মহালয়ার তত্ত্ব কথা ~ রূপম চক্রবর্ত্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 মহালয়ার তত্ত্ব কথা

রূপম চক্রবর্ত্তী

(সনাতন ধর্মীয় বক্তা, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট )


  চিন্তা চেতনায় সমৃদ্ধ ভক্ত সজ্জনদের কাছে মহালয়া তিথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

মহালয়া এলেই বাংলার মাটি-নদী –আকাশ প্রস্তুত হয় মাতৃপূজার মহালগ্নকে বরণ করার জন্য। কাশফুল ফুটলে শরৎ আসে, না শরৎ এলে কাশফুল এসব নিয়ে বিস্তর তর্ক চলতে পারে। কিন্তু মহালয়া এলেই যে দূর্গাপূজা এসে যায়, তা নিয়ে তর্কের কোনও অবকাশ 

নেই। মহালয়া এলেই সেই দেবী-বন্দনার সুর ধ্বনিত হয় বাংলার হৃদয়ে। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। বুকের মধ্যে জাগে আনন্দ-শিহরিত কম্পন, মা আসবেন সেই অপেক্ষায় থাকে ভক্তকূল। মহালয়া শব্দের আক্ষরিক সমার্থ হলো 'আনন্দ নিকেতন’। দেবী মায়ের আগমনী সুরে আনন্দের বার্তা আসে পৃথিবী জুড়ে। দেবীপক্ষের সূচনাকালেই ধরাধামে আবির্ভূত হন দুর্গা। চাঁদের হিসেব অনুসারে দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্বের অমাবস্যার দিনে। এই দিনটিই মহালয়া নামে পরিচিত। যেহেতু চাঁদের হিসেবে প্রতি অর্ধমাসে একবার করে পূর্ণিমা ও অমাবস্যা হয়, তাই দেবীপক্ষের সমাপ্তি যে পঞ্চদশ দিনে অর্থাৎ পূর্ণিমায়, এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ দিনটিতে লক্ষ্মীপূজার আয়োজন করে থাকেন। দুর্গাপূজা মূলত 

পাঁচদিন ব্যাপ্তির পূজো হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা।


বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডী পাঠ আর মাতৃ সংগীত শুনতে শুনতে মহালয়া শুরু হয়। 

এই মহালয়া সম্পর্কে আমাদের সবার জানা দরকার। মহালয়া তিথি সনাতনী সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মহালয়ার পূর্বের ১৫ দিন এবং মহালয়ার পরের ১৫ দিন সনাতনী সম্প্রদায় তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ এবং মাতৃ আরাধনায় নিজেদের সমর্পিত করেন। 

সনাতন ধর্মের ইতিহাস অনুযায়ী, সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষের সূচনা হয়। মানুষের বিশ্বাস, এসময় পূর্বপুরুষরা পিতৃলোক ছেড়ে করে তাঁদের উত্তরপুরুষদের বাড়িতে অবস্থান করেন। পরে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে তাঁদের উদ্দেশে তর্পণ করতে হয়।

এই অনুষ্ঠানে পূর্ববর্তী তিন পুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল প্রদান করা হয়, তাদের নাম উচ্চারণ করা হয় এবং গোত্রের পিতাকে স্মরণ করা হয়। এই কারণে একজন 

ব্যক্তির পক্ষে বংশের ছয় প্রজন্মের নাম স্মরণ রাখা সম্ভব হয় এবং এর ফলে বংশের বন্ধন দৃঢ় হয়। ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতাত্ত্বিক উষা মেননের মতেও, পিতৃপক্ষ বংশের বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে। এই পক্ষে বংশের বর্তমান প্রজন্ম পূর্বপুরুষের নাম স্মরণ করে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ।


মহালয়া মানে পিতৃপক্ষের শেষ আর দেবীপক্ষের শুরু । হিন্দুধর্ম মতে, পিতৃপক্ষ পূর্বপূরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত।পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্য 

মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন 

এবং পরমাত্মায় (ঈশ্বর) লীন হন এবং এইপ্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের উর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।


তর্পণ শব্দটির সাথে হয়তো সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের বাইরে অন্যরা সেভাবে অনেকে পরিচিত নয়। তর্পণ মানে কাউকে সন্তুষ্ট করা, খুশি করা। সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে পূর্বপুরুষদের জন্য, যাদের পিতা-মাতা নেই, তাদের পিতা-মাতার জন্য, সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়। শ্রীরাম যখন রাবণের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্যে লঙ্কায় যান, তার পূর্বে তিনিও তর্পণ করেছিলেন। 

হিন্দুদের মতে, প্রকৃতির সন্তুষ্টি ব্যতীত কোনো শুভ কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়া কঠিন বলে মনে করা হয়। মহালয়াতে যারা গঙ্গার জলে অঞ্জলি প্রদান করে থাকেন, তারা মূলত পৃথিবীর সকল সৃষ্টির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন ও তর্পণ প্রদান করেন। যারা নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তারা এই দিন শ্রাদ্ধ করতে পারেন।


এ সম্পর্কে মহাভারতে একটি কাহিনী বর্ণীত আছে যে: প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তার আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা 

হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। 

তাই স্বর্গে তাকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তার পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে 

স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই 

পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।এই কাহিনির কোনো কোনো পাঠান্তরে, ইন্দ্রের বদলে যমকে দেখা যায়। 


"ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম/ আব্রহ্ম স্তম্ভ 

পর্যন্তং জগত্‍ তৃপ্যতু


প্রথানুসারে মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন, তারা তাদের পূর্বপূরুষকে স্মরণ করে, পূর্বপূরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। হিন্দু পুরাণ 

অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই পিতৃলোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং এভাবে মৃত ব্যক্তি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের ঊর্ধ্বে উঠে যান। এ কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মবিশ্বাস বলে, মহালয়ার দিনে মৃত সকল ব্যক্তির আত্মাদের ধরায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রয়াত সকল আত্মার যে মহা এক সমাবেশের সৃষ্টি হয়, তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মূলত মহালয়া শব্দটি এসেছে। মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথি আছে। 

তাদের নাম হল, প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। সনাতন মতে, যে ব্যক্তি তর্পণে ইচ্ছুক হন, তাঁকে তাঁর পিতার মৃত্যুর তিথিতে তর্পণ করতে হয়। তবে অমাবস্যার দিন তিথি না থাকলেও সব পূর্বপুরুষের শ্রাদ্ধ করা হয়। 


যাঁরা নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তাঁরা এই দিন শ্রাদ্ধ করতে পারেন। এই দিন গয়ায় শ্রাদ্ধ করলে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়। উল্লেখ্য, গয়ায় সমগ্র পিতৃপক্ষ জুড়ে মেলা চলে। আর বাংলায় মহালয়ার দিন দুর্গাপুজোর সূচনা হয়। বিশ্বাস অনুযায়ী, এইদিন দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হন। মহালয়ার দিন অতি প্রত্যুষে চণ্ডীপাঠ করার রীতি রয়েছে। আশ্বিন শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে দৌহিত্ররা মাতামহের তর্পণ করেন।


সনাতন ধর্মবিশ্বাস মতে, অশুভ শক্তির বিনাশ আর ধর্ম রক্ষায় যুগে যুগে মর্ত্যলোকে দেবতাদের আবির্ভাব হয়েছে। যার ধারাবাহিকতাতেই অসুরকূলের হাত থেকে দেবগণকে রক্ষায় দেবী দুর্গার আগমন ঘটেছিল। পৃথিবীতে যখনই ব্রহ্মার বরপ্রাপ্তের মতো শক্তিশালী মহিষাসুরেরা ফিরে আসে বারবার, ধর্মের গ্লানি হয় এবং পাপ বৃদ্ধি পায়, তখন তাদের ত্রাস-সংহারে দেবী দুর্গা ফিরে আসেন বারবার। আর দেবীর এ শুভাগমন ঘটে শুভ মহালয়ায়। মহালয়ার শুভক্ষণে যাবতীয় আঁধার গ্লানি মুছে যায় অসুরনাশিনী শাস্ত্রমতে মহালয়া হচ্ছে একটি অমাবস্যা তিথি, এ তিথিতে সাধারণত পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ তর্পণ করা হয়। এ দিন তর্পণ করলে পিতৃপুরুষরা নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে উত্তরসূরিদের  আশীর্বাদ প্রদান করেন। এছাড়া মহালয়ার দিনে দেবী দুর্গার বোধন করা হয়, বোধন অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার পর দেবীপক্ষের/শুক্লপক্ষের প্রতিপদে ঘট বসিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজার সূচনা করা হয়। 

শ্রাবণ থেকে পৌষ এই ছয় মাস দক্ষিনায়ণ, দক্ষিণায়ণ দেবতাদের ঘুমের কাল। তাই বোধন করে দেবতাদের জাগ্রত করা হয়। মহালয়ার পর প্রতিপদে যে বোধন হয় সে সময় সংকল্প করে দুর্গাপূজার আয়োজন চলে। একে বলে কল্পরম্ভা, যদিও ষষ্ঠী থেকে পূজার প্রধান কার্যক্রম শুরু হয় তাই বলা হয় ষষ্ঠাদিকল্পরম্ভা। এবং সপ্তমী থেকে বিগ্রহতে। প্রতিপদ থেকে শুধু ঘটে পূজা ও চন্ডী পাঠ চলে। গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষদের স্মরণ ও মননের মাধ্যমে র্তপণ করা হয়৷ যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হল এই মহালয়া৷ অনেকেই এই দিনটিকে দেবীপক্ষের সূচনা বলে থাকেন। মহালয়া থেকে দেবীপক্ষ আমাদের সনাতনী সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনগুলোতে আমরা মাতৃ চিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ