শব্দমালা || ধারাবাহিক কলম || ২য় পর্ব || কবি জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

একদিন ঘুম ভেঙে 

একদিন ঘুম ভেঙে দেখবাে 
খাঁচা থেকে উড়ে গেছে সব পাখি 
সীমান্তে সীমান্তে চলছে রাখীবন্ধন 
স্বয়ংক্রিয় রাইফেল সরিয়ে উর্দিধারী সৈনিকেরা
মানুষকে শেখাচ্ছে ভালােবাসার গান
 কৃষ্ণচূড়া বিছানাে পথে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাচ্ছে স্বপ্ন 
হাজার শিশুর মুখে খুশির অপার্থিব আলাে.. 

একদিন ঘুম ভেঙে দেখবাে 
প্রতিটি মানুষের মধ্যে সূর্যের দীপ্তি চাঁদের স্নিগ্ধতা
প্রত্যয়ী মানুষ নিজেকে ছাড়িয়ে নিজেই পাড়ি দিয়েছে অসীমে...
একদিন ঘুম ভেঙে দেখবাে

====
 উনিশ 

উনিশ      আমার আবহমানের ভাের
উনিশ      আমার প্রদীপ্ত আবাহন
উনিশ      আমার সংগ্রামী হাতিয়ার
উনিশ      আমার একাদশ ভাইবােন। 

উনিশ       আমার মাথা উঁচু করে বাঁচা
উনিশ       আমার বাংলায় ধারাস্নান
উনিশ       আমার গর্জে ওঠার ভাষা
উনিশ       আমার চেতনায় অম্লান। 

উনিশ       আমার রক্তঋণের গাথা।
উনিশ       আমার মর্যাদা-স্বাধীকার
উনিশ       আমার ঘুম ভাঙানাের গান
উনিশ       আমার একুশের পারাপার। 

উনিশ      আমার চিরজাগা বাতিঘর
উনিশ      আমার সত্তায় মহিয়ান 
উনিশ      আমার বাঙালীবিশ্বে আলাে
উনিশ      আমার জননীর সম্মান।

=====
আলাের শপথ 

নিদারুণ এক সঙ্কট ছুঁয়ে আমরা
মৃত্যুমিছিলে বিশ্বের ক্রন্দন 
সভ্যতা বুঝি বিপন্ন অসহায় 
সবুজ বসুধা আশ্রয় গৃহকোণ। 

বােশেখ পঁচিশে পরিয়েছি কত মালা 
গান কবিতায় ঝংকৃত পরিবেশ 
ভাবনা তােমার গ্রহণ করিনি আজও 
ক্ষমতা নেশায় বাড়িয়েছি বিদ্বেষ। 

সমাজ-দূষণে মানুষ ত্রস্ত আজ 
বন্দীজীবন অতিমারী প্রাণঘাতী
অগণন প্রাণ দুর্গত, দিশাহীন 
প্রত্যাশা শুধু সহমর্মিতা, সাথী। 

রবীন্দ্রনাথ চলমান দর্শন 
সৃজনের স্রোতে জীবনের জয়গান 
বিশ্ব প্রকৃতি সম্প্রীতি একাকার 
মানুষের শিরে বিজয়ীর সম্মান। 

তুমি আমাদের ধমনীর স্রোতে উষা
 পরম্পরার লাবণ্য প্রত্যয় 
আলাের শপথে ঐক্যের সাতরঙ 
মানবিক ত্রাণ, দীপ্ত জ্যোতির্ময়।
 চিরবসন্তের কবি 

ডাক্তারী পড়ায় ইতি টেনেছিলেন কবিতা লেখার নেশায়। বই প্রকাশের পর দুটি নামী পত্রিকা থেকেই ধেয়ে এসেছিল তীব্র বিদ্রুপের কশাঘাত - “ছিল হাসপাতালের শিক্ষানবিশ, শখ হল কবি হবার! কবিতার নামে যা লেখা হয়েছে, তা নেহাত নির্বোধের কাজ। কবিতা লেখা ছেড়ে, যাও হে, তোমার হাসপাতালে, বা বাবার আস্তাবলে''। ঘটনার নির্মম অভিঘাতে স্বভাবতই ভেঙে পড়েছিলেন। অস্তিত্ব জুড়ে নেমে এসেছিল অন্ধকার। তবু হাল ছাড়েননি। নতজানু হয়েছিলেন শব্দের কাছে, প্রকৃতির কাছে। 

ঘােড়া থেকে প'ড়ে অসময়ে চলে গেলেন বাবা। মা আবার বিয়ে করলেন। সে বিয়েও স্থায়ী হল না। অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। দশ বছরের কিশাের ছেলেটি সেবা করে চলল মায়ের৷ কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। কিছুদিন পর তিনিও বিদায় নিলেন দুরারােগ্য যক্ষা রােগে। দুই ভাইকে নিয়ে একরত্তি ছেলেটির শৈশব-কৈশাের জুড়ে শুধুই বিষাদ আর অনিশ্চয়তার ঘূর্ণি। 

এনফিল্ডের আবাসিক স্কুলের পর, এখন মেডিকেল কলেজ। অভিভাবক হিসেবে মিস্টার অ্যাবি সঙ্গত কারণেই, চাইলেন না মেধাবী ছেলেটি ডাক্তারী পড়া ছেড়ে লেখালেখির মতাে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিক। 

কিন্তু যার জীবন ছুঁয়ে রহস্যময় প্রকৃতির সতত উন্মােচন, অপার সৌন্দর্যের হাতছানি, তার কাছে যে ছন্দহীন, অসার, কঠোর বাস্তবতার দিনলিপি। 

এক ভাই বিদায় নিল যক্ষা রােগে। আর এক ভাই বিয়ে করে ভাগ্য অন্বেষণে চলে গেল আমেরিকা। বাড়ীতে ভাড়াটিয়া হয়ে এলাে সুন্দরী প্রাণােচ্ছল তরুণী ফ্যানি ব্রন ও তার মা। তরুণ কবির জীবনে এল অন্য এক বসন্ত। নতুন প্রাণ পেল কবিতাশরীর। অনুপম লাবণ্যে বিকশিত হতে লাগলাে অনুভবী শব্দমালা। 

ফ্যানিকে বিয়ে করতে চেয়ে আশাহত হলেন কবি। ফ্যানির মা পরিস্কার জানিয়ে দিলেন, আগে হতে হবে স্বাবলম্বী। 

মানসিক অস্থিরতায় ক্রমশ ভেঙে পড়ছে শরীর। মারণ রােগের ছায়া যেন তাড়া করে ফিরছে। সুস্থতার আশায় এবার ফ্যানিদের বাড়ী অতিথি হয়ে থাকলেন এক মাস৷ পাশে পেলেন তাঁর একান্ত ভালোবাসার মানুষটিকে৷ প্রিয়তার উষ্ণতায় হয়তো জয় করতে চাইলেন জীবনের সব অন্ধকার৷

ডাক্তারের পরামর্শে স্বাস্থ্য উদ্ধারে এবার পাড়ি, রৌদ্রকরােজ্জ্বল ইতালি। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার ধকলে আরাে ভেঙে যাচ্ছে শরীর। জাহাজে যেতে যেতে আকাশের ধ্রুবতারার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা। মনে হতাে, মৃত্যুর পর তিনি ঐ ধ্রুবতারার সঙ্গে একদিন একাত্ম হয়ে যাবেন। 

ইতালি পোঁছে সঙ্গী হিসেবে পেলেন বন্ধু সেভার্নকে। কবিবন্ধু শেলীর আমন্ত্রণে গেলেন পিসায়। চিকিৎসার জন্য আসতে হল রােমে। সেখান থেকেই বন্ধুদের উদ্দেশে লিখে চললেন চিঠি। কিন্তু প্রিয়তমা ফ্যানিকে জানালেন না, গােপন ব্যথার উচ্চারণ।

ঘন ঘন কাশির দমক, রক্ত উঠছে। রক্তের এই লাল রঙ যে তার চেনা! দূর্বল শরীর, বন্ধু সেভানের পাশে শুয়ে, শুনছেন তাঁর কবিতা। অবশেষে এসে পৌঁছলাে বহু প্রতীক্ষার সেই সােনালী রােদ্দুর, ফ্যানির চিঠি।। 

এবার যে নিশ্চিন্তে পাড়ি দেওয়া যায়! সমস্ত দিন আচ্ছন্নতায় কাটলাে। মাথার পাশে বসে চিত্রকর বন্ধু সেভার্ন। অস্ফুট স্বরে কবি বললেন - “আমাকে তুলে ধরাে, আমার মৃত্যু এগিয়ে আসছে। আমি শান্তিতে মরতে চাই, তুমি ভয় পেও না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ"। 

কবিতা শুনতে শুনতে একসময় স্থির হয়ে গেল শরীর। চিরসুন্দরের কবি, পঁচিশটি বসন্ত পার করে পাড়ি দিলেন নতুন গন্তব্যে। 

কবির শেষ ইচ্ছায় রােমের সমাধিক্ষেত্রে তাঁর বুকের ওপর রাখা হল মুখবন্ধ সেই খাম। ভালােবাসার মন্দ্রিত ঐশ্বর্য বুকে নিয়ে কবি যাত্রা করলেন অমর্ত্যলােকে। 

দেশ-কালের সীমারেখা ছাড়িয়ে সময়শরীরে জেগে কবির স্বপ্ন, অনন্ত প্রত্যাশা। সেই অপঠিত রহস্যচিঠির প্রতিটি অক্ষর আজও ভােররাতে রঙিন প্রজাপতি হয়ে প্রদক্ষিণ করে সবুজ হৃদয়, মন্ত্র দেয় ভালােবাসার। 

আজও তাঁর কবিতার হাত ধরে চন্দ্রের দেবীকে চুম্বন করে মর্তের এক তরুণ প্রেমিক। 

চিরবসন্তের কবি, জন কীটস্ জেগে থাকেন সৌন্দর্য-সুষমার যাত্রাপথে, আবহমানের ধ্রুপদী শব্দমালায়, ধ্রুবতারার অনন্ত দীপ্তিতে৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ