পোস্ট বার দেখা হয়েছে
একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে এবং মাদ্রাসা ও ইসলাম ধর্ম পঠনপাঠনের পরেও সেই সময় কিভাবে নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন " শ্যামা " কিংবা " কালী দেবীর প্রতি , লিখছেন দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য
ছবি সংগৃহীত |
‘রাঙা-জবা’
সাধনা জীবনের এক চরম অধ্যায়। প্রভাব আর পরম্পরায় বিভিন্ন ধারা উপধারায় আরাধনা কিংবা সাধনার বিস্তার যুগ যুগ ধরে মানুষের সঞ্চালন শক্তিকে আরও সুতীব্র করতে সহযোগিতা করেছে । আধ্যাত্মিকতা হোক কিংবা একেশ্বরবাদ সর্বত্র এর বিস্তার । সাধনা কিংবা আরাধনা জাতি - ধর্ম নির্বিশেষে সমভাবে প্রভাবিত এবং সম্প্রসারিত।
সেইভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে এর বিভাজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নরকম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবে আধ্যাত্মিক বিন্যাস আস্তিক ( যাঁর ঈশ্বর/ আল্লাহর মধ্যে বিশ্বাসের মাধ্যমে সাধনা কিংবা আরাধনা করে থাকেন) অপরপক্ষে নাস্তিক ( যাঁরা নিরাকারে বিশ্বাস করেন এবং কর্ম ফলের উপর নির্ভর করে এগিয়ে চলেন ) ।
ঠিক এমনই সাধনারও বিভিন্ন ভাগ শাখা উপশাখা রয়েছে। সাধনা আধ্যাত্মিক হতে পারে, সমাজতান্ত্রিক সমাজসেবামূলক হতে পারে, সৃষ্টি কিংবা সৃজনশীল ধর্মী হতে পারে আবার মনস্তাত্বিক হতে পারে । এই মনস্তাত্বিক সাধনাই আধ্যাত্মিকতার জন্ম দিয়েছে।
আজকের আলোচনার বিষয় এই আধ্যাত্মিকতা ও তার আশ্চর্যজনক প্রভাব কিভাবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় নিবন্ধিত হয়েছিলো তার উপরই আলোকপাত করার চেষ্টা।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতানুসারে, আরাধ্য দুর্গাদেবীর একটি বিশেষ রূপ হল ‘কালী’। এই কালীদেবীরই অন্য নাম আবার "শ্যামা"। শ্যামাবন্দনা বা শ্যামাদেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গানগুলোকে সাধারণভাবে "শ্যামাসঙ্গীত" বলা হয়। এই শ্যামা কিংবা কালী শক্তির এক উন্মুক্ত চিন্তার প্রতিফলন বলা যায়। যেখানে ক্রোধ এবং আত্মবলিদানের মাধ্যমে শত্রুর প্রতি প্রতিশোধের আরাধনা নিযুক্ত।
খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি "শাক্তধর্মের" উদ্ভব ঘটে এবং তাকে কেন্দ্র করেই শাক্তগীতি চর্চার একটি বিশেষ ধারার প্রচলন হয়। এই সময় বঙ্গদেশে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণব ধর্মের চেয়ে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। শ্যামা সঙ্গীতের ধারাটি বিকাশ লাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন এতে প্রাণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে শাক্ত পদাবলি বা শ্যামা সঙ্গীত নামে একটি বিশেষ সঙ্গীতধারার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামা সঙ্গীতকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
প্রসঙ্গত বলে রাখি , শাক্তধর্ম মানে শক্তিবাদ। হিন্দুধর্মের প্রধান তিনটি বিভাগের অন্যতম এটি। হিন্দুধর্মের একটি শাখাসম্প্রদায় ছিল এই শাক্ত অনুসারী। হিন্দু দিব্য মাতৃকা শক্তি বা দেবী পরম ও সর্বোচ্চ ঈশ্বর– এই মতবাদের ওপর ভিত্তি করেই শাক্তধর্মের উদ্ভব।
ছবি সংগৃহীত |
এখন কিছু প্রশ্ন উঠতেই পারে ; একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে এবং মাদ্রাসা ও ইসলাম ধর্ম পঠনপাঠনের পরেও সেই সময় কিভাবে নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন " শ্যামা " কিংবা " কালী দেবীর প্রতি। কেবলমাত্র প্রভাব বল্লে ভুল হবে " শ্যামাসংগীত " জগতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন নজরুল। এই বিশেষ পর্বে সেই চেতনা উদঘাটন করারই চেষ্টা করবো।
ভারতবর্ষের অবস্থা তখন উত্তাল, একদিকে বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন। অনাহারে ক্ষুধার্ত - রক্তাক্ত - বিপ্লবী মানুষের দল চারপাশে। নজরুলের কলম সবসময়ই ঝলসে উঠেছে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ।
মানব সাধন ভজনে তৃপ্ত কবি মন ছুটেছে নানা প্রান্তে । একটা সময় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই হিন্দু মুসলিম বিভাজনই ব্রিটিশ শক্তির বিস্তারের মূল হাতিয়ার । তৎক্ষণাৎ তাঁর কলম চলেছিলো এই বিভাজন মেটানোর তাগিদে ; ছন্দে - গানে মানুষকে আত্মহনন থেকে দূরে করা তাঁর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় যা তাঁর বিভিন্ন রচনায় আমরা পেয়ে থাকি " একই বৃন্তে দুটি কুসুম " আখ্যান।
ছবি সংগৃহীত |
বিশ্বাস আচার ভিন্ন হতে পারে কিন্তু রক্ত - শোক - কামনা - বাসনা বিচারে মানুষ অভিন্ন। অপরদিকে মাতৃভূমিকে " মা " বলে অভিবাদন করা হতো। তাঁকে কুশাসন থেকে মুক্ত করাই হাজার বিপ্লবীদের মতো তাঁরও স্বপ্ন হয়ে দাঁড়ায়। সেই নিরিখে শক্তিরূপিনী দেবীর আরাধনায় মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। যাঁর প্রভাব স্পষ্ট তাঁর রচিত "শ্যামা সঙ্গীতে " । তাঁর কাছে এই রূপ ছিলো নিস্তারের, সাম্যের,আত্মবিশ্বাসের, ধৈর্যের এবং শক্তির।
ছবি সংগৃহীত |
১৯৬৬ সালে ১০০টি শ্যামাসঙ্গীতে সমৃদ্ধ ‘রাঙা-জবা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। ‘রাঙা-জবা’ ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে নজরুলের আরও শতাধিক শ্যামাসঙ্গীত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
স্বামী বিবেকানন্দ যে কালীর কথা বলেছেন, নিবেদিতা তাঁর ‘kali, the mother’ এ যে কালীর কথা বলেছেন, নজরুল সেই কালীর কথাই বলেছেন বারেবারে যিনি একাধারে ‘মৃত্যুময়ী মা’ আবার অন্যদিকে ‘অনন্ত জীবনের প্রতীক’।
নজরুলের শ্যামা সর্বধর্মের সমন্বয়ে গড়া। এবং শ্যামার প্রতিফলন হয় সমাজতন্ত্রের রূপকার হয়ে। শ্বেতাঙ্গ- শাসকদের বিনাশিনীরূপে অবতীর্ণা মহাকালীর ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় নজরুলের শ্যামার মধ্যে।
ছবি সংগৃহীত |
ধূমকেতুতে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামে যে কবিতাটির জন্য কবির এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। সেই কবিতায় ছিল শাক্তসাধনার প্রকাশ-
“আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”
তবে এই ধরনের রচনার জন্য যার পর নাই বেগ পেতে হয়েছিলো নজরুলকে । একজন মুসলিম হয়ে " শ্যামাসঙ্গীত " রচনা যথেষ্ট সাহসিকতার পদক্ষেপ ছিলো। জানা যায়, হিন্দুদের কিছু অংশ ভালো চোখে দেখেননি বিষয়টি , কেবলমাত্র তাই নয় মুসলিমদের মধ্যেও কিছু অংশ তাকে 'কাফের ' বলেছিলো ।
কিন্তু তিনি তার লক্ষ্যে অটল ছিলেন, প্রবল সাহস এবং মানুষকে কুশাসন থেকে মুক্ত করা হিন্দু মুসলিম ঐক্যকে বজায় রাখাই ছিলো তার একমাত্র উদ্দেশ্য।
যে আত্মা কেবলমাত্র মানুষের জন্য উৎসর্গীকৃত ছিলো ; যাঁর ধর্ম একটাই ছিলো মনুষত্ব্য ; যে মানুষটি নির্ভিক - দুঃসাহসী - দুর্জয় তাঁর কলমে ছত্রে ছত্রে একটাই স্লোগান - হিন্দু মুসলিম ঐক্য তথা সাম্যবাদ। ইতিহাসের পাতা আজও কুর্নিশ জানায় সেই মহামানবকে ।যুগে যুগে এমন মানুষ এমন বিরল প্রতিভা মানুষের মুক্তির পথের দিশারী হয়ে জন্মায়।
ছবি সংগৃহীত |
21 মন্তব্যসমূহ
উত্তরমুছুনদুর্দান্ত ও যথার্থ বিশ্লেষণ ,
ভীষণ উপযুক্ত ভাষা ও বর্ণনায় সেজে উঠেছে লেখাটা 👍👍
নজরুল সঙ্গীতে শ্যামা সঙ্গীত একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবধারিত শিক্ষণীয় অধ্যায় 🙏
ধন্যবাদ
মুছুনঅপূর্ব লেখা। সমৃদ্ধ হলাম..
উত্তরমুছুনঅপূর্ব লেখা। সমৃদ্ধ হলাম..
উত্তরমুছুনঅসাধারণ সত্যি কত কিছু জানছি
উত্তরমুছুনআর সমৃদ্ধ হচ্ছি
ধন্যবাদ
মুছুনচমৎকার উপস্থাপন করলেন!!
উত্তরমুছুনতথ্যসমৃদ্ধতায় অসাধারণ !
ধন্যবাদ
মুছুন
উত্তরমুছুনদর্শনে ভাবে ও কথায় সাহিত্যে কোনও চিরাচরিত ধারণাকে নতুনভাবে, চমকে দেওয়ার মত প্রকাশভঙ্গীর মাধ্যমে ব্যাখ্যা হয়েছে এই অসামান্য লেখার মধ্যেদিয়ে ৷
ধন্যবাদ
মুছুননজরুলের শ্যামা সঙ্গীত অনেক সময় এক বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজও অনেকেই যখন তাঁর প্রতিভার বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখেন বা বলেন , তার সঙ্গীত ক্ষেত্রে এই বিরাট অবদানের কথা উল্লেখ করেন না।
উত্তরমুছুনদেবাশীষের এই রচনায়
নজরুলের এই দিকটি সুন্দর ভাবে বিশ্লষণ করা হয়েছে। এমন প্রতিবেদনের এই সময়ে খুবই দরকার ছিল। অনেক কিছু তথ্য সামনে এল। খুব ভালো লাগল।
একদম ঠিক বলেছেন দাদা
মুছুনসুনিপুণ মুগ্ধময় কাব্য সৃজন আপনার,, পাঠে মুগ্ধতা,অনাবিল আনন্দে কলম চলুক।শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় কবি।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনসহজ সরল বিশ্লেষণ মুগ্ধ করল
উত্তরমুছুনঅপূর্ব বিশ্লেষণ বিদ্রোহী কবি নজরুলের। আসলে মানুষ কখনো বা দেবতা রূপে পৃথিবীতে আসে, তাঁর কাজ করে, চলেও যায়। রেখে যায় এক মসৃণ মানবতার পথ। সে আভাসই যেন এই লেখাটি আমাদের দিয়ে গেল। খুব ভালো লেখা 🙏🙏🙏🙏🙏
উত্তরমুছুনচমৎকার উপস্থাপনা। তথ্য সমৃদ্ধ সুন্দর আলোকপাত। ভীষণ ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুননজরুল শ্যামাসঙ্গীত প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন নানাহ কারণে। পরাধীন ভারতে বাঙালির শক্তি ধর্মের নামে খণ্ডিত, এই বিষয়টি কবি নজরুলকে খুবই ব্যাথিত করে তুলে। তিনি এব্যাপারে বরাবরই খুব কষ্ট পেতেন বলেই তাঁর লেখা কবিতা, গান সবকিছুর মধ্যেই ছিল সাম্যবাদের ছোঁয়া। তাইতো তিনি সাম্যবাদের কবি।
তাঁর শ্যামাসঙ্গীত প্রীতির পেছনে তাঁর মায়ের প্রতি অসীম ভক্তি। মা ছিলেন খুব সুন্দরী। অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর নজরুল একসময় মায়ের সাহচর্য থেকে সরে আসেন। উনার মা জীবদ্দশায় বহু চেষ্টা করেও নজরুলের সান্নিধ্য আর নিতে পারেননি। সে কারণ জানা যায়নি। তবে নজরুল তাঁর মা'কে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। আর সেই মা ডাকটা উনি শ্যামা মা'কে ডেকে ডেকে সান্ত্বনা নিতেন। সেই কারণেই তাঁর রচিত শ্যামা সঙ্গীত আজো অন্য আবেগের। শ্যামা সঙ্গীতগুলো শুনলেই যেন মায়ের প্রতি মন প্রাণ উদ্বেলিত হয়ে উঠে। এই কথাগুলোও অতি প্রাসঙ্গিক।
অনেকবার পড়লাম...যতবার পড়ছি, নতুন কিছু মাথায় গেঁথে যাচ্ছে...অনেক ধন্যবাদ এভাবে ঋদ্ধ করার জন্য...
উত্তরমুছুনসুন্দর এলালেসিস। অনেক কিছুই জানলাম।
উত্তরমুছুননজরুল সমন্ধে জানার অনেক কিছু আছে।
নজরুল একটা Total University.
একাধারে কবি নজরুল, একাধারে ধরবেন নজরুল, একাধারে নাস্তিক নজরুল, সর্বোপরি কবি নজরুলের শক্তি আরাধনার দেবী শ্যামা সঙ্গীতের যে বিস্ময়কর সাধনা তার সম্পর্কে আপনার এই লেখনীতে অনেকটাই সমৃদ্ধ হলাম। শ্রদ্ধেয় দেবাশীষ বাবু আপনার প্রতি রইল অশেষ শুভকামনা।
উত্তরমুছুনচমৎকার বিশ্লেষনী লেখা লেখককে অভিনন্দন। লেখার শুরুতে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন আস্তিক নাস্তিকের তার সাথে ভিন্ন মত পোষন করছি। আস্তিক আল্লাহ/ ঈশ্বর বা ভগবানে বিশ্বাস করে সে অনুযায়ী সাধনা আরাধনা ঠিক আছে কিন্তু নাস্তিক কখনো নিরাকারে বিশ্বাস করে না প্রকৃতপক্ষে মুসলিম রা বিশ্বাস করে আল্লাহ নিরাকার। কারন হিন্দুরা ৩৩ কোটি আকার বিশিষ্ট দেবতা কে রুপক ভেবে ভগবান বিশ্বাস করে আর খৃষ্টানেরা যীশু ও তার মাতা মেরির মাঝে ঈশ্বর কে খুজেন একইভাবে বৌদ্ধরা গৌতম বুদ্ধের মুর্তির মাঝে স্রস্টাকে খুজেন। আর প্রকৃত ধর্ম কখনো মানুষে মানুষে বিভাজন করে না ইসলাম বলে ধর্মে কোন জোর জবরদস্তি নেই প্রকৃত ধর্ম আলোর মত দীপ্যমান হবেই।
উত্তরমুছুন