পোস্ট বার দেখা হয়েছে
" একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি;
হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেই দিন -গিয়েছে যে শান -হিম ঘরে, ..."
কতোটা হতাশাজনক অবস্থায় একজন কবি এই ধরনের কথা বলতে পারে তা সহজেই বোঝা যায়। আসলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর পরেই কোন সৃজনশীলতার গুরুত্ব পাওয়াটা বহু বছর আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো । কোন কবি লেখকের বেঁচে থাকা অবস্থায় তাঁর রচনার সঠিক বিচার খুব কম মানুষ পেয়েছেন।
জীবনানন্দ দাশ ওঁদের মধ্যে অন্যতম।
তবে প্রত্যেকটি গভীরে গভীরে যে ফসল রয়েছে তার গভীরতা কতোটা বিশাল সেই সাগরে ডুব না দিলে বোঝা মুষ্কিল ।
বর্তমানে প্রত্যেকটা " আমি" র ভেতরে জীবনানন্দ দাশ এর অস্তিত্ব। প্রত্যেকটা " আমি " যেনো জীবনানন্দের কাছাকাছি মেলে ধরতে চায়। নিরালায় - হতাশায় কবির লেখা চোখ থেকে মস্তিষ্ক হয়ে সারা শরীরে মিশে যেতে থাকে।
" ..... আশ্চর্য আর বিস্ময়ে আমি চেয়ে রবো কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে, ......"জীবন কালে খুব স্বল্প পরিমাণ কবিতাই ছাপা হয়েছিলো তাঁর। তাও বিভিন্ন পত্রিকায়। তবে সে সময়ে বিভিন্ন নামীদামি পত্রিকা যেমন ‘কল্লোল’, ‘কালি ও কলম’, ‘প্রগতি’সহ অন্যান্যতে তাঁর বিভিন্ন লেখা ছাপা হতে থাকে। বহু কবিতা ছাড়াও তাঁর প্রচুর নিবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প অপ্রকাশিত থেকে যায়।
জীবনানন্দের মৃত্যুু পর তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ , অজস্র অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ট্রাঙ্কে করে নিয়ে আসছিলেন ট্রেনে। ট্রাঙ্কটি চুরি যায় এবং চোর সাত কিলো ওজনের ওই রদ্দি কাগজপত্র বিক্রি করে দেন মাত্র সাড়ে ১২ টাকায় । তারপর বেশ কিছু ঠোঁঙায় ব্যবহার হয়ে গেলেও পুলিশি তৎপরতায় বেশ কিছু উদ্ধারও সম্ভব হয়। তবে পুরোটা পাওয়া যায়নি। কাউকে দেখানোর জন্য নয়, নিজের জন্যই যেন লেখাগুলো লিখতেন। লিখে ট্রাঙ্কভর্তি করে রাখতেন। ছাপাতে দেওয়ার আগে ওখান থেকেই বার করে দিতেন।
তাঁকে কাব্যজীবনের সূচনাপর্বেই শুধু মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়নি, দুর্বিষহ জীবনের শিকার হতে হয়েছিল। রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতায় তাঁর অবিসংবাদিত পরিচিতি নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। যদিও কাজি নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রায় সমবয়সি জীবনানন্দ দাশের ভাগ্যে তৎকালীন সময়ে বিদ্রোহী কবির মতো জনপ্রিয়তার ছিটেফোঁটা জোটেনি।
".....মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা
সেই নগরীর এক ধুসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে। "
সজনীকান্ত যেভাবে কবিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করেছিলেন। তা শুধু তাঁর কবিতাকেই বিমুখতার সামনে ঠেলে দেয়নি, কবি-পরিচিতিকেও ব্রাত্য করে তুলেছিল।
তাঁকে ‘বিভ্রান্ত কবি’ বলে যে ভাবে তাঁর সংবেদী কবিচিত্তকে দিশাহীনতায় অচল করে তোলার চেষ্টা হয়েছিলো, সেখানে কবি হিসাবে জীবনানন্দের দৃঢ়তা, আত্মিক সত্তায় আজীবন অবিচল থাকার বিষয়গুলিই উপেক্ষার অন্তরালে থেকে গিয়েছে।
" এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি -আমি হৃষ্ট কবি
আমি এক; -ধুয়েছি আমার দেহ অন্ধকারে একা একা সমুদ্রের জলে; "
কবি কুসুমকুমারী দাশ কি ভবিষ্যৎ দেখতে জানতেন? তিনিও তো লিখে গিয়েছিলেন সেই মানুষের কথা, যে ‘কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে’। জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী দাশ কি তখন জানতেন তখন তাঁর রুগ্ন সন্তান জীবনানন্দ—যাঁর পারিবারিক নাম মিলু—হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে যাবেন? ‘সর্বানন্দ ভবন’-এর সবুজে বেড়ে ওঠা সেই মিলু, যাঁর পাড়ার বন্ধু বৃদ্ধ গাছি, রাজমিস্ত্রি, সত্যানন্দ ফকিরের চোখ দিয়ে জীবন সেঁচা ওই মিলু নিজের কাজের মাধ্যমে হবে কালোত্তীর্ণ জীবনের বাসিন্দা—হয়ে উঠবেন জীবনানন্দ দাশ, এতটা কি তিনিও ভাবতে পেরেছিলেন?
" আমাকে
তুমি দেখিয়েছিলে একদিন;
মস্ত বড় ময়দান — দেবদারু পামের নিবিড় মাথা — মাইলের পর মাইল;
দুপুরবেলার জনবিরল গভীর বাতাস
দূর শূন্যে চিলের পাটকিলে ডানার ভিতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে যায়;
জোয়ারের মতো ফিরে আসে আবার;
জানালায় জানালায় অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে:
পৃথিবীকে মায়াবী নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়। "
দীর্ঘ বেকার জীবনে তিনি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন এবং জীবনের অধিকাংশ সময় গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালিয়েছেন। বন্ধুর সঙ্গে ব্যবসায়ের চেষ্টাও করেছিলেন বছরখানেক। দারিদ্র্য এবং অনটন ছিল তাঁর কর্মজীবনের নিত্যসঙ্গী।
একজন ব্যক্তি তাঁর জীবনে কতটা বোধের অধিকারী হলে কবি জীবনানন্দ হয়ে ওঠেন, হয়তো বা একজীবনে তা উপলব্ধি করা সম্ভবও নয়! দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে শিক্ষক ও সাহিত্যপিপাসু মা–বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর ডাকনাম ছিল মিলু। বাবা কমবয়সে স্কুলে ভর্তি হওয়ার বিরোধী ছিলেন বলেই ভোরে ঘুম থেকে উঠেই পিতার কণ্ঠে উপনিষদ আবৃত্তি ও মায়ের গান শুনে তাঁর বেড়ে ওঠা।
কবি ছিলেন অসম্ভব গম্ভীর প্রকৃতির এবং চরম ধৈর্যশীল মানুষ। ভালোবাসতেন পরিবারকে, সংসারের টুকিটাকি কাজগুলো ভালোবাসতেন। দুই ছেলেমেয়ে, স্ত্রী লাবণ্যের পেনসিলের মাথা ধার করা, ফাউন্টেন কলমে কালি ভরার কাজগুলো নিয়ে কখনো ভাবতে হতো না। এমনকি ছেলেমেয়েকে রাত জেগে ঘুম পাড়ানোতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ভালোবাসতেন গুরুত্ব পেতে, সামান্য অসুখে আশা করতেন সেবা–শুশ্রূষা পেতে। তাঁর রাশভারী স্বভাবেও মাঝেমধ্যে কৌতুক করতেন। আর খেতে ভালোবাসতেন ডিম। ডিমের যেকোনো পদ দেখলেই তিনি লোভ সামলাতে পারতেন না। ছেলের পাতের থেকে ডিমের কিছু অংশ খাওয়া নিয়ে বাপ–ছেলের খুনসুটি প্রায়ই লেগে থাকত।
১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ সাল , কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় কবি জীবনানন্দ আহত ও পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।কুড়ি বছর ধরে, হাজার বছর পরে—এখনো যখন কোনো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিক আকাশ খোঁজে, খোঁজে একটু ভালো আলো,
অনেক দূরের থেকে নির্নিমেষ হয়ে চেয়ে থাকা নক্ষত্র তাকে বলে যায়,
‘সুচেতনা এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ;
এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;
প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে
গ’ড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।’
কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করে।
তথ্যসূত্র :
১| জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা, বেঙ্গল পাবলিশার্স (প্রা.) লিমিটেড
২| আনন্দবাজার
5 মন্তব্যসমূহ
অভিভূত হলাম ... এই নিবন্ধ দৃষ্টি খুলে দেয় 🙏
উত্তরমুছুনঅসাধারণ শ্রদ্ধাঞ্জলি পাঠে মুগ্ধ হলাম
উত্তরমুছুনঅজানা তথ্য সম্ভারে সমৃদ্ধ জীবনানন্দ দাশের এক অনন্য জীবনকাহিনী। পাঠ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরে আমি
উত্তরমুছুনবিমোহিত।
সুন্দর উপস্থাপনা।
সমৃদ্ধ পোস্ট।অনিন্দ্য সুুন্দর শব্দ চয়নে অনুপম রূপক-উপমায় মোড়ানো চমৎকার প্রকাশ। মুগ্ধতা একরাশ।
উত্তরমুছুনভীষণ ভালো লাগলো সমৃদ্ধ হলাম
উত্তরমুছুন