দর্পণ || গল্প || বেরঙীন দোল - শ্রেয়সী রানা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বেরঙীন দোল

শ্রেয়সী রানা


৮ টা বাজে,সকাল টা বেশ রঙিন,হাতে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো তৃষা,সকাল থেকেই কি যেন একটা ভাবনায় মেতে রয়েছে ও,বড্ডো অন্য মনস্ক দেখাচ্ছে ওকে, চায় একবার চুমুক দিয়ে 

আবার ভবনায় নিমজ্জিত,.....

ফোন টা বেজে উঠতেই তৃষা চমকে উঠলো, দেখলো কৃষ্ণেন্দুর ফোন... 

কৃষ্ণেন্দু হলো তৃষার খুব ভালো বন্ধু, পড়াশোনায় খুব ভালো,আর নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে খুব সিরিয়াস,আর ওর সবেচেয়ে ভালো গুন্ হলো ও নিজের ইমোশন খুব সুন্দর কন্ট্রোল করতে পারে,যেটা তৃষার ক্ষেত্রে পুরো উল্টো,...

ওদের একটা পুরো গ্রুপ আছে.... 

তবে এই বন্ধুত্বের গ্রুপ টা অন্য গ্রুপ এর থেকে আলাদা, কৃষ্ণেন্দু,সোহম,রৌনক,রাজ্ আর তৃষা,ও একাই মেয়ে, তাই সবার কাছেই ওর গুরুত্বটা একটু বেশি....  

  

ফোন ধরতেই কৃষ্ণেন্দু বলে উঠলো কিরে পড়তে জাবি না?

তৃষা - না রে আজ ভালো লাগছে না কিছু.....

কৃষ্ণেন্দু- কোনো কি হলো আবার, এত মন খারাপ হয় কোনো? 

তৃষা - তোকে বললে যেন তুই বুঝবি? সেই তো আমাকে বলবি আমি বেশি ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি,তার থেকে দরকার নেই আমার মন খারাপ আমি বুঝে নেবো.. 


কৃষ্ণেন্দু আর তৃষার বন্ধুত্বটা বেশ অন্যরকম ওরা একে ওপর কে খুব ভালো করে বোঝে,কৃষ্ণেন্দুর প্রবলেম এ যেমন তৃষা সবসময় পশে থাকে সেরকমই কৃষ্ণেন্দুর কাছেও তৃষার প্রবলেম মানেই ওর প্রবলেম, আর বাকিরা তো আছেই...


তবে এবারের ব্যাপার টা ঠিক ধরতে পারলোনা কৃষ্ণেন্দু...সব তো ঠিকই চলছিল, তাহলে হটাৎ কি হলো,তবে এই টুকু কৃষ্ণেন্দু বুঝতেই পেরেছে যে নিশ্চই কোনো ছোটোখাটো ব্যাপারকেই তৃষা বড়ো করে  ভেবে মন খারাপ করে বসে আছে, তাই ও ওর বাকি বন্ধুদের ফোন করে তৃষার সাথে দেখা করবে ঠিক করলো,কারণ ওদের পুরো গ্রুপ  টা একসাথে হলে কারোর পক্ষেই মন খারাপ করে থাকা সম্ভব নয়,.....


তৃষা কিন্তু ভেবেই চলেছে,যত ভাবছে ততো বেশি মন খারাপ হচ্ছে ওর,এমন সময় পেছন থেকে এসে কৃষনেন্দু  চুল টা টানতেই তৃষা পেছনে ঘুরলো 

আবার শুরু করেছিস তুই মার খাবি এবার,ভালো লাগছেনা কিন্তু....

ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে সোহম এসে ওর চোখ দুটো হাত দিয়ে চাপা দিলো,তৃষা আন্দাজে বলে উঠলো....

"দেখ রৌনক রাজ্ আর সোহম যেই হোস না কেনো ছাড় খুব মার খাবি এবার সবকটা."...


সোহম ছেড়ে দিলো যেমন কথা তেমন কাজ শুরু হয় গেল মারামারি 

কৃষ্ণেন্দু সবাইকে থামিয়ে বললো কি হয়েজছে বলতো?

তৃষার মুড তখন অনেকটা ঠিক হয় গেছে, তাই ও বললো 

দেখ এটাই আমাদের লাস্ট বছর,এর পর আমাদের সবাইকে ক্যারিয়ার নিয়ে ভবতে হবে আর পুরো বছর টা তো করোনা করোনা করেই কেটে গেল,এবারের দোল টাও কি আমরা একসাথে সেলিব্রেশট করতে পারবোনা? বলে কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকালো তৃষা 

"ধুর পাগলী এত ছোট্ট একটা ব্যাপার?ঠিক আছে চল এবারের দোল টা আমরা সবচেয়ে বড়ো আর ভালো করে সেলিব্রেশট করবো যাতে বেস্ট মেমরি ক্রিয়েট হয়,"

তৃষা হেসে বললো এই জন্যই তোকে আমি এত ভালোবাসি কৃষ্ণেন্দু 


কৃষ্ণেন্দু -"কি বলি"?


তৃষা - "অরে কিছুনা এবারের দোলে তোকে একটা কথা বলার আছে আর এই গ্রুপ এর সবার থেকে একটা প্রমিসে নেয়ার আছে রাজি তো"


"যো হুকুম মেরি মা "  (বলে উঠলো সবাই )

       

(দোলের দিন সকালে )  


প্ল্যান সব রেডি.. অনেক অনেক আসা করে ছিল তৃষা, ওর মনে অনেক কথা জমে ছিল,....যেগুলো ও এবারের দোল এ বলে নিজেকে হালকা করবে আর নতুন একটা শুরু করবে ....২৬ দিনের পর আজ তার অপেক্ষার অবসান....


কথা অনুযায়ী সবাই একজোট হলো সকালে সবাই সাদা জামা র হাতে আবির নিয়ে সোহম এর ছাদে উপস্থিত,কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর কোনো পাত্তা নেই,সকাল থেকে ওকে সবাই প্রায় অনেকক্ষণ ধরে ফোন করেছে কিন্তু ব্যাস্ত ব্যাস্ত বলেই যাচ্ছে, সকাল ৯ টা.....১২ টায় পরিণত হলো,এখনো কেউ এক ফোটা আবীর মাখেনি আর তৃষা তো মাখেই নি,....কারণ ও প্রতি বছর আগে কৃষ্ণেন্দুকে আবির মাখিয়ে ভুত বানায় তরপর নিজে মাখে,

কিন্তু আজ তৃষার খুব রাগ ধরছে খুব অভিমান হচ্ছে,আবার চিন্তাও হচ্ছে..সব মিলিয়ে যেন একটা অস্সস্তিকর পরিস্থিতি আর এদিকে বাকি তিন জন তৃষা কে বুঝিয়েই যাচ্ছে যে আবার বাড়ি চল অনেক বেলা হয়েছে কৃষ্ণেন্দু র আসবে না..... 


কিন্তু তৃষার জেদ আজ যতক্ষণ না কৃষ্ণেন্দু আসবে ততক্ষন ও নড়বেনা ওর অনেক কিছু বলার আছে কৃষ্ণেন্দুকে যার জন্য ও ২৬ দিন অপেক্ষা করে গেছে.... 

বলতে বলতেই আবার কেঁদে ফেললো তৃষা.....


ঠিক তখনি কৃষ্ণেন্দু উপস্থিত তখন প্রায় ১ টা বাজে কৃষ্ণেন্দুকে দেখে চোখের জল মুছে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো তৃষা....

আমি জানি তুই অনেক রাগ করেছিস,আমি পুরো প্ল্যান করে আমি ভেস্তে দিলাম খুব খারাপ লাগছে রে আমার কিন্তু একটা খুশির খবর দেয়ার আছে....  তার আগে তুই কিসব বলবি বলেছিলিস আর কিসব প্রমিস করাবি বলেছিলিস সেগুলো আগে সেরে নে....


এবার তৃষা ঘুরে দাঁড়িরে কাঁদো কাঁদো অভিমানী গলায় বললো...

 না! আগে তুই বল যে কি এমন খুশির খবর যার জন্য তুই আমাদের এতক্ষন অপেক্ষা করালি আর আমার সব আসায় এভাবে জল ঢেলে দিলি..... 


কৃষ্ণেন্দু তৃষার হাত দুটো ধরে বললো....."দেখ আজ পর্যন্ত তুই আমাকে সবচেয়ে ভালো বুঝিস....

আমি জানি এটা সোনার পর তোর থেকে খুশি হয়তো আর কেউ হবে না,"

তৃষা - "ধুর বাবা..... বলবি তুই? আমার অপেক্ষার পরীক্ষা নিস না" 

কৃষ্ণেন্দু - "ওকে মেরি মা শোন্ তাহলে, 

কাল রাট ৬ তাই আমার ফ্লাইট আমি বেঙ্গালুরু চলে যাচ্ছি একটা চাকরি পেয়েছি তবে শিফটিং ওয়ার্ক আজ সকালেই ফোন এল,তাই ব্যাস্ত ছিলাম,কাজের সূত্রে হলেও কত জায়গায় ঘুরবো?......আর ওখানের মেয়ে গুলো কত সুন্দর হবে, আমার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে আমি জানি এই খবর টা শুনে তুই আর রেগে থাকবিনা..."


হাত টা ছাড়িয়ে নিলো তৃষা ওর চোখে ছিল অনেক না বলা কথা,

আর কৃষ্ণেন্দুর চোখে ছিল হাজারো স্বপ্ন,

চোখ বন্ধ করলো তৃষা,মনে মনে বললো "ভালোবাসি কৃষ্ণেন্দু খুব ভালোবাসি তোকে,তোর ক্যারিয়ার এর এই সাকসেস এ আমি সত্যি খুব খুশি কিন্তু".....


কৃষ্ণেন্দু -.....কিন্তু খুব মিস করবো তোকে জানিস তৃষা,

তৃষা চোখ খুললো,

কৃষ্ণেন্দু বললো - "আজ থেকে আমার জীবনের সব সিচুয়েশন এ তুই ছিলিস, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এর থেকেও অনেক বেশি কিছু,ওখানে গেলে কে চেচাবে আমার ওপর কে বকাবকি করবে ,কোনো মেয়ের দিকে তাকালে কে রেগে যাবে বলতো?..."


.....সেদিন চরিত্র দুটো পাল্টে গেছিলো,যে ছেলেটা নিজের ইমোশন কে সবসময় সবচেয়ে বেশি সামলে রাখতো সে যেন নিমিষেই বড্ডো আবেগী হয়ে পড়েছিল নিজের মনের সব কথা এক নিস্সাসে তৃষাকে বলে গেল আর ওর বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে বললো ভাই ফ্লাইট পর্যন্ত থেকে যাস.....

আর এদিকে তৃষা,  যে কথায় কথায় ইমোশনাল হয়ে যেত সে আজ নিজের সব ইমোশন কন্ট্রোল করতে শিখে গেল অনেক জমানো কথা কিন্তু একটা শব্দও বেরোচ্ছে না,পুরো চুপ।


"...কিরে কি বলবি বলছিলিস,কিসব প্রমিস করবি বলছিলিস,বল এবার" 

তৃষা বললো অল দ‍্যা বেস্ট,তুই চলে যাচ্ছিস আমার পড়াশোনার চাপ থাকবে, এই গ্রুপ টাকে কোনো দিনও ভাঙতে না দেয়ার প্রমিস করতাম কিন্তু আমি পাগল কোনো জিনিস ই স্থায়ী নয় তবে আমার জীবনে তোদের গুরুত্ব অনেক টা, আর কৌস্তব ভালো থাকিস কোনো বাজে মেয়ের পাল্লায় পড়িস না..... 


নারে পাগলী বাজে মেয়ের পাল্লায় তো পোড়বই না উল্টে সবচেয়ে সুন্দরী বৌ হবে আমার...দেখিস... তৃষা কে রাগিয়ে বললো কৌস্তব 


তৃষা আবীরের থালাটা রেখে দিল,

কৃষ্ণেন্দু  - "কিরে আবির মাখবিনা আমায়"?


একবার হেসে, কিছু না বলে ঘরে চলে এল তৃষা, তবে এক ফোটাও জল বেরোয়নি ওর চোখ দিয়ে সেদিন, আসলে যে দিনটা কে ও সবচেয়ে রঙিন করে তুলবে ভেবেছিলো সেই দিনটা যে ওর সব স্বপ্ন কে বেরঙিন করে দিলো, আলাদা হয়ে গেল সবাই...

           

(পরের দিন সন্ধে বেলা )


কিরে তৃষা আসবে না আমাকে ছাড়তে? কৃষ্ণেন্দু  বললো...

না রে সকাল থেকে ওকে অনেক বার ফোন করেছি ফোন ধরেনি 

বাড়িতেও ছিলোনা জানিনা কোথায়? 

অনেকক্ষন অপেক্ষা করলো কৃষ্ণেন্দু  ওর অভিমান হলো একবার কী তৃষা পারতোনা? শেষবারের মতো দেখা করতে....খুব কষ্ট পেলো কৌস্তব.....


তৃষা বসে আছে গঙ্গার পারে যেখানে প্রায়ই ওরা দুজন আড্ডা মারতে আসতো আসলে তৃষা বাধা হতে চায়নি কৃষ্ণেন্দু  আর,যদি নিজেকে সামলাতে না পারে,যদি মনের কোনে জমে থাকা কথা গুলো নিমিষেই বেরিয়ে আসে?.... তখন কি হবে?... 


তাই আর দেখা করেনি,তবে কৃষ্ণেন্দু  এর মতো কাউকে তৃষা ভালোবাসেনি র বাসবেও না কোনোদিন কারণ কৌস্তব এর মতো ওকে কেউ বুঝতো না....


যে গল্পটা তৃষা সাদা সারি পাঞ্জাবিতে বিভিন্ন রং দিয়ে সাজিয়ে শুরু করবে ভেবেছিলো সেই গল্পটা শুরুর আগেই বেরঙিন হয়ে শেষ হয়ে গেল।।....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ