দর্পণ | ধারাবাহিক কলম | উপন্যাস ~ কংসাবতী | দ্বিতীয় পর্ব




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

কংসাবতী (পর্ব-২)

উপস্থাপনায় -- মহুয়া 


হঠাৎ কনস্টেবলের ডাকে চমকে ওঠে সুচেতা ।

---- ম্যাডাম স্যার ডাকছেন আপনাকে । আমাদের থানায় ফিরতে হবে ।

----- হ্যাঁ, হ্যাঁ , চলুন । খুব খারাপ লাগছে জানেন । এদের বাড়িতে কোনো খবর ও দেওয়া গেলো না । ওদের গাড়িতে কি কি আছে সেটাও দেখিনি । ওই ব্যাগটা খালি ভদ্রমহিলার কাছে ছিল । 

------ স্যার আসার সময় গাড়ি চেক করে একটা বড়ো ব্যাগ আর একটা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ পেয়েছে । থানায় গিয়ে দেখা যাবে ম্যাডাম , আপনি চিন্তা করবেন না ।


 ------ আচ্ছা ডক্টর রায় , আমরা তাহলে আজকের মত যাচ্ছি । এককড়ি তুমি ম্যাডামকে গাড়িতে তুলে দাও । রামধন , চলো । ম্যাডাম আপনাকে কোথায় নামাব ?

------- আমাকে খাতড়ার মোড়ে নামিয়ে দিলে চলে যেতে পারবো ।

 

গাড়ি ছুটলো থানার দিকে ।


প্রায় পনের বছর । রানিবাঁধ হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয় বাঁকুড়ার সারেঙ্গা গ্রামের মেধাবী ,বোকাসোকা ,শহুরে আদবকায়দা না জানা উনিশ বছরের সুচেতা ওরফে চিন্তমনি টুডু।

গ্রামের জলহাওয়ায় বড় হওয়া মেয়েটা বাবার হাত ধরে হাওড়া স্টেশনে পা রেখেই কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল । 

------ হ ,বাপ আমাকে ইকা থাকইতে হব্যেক ই সহরে ?

------- হ রে মা , তু ইখানে পইড়তে আসেছু , থাকইতে লয় । যখন কেলাস থাইকবেক , তখন

          খালি থায়কবি । আর সময় ঘর চইলে যাবি । কন ডর নাই । তকে আমার বন্ধুর ঘরে রাইখ্যে যাব্য । তুই চিন্তা করিস না । খালি মন লাগাই পইড়ে যা । তকে বড় হইতে হবেক । সুনামনির মত করেছু ত বুঝে লে , তর বাপট আর বাঁইচবেক লাই ।কত কষ্ট কইরে তকে লেখাপড়া সিখাচ্ছি । 

 

শহরের লোকের কাছে চিন্তামনি দেখবার আর শোনবার বস্তু বটে । প্রথম দিন কলেজে তো ওকে সবাই দুর থেকে দেখছিল । ক্লাসে ঢুকে বসার জায়গা পাচ্ছিল না । কোনো কোনো বেঞ্চে বসার জায়গা থাকলেও বসতে দিচ্ছিল না । "জায়গা আছে" বলে দিচ্ছিল । শেষে লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসেছিল । এইভাবে একটা একটা করে দিন চলে যাচ্ছিলো । একটু একটু করে মানিয়ে নিতে শিখে যাচ্ছিলো চিন্তামনি । তবুও আদিবাসী শুনলে সবাইই একটা অন্য নজরে দেখতো । এমনকি শিক্ষক শিক্ষিকারা ও এর ব্যাতিক্রম ছিল না । কেউ কেউ বলতো ও ক্লাসে ঢুকলেই নাকি কেমন একটা গন্ধ ছাড়ে । তারপর ওর ভাষা শুনে সবাই খুব মজা পেত । বারবার করে বলতো "তুই এটা বল , তুই ওটা বল" ,সেটা নিয়ে চলতো মজা । কেউ কেউ ওর কথা নকল করে ভ্যাঙাত । এরপর ছিল কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে টোন টিটকিরি । আদিবাসী বলেই নাকি ও চান্স পেয়েছে যাদবপুরের মত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার । ওইসব সংরক্ষণ প্রথার জন্যে । যতবারই চিন্তামনি বোঝানোর চেষ্টা করে সে তার জাতি হিসেবে নয় , উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের ভিত্তিতে ভর্তি হয়েছে , ততবারই তাকে বিফলমনোরাথ হতে হয়েছে । ক্লাসের পরীক্ষায় ভালো ফল করলেও প্রায় সবাইই বলতো যে ওকে দয়া করে নাম্বার দিয়েছে । 

কেউই তার সাথে বিশেষ কথা বলত না , শুধু যারা ক্লাস ফাঁকি দিত তারা ওর থেকে নোটস নেবার জন্যে কথা বলতো । বড্ড মনমরা হয়ে থাকতো চিন্তামনি । গ্রামের খোলামেলা পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা মেয়েটা কেমন যেনো হারিয়ে যেতে লাগলো । দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেলো । প্রথম বছর পরীক্ষার ফল খুব ভালো হোলো না । যদিও অনার্স রয়ে গেলো । এমনসময় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন চিন্তামনির অমল খুড়া , চিন্তামনির বাবার বন্ধু অমল চক্রবর্তী । একদিন চিন্তা কে ডেকে বললেন ,"তুই এত মন মরা হয়ে থাকিস কেনো রে মা ? বাড়ির জন্যে মন খারাপ করে ? বাবাকে অনেকদিন দেখিসনি তাই না ? কলেজ কেমন লাগছে তোর ?" বলতেই চিন্তা হুহু করে কেঁদে ফেলে । "

------ হ গ খুড়া , আমার ইখানে থাকইতে ভাল্য নাই লাগে । কলেজে ছেলেমেয়েগুলান আমার সাথে কথা নাই বলে । উরা আমাকে দেইখে মজাক করে । আমি আদিবাসী আছি সি জন্যে । তুমি বাপকে বলে ,আমাকে নিয়ে যাত্যে বল । ই কলকাতা শহুরে আমাদের জন্যে কুনু জায়গা লাই বটে ।

------- শোন চিন্তা ভয় পাস না , আমি আছি তো তোর আর এক বাপ । আয় আমার কাছে আয় । আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে । এবার তোর বাপ আসলে ওর কাছ থেকে একটা পারমিশন নেবো । দেখিস আর কোনো ঝামেলা থাকবে না । 

------- হ খুড়া , কি বুদ্ধি খুইলে বুল ত । 

-------- সুচেতা নামটা কেমন ? চিন্তা মনি টুডু থাকবে না , থাকবে সুচেতা চক্রবর্তী । তোকে এ্যাডপ করে কোর্টে এফিডেফিড করিয়ে নিলেই কেল্লা ফতে । তুই শুধু তোর কথাগুলো ঠিক করে নে । অনেকটা হয়েছে , আর একটু করতে হবে । আমার এতদিন একটা মেয়ে ছিল , আজ থেকে দুটো মেয়ে হোলো । কাল থেকে অলি কে সায়েন্স গ্রুপটা তুই দেখিয়ে দিবি । 

তোর মতো মেধাবী মেয়ে আমাদের সম্পদ , তোকে তো হারিয়ে যেতে দিতে পারি না । 

 

এরপর থেকে আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাস টা একটু একটু করে ফিরে আসছিল চিন্তার । সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট আশাতীত ভালো হোলো । প্রিন্সিপাল স্যার , হেড অব দা ডিপার্টমেন্ট সঞ্জয় স্যার , ক্লাস টিচার সবাই ওকে ডেকে অভিনন্দন জানালো । আর আশ্চর্যজনকভাবে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ব্যবহার ও কেমন পাল্টে যেতে লাগলো । কেউ কেউ আবার ওর ঘনিষ্ট হবার চেষ্টায় ব্রতী হোলো । কেউ কেউ ওর থেকে নোটস পাওয়ার জন্যে অয়েলিং করাও শুরু করে দিলো । এই অভাবনীয় পরিবর্তন চিন্তামনিকে পড়াশুনোর প্রতি আর ও আগ্রহী করে তুললো ।

ঠিক এই সময় একদিন কলেজে মাইনে দিতে গিয়ে আলাপ হোলো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিযারিং এর ছাত্র প্রতুল বসুর সাথে । 


------- ম্যাডাম খাতড়ার মোড় চলে এসেছি , কোথায় নামাবো আপনাকে ? 

------- অ্যা , হ্যাঁ ,এখানেই নামিয়ে দিন , চলে যাবো ।

------- আপনি বললে বাড়িতেও নামিয়ে দিয়ে আসতে পারি , তবে কিনা পুলিশের গাড়ি তো লোকজন চমকে যেতে পারে । 

------ না না দরকার হবে না , মিনিট দশেক হাঁটলেই পৌঁছে যাবো । ডোন্ট ওরি । ধন্যবাদ । শুভ রাত্রি ।

------- শুভ রাত্রি , তবে দরকার পড়লে কিন্তু ম্যাডাম আসতে হবে । ধন্যবাদ আপনাকেও। আজকের দিনে যেখানে মানবিকতা নেই বললেই চলে , সেখানে আপনি নিজের দায়িত্বে দুটো আধমরা মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন । অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন । 

------- হুমমম, আসলে জীবনের ঠিক কোন সময় দাঁড়িয়ে মানুষ সাহসিকতার পরিচয় দেয় , সেটা সে নিজেই জানে না । প্রত্যেকটা মানুষই পরিস্থিতির শিকার । এই যেমন আপনি জানেন না ,ঠিক এই মুহূর্তে আপনার খুব নিকটজনের প্রাণ সংশয় হলে আপনি কতটা সাহসী হবেন ? চলি , শুভ রাত্রি ।

(চলবে)


আগের পর্ব পড়ুন ....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ