ধারাবাহিক ভৌতিক উপন্যাস | ৩য় পর্ব | সোমনাথ ঘোষাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে



লম্বিত জিহবা
সোমনাথ ঘোষাল
তৃতীয় পর্ব

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর শান্তিলতা মতিলাল সিং-কে বললো, দাদু তুমি কি এখন একটু বিশ্রাম নেবে? 
মতিলাল সিং একটু হেসে বললো, তার কোনো মানে নেই নিতেই হবে। কাজ থাকলে আরাম বিশ্রাম সবই ত্যাগ করতে হবে। আচ্ছা বৌমনি আমার কি কোনো কাজ আছে?
শান্তিলতা বললো, হ্যাঁ, একটু পরে আমাদের শোবার ঘরে একটু আসতে হবে কথা আছে। 
মতিলাল সিং বললো, ঠিক আছে বৌমনি আমি জরুর যাবো। 

ছুটি ছাঁটার দিন গুলোতে দুপুরে আমি সাধারনত ঘুমােই না, এমনি শুয়ে বসে থাকি। কাজের দিন দপ্তর থেকে আসতেই বিকেল গড়িয়ে যায়,ছুটির দিন ছাড়া দুপুর পাই না। 
দুপুরের খাওয়া সেরে আমি শোবার ঘরে এসে টান টান করে শরীরটা পালঙ্কে বিছিয়ে দিলাম। শান্তিলতা বাইরের কাজ কর্ম সেরে মতিলাল দাদুকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। শান্তিলতা পালঙ্কে উঠে আমার পায়ের নিচে বসে, মতিলাল সিং-কে চেয়ারে বসতে বললো, আমি আধশোয়া অবস্হায় পালঙ্কে উঠে বসলাম, 

শান্তিলতা মতিলাল দাদুকে বললো, দাদু সেদিন তুমি এই মহলের ইতিহাস বলতে গিয়ে অনেক কিছুই বাদ দিয়ে দিয়েছো, সেটা আমরা ভালোই বুঝতে পেরেছি। তবে এতে তোমাকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না। তোমরা পুরোনো দিনের মানুষরা মনিবদের সন্মান দিতে জানো। তুমি তোমার দিক থেকে ঠিক আছো। এখন মনে কোনো সঙ্কোচ না রেখে এই রাজমহলের যা ইতিহাস তোমার জানা আছে আমাদের বলো। এতে আমাদের সকলের ভালো হবে, আর এই মহল ভগ্ন অবস্হায় থেকেও আরো কিছু বছর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। 

শান্তিলতার কথায় আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একজন গ্রাম্য সামান্য লেখাপড়া জানা মেয়ে কেমন সুন্দর গুছিয়ে কথা বলতে পারে। এই আমার, চট্টরাজ মহলের যোগ্য বৌ। এতো বছর ধরে কেউ যা পারেনি এক পিশাচের হাত থেকে এই মহলকে রক্ষা করতে। আজ শান্তিলতা দেবী দশভূজা রূপে শত্রু নাশ করতে এই মহলে আবির্ভুত হয়েছে। 
                                          ছবি সংগৃহীত 
কি গো তুমি কি বলো? শান্তিলতার কথায় আমি চমকে উঠলাম। নিজেকে ততক্ষনাত সামলিয়ে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ কোনো সংকোচ লজ্জা ভয় না করে দাদু তুমি শুরু করো এই রাজ মহলের কাহিনী। 
মতিলাল সিং কয়েক সেকেন্ড দুচোখ বন্ধ করলো, তারপর শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে বললো, কি জানতে চাও বৌমনি? 
শান্তিলতা বললো, তোমার ঠাকুমা, মানে মনু ডাকাতের মেয়ে হটাৎ কি করে হারিয়ে গেলেন ? তোমার দাদু ত্রিবেদী সিং কি এই মহলেই থাকতেন? আর আমাদের পূর্ব পুরুষ জমিদার শঙ্খনাথ চট্টরাজ উঁনি ঠিক কেমন মানুষ ছিলেন? দাদু তুমি যা জানো, যতটা জানো আমাদের বলো, তাহলে আমরা সবাই এক হয়ে এই লম্বিত জিহ্বার হাত থেকে আমরা নিজেদের এবং এই মহলকে বাঁচাতে পারি। তুমি কোনো রকম দ্বিধার মধ্যে না গিয়ে বলতে পারো। 

মতিলাল সিং একটু নড়ে চড়ে বসলো, তারপর শান্তিলতার দিকে তাকিয়ে বললো, বৌমনি আমার দাদু ত্রিবেদী সিং মনু ডাকাতের মেয়ে কাজরীকে বিয়ে করার আগে এই মহলেই থাকতেন। বিয়ে করার পরে এই মহলের ঠিক পিছনে ফাঁকা জমিতে শঙ্খনাথ বাবু নিজে দাদুকে থাকার জন্য ঘর করে দিয়েছিলেন। আমার ঠাকুমা সবসময় ঘরেই থাকতেন, প্রয়োজন ছাড়া উঁনি বাইরে বেড়ােতেন না। 

আমার ঠাকুমা মনু ডাকাতের মেয়ে চম্পাকলি সত্যি ডাকাত রানী ছিলেন। যেমন লম্বা চওড়া শক্ত পোক্ত চেহারা, তেমন সুন্দরী, তাই আমার দাদু ত্রিবেদী সিং এক দেখায় পছন্দ করে ফেলেন। সব ঠিক-ঠাকই চলছিলো,হটাৎ কি থেকে যে কি হয়ে গেলো ! সে সময় অনেকে অনেক কিছুই জানতো কিন্তু সবাই চুপ, মুখে কুলুপ এঁটে থাকলো। 

আমি বললাম, সবাই সব জানতো মানে? কি জানতো আমাদের খুলে বলো। 
শান্তিলতা বললো, তুমি নির্ভয়ে বলো দাদু। তোমার কাছে আমরা এখন আশাবাদী। অনেকটা দূর এগোতে হবে আমাদের, আর তুমিই হচ্ছো আমাদের অবলম্বন, তাই যা জানো যা শুনেছো সব খুলে বলো আমাদের। 

মতিলাল সিং বললো, আমি যা বলবো  সবই আমার শোনা, বলতে পারো এটা একটা ইতিহাস। তবে এটা ঠিক ইতিহাস অনেক সত্যিই বহন করে যদিও এটা লেখনী নয় তবে শ্রুতি ইতিহাসও মিথ্যা হয় না। 

 জমিদার মাত্রেই ভোগ-বিলাসিতা, বাগান বাড়িতে বাঈজী নাচ, মুঠো মুঠো টাকা বিলাসিতায় ওড়ানো, কম বেশি প্রজা শোষন, বাজি ধরে মোড়ক লড়াই ইত্যাদি ইত্যাদি গুন থাকে। এই চট্টরাজ বংশের প্রায় জমিদাররা এমনই ছিলেন, কিন্তু জমিদার শঙ্খনাথ চট্টরাজের মতো জমিদার এই বংশে আর দ্বিতীয়টি জন্মায় নি। প্রচন্ড খামখেয়ালি আর চরিত্রহীন জমিদার ছিলেন এই শঙ্খনাথ চট্টরাজ। ভোগ-বিলাসিতায় বংশের তিনিই ছিলেন প্রথম জমিদার। শোনা যায় দিনের বেলায় তিনি যেমনটি ভদ্র, রাতে তিনি তেমনই অসভ্য, নিষ্ঠুর। প্রতিদিন রাতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে সুন্দরী মেয়ে বৌ-দের ধরে এনে বাগান বাড়িতে জলসা বসাতো, নাচ গান শেষ হলে রাতে ফুর্তির পর ভোরে তাদের আর পাত্তা পাওয়া যেতো না,কর্পূরের মতো তারা কোথায় যেন উবে যেতো। 

আগেই বলেছি আমার দাদু ত্রিবেদী সিং জমিদার শঙ্খনাথ বাবুর খুব কাছের মানুষ ছিলেন। কাছের মানুষ হওয়ার কারনও ছিলো। সেই সময় সারা গ্রাম অঞ্চলে সেরা লাঠিয়াল ছিলেন ত্রিবেদী সিং। দোহারা চেহারা, সাহস শক্তিতে ভরপুর উদ্দাম, শত্রুর মোকাবিলায় সে একাই একশো। মনিবের আদেশ তার কাছে ভগবানের আদেশের মতো। কাজেই তাকে দিয়ে শঙ্খনাথবাবু তার চাহিদা গুলো পূরন করে নিতেন। 

আমার ঠাকুমা চম্পাকলি মনু ডাকাতের মেয়েকে প্রথম দিন দেখার পর জমিদার বাবুর জিভ লক লক করে ওঠে। তার সাথে সে দিনের রাতটা কাটাবার খুবই ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু ত্রিবেদী সিং বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় উনি নিজেকে একটু গুটিয়ে নেন। কিন্তু মনে মনে ভীষন খুশি হলেন, এক রাতে এ মেয়েকে নিয়ে সুখ পাওয়া যাবে না, বেশ কয়েকটা রাত দরকার, আর তা হয়েও যাবে। তাই উঁনি ত্রিবেদী সিং-এর বিয়ের প্রস্তাবকে সমর্থন করে এগিয়ে আসেন। 
                                            ছবি সংগৃহীত 
ত্রিবেদী সিং-এর প্রস্তাব পেয়ে জমিদারবাবু নিজে মনু ডাকাতের সঙ্গে কথা বলেন আর ওর চম্পাকলিকে আড়ালে নিয়ে গিয়েও কথা বলেন, সেখানে দুজনের মধ্যে এক চুক্তি হয়, তাদের এই চুক্তি কেউ জানতে পারেনি। এই চুক্তির ব্যাপারে ত্রিবেদী সিং যখন জানতে পারেন তখন অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। নোংড়া মানুষিকতার মানুষ ছিলেন এই শঙ্খনাথ চট্টরাজ। নারী ভোগ তার কাছে সবচেয়ে আগে, এর বিনিময়ে তিনি যে কোনো মূল্য দিতে রাজি ছিলেন। 

ত্রিবেদী সিং-এর সঙ্গে মনু ডাকাতের মেয়ের বিয়ে তিনি রাতারাতি দেন কালি মন্দিরে, যাতে প্রজারা কেউ জানতে না পারে ডাকাতের মেয়ের সঙ্গে ত্রিবেদী সিং-এর বিয়ে হয়েছে। নিজের লালসার জন্য নিজের রাস্তাটা পরিষ্কার করে রেখে দেন, যাতে ত্রিবেদীর অনুপস্হিতিতে তার লালসা মেটে, তাই প্রায় সময় খাজনার তাগাদায় তিনি দাদুকে দূর দূর গ্রামে পাঠিয়ে দিতে শুরু করলেন, যাতে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত চম্পাকলিকে তিনি একা পান। অসহায় চম্পাকলি শুধু চুপচাপ এ অত্যাচার সহ্য করতেন।  

 চম্পাকলি বিয়ে করার দু মাসের মধ্যে গর্ভবতী হন। আমার দাদু ত্রিবেদী সিং আনন্দে আত্মহারা হলেন। সে বাবা হবেন, তাই চম্পাকলিকে একটু ভালোভাবে দেখা শোনা করতে হবে। সুতরাং সে দূরে কোথায় যাবে না খুব প্রয়োজন ছাড়া এটা তিনি জমিদার শঙ্খনাথ চট্টরাজকে জানিয়ে দিলেন। চতুর জমিদার ত্রিবেদীর কথায় মনে মনে চোটলেও এমন ভাব দেখালেন যে ত্রিবেদীর কথাই ঠিক। সে আরো ঠিক করলেন যে রাতের অন্ধকারে সে মেয়ে ধরে আনতে পারবে না। এখন থেকে এ কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করাতে। 

                                         🎊চলবে...........



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ