ভাষা ও সাহিত্য ~ অয়ন দাস




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

ভাষা ও সাহিত্য 

অয়ন দাস


আজ থেকে ৮০০০বছর আগে নতুন প্রস্তর যুগের মানুষ প্রথম কথা বলতে পেরেছিল।তার আগে মানুষ শুধু শব্দ করে আর ইশারা তে মনের ভাব প্রকাশ করত।কথা বলতে পারার পরও তারা ইশারার ব্যবহার ত্যাগ করেনি।এখনও পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষার মানুষের ইশারার ভঙ্গি ও অর্থ এক।এই ভাষা আবিস্কারের ফলেই মানুষ পৃথিবীকে ডমিনেট করতে পারল।


সুদীর্ঘকাল ভাষা ছিল একান্ত একাকী, নিঃসঙ্গ।সাহিত্য এসেছে বহু বহু যুগ পরে।কারণ ভাষা প্রয়োজনের,সাহিত্য শখের।ভাষাকে সাহিত্যের স্তরে নিয়ে যেতে লেগেছে কয়েক লক্ষ বছর। 


এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ২৭৯৬ টি ভাষা প্রচলিত।তার মধ্যে প্রধান ভাষা ১৬০টি।আর ভারতে ১৬৫২টি ভাষার মধ্যে প্রধান ভাষা হল ২২টি।যথা-হিন্দি,বাংলা,তেলেগু,তামিল,মারাঠি,গুজরাটি,মালয়ালম,কন্নড়,ওড়িয়া,পাঞ্জাবি,অসমিয়া,সিন্ধি,নেপালি,কোঙ্কনি,মণিপুরি,কাশ্মীরি,সংস্কৃত,বোরো,ডোগরি,মৈথিলি ও সাঁওতালি।

মজা হল-অঞ্চলভেদে আমাদের বাংলা ভাষার কথ্য রূপও পাল্টে যায়।

মজা দেখুন-

কলকাতা-ছোটো ছেলেটি তার বাবাকে বলল


ঢাকা-ছোটো ছাওয়াল তার বাপেরে কইলো


কোচবিহার-ছোটো বেটা উয়ার বাপোক কইলো


পুরুলিয়া-ছুট্ বেটা তার বাপকে বল্লেক


চট্টগ্রাম-ছোড়ুয়া পোয়া তার ব-রে কইলো।

-----------------------------------

এই যে আমরা গল্প লেখার জন্য একেবারে মুখের ভাষা ব্যবহার করি-এর সুচনা হয় ১৮৫০সালের পর থেকে।কারন লেখকরা কিছুতেই অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছিলেননা।এইবার মুশকিল হল একএক জায়গার তো একএক কথ্যরূপ।তাহলে কোনটা নেওয়া হবে?এইসময় বেশ একটা পলিটিক্স হয়েছিল।কলকাতা,নদীয়া,২৪পরগনা তে যেহেতু পন্ডিত দের সংখ্যা বেশি-অতএব এখানকার কথ্য ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল।এইবার ভাষা হয়ে উঠল জীবন্ত।লেখকরা সাধারন মানুষের মনে জায়গা পেলেন।

একটা কথা জানলে অবাক হই যে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে আজ থেকে ১০০০ বছর আগে অথচ বাংলা ব্যকরণ প্রথম রচিত হয় মাত্র পৌনে তিনশো বছর আগে।শুনলে অবাক হবেন প্রথম বাংলা ব্যকরন লেখেন একজন সাদা চামড়ার সাহেব।নাম-মানোয়েল দ্য আস্সুম্পসাম।১৭৪৩সালে পোর্তুগালের লিসবন শহরে রোমান অক্ষরে তা ছাপা হয় কারন 'ছাপার' জন্য বাংলা অক্ষর তখনও তৈরি হয়নি।১৭৭৮সালে নাথানিয়েল হ্যালহেড নামের এক ইংরেজ ইংরেজি ভাষায় একটি বাংলা ব্যকরন বই লেখেন যেখানে প্রথম ছাপার সময় বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হয়।

রাজা রামমোহন রায় হলেন প্রথম বাঙালি যিনি বাংলা ব্যকরণ বই লেখেন ১৮২৬ সালে।দুঃখের বিষয় এই বইটিও ইংরিজিতে লেখা।১৮৩৩ সালে এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ বাজারে প্রকাশিত হয় ও অচিরেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।(তথ্য সংগ্রহ-রণেন গুপ্ত-নবোদয় ব্যকরণ)


ভাষার দুই ক্ষেত্র,গদ্য ও পদ্য।সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে গৃহীত হয় পদ্য।আদর করে নাম দেওয়া হয় কাব্য।শতাব্দীর পর শতাব্দী কেটে গেছে- গদ্যকেও যে সাহিত্য রচনায় স্থান দেওয়া যায় সাহিত্যিকরা তা ভাবতেও পারেননি। 


১৮০১ সালে প্রথম গদ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হল, লেখক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। এবং তার পরেই এক দুর্দমনীয় ক্ষিপ্রতায় গদ্য সাহিত্য পদ্য সাহিত্য কে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। 

প্রথম গদ্যগ্রন্থটি প্রকাশের পনেরো বছর পর রাজা রামমোহন রায় একটি গদ্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন।নাম দেন বেদান্তগ্রন্থ।

এর পরে যিনি বাংলা ভাষাকে পরিণত করেছেন তিনি হলেন বিদ্যাসাগর। 

বাংলা গদ্যকে আরও কিছুটা সমৃদ্ধ করেছেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত।

এর কিছুদিন পরেই বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব। ১৮০১ সালে গদ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হবার ঠিক চৌষট্টি বছর পর ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হল বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস "দুর্গেশনন্দিনী "।

বাংলা ভাষার কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর আর সেই ভাষার দেহ সৌষ্ঠব তৈরি করেছেন বঙ্কিমচন্দ্র। 

বাংলা ভাষায় যখন ররবীন্দ্রনাথ প্রবেশ করলেন তখন তা হল আরও হৃদয়গ্রাহী,আরও সহজ, আরও জীবনমুখী আরও সাবলীল। 

একটি বিস্ময়কর তথ্য হল বাংলা ভাষায় প্রথম চলিত ভাষায় রূপ দেন স্বামী বিবেকানন্দ।গ্রন্থটির নাম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য। 

গদ্যের ভাষা যে চলিত ভাষা হবে তা নিয়ে একসময় তুমুল আন্দোলন হয়েছিল।এই আন্দোলনের পুরভাগে ছিলেন সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী। 


একটি কথা মনে রাখা দরকার। সাহিত্যকে কিন্তু শিক্ষকের ভূমিকায় ঠিক মানায় না।সাহিত্যের ভূমিকা হল রসিকের ভূমিকা, শিল্পীর ভূমিকা। আমার মনে হয়,আনন্দ দানই হল সাহিত্য সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ