দর্পণ || গল্প || রামধনু জীবন - পারমিতা রাহা হালদার(বিজয়া)




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

রামধনু জীবন 

পারমিতা রাহা হালদার(বিজয়া)


       তৃণার বসন্ত, বিবর্ণতায় ভরে উঠেছে গত দুবছরে। বিয়ের মাত্র নয় মাসের মধ্যে বৈধব্য যন্ত্রণা বুকে চেপে বাঙালি মিষ্টি মেয়েটি রাজস্থানি শ্বশুর বাড়িতে সংসার করছে।  সৈনিক স্বামী দেশমাতৃকার রক্ষার্থে প্রাণ দিয়েছে সে কথা কষ্টের হলেও গর্বের কিন্তু বৈবাহিক জীবনের সুখ শুরুর আগেই  বিদায় নিয়েছিল কৃষানের জ্বলন্ত চিতার সাথে। পলাশ, শিমূলের রক্তিম আভার উষ্ণ চুম্বন তৃণার মুখ উজ্জ্বলতায় ভরায় না আর দশটা নববধূর মতো, বরং অকালেই যেন অযাচিত দুঃখ কষ্টের ক্ষত গুলো তাজা হয়ে ধরা দিয়েছে চেহারায়। 

     কৃষাণ আর রঞ্জন সৈনিক।স্কুলের বন্ধুত্ব থেকে এয়ারফোর্স ট্রেনিং এমন কি কৃষানের মৃত্যুর সময় কাশ্মীরে পোস্টিং পুরোটাই একসাথে। কৃষাণের বিয়েতেই প্রথম দেখা তৃণার সঙ্গে। বন্ধুর কফিন নিজের কাঁধে আনার সময় বেশ ভারি বোধ হচ্ছিল। তৃণার চোখে চোখ রাখতে পারেনি রঞ্জন। 

     রঞ্জনের বাড়ি কৃষাণদের থেকে সামান্য  দূরে। মাসদেড়েকের ছুটি রঞ্জনের। প্রতিটা নিঃশ্বাসে মিস করে কৃষাণকে। কি জানি কৃষাণের শোকার্ত পরিবার কেমন আছে?! কাল হোলি, দুমুঠো রঙ নিয়ে যাবো ওদের মাখাতে। কৃষাণই হোলিটা মাতিয়ে রাখতো। সেই কৃষাণ...

    পরের দিন কৃষাণের বাড়িতে ঢুকতেই কানে ভেসে এলো মিষ্টি সুর "ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় ঝরেছে যে প্রাণ ", কে গাইছে?! বাড়ির বাগানের দিক থেকেই সুর ভাসছে যেন; ঔৎসুক‍্য নিয়ে রঞ্জন বাগানের দিকে এগিয়ে যেতেই আচমকা ধাক্কায় কার ফুলের  ঝুড়ি থেকে সব ফুল গুলো ছড়িয়ে পড়লো মাটিতে! রঞ্জনের হাতে থাকা রঙ ছড়িয়ে পড়তেই রঞ্জন বললো, একি তৃণা তুমি... ! তোমার চেহারার এতো পরিবর্তন! তৃণা ছড়িয়ে পড়া ফুলগুলো কুড়াতে গেলে রঞ্জন হাত লাগাল তৃনার বারণ অগ্রাহ্য করে।

     তৃণা নিজের গায়ের উপর পড়া রঙ ঝেড়ে  রঞ্জনের আতিথেয়তার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হলো। ঘটে যাওয়া ঝড়ের বিষন্নতা কাটিয়ে এসেছে  সুসংবাদ, কৃষানের বোন ঋষার বিয়ে। কৃষানের মা বাবার অনুরোধে শাদীর দায়িত্ব পড়ল রঞ্জনের কাঁধে।

      দিন পনেরো বিয়ের বাকি। তৃণা আর রঞ্জন দুজনে মিলে বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব পালনের ব্যস্ততায় ঘিরে, তারই মাঝে দুজনের মধ্যে তৈরি হচ্ছিল বন্ধুত্ব। রঞ্জন লক্ষ্য করছে তার কথাতে তৃণা হেসে উঠছে। এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশ রঞ্জন কে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। এই ভালোলাগার তৃপ্তিটা কোনভাবে হারাতে চায়না রঞ্জন। 

       ঋষার বিয়ের জন্য বাড়িতে আত্মীয়দের ভীড়। চারিদিকে হৈ চৈ। কিন্তু তৃণা কোথায়? রঞ্জন পুরো বাড়িতে খোঁজার পর বাগানে পেল তৃণা কে। এখানে একা দাঁড়িয়ে কাঁদছে তৃণা?!

      জানো রঞ্জন, কৃষাণ ভালবাসার প্রপোজাল দিয়েছিল এই বাগানে! এখনও যখন বাগানে আসি কৃষাণ পাশে থাকে,অনুভব করি। আজ অভিযোগ নিয়ে এসেছি কৃষাণের কাছে। ঋষা বিয়ের  দিনকয়েকের মধ্যে বিদেশে চলে গেলে আমি একা...!

      তৃণার কথার শেষে দীর্ঘশ্বাস, বুকে আঘাত করলো রঞ্জনের। নিজেকে সামলে বললো, তাই জ্যোৎস্না মুখে অমাবস্যার চাঁদ। তৃণা তুমি এবার কিছু কাজ করে নিজের পরিচয় তৈরি করো। টাকার জন্য নয়, দেশের জন্য নিজের ভালোলাগার জন্য করো। সময় কে এইভাবে বইতে দিও না। মূল্যবান বানিয়ে তোলো নিজের সময় কে। 

       আমি ভীষণ সাধারণ মেয়ে রঞ্জন, কি করতে পারি আমি?! আমার তো কোন ক্ষমতাই নেই। 

       কে বলতে পারে কার কতটুকু ক্ষমতা। যতক্ষণ না তুমি নিজে কিছু করার চেষ্টা  করছো ততক্ষণ তুমি তোমার ক্ষমতা জানবে কি করে তৃণা।

        ডাক পড়লো তৃণার, ভিতরে  ছুটে গেল তৃণা সাড়া দিয়ে। রঞ্জন কাজে ব্যস্ত হলো।

         বিয়ের কোন জিনিসই ছোঁবে না তৃণা।  কোন কাজের মধ্যেও থাকবে না দূর থেকে শাদী দেখবে। চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এলো, রঞ্জন ও।

          ঋষা বললো, ভাবী কেন ছুঁতে পারবে না?! ভাবী আমাকে হলদি না মাখালে আমি মাখবো না। 

         ঋষা বিধবা অওরত অশুভ হয়, শুভ কাজে হাত দিতে পারেনা। তুমি যেটা বোঝানা সেটা নিয়ে কথা বলোনা চুপ থাকো। 

          ঋষা কোন কথা মানতে চাইলো না, এই নিয়ে বাড়িতে আসা আত্মীয়দের সাথে শুরু হলো গন্ডগোল। প্রথম দিকে রঞ্জন চুপ থাকলেও পরে তৃণা কে করা কিছু অপমানকর কথাবার্তায় প্রতিবাদ করলো।উত্তেজনায় তৃণার সারা জীবনের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল সবার সামনে। 

           কথাটা শুনেই তৃণা কষিয়ে একটা চড় মেরে রঞ্জন কে বললো আমি শুধু কৃষাণ কেই ভালোবাসি,তোমার স্পর্ধায় অবাক হচ্ছি কৃষাণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলে তুমি?!

          ঋষার বিদায়ের সাথে রঞ্জন বিদায় নিল। যাওয়ার সময় বলল আজীবন তোমার জন্য অপেক্ষা করবো তৃণা। আমার বিশ্বাস তুমি একদিন বুঝবে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।

         আমি বিধবা রঞ্জন, এই সব ভাবনা আমার জন্য পাপ। তাছাড়া আমি কৃষাণের বিধবা নামেই বাঁচতে চাই। তোমাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে কিছু নেই, তুমি এই সমস্ত ঘটনা ভুলে যাও, তোমাদের সমাজ এই সম্পর্ক মেনে নেবে না। আমি মাসা- বাবাসার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবো না। কৃষানের পর আমি ওনাদের শেষ সম্বল।

          যুগের সাথে সমাজ পরিবর্তনশীল, তোমার ভ্রান্ত চিন্তাধারা মুছে ফেলো তৃণা।  বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ আইন কেন এনেছিল তৃণা?

        বছর ঘুরে গেছে রঞ্জন ফিরে গেছে। তৃণা হাজার চেষ্টাতেও রঞ্জনের সাথে কাটানো সময়, ওর বলা কথাগুলো ভুলতে পারছে না। তবে বিবেক জিতে যাচ্ছে মনের কাছে। তাই রঞ্জনের সাথে মন চাইলেও যোগাযোগ করতে পারেনা তৃণা।

         6 এপ্রিল 2009, গৌহাটিতে জঙ্গি হামলায় রঞ্জনের গুরুতর আহতের খবর আসে। রক্তের হোলি খেলল গৌহাটির আকাশ বাতাস।খবর পেয়ে তৃণা বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে গিয়ে আটকে যায়। মাসা সাহস দিয়ে বললেন "ফিরিয়ে আন বহু রঞ্জন কে।"

      এপ্রিল 10, রাজস্থান থেকে তৃণার ফ্লাইট উড়ল আকাশে। বসন্ত হয়তো রঙিন হবে তৃণার জীবনে রঞ্জনের হাত ধরেই। কিন্তু তৃণা আর কোন কৃষাণ কে হারাতে চায়না। ফ্লাইট  দিল্লি হয়ে গৌহাটি আর তৃণা পুরনো জীবন ফেলে নতুন জীবনের মাটিতে পা রাখলো। তৃণার স্বাগতম হলো আনুষ্ঠানিক ভাবে "আফোয়া" তেই "বসন্ত এসে গেছে", নাচ গানের তালের সুরে। 

        তৃনার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো আবির রঙের রঙিন বসন্তে....!!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ