 'বাসন্তী হে ভুবনমোহিনী' বা 'শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ' কোনকালে হয়ত তামিল বা হিন্দি গান ছিল, কিন্তু সুরের কাঠামোটা অপরিবর্তিত রেখেও যে বদলটা ঘটানো হয়েছে, তার চেয়ে বড় বিস্ময় বুঝি আর হয়না ।’’ 

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে দেশসমূহ ভ্রমণ করেছেন, সেখানকার সাহিত্য থেকে তুলে এনেছেন রত্নরাজি । যা দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে। বিদেশী ভাষার বেশ কিছু সংখ্যক গান সুরে বাংলায় নিয়ে এসেছেন, কিন্তু নিজস্ব স্বকীয়তা হারাননি। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করছে। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের কট্টর সমালোচক ডি.এল রায়ের পুত্র দিলীপ কুমার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে ভ্যারিয়েশন করার অনুমতি পাননি।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের বক্তব্য ষ্পষ্ট – “ হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকার, তাঁদের সুরের মধ্যকার ফাঁক গায়ক ভরিয়ে দেবে এটা যে চেয়েছিলেন। তাই কোনো দরবারী কানাড়ার খেয়াল সাদামাটা ভাবে গেয়ে গেলে সেটা নেড়া-নেড়া না শুনিয়ে পারে না।….

…..আমার গানেতো আমি সেরকম ফাঁক রাখিনি যে সেটা অপরের ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব।’’

আসলেও তাঁর গানে সুরের কোন ফাঁক নেই । যেটা অন্য কেউ ভ্যারিয়েশন করে ঠিক করবে।

ইদানিং লক্ষ্য করা যায়, ব্যান্ড সঙ্গীতে ফিউশন নামে একটি বিষয় যোগ হয়েছে। কোনো কোনো ব্যান্ড দল কবি গুরুর গান ফিউশন করায় সঠিক সুর ও তালে থাকছে না।এটা বন্ধ হওয়া দরকার। রবীন্দ্র সঙ্গীতকে তাঁর স্বরলিপি অনুসারে শুদ্ধভাবেই গাইতে হবে। কবি গুরু বেঁচে থাকলে আমরা বিশ্বাস করি তিনি কোন ক্রমেই ফিউশন করার অনুমতি দিতে না। এ ব্যাপারে আমরা রবীন্দ্রনাথের গানের যাঁরা শুদ্ধ চর্চা করেন, তাদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।

রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভেতরে প্রাকৃতিক পরিবেশ তো আছেই, সেই সাথে আধ্যাত্মিকভাব , ধর্মীয়ভাব মিশ্রণ আছে। প্রেম-বিরহ ভালোবাসার এক সম্মিলন রয়েছে। সব মিলিয়ে তাঁর গান এক বিস্ময়কর অবস্থানে আসীন হয়ে আছে । আমরা আগেইে উল্লেখ করেছি; তিনি নিজেই বলেছেন; ‘আমার গান থাকবে চিরকাল।’ তাঁর গানে সুর ও বাণীতে শিল্পী আত্মার এক বিচিত্র রূপ ফুটে আছে।আধ্যাত্মিক গানে তিনি তাঁর জমিদারী এলাকার মধ্যে জোড়াসাঁকোর অদূরে এপার বাংলার কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউরিতে বসবাসকারী বাউল সম্রাট লালন শাহ’র খোঁজ পান। কু্ষ্টিয়ার অজো পাড়া গাঁও ছেঁউরির লালন সাঁইকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৩ সালে হার্ভাড ইউনিভার্সিটিতে 

তাঁর ভাষণে বলেন, ‘ লালন সাঁই নামের একজনের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। লালন শাহ একজন আধ্যাত্মিক কবি ও গীতিকার। ‘‘ আমি তাঁর সঙ্গীতের ধারায় কিছু গানের সুরারোপ করেছি।’’

এই প্রবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য রবীন্দ্র-সঙ্গীতের সুর নিয়ে নিখুঁত কোন আলোচনা নয়।এই কাজ আমার নয়। এটি সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ পন্ডিতজনের কাজ। আমরা তাঁর গানের বাণী সুরের ব্যঞ্জনা নিয়ে সম্যক আলোচনা করতে চাই। 

শব্দ-সুর এক হয়ে আমাদের মনের গভীরে প্রোথিত হয়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘‘ সুর অনির্বচনীয়ের প্রধান বাহন। কিন্তু মানুষ কেবল যে ব্যবহার্য সামগ্রীর সঙ্গেই অনির্বচনীয়কে প্রকাশ করতে চেয়েছে তা নয়। তার চেয়ে অনেক বেশী ব্যাকুল হতে চেয়েছে আপন সুখ দু:খ ভালোবাসর সহযোগে।অর্থাৎ যে সব শব্দ তার হৃদয়াবেগের সংবাদমাত্র দেয়, শিল্প-কলার দ্বারা তার মধ্যে সে অসীমের ব্যঞ্জনা আনতে চায়।আদিকাল থেকেই মানুষ তাই শব্দের সঙ্গে সুরকে মিলিয়ে গান গেয়েছে।’’

 কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের এই শব্দ সুরের ব্যঞ্জনায় গানের বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরে ছিলেন বলেই তাঁর গান আমাদের টানছে যুগের পর যুগ গভীরভাবে। রবীন্দ্র-সঙ্গীত আমাদেরকে মুগ্ধ করে চলেছে। তাঁর গানের বাণীতে সুখ-দু:খ, বিরহ , বিচ্ছেদ , বাউল তত্ব যা আধ্যাত্বিকতা নামে পরিচিত, ধর্মীয় দিক সব কিছুই আছে।

বাক্য যা বলতে পারে না, গানের অমোঘ শক্তি তা পারে। যে কোনো গানেরই যদি সুর ভাল হয় আর গায়কী কন্ঠ যদি সুমধুর হয় তাহলে সেই গান শুনতে সবারই ভালো লাগে, মনের মধ্যে গেঁথে যায় ।কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্রুপদী ভারতীয় সঙ্গীত, বাংলা লোকসঙ্গীত, বাউল সঙ্গীতের সহেযোগিতায় সঙ্গীত, ইউরোপীয় সঙ্গীতের ধারায় নিজ প্রতিভায় সুর শৈলী সৃষ্টি করেন। তাঁর গানের বাণীতে যে সুর করেন; সেই সুর ঝংকার তোলে মানুষের মনে। তিনি অনেক কবিতাকে সুর দিয়ে গানে রূপান্তরিত করেছেন। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ সুকুমার সেন রবীন্দ্র সঙ্গীত রচনার চারটি পর্ব নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‌‌‘‘প্রথম পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট গীতের অনুরকরণে গান রচনা শুরু করেছিলেন।দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৮৮৪-১৯০০ পল্লীগীতি ও কীর্তনের অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ গান রচনা করেন। এই পযায়ে তিনি নিজস্ব সুরারোপ করেন। ১৯০০ সালে শান্তি নিকেতনে বসবাসকালে তাঁর তৃতীয় পর্বের গান রচনা শুরু হয়। এই সময় বাউল গানের সুর ও প্রভাব তাঁর নিজের গানে অঙ্গীভূত করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান রচনার চতুর্থ পর্বের সূচনা হয়। এই সময়ে তাঁর গানে নতুন নতুন ঠাটের প্রয়োগ এবং বিচিত্র ও দুরূহ সুর সৃষ্টি করেন।

তাঁর সকল গান সংকলিত হয়েছে গীতবিতান গ্রন্থে। এই  গ্রন্থে ‘ পূজা’, ‘প্রেম’, ‘প্রকৃতি’, ‘স্বদেশ’ ‘আনুষ্ঠানিক’ ও ‘বিচিত্র’ পর্যায়ের মোট দেড় হাজার গান সংকলিত হয়। পরে গীতনাট্য , নৃত্যনাট্য, নাটক, কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য সংকলন থেকে বহু গান এই বইতে সংকলিত হয় ।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ তাঁর জীবন দেবতার চরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি। এখানে বহু সংখ্যক বর্ষার গান রয়েছে।’’



আমরা আগেই বলেছি; কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের তাল-লয় আমাদের এই প্রবন্ধের মুখ্য আলোচনা নয়। আমরা তাঁর গানের বাণী নিয়েই কথা বলতে চাইছি। আর গানে সুর তো থাকেই সবাই জানেন, সুর ছাড়া তো গান হয় না। আমরা রবীন্দ্র-সঙ্গীতের একটি গান দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। ‘‘তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ

ও মোর ভালোবাসার ধন।

দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন,

ও মোর ভালোবাসার ধন।….

….তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে,

ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন,

ও মোর ভালোবাসার ধন।”

এই গানটি গীতবিতানে সংকলিত হয়েছে(পৃ: ৪৫)। গানটি পূজা পর্বের গান। গানটি .

খুব সাদামাটাভাবে যদি গানটিকে শোনা হয়, তাহলে মনে হবে, কোন রমণীকে নতুন করে পাবার জন্যে বারবার হারানোর কথা বলেছেন বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আসলে কী তাই? এই গানের শব্দ-বাণীকে আমরা যদি আলোচনা করি তাহলে এইভাবে বলতে পারি, এই গানটির কোন জায়গায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এবং রাধার নাম উল্লেখিত হয়নি। রাধা 


ভগবান শ্রী কৃষ্ণ’র উদ্দেশ্যে তাঁর আবেদন-নিবেদনের কথা বলেছেন এই ভাবে শ্রী কৃষ্ণকে নতুন করে পাওয়ার জন্য তাঁকে বারবার হারিয়ে ফেলছেন। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ দেখা দেবেন বলে দর্শনের আড়ালে চলে যাচ্ছেন।

একজন কবি-গীতিকার-সাহিতিক্যের মনের ভাবনা বিশ্লেষণ করা খুব সহজ নয়। 

তারপর কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে এই কাজটি তো আরো দুরূহ। কবি গুরু কখনও একটি কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করে সুর দিয়ে সেটাকে গান করে তুলেছেন। দেখা গেল পূজার জন্য যে গান রচনা করলেন, সেটা বাণী-শব্দ প্রেমের বাণীতে পরিনত হয়েছে। এইভাবে একটি লেখাকে তিনি নানাভাবে শিল্পী মনের ভাব দিয়ে বিবর্তন করে তুলেছেন। তাঁর প্রেমের একটি গান – ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে,

তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে।।


………………………………………………

চাইল রবি শেষ চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে।

…………………………………………………….

এল আমার ক্লান্ত হাতে ফুল-ঝরানো শীতের রাতে

………………………………………………………

তখন ছুটি ফুরিয়ে গেছে কখন অন্যমনে।।।

(রচনাকাল :২২ কার্তিক,১৩৩৪(বঙ্গাব্দ)

তাঁর এই গানে দেখা যায়, ‘ প্রেমের তৃষ্ণার অপ্রাপ্তি আছে। তবে কোন ক্ষোভ নেই। ‘ ছুটির নিমন্ত্রণে প্রিয়াকে আহ্বান জানিয়ে লিপি প্রেরণ করলে সে-লিপি তার হাতে গিয়ে পৌঁছায় ‘‘ ফুল –ঝরানো শীতের রাতে’’। যখন ছুটি শেষ হয়ে গেছে

 ‘তুমি কোন্ কাননের ফুল, কোন্ গগনের তারা।

তোমায় কোথায় দেখেছি যেন কোন্ স্বপনের পারা।।

………………………………………………………..।’

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটিও প্রেম পর্যায়ের গান। (রচনাকাল 

১২৯৩(বঙ্গাব্দ), ১৮৮৬ খ্রী : এই গানের সুর ও বানী গভীরে টানে আমাদেরকে।

‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।

মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ।

……………………………………………………………………………………

কালো ? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।’

(রচনাকাল : ৪ আষাঢ় ১৩০৭ (বঙ্গাব্দ)।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এটি কবিতা । পরে এই বাণী-শব্দকে সুরারোপ করে গানে রূপান্তর করেন।এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন, ‘‘ ১৯৩১ সালে বর্ষামঙ্গল উপলক্ষ্যে ‘ক্ষণিকার’র ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতাটিতে সুর দিলেন কীর্তন ও নানা রাগিণী মিশিয়ে। তাঁকে দিয়ে এই গানটি গাইয়ে পরীক্ষা করলেন। গানের বাঁধা ছন্দকে ভেঙে আবৃত্তির ধরণটি ঠিক রেখে গানটি গাইলেন তিনি।

‘আসলে আবেগের ভাষাই সঙ্গীতের মূল।’’

 আমরা  কবি গুরু এই গানটি দিয়ে শেষ করতে চাই আমাদের এই লেখাটি 

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে ।



চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,

মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,

বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে,

তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,

তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে।

……………………………………………………..

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।..

………………………………………………….।’

এই গানটির বাণী ও সুরে বাউলের ধাঁচ রয়েছে।এই গানটি বাউলের সুরের ধাঁচে করা হলেও এই গানের নিবিড় অর্থ ভিন্ন বলেই মনে হয়, এই গানটিতে কবি গুরু চলে যাবেন । যেখান থেকে আর কেউ ফিরে আসেন না। তারপরও এই বাটে,ঘাটে,হাটে তার যে পদচিহ্ন সেটি থেকে যাবেই। যদি তারার পানে চেয়ে তাঁকে নাও ডাকা হয়। আমরা তাঁকে ভুলে যাবো না। ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি।’

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বাংলা সাহিত্যের অলংকার-অহংকার।তাঁর গান অমর সৃষ্টি এবং তিনি এক স্বর্ণযুগের স্রষ্টা । 

কবি গুরু  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  ৮১তম প্রয়াণ দিবসে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা 


ফ্লোরিডা, ইউএসএ 

 ১৮ই শ্রাবণ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ,    ৮.২.২০২২ ইংরেজি।

___________________________________

তথ্য সূত্র :প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।

লেখক :  (   শিল্প-সাহিত্যের সেবক, বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক রাইটার, অ্যাডভোকেট,জজকোর্ট,পাবনা,বাংলাদেশ), 

ফ্লোরিডা , ইউএসএ প্রবাসী)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ