আ মরি বাংলা ভাষা ~ বন্যা গাঙ্গুলি




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

আ মরি বাংলা ভাষা

 বন্যা গাঙ্গুলি

       

মুম্বাই থেকে দোহা এয়ারপোর্ট অবধি আসতে তপতীদেবীর ভাষাগত কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল দোহা থেকে ফ্লাইট ধরতে। এখানে ইংরেজিটাও চলে না। আরবী ভাষা সরকারি ভাষা। অধ্যাপিকা তপতি সেন এর আগেও প্লেনে উেঠেছেন। এই প্রথমবার নয়। স্বামীর ট্রান্সফারেবেল জব হওয়ায় এ শহর ও শহর করে বেড়াতে হয়েছে। শহরের নামকরা এক কলেজে বাংলা পড়াতেন তপতীদেবী। স্বামী কর্ম সূত্রে ভিনরাজ্যে ডানা মেলেছিলো । তাই একাই এলোমেলো সময়ে ছেলের অগোছালো শৈশবকে বেশ যত্ন করে অনেক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গুছিয়ে যৌবনে এনে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি  তপতীকে। সেই ছেলের কাছেই আমেরিকা যাচ্ছেন ষাটোর্ধ বয়সের গরবিনী মা। ভায়া  কাতার হয়ে। মনে মনে ছেলের ওপর রাগ করলেন,ভাষা একেবারে বোধগম্মের বাইরে। ছেলে সমানে মা এর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করছে। সবসময় নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। এদিকে তপতীদেবীর দিশেহারা অবস্থা। ভীষন ভয় করতে লাগলো। এভাবে এতো একা নিজেকে কখনো মনে হয়নি। সঙ্গে কয়েকটা লাগেজ।  যেগুলো লাগেজ কেরিয়ারে যায়নি। চোখে জল এসে যায় তপতীদেবীর। ঝাপসা লাগে চারপাশটা। মনে মনে বলতে থাকেন "ছেলেটা এসে নিয়ে যেতে পারতো। কি দরকার ছিলো আমাকে টেনে এনে এই বিদেশবিভূঁইতে বিড়ম্বনায় ফেলার। দেখা হোক একবার দুকথা শুনিয়ে দেবো বেশ করে। বড্ড বিজ্ঞ হয়ে গেছে। আমি এখন কি করি!" 

আসলে কলকাতায় তপতী দেবী খুব একা। আজকাল টিভি সিরিয়ালগুলোর গল্পগুলো বড্ড একঘেয়ে। কত আর ফেসবুকে কবিতা পোষ্ট করা যায়! প্রথম প্রথম বেশ গোটাকতক লাইক টাইট আসতো, এখন সেখানেও ভাঁড়ের মা ভবানী। মানুষের উদারতায় এখন ভয়ানক কার্পণ্য। সায়ন গতবারের পূজোর সময় দেশে এসে মায়ের এই বাণপ্রস্থ মার্কা জীবন দেখে মা কে কিছুদিনের জন্য শিকাগোতে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ফ্লাইট এর টিকিট কেটে অনলাইনে পাঠিয়ে মা কে বলেছিল "কষ্ট করে এই আট ন ঘণ্টার জার্নিটাকে সামলে নিও মা তারপর শিকাগো এয়ারপোর্ট এ তো আমরা থাকবো।"

 ফোনে রিং হয়,তপতীদেবী কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করেন "মা তুমি কোথায় আছো?  তোমার চেক আউট হয়ে গেছে?  তোমার নেক্সট ফ্লাইটের তো টাইম হয়ে গেলো। শরীর ঠিক আছে তো?" তপতী দেবী খন খনে গলায় বললেন,”সায়ন আমি বোধহয় প্লেন মিস করবো।আমি এখানকার ভাষা কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।কেউ যদি একটু সাহায্য করতো তাহলে খুব উপকার হতো রে। ভাষা যে এতো বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে তা আমি বুঝতে পারিনি।দেখি কতটা লড়তে পারি,এতো তাড়াতাড়ি হাল ছাড়ছি না।” অসহায়ের মতো ফোনটা কেটে দেয় সায়ন ।

তপতীদেবী শূন্যদৃষ্টিতে টাইমটেবিলের লেখাগুলোর আসা যাওয়া দেখতে থাকেন কিমকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে। অনেকটা বিপরীত স্রোতে  হাল ধরে রাখা নাবিকের মতো চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলেন আর আরাধ্যা দেবীকে স্মরণ করতে লাগলেন।হঠাৎ কানে এলো একটি আঠাশ উনত্রিশ বছরের ছেলে তাঁর ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে।,”হ্যাঁ মা আমি কথা বলে দেখছি কিভাবে সাহায্য করা যায়।হ্যাঁ তোমারই বয়সি হবেন ভদ্রমহিলা। চলো টা টা।” বলতে লজ্জা নেই তপতীদেবী মা ছেলের ফোনালাপ ওভারহিয়ার করছিলেন। "তুমি কি বাঙালি? কিছু মনে কোরো না বাবা আমি তোমার ফোনে কথা বলা শুনে বলছি আরকি। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে প্রবীনার ঘোলাটে চোখ বাঙালি যুবকের মুখমণ্ডলে বাংলা ভাষার মিষ্টতাকে খুঁজতে থাকে। এইরকম যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে সেটা ছেলেটি আন্দাজ করেছিল। "হ্যাঁ আমি বাঙালি।আপনার সঙ্গে কেউ নেই?" তপতীদেবী একটু ইতস্তত করে বলেন," না শিকাগোতে ছেলে বৌমা থাকবে।" ছেলেটি হাত বাড়িয়ে  তপতীদেবীর হাত থেকে দু একটা লাগেজ নিতে যায় এবং বলে,"চলুন আমিও শিকাগোতেই যাচ্ছি। আমরা দুজনেই বাঙালি। আমার নাম জাভেদ। আমি শিকাগোতেই সেটেল্ড। কাতারে একটা মিটিং জয়েন করতে এসেছিলাম। অনেকদিন পরে আপনার সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে পেরে খুব ভালো লাগছে।" তপতী দেবীও ভাঙ্গা গালে একগাল হেসে বলেন, "সে আর বলতে। আমিও তোমার সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলতে পেরে যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। এই পরিস্থিতিতে না পড়লে বুঝতে পড়তাম না নিজের ভাষার গভীরতাটা।" জাভেদ মিষ্টি করে হেসে বলে, "আমি আজ বহুদিন পরে আপনার সঙ্গে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পেরে খুব আপ্লুত। আমার মিসেস কোরিয়ান। সুতরাং বুঝতেই পারছেন বাংলায় কথা বলতে পারাটা আমার কাছে অনেকটা মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে, গলার কাছে জমে থাকা দলা পাকানো মাতৃ ভাষার ঠুলিটাকে বার করে   মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করা।" চোখের পাতা ভিজে যায় জাভেদের। কথা বলতে বলতে ওরা কাস্টমস পেরিয়ে প্লেনের সিটে এসে বসে। সৌভাগ্যক্রমে পাশাপাশি বসে নবীন প্রবীণ এ। অনেক কথার মধ্যে জাভেদ তপতীদেবীকে দেখে  নস্টালজিক হয়ে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। উনিশ শতকে বাংলাদেশে  ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র  তার কাকাকে আর তার বন্ধুকে কিভাবে গুলি করে মারা হয় তার গল্প করতে থাকে। অবশ্য এই 'অমর একুশ' বা ২১শে ফেব্রুয়ারি কেনো শহীদ দিবস, সবই তার শোনা গল্প। আজ যে বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে তাতে জাভেদদের মতো পরিবারেরা খুব খুশি। অনেককিছু হারাতে হয়েছে এই সম্মান আদায় করতে।

শিকাগোতে সায়নের সঙ্গে জাভেদের আলাপ করিয়ে দেন তপতীদেবী। সায়ান হাত জড়ো করে কৃতজ্ঞতা জানায় জাভেদকে। সে সাহায্য না করলে তার মায়ের হয়তো শিকাগোতে এসে পৌঁছনো হতো না। সবাই সবায়ের সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলতে পেরে বাঙালি হিসেবে বেশ গর্ব বোধ করতে লাগলো। "সত্যি মা ' আ মরি বাংলা ভাষা ' ছোটবেলা থেকে অনেকবার শুনেছি তোমার মুখে কথাটা। সবাই এক সাথে হেসে ওঠে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ