আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' মানেই শুধুমাত্র আবেগে ভাসা নয় ~ সুকুমার রুজ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' মানেই শুধুমাত্র আবেগে ভাসা নয়

সুকুমার রুজ   

 

  'সাত রাজার ধন মানিক যখন পাওয়া আমার হয়েই গেছে, বয়েই গেছে।' 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' নিয়ে কিছু সংখ্যক বাঙালির ভাবখানা এখন এরকম।      

  বাংলা ভাষা নিয়ে লড়াই করার দিনটা যখন 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতি পেয়েছে, তখন আর  চাই কী! সারাবছর ধরে মাতৃভাষা নিয়ে চর্চা বা ভাবনা-চিন্তা না করলেও চলবে। বছরের এই বিশেষ দিনটিতে বাঙালিবাবু  সেজে, রফিক, সালাম, বরকতদের নাম উচ্চারণ করলেই তো বাংলা ভাষার প্রতি কর্তব্যপরায়ণতা দেখানো হলো। 'চুমু  দিবস', 'প্রেম দিবস', 'বাবা দিবস', 'মা দিবস'-এর মতো বাংলাভাষাকেও একটা দিবসে যখন বেঁধে ফেলা গেছে, তখন      'কেল্লাফতে'। ওই দিনটাতে একটু আদেখলেপনা দেখালেই হলো। তারপর ছেলের ঘুম ভাঙানোর জন্য, 'পাপান, সিক্স ও ক্লক,  ওয়েক আপ, ওয়েক আপ', বললে ক্ষতি কী? মেয়ে, 'মা ভাত দাও', বললে মেয়েকে বকুনি দিলে ক্ষতি কী? সপরিবারে  অনুষ্ঠানে গিয়ে, 'মাই সান কান্ট্ স্পিক ভেঙ্গলি প্রপারলি', বলে আহ্লাদিত হলে ক্ষতি কী?      

 'হুঁ হুঁ বাবা! আমাদের ভাষার জন্য লড়াই করার দিনটা তো সারা বিশ্ব স্মরণ করে, এ কী চাড্ডিখানি কথা!' এই জায়গা থেকে বের হতে না পারলে, সত্যিই বাংলাভাষা একদিন অবলুপ্ত হবে। বাংলাভাষা নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার দিন যে এসে গেছে, তা ট্রেনে-বাসে, ক্লাবে-রেস্তোরাঁয় কান পাতলে, কিম্বা টুইটার, ফেসবুক ইত্যাদি সোশ্যাল সাইটগুলোতে চোখ বুলোলেই বোঝা যায়। একটা বাংলা বাক্য বললে, তার মধ্যে তিনটি ইংরেজি ও দুটি হিন্দি শব্দ না গুঁজে দিলে স্মার্ট হওয়া যায় না। রেডিও জকিদের কথা শুনলে তো বোঝাই মুশকিল যে, বাংলা চ্যানেল শুনছি কিনা!       

  আমরা সেসব নির্বিকারে মেনেও নিচ্ছি।  কোথাও নেই কোন প্রতিবাদ, নেই কোন সংস্কার। কারণ একটাই, 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' তো আমাদের। সুতরাং এই দিনটার বাখানি রেডিও-টিভিতে, কাগজ-পত্রিকাতে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করলে কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারিতে গোটা কতক সভা করলেই তো 'সাত খুন মাপ'! 

  হয়তো কথাগুলো ঠিকঠাক হজম করা যাচ্ছে না। কিন্তু একটু চোখ চাড়ালে বা কান বাড়ালে এমনই শোনা যায়। তখন বুকে বড় ব্যথা লাগে। কেননা, মাতৃভাষা মুখের ভাষা, বুকের ভাষা, সুখের ভাষা, দুঃখের ভাষা, আর আমাদের সেটা হলো বাংলা ভাষা। 

  সারা পৃথিবীতে প্রায় ৬০০০ ভাষা আছে। তার মধ্যে একমাত্র বাংলা ভাষাকেই যুগে যুগে তার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, এখনও লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।    

  প্রশ্ন উঠবে, যুগে যুগে কোথায়! মনে করা যাক সেই একাদশ শতাব্দীর সেন রাজত্বকালের কথা। তখন বাংলাভাষা চর্চার বিরুদ্ধে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ফরমান ছিল, বাংলাভাষা চর্চা করলে 'রৌরব' নামক নরকে যেতে হবে। তখন লড়াই করেই কোনক্রমে বাংলাভাষা টিঁকে ছিল। দেশভাগের সময়ে বাংলাভাষা সবচেয়ে সংকটে পড়লো। ইংরেজ আমলে সরকারি ভাষা ইংরেজি ছিল। দেশভাগ ও স্বাধীনতা লাভের পর স্বাধীন ভারত সরকার ঠিক করল সরকারি ভাষা হবে হিন্দি, যেহেতু বেশি সংখ্যক মানুষ হিন্দিভাষী। তখন স্বাধীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল বাংলাভাষী। সেই সঙ্গে পঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, পখতুন ইত্যাদি ভাষাভাষী মানুষও ছিল। কিন্তু তারা সংখ্যালঘু। অথচ পাকিস্তানের কোনও অঞ্চলের মানুষের  মাতৃভাষা উর্দু না হওয়া সত্বেও, স্বাধীনতার প্রায় তিন মাস পরে ডিসেম্বর মাসে এক শিক্ষা সম্মেলনে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলেন। সে জন্য ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে সামিল হয়েছিল। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। আন্দোলন মাঠে মারা গিয়েছিল। তার দু'মাস পর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংসদে ব্যবহারের  ভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও অন্যতম ভাষা করার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু একমাত্র রাজকুমার চক্রবর্তী ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তির সমর্থন পাননি। এই সময় মোহাম্মদ আলী জিন্না ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করলেন, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'।     

  এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-ধর্মঘট পালিত হলো। তাতে কোন হেলদোল না হওয়ায় ১১ মার্চ থেকে আবার লাগাতার ছয়দিন ধরে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হলো। নিরুপায় হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদার প্রশ্নটি মেনে নিলেন। কিন্তু পাকিস্তান দেশের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই রইল। বিষয়টা তখনকার মতো ধামাচাপা দেওয়া হল।        

  ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মুসলিম লীগের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে এই ভাষা আন্দোলনকে আবার উসকে দিলেন। তিনি বললেন, 'একমাত্র উর্দুই হবে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'। 

  ছাত্ররা আবার প্রতিবাদে সামিল হলো। ২১ ফেব্রুয়ারি আবার ছাত্র-ধর্মঘটের ডাক দিল। ছাত্রদের মিছিলের উপর পাকিস্তান সরকার নির্বিচারে গুলি চালালো। মাতৃভাষা রক্ষার সংগ্রামে শহীদ হলেন সালাম, বরকত, জব্বর, রফিক ও শফিক। আহত হলেন কয়েকশো ছাত্র। এরপর খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষাকে বহাল রাখতে বাধ্য হলেন। ভাষা আন্দোলনের এ ইতিহাস প্রায় সকলের জানা। 

  সে আন্দোলনকে মর্যাদা দিতেই ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করলো। আর সেটাই যেন 'সাত রাজার ধন মানিক পাওয়া' ধরে নিল সমগ্র বাঙালি জাতি। আহ্লাদে মাটিতে আর পা পড়ে না। কিন্তু এদিকে যে ঘাঁটি আগলানো দায় হয়ে পড়েছে। তার প্রমাণ তো নিউ জেনারেশনের 'বাংলিশ' বা 'হিংলা' ভাষা। তার জন্য কিন্তু ওদেরকে  দায়ী করা যায় না। দায়ী আমরাই, অভিভাবকেরাই। মাতৃভাষার মর্যাদাবোধ ওদেরকে শেখাতে পারিনি। অনেকে বাংলা  বললেও সে ভাষার উচ্চারণ বিকৃতি যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত শোনানোর  কল্যাণে সেটার উচ্চারণও 'জ্যানা গ্যানা ম্যানা অধিনায়াকা জ্যায়া হে...' হয়ে যাচ্ছে। এখন অবাঙালি সুলভ বাংলা উচ্চারণ এক  ধরনের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাংলা ভাষার যে শ্রুতিমাধুর্য, সেটাই নষ্ট হতে বসেছে। 'বিন্দাস', 'পরন্তু', 'কিঁউকি'  ইত্যাদি শব্দ বাংলা ভাষা বলতে গিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা বাংলা ভাষার পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক।    

  অনেকে হয়তো যুক্তি দেবেন, ''বাংলা ভাষা প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন, তাই বহু বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে বাংলা ভাষায় পরিণত হয়েছে। যেমন পর্তুগিজ শব্দ 'আলমিরা' থেকে 'আলমারি', 'বাইগোর্নিয়া' থেকে 'বাইগন' থেকে 'বেগুন', 'অ্যানানাস'  থেকে 'আনারস' ইত্যাদিতে পরিণত হয়েছে। আবার 'কাগজ', 'জরিমানা', 'চশমা' ইত্যাদি ফারসি শব্দ বাংলা শব্দকোষে   সরাসরি ঢুকে গেছে। এতে বাংলা ভাষার কোন ক্ষতি হবে না। এত চিন্তা করার কোনও কারণ নেই।''          

  কিন্তু সেই 'অনেকেরা' একটু তলিয়ে ভাবলে বুঝবেন, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। এগুলো আলাদা বিষয়। বর্তমান সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। 'পাপান, ছ'টা বেজে গেছে, উঠে পড়ো উঠে পড়ো!' এই কথা বলার জায়গায় 'পাপান সিক্স ও ক্লক, ওয়েক আপ ওয়েক আপ!' কিংবা 'মা খেতে দাও'-এর জায়গায় 'মম! খানা লাগাও!' মোটেও এক জিনিস নয়, এটা বুঝতে হবে।          

  এখনকার ছেলেমেয়েরা 'কুকুর' তো চেনেই না! তারা 'ডগ' বা 'ডগি' চেনে। 'চিনি' বা 'নুন' দেখেইনি। তারা 'সুগার' আর 'সল্ট' চেনে। এটাই ভয়ংকর। এমন চলতে থাকলে 'মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা' একদিন 'সফল হলো ওদের আশা, আহা মরা বাংলাভাষা'য় পরিণত হবে। 

  এমন চলতে থাকলে সত্যিই বাংলা ভাষা একদিন অপ্রচলিত ভাষা হিসাবে গণ্য হবে। এখনও সময় আছে, মুমূর্ষু মায়ের ভাষাকে সেবা-শুশ্রূষা করে সজীব করে তোলা যেতে পারে। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে আবার একটা আন্দোলনের আশু প্রয়োজন।  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ