পোস্ট বার দেখা হয়েছে
কংসাবতী
( পর্ব --১৭)
মহুয়া
কলকাতা থেকে বাড়ি ফেরার প্রায় মাস দুয়েক বাদে সুচেতা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছিল । অসুস্থ হয়ে বাঁকুড়ায় থাকাকালীন সুচেতা প্রচুর পড়াশুনো করতো । সুস্থ হবার বেশ কিছুদিন বাদে সুচেতা কলকাতায় ফিরে আসে এম এস সি তে ভর্তি হবার জন্যে । রেজাল্ট তুলতে কলেজে গিয়েছিল কাকার সাথে । কলেজে গিয়ে হেড অব দা ডিপার্টমেন্ট স্যারের সাথে দেখা করতেই সবাই জেনে গেলো ওর কথা । সুচেতার কিছু শুভাকাঙ্ক্ষী ক্লাসমেট আর অন্যান্য স্যারেরা দেখা করে সবাই অভিনন্দন জানালো । প্রিন্সিপাল স্যার নিজে এসে দেখা করলেন এবং বললেন পি জি তে ওর সব পড়ার খরচ ফ্রি । এত আনন্দের মধ্যেও সুচেতা কোনো আনন্দ অনুভব করলো না । কোথায় যেনো একটা সুর কেটে গেছে মনে হলো । গত দু বছর ধরে কলেজে পা দিলেই যে মুখে আলো জ্বলে উঠতো সেই মুখটা ওকে তাড়া করতে লাগলো ভেতরে ভেতরে । কলেজের মারপিটের ঘটনায় যখন জখম হয়েছিল তার থেকেও আজ ওর বেশি যন্ত্রনা হতে লাগলো । তাড়াতাড়ি কলেজের কাজ মিটিয়ে ফিরে এলো । ঘরে ফিরে মনে মনে ঠিক করলো প্রতুলের খবর নেবে যে ভাবেই হোক । প্রতুল হারিয়ে যেতে পারে না । দরকার পড়লে ওদের বাড়ি যাবে কোনো বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ।
পরদিন পি জির কিছু বই কিনবে বলে কাকাকে বলে বেরোলো । তারপর বেরিয়েই প্রতুলের নং এ ফোন করলো । দুবার বেজে যাবার পরে একজন মহিলা ধরলেন ।©️
----- হ্যালো , কে বলছেন ?
----- আমি প্রতুলের সাথে কি কথা বলতে পারি ?
----- আপনি কে ? তাছাড়া প্রতুল তো এখানে থাকে না ।
----- থাকে না ? কিন্তু প্রতুল তো এই নং টাই দিয়েছিল ।
----- হ্যাঁ এটা প্রতুলেরই বাড়ি । কিন্তু একমাস হলো ও বিদেশে চলে গেছে পড়তে ।
----- বিদেশে চলে গেছে ? কোথায় ?
----- আপনি কে না জেনেই আমি আপনার সাথে এত কথা বলবো কেনো ? আপনি কে বলছেন ?
----- আমি ওর সাথে কলেজে একসাথে পড়তাম । অনেকদিন অসুস্থ থাকার জন্যে আমি ওর কোনো খোঁজ নিতে পারিনি । ওর ঠিকানা টা বললে আমি লিখে নিতাম ।
------ আপনি কি সুচেতা মানে চিন্তা মনি টুডু ? বাঁকুড়ায় থাকো ?
------ হ্যাঁ আমি সুচেতা , আপনি যদি ওর ঠিকানা টা একটু দিতেন , তাহলে আমি যোগাযোগ করে নিতাম ।
------ শোনো মেয়ে, আমার ছেলের পিছু ছাড়ো । তুমি সুস্থ হয়েছ খুব ভালো কথা । এবার তুমি নিজের রাস্তা দেখো , নিজের পায়ে দাঁড়া ও । আমার ছেলের কথা ভুলে যাও । তোমাদের সাথে আমাদের মেলে না । আমার হাসব্যান্ড এখনও জানে না তোমাদের কথা । জানলে ভালো হবে না । তাই তোমাকে সাবধান করছি তুমি আমার ছেলের পিছু ছাড়ো । যদি টাকার দরকার হয় বলতে পারো ।
সুচেতার পায়ের নিচ থেকে যেনো আচমকা মাটি সরে গেলো । মাথাটা কেমন ফাঁকা বোধ হোলো । ও একটা কথাও না বলে ফোনটা নামিয়ে রাখলো । কিছুক্ষণ হতবম্বের মত দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলো । হঠাৎ করে একটা ট্যাক্সি ব্রেক কষে ওর প্রায় গায়ের ওপর দাঁড়ালো ।
------ কি ব্যাপার দেখে রাস্তা পার হতে পারেন না ? সুইসাইড করতে এসেছেন নাকি ? তাহলে নিজের বাড়িতে গিয়ে করুন । মাঝরাস্তায় দশটা মানুষের কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে সুইসাইড না করাই উচিৎ । একটু চোখ খুলে চলাফেরা করুন । যত্তসব ©️
ট্যাক্সি টা চলে যায় । ভালোবাসা যে এভাবে মানুষকে কাঙাল করে দেয় সেটা আজ বুঝতে পারল সুচেতা । দিব্যি ছিল গ্রামে , শহরে পড়তে এসে এভাবে নিঃস্ব হয়ে যাবে বুঝতে পারলে কোনোদিনই প্রতুলের সাথে জড়াতো না । কিন্তু কিছুতেই সুচেতা বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে প্রতুল এমন করতে পারে । কিছুতেই না । চোখ ফেটে জল আসছিল , বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল । কতদিন প্রতুল কে দেখেনি , ছোঁয়নি । কলকাতা মানেই প্রতুল ।এই শহরের যে কটা রাস্তা ও চেনে সবকটা রাস্তায় প্রতুলের পায়ের ছাপ আছে । শরীর মন কোনোটাই তো আর ওর নিজের নয় , সবটাই তো প্রতুলের । বিদেশ যাবার কথা তো ছিলই কিন্তু তাই বলে না জানিয়ে ? প্রতুল তো জানে ওর বাড়ির ঠিকানা , একবার চিঠিও দিয়েছিল । ও কি একটা চিঠিও দেবে না ? নাকি দিয়েছে ? কি করবে বুঝে উঠতে পারে না । শ্লথগতি তে বাড়ি ঢুকলো । কাকিমা দেখেই বললো , "কিরে তোর শরীর খারাপ নাকি ? মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেনো ? হাতপা ধুয়ে খেতে আয় "।
------ কাকিমা আমার শরীরটা ভালো লাগছে না , একটু শুয়ে থাকি । পরে খাবো ।
বলে ঘরে ঢুকে শুয়ে পরে আর দু চোখে কাঁসাইয়ের বান ডাকে। অনেক পরে মনস্থির করে , যাই হয়ে যাক বাবাকে দেওয়া কথা ওকে রাখতেই হবে । একদিকে চাকরির পড়া আর একদিকে পি জির র পড়া চালিয়ে যেতে হবে । নিজেকে প্রতুলের উপযুক্ত করে তুলতে হবে । যে জীবনসংগ্রাম টা ছোট থেকে করে আসছিল সেই সংগ্রামটা আর ও জোরদার হোলো । প্রতিজ্ঞা করলো এই সংগ্রাম ওকে জিততে হবে । জিততেই হবে ।
শুরু হলো ওর কলেজ , পড়াশোনা আর পড়াশোনা । নিজেকে বেশি করে ডুবিয়ে দিতে লাগলো পড়ার ভেতরে । একবগগা ঘোড়ার মত ছুটে চললো লক্ষ্যে । এর মধ্যেই বাবা খবর পাঠালো গ্রামে ফেরার জন্যে । গ্রামের বাড়ি নাকি ছাড়তে হবে । কি সব বলছিল যেন বাবা !©️
হ্যাঁ , চিন্তার বাবা ভাগচাষী। শিমলি র বাড়িটা হোলো গ্রামের বড়ো কর্তা দের । দুই পুরুষ ধরে বাস ওই বাড়িতে । কি হলো কে জানে ? চিন্তিত মনে রওনা দিল গ্রামে । গিয়ে শুনলো বড়ো কর্তার ছোট ছেলে বিদেশ থেকে গ্রামে ফিরে একটা ফার্ম হাউস বানাবে , তাই তার বাবাকে বড়ো কর্তা শিমলির কাছেই সারেঙ্গা গ্রামে জমি শুদ্ধু একটা আটচালা দিয়েছে । শুনে নিশ্চিন্ত হোলো সুচেতা । কিন্তু মা কেমন একটা চুপচাপ হয়ে গেছে । সুচেতার সাথে ঠিকমত কথাও বলে না । সাত আট দিন বাড়ি পরিবর্তন করে নতুন বাড়ি গোছানোতেই কেটে গেলো । তার মধ্যেই শিমলি পোষ্ট অফিসে গেলো প্রতুলের কোনো চিঠি আছে দেখতে । পিয়ন কাকা বলল , একটা সাদা খামে সুচেতার নাম লেখা একটা চিঠি ওর বাড়িতে দিয়ে এসেছিল । একথা শুনে সুচেতা আর দাঁড়ায় না । প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে বাড়ি এসেই মাকে জিজ্ঞেস করে , কোনো চিঠি এসেছে কিনা ? ©️
------ হ , আসেছিল । কুতোগুলান খারাপ খারাপ কুথা লিখা ছিল । উটা কার চিঠি আসেছিল ? তুর বাপ উটা পিয়ন বাবুর থিকে পড়াই ছিল । তুকে আগেই বইলেছিলাম , শহরে যাবি যা , উসব বিটা ছেলেদের সাথে ভাব ভালোবাসা করবি নায় । ভুইলে গেলি তুর দিদির কুথা ? আমাদের বিটা ছানা নাই , তুরাই আমাদের বিটা । ইকজন বুকে শেল দিয়ে ভাগে গেলো ইখন তুইও ?
------ মা , তুমি ভুল কইরচ্ছ । হ্যাঁ আমি প্রতুল কে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু তুমাদের দেওয়া কথা আমি ভুলি নায় ।
----- তখন বুঝি নায় উ বিটাছানাটা আমাদের বাড়ি আসেছিল কেনো ? উ চিঠি আমি পুড়ায় দিছি ।
সুচেতা কিছু না বলেই ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে হু হু করে কেঁদে ফেললো । আর কোনো আশাই রইলো না প্রতুলের সঙ্গে যোগযোগ করার । কলেজে প্রতুলের বন্ধুদের কাউকেই তেমন চেনে না যে কারো কাছে প্রতুলের খোঁজ নেবে । কলেজে কানাঘুষোয় একটু শুনেছে যে প্রতুল ক্যালিফোর্নিয়ায় আছে । নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে । নতুন বাড়ি আসার পাঁচ ছ দিন পরে সুচেতা আবার কলকাতায় ফিরে আসে । নিজেকে তৈরি করতে থাকে এক বুক আশা নিয়ে । আজ না হোক একদিন না একদিন প্রতুল কে ও পাবেই । ওর দেওয়া সিঁদুর কি মিথ্যে হয়ে যাবে নাকি ? কিছুতেই না -----
(চলবে)
0 মন্তব্যসমূহ