নারী ও সাহিত্য -- যুগে যুগে ~ সুজিত চক্রবর্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

  সময়টা গত শতাব্দীর প্রথমার্ধ । বাংলাদেশের ঘরে ঘরে নবজাগরণের ঢেউ এসে পৌঁছেছে। তখন বাঙালি আজ যা ভাবছে , ভারতবর্ষ আগামীকাল তা ভাববে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উদ্যোগে সেদিনের বাঙালির চিন্তা জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসছে। নারী শিক্ষার পাশাপাশি বিধবা বিবাহের আয়োজন করা হচ্ছে অনেক। আর এ কথা তো সবার জানা সেই সময় বাল্য বিধবাদের সংখ্যাও কম ছিল না। কন্যা সন্তানের আইবুড়ো বদনাম ঘোচানোর বাসনায় মেয়েদের দরিদ্র বাবারা মৃত্যু পথযাত্রী বৃদ্ধের সাথে মেয়েকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নিশ্চিন্ত হতে চাইতেন এই কারণে যে এমন না করলে গোটা পরিবারকে গ্রামের মুরুব্বিরা একঘরে করে  দেবে ! এর অনিবার্য ফল ছিল বৃদ্ধের অন্তর্জলী যাত্রা এবং কন্যার অকাল বৈধব্য। 


       এরপর যখন এ দেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করল তখন এই বাল্য বিধবাদের কেউ কেউ বিদ্রোহী হয়ে ঘোষণা করে দিতে শুরু করল যে আমরা এইসব কুসংস্কার মানি না। দিদিমার কাছে ছোট বেলায় শুনেছি তাদের গ্রামের ' বুড়ি মাসিমা ' বেশ গোছ-ব্যবস্থা করেই এক একাদশীর দিন গ্রামের সব মানুষকে হেলা-বট তলায় ( যা কালীতলা বলেও পরিচিত ) জমা হবার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। কেন ? কারণ , সেই একাদশীর দিন তিনি সবার সামনে জল খেয়ে তাঁর আজন্ম লালিত নির্জলা উপবাস ভঙ্গ করবেন এবং সবাইকে দেখিয়ে দেবেন যে এতে পাপ হওয়ার ন্যুনতম সম্ভাবনাও নেই। আর পাপের ফলস্বরূপ যদি তাঁর মৃত্যু হয় , সে তো সোনায় সোহাগা ! এর ফলে অর্ধমৃত হয়ে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। 


          আর আমাদের গ্রামে ছিলেন উমা পিসি ।এমন নয় যে পুরো গ্রামে তিনি একমাত্র বাল্য বিধবা ছিলেন। আসলে তাঁর কথা একটা বিশেষ ঘটনার সঙ্গে জড়িত এবং সেই ঘটনা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলেই সে কাহিনির  অবতরণা । এবার মায়ের মুখে শোনা এবং  আমার স্মৃতির পাতায় লেখা সেই ঘটনার কথা বলা যাক। উমা পিসির বাবা রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করতেন। সেখানে গুরুদেব মাঝে মাঝেই আসতেন।  উমা পিসির বাবা একবার স্থির করলেন মেয়েকে শিলাইদহে নিয়ে গিয়ে কবিকে স্বচক্ষে দেখা এবং প্রণাম করার সুযোগ করে দেওয়া যাক ।


           উমা পিসিকে দেখে রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেছিলেন , " উমার বয়স কম । ওর আবার বিয়ে দিয়ে দাও । " 

            সেকথা শুনে উমা পিসি বলেছিলেন, " না বাবা ! আবার যদি বিধবা হই !" 

             রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ,  " তাহলে থাক ,  উমার  আর বিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। "


         পরে বড় হয়ে যখন রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প

' স্ত্রীর পত্র ' পড়লাম সেখানে বিন্দুকে পেলাম। দেখলাম তার বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে কিন্তু সে বিয়েতে বিন্দুর মন সায় দেয় না কিছুতেই। মেজ বৌ মৃণালের লেখা চিঠিতে পড়লাম ,  : বিন্দু আমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল , বললে , ' দিদি আমার আবার বিয়ে করা কেন। ' 

      পরবর্তীতে পাগল স্বামীর হাত থেকে বাঁচার জন্য বিন্দু কাপড়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। মৃণাল তাঁর চিঠিতে লিখেছেন , " তার পরে এও দেখেছি , ও মেয়ে বটে  তবু ভগবান ওকে ত্যাগ করেন নি ।  ওর ওপর তোমাদের যত  জোরই থাক্-না কেন তার অন্ত আছে । ও আপনার হতভাগ্য মানবজন্মের চেয়ে বড়ো। তোমরাই যে আপন ইচ্ছেমতো আপন দস্তুর দিয়ে ওর জীবনটাকে চিরকাল পায়ের তলায় চেপে রেখে দেবে , তোমাদের পা এত লম্বা নয় । " 


         রবি ঠাকুরের লেখা পড়ে পাঠকের  মনোবল বৃদ্ধি পায় তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই , কিন্তু সামাজিক  অত্যাচারের এই দর্পিত পা যে খুব ছোট ছিল না সেকালে তার নিদর্শনও তো কম নয়!  সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবী নিজের বাল্য জীবনের স্মৃতিচারণে বলছেন , " ইস্কুলে পড়লেই যে মেয়েরা .... বাচাল হয়ে উঠবে এই তথ্য আর কেউ না জানুক আমাদের ঠাকুমা ভালোভাবেই জানতেন , এবং মাতৃ ভক্ত পুত্রদের পক্ষে ওই জানার বিরূদ্ধে কিছু করার শক্তি ছিল না। " 


        ভাবতে অবাক লাগে ঠাকুরমার অনুশাসনের কারণে যিনি প্রথাগত শিক্ষা লাভের সুযোগ পান নি কখনও সেই তিনিই একশো ছিয়াত্তরটি উপন্যাস , পনেরো শো গল্প ,  ছোটদের জন্য সাতচল্লিশ খানা বই ছাড়া পঁচিশটা  অন্যান্য  সংকলন গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। লেখার বিষয়বস্তু ছিল গৃহজীবন ।

সমাজে বইয়ের চেয়ে তার মলাটের কদর বেশি এই উপলব্ধি তাঁকে ব্যথিত করেছে । ব্যথা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। সেসব প্রশ্ন কখনও উচ্চারিত হয়েছে লেখকের কন্ঠে , কখনও তাঁর লেখা পড়ে পাঠকের মনে উদয় হয় । একটি উদাহরণ এখানে নাহয় তুলে দেওয়া যাক এখানে।  

" নারী ছলনাময়ী ,  নারী জন্ম অভিনেত্রী। কিন্তু সে কি শুধু পুরুষজাতিকে মুগ্ধ করার জন্যে ? বিভ্রান্ত করার জন্যে ? বাঁচবার জন্যে নয় ? আশ্রয় দেবার জন্যে নয় ? " ( সূত্র :  আর এক আশাপূর্ণা) 


       আশাপূর্ণা দেবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই তাঁর ট্রিলজি যেখানে তিনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস একসাথে গ্রন্থিত হয়েছে  : প্রথম প্রতিশ্রুতি,  সুবর্ণলতা এবং বকুল কথা। সত্যবতী সেই প্রাচীন কালেই এক আদ্যন্ত বিদ্রোহী নারী , যিনি আপোস করেন না অন্যায়ের সাথে । সত্যবতীর মেয়ে সুবর্ণলতা আর সুবর্ণর মেয়ে বকুল। হাজার মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন সুবর্ণলতার কন্ঠরোধ করতে ব্যর্থ, সে তার মায়ের মতোই প্রতিবাদী। তুলনায়  বকুল যেন বেশ কিছুটা আধুনিক তার কারণ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি  । সুবর্ণলতা বা সত্যবতী মেয়েদের এ স্বাধীনতা হয়তো কখনও চাইতেন না ।কিন্তু , এগোনো-পিছোনোর কথা বলা সহজ না হলেও সময় যে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না এটা সবার জানা।  


   এবার তাকানো যাক বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ।

ভারত স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বিখন্ডিত হয়েছে। দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি তখনও মানুষের মনের মধ্যে তাজা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধংসলীলা দেখে মানুষ আতঙ্কিত।  হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মৃত্যুর মিছিলের শেষে যারা জীবিত রইল তাদের অনেকেই বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে। পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয় বিকিরণের অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব তাদের সন্তানদের ওপরও বেঁচে থাকবে এ তথ্য  ততদিনে আমাদের জানা হয়ে গেছে । অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় মানুষ অস্থির হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি করে দেখা দিয়েছে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কারে মানুষ চমৎকৃত হলেও তাকে যেন সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। বিজ্ঞানী বলছেন ,  তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের রূপ কতটা ভয়ংকর হবে বলতে পারব না তবে চতুর্থ যুদ্ধে হয়তো তির ধনুক নিয়েই মানুষ আবার লড়াই করবে। আর এসবের ফলস্বরূপ আর এক পরিবর্তন এল সমাজ জীবনে। একা পুরুষের রোজগারে ঠিক হয়ে উঠছে না দেখে গৃহবধূরাও অনেকে উপার্জনের পথে এগিয়ে গেলেন এই কারণে যে শুধু নীতি কথা দিয়ে তো আর সংসারে সবার পেট ভরানো যাবে না।  


     খুব স্বাভাবিক ভাবেই তখন ট্রামে, বাসে , ট্রেনে দেখা যেতে শুরু হলো অনেক একাকী রমণী । একান্নবর্তি পরিবার ভেঙে বাহান্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। পরে এল ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকার সুযোগ। ইওরোপে যা বহু দিন আগেই স্বাভাবিক ছিল, আমাদের অনভ্যস্ত চোখে সে দৃশ্য দেখে অনেকে আবার  অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল । কবি , সাহিত্যিকের কাজ হলো সমাজ দর্শন। পাল্টাতে হবে সাহিত্যের ভাষা --- ততদিনে এটা তাঁরা বুঝে গেছেন । 


     " আমিই সেই মেয়ে l / বাসে ট্রেনে রাস্তায় যাকে রোজ  দেখেন / যার শাড়ি,  কপালের টিপ আর পায়ের গোড়ালি / আপনি রোজ দেখেন।  / আর / আরও অনেক কিছু দেখতে পাবার স্বপ্ন দেখেন ।" 

( আমিই সেই মেয়ে ll শুভ দাশগুপ্ত  ) 


        আরও পরে এল অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের যুগ।

আধুনিকীকরণ , উদারীকরণের সাথে সরকারি সংস্থার ' নিজিকরণ ' বা প্রাইভেটাইজ়েশনের দিন ।

এসব কিছুর মধ্যেও নারীর মূল লক্ষ্য রয়ে গেল তার বাসাটি  , যাকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যেই তার পথে নামা ! তার শিকড়ের টান কমল না আবার বহির্বিশ্বের গলা কেটে নেওয়া প্রতিযোগিতায় তাকে এখন সামিল হতে হয়েছে।  আমরা পড়লাম  : 

" হস্তিনাপুরের এক গৃহবধূ , সেই আমি আবার জন্মেছি / ভারতবর্ষের দিকে যে মেয়েটি এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল  / স্ত্রীকে পণ রাখবার অধিকার কে দিল স্বামীকে ? " 

( দ্রৌপদী জন্ম। মল্লিকা সেনগুপ্ত ) 


   এখন নারী খোলাখুলি প্রতিবাদ করতে শিখেছে। পুরুষের সাথে সে আজ প্রতিযোগিতার অঙ্গনে  নামছে প্রতিদিন , প্রতি মুহূর্তে। সে স্পষ্ট ভাষায় প্রতিরোধ করে পুরুষকে।  

" আর শক্তির দম্ভে যার গর্ভে রেখে যান কুমারীর অপমান  / আর চোখের জলে কুন্তী হয়ে নদীর জলে / বিসর্জন দিতে হয় কর্ণকে। আত্মজকে। " 

( আমিই সেই মেয়ে ll শুভ দাশগুপ্ত) 


      এ রচনা শুরু করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের সময়ের কথায় , আসুন না আরও একবার পেছনে ফিরে তাকানো যাক । মা বলতো , শরৎচন্দ্র এবং রবীন্দ্রনাথ , এনারা মেয়েদের মনের কথা জানতেন বলেই সাহিত্য রচনায় সফলতা পেয়েছিলেন। কথাটা নিশ্চয়ই সত্যি , তবুও একটা কথা বলতেই হবে। শরৎচন্দ্র তুলনায় অনেক বেশি সহজবোধ্য হওয়ার কারণে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন আর তাঁর বইয়ের বিক্রি রবি ঠাকুরের বইয়ের চেয়ে ঢের বেশি ছিল।শরৎচন্দ্রকে পাঠকরা বলতেন , ' আপনি যা লেখেন তা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু রবি ঠাকুরের লেখা তেমন একটা বুঝতে পারি না  । '  

জবাবে শরৎবাবু বলতেন,  আমি আপনাদের জন্যে লিখি। আর , রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্যে লেখেন। উনি না লিখলে আমরা লেখকরা কী পড়ব বলুন তো !  

সেসময় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ' সাধারণ মেয়ে ' কবিতাটি । এই কবিতার মুখ্য চরিত্র মালতী শরৎবাবুকে কাতর অনুরোধ জানিয়েছে তাকে নিয়ে একটা গল্প লেখার জন্য।  কী লেখা হবে সেই গল্পে সেই নিয়েই এই কবিতা লেখা।  সেখানেই বলা আছে সেই সময় সাধারণ মেয়েরা কেমন ছিল সে কথা : " তারা ফরাসি জার্মান জানে না , / কাঁদতে জানে । " এর পরে গঙ্গা-তিস্তায় অনেক জল গড়িয়েছে। আজ অন্ততঃ গড়পড়তা সাধারণ মেয়েরা অনেক এগিয়ে গেছে।  তাই তাদের চিন্তাধারায় পরিবর্তন যে এসেছে সে তো বলাই বাহুল্য।  এবার এই রচনায় ইতি টানতে চাই এই সময়ের কবিতার আর একটা লাইন উদ্ধৃত করে। 


          " দুঃশাসন সেই চুল টানতে টানতে এনে প্রকাশ্য সভায় / দাঁড় করালেন এক অসূর্যম্পশ্যা মহিষীকে । / তোমরা পুরুষজন , বাঁ হাতে নারীকে ঠেলে অন্দরে পাঠাও / ডান হাতে তোমরাও গা থেকে কাপড় টেনে খুলে নাও উন্মুক্ত বাজারে "  ll 

( দ্রৌপদী জন্ম ll মল্লিকা সেনগুপ্ত ) 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ