পোস্ট বার দেখা হয়েছে
আমাদের স্কুলের ভূগোল স্যার বড় অদ্ভুত মানুষ ছিলেন। ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই বলতেন, " যারা পড়া করে আসিস নি , তারা সব বেঞ্চের ওপর দাঁড়া। আর যারা করে এসেছে তারা পরে দাঁড়াবে ! "
এ কথার সহজ অর্থ এই যে, যারা মনে করছে তারা স্যারের হোমওয়ার্ক করে এসেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি প্রশ্ন করে তাদের ভুল প্রমাণিত করে অনায়াসে হারিয়ে দেবেন এবং যথাযোগ্য শাস্তি দেবেন !
আমাদের ক্লাসেই পড়ত উত্তম । পোশাক , চলনে-বলনে স্মার্ট ছিল বলে আমরা তাকে উত্তম কুমার বা রূপকুমার বলেও ডাকতাম। ভূগোল স্যার মহাদেব সাহা ছিলেন উত্তমের ওপর হাড়ে চটা । পড়াশোনার বিচারে উত্তম বেশ মধ্যম মানের ছিল, হয়তো কিছুটা অধমের স্তরে ছিল বললেও কারও আপত্তি থাকার কথা নয় ! তবে লেখাপড়া অপেক্ষা তার স্টাইলই মনে হয় মহাদেববাবুর উষ্মা প্রকাশের বড় কারণ ছিল ! অথবা তিনি হয়তো মনে করতেন , উত্তমের অধোগতির মূল কারণ হচ্ছে ওর স্টাইল।
আবার উত্তমও কম জ্বালাতন করে নি মহাদেব স্যারকে।আড়ালে আবডালে তাঁকে শুনিয়ে গেয়ে উঠত সে যুগের বাংলা সিনেমার সেই বিখ্যাত গান : ' সাজতে হবে, শিব তোমারে সাজতে হবে। ' এই গানের সুর শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতেন মহাদেব ! ওনার মাথায় জটা না থাকলেও
ভীষণ রেগে যেতেন যখন উত্তম চাপা স্বরে আর কর্কশ আওয়াজে উচ্চারণ করত, ' জটার ঘটা কেটে শিব আলবাটে কাটিবে / মচর মচর শব্দে অঙ্গে উমা হেলে রবে । '
তা এহেন উত্তম একদিন ভূগোলের ক্লাসে অনেক যত্নে ভারতবর্ষের মানচিত্র এঁকে এনে অনেক আশা নিয়ে মাস্টারমশাইকে দেখালো । ম্যাপটাকে দাঁড় করানোর জন্য সত্যি খেটেছিল উত্তম । চাইনিজ় ইঙ্ক দিয়ে কয়েক জায়গায় শেড্ও দিয়েছিল ।
কিন্তু , বিধি বাম ! ম্যাপটা হাতে নিয়ে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ব্যঙ্গাত্মক হাসি হেসে মহাদেববাবু বললেন , ' বাবা উত্তম , ভারতমাতাকে এমনভাবে কালিমালিপ্ত না করে এইসব চুনকালি নিজের মুখে মাখালেই তো পারতিস বাছা ! তাতে , অন্তত বড় হয়ে সার্কাসের জোকারের কাজ করে দু'পয়সা রোজগার হতো । লেখাপড়া তোর জন্যে নয় রে ! '
এরপর এক অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে উত্তমের ঈষৎ কোঁকড়ানো চুলের ওপর দিয়ে আলতো করে হাতটাকে ঢেউ খেলানোর মতো চালিয়ে দিয়ে গেয়ে উঠলেন , ' এমন ধানের ওপর খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে । '
জানি না উত্তম আজ কোথায় আছে বা কী করে ! তার সেই সুন্দর কেশরাশি আজ পেকে ধুসর হয়ে গ্যাছে অথবা কাঁচায় পেড়ে খেয়ে ফেলার কারণে তার এখন মাথা জুড়ে টাক নেমেছে , জানি না তাও ! কে জানে হয়তো এখন সে রবিবার সকালে সস্ত্রীক চুলে হেনা-মেহেন্দি আর মুখে ফেস প্যাকের একগাদা ফেনা মেখে পাথরের মূর্তির মতন নট-নড়ন-চড়ন বসে থাকে টিভির সামনে।
উত্তমের জীবনের খুঁটিনাটি না জানলেও টিভি , ইউ টিউব, মোবাইল দেখে এটা স্বচ্ছন্দে বলা যায় যে রূপচর্চা দিনে দিনে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে । আগেকার দিনে পুরুষের রূপচর্চা সমাজে কিছুটা অবজ্ঞার চোখে দেখার কথা ইতিহাসে লেখা থাকলেও এখন আর তেমন হয় না । সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক উদার হয়েছে।
এসব আদিখ্যেতা দেখলে মহাদেব মাস্টার
কী বলতেন জানি না , তবে ব্রণ-মেচেতার দাগ লুকোতে ' ত্বকের যত্ন নিন ' বলে যার জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল তা আজ আন্তর্জাতিক সংস্করণে এসে কলা , বাণিজ্য থেকে বিজ্ঞানকেও জড়িয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই ! এই যেমন কসমেটিক্ সার্জারির কথাই ধরা যাক। সার্জারির গুঁতোয় কুরূপা সুরূপা হতে কতক্ষণ ? প্রয়োজন কেবল আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং আধুনিক মন ।
চুলের যত্ন নেওয়ার সঠিক পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে নিরন্তর তা তখনই জানতে পারলাম , যখন এক টাকার শ্যাম্পুর স্যাকেট কেনার আগে আমাকে প্রশ্ন করা হলো : আপনার চুল তৈলাক্ত, শুষ্ক না এ দুইয়ের মাঝামাঝি ? এতো জানলে কী আর ইন্ডিয়াতে পড়ে থাকতাম বাপু ! বেশি টেনসন হওয়ার আগে ভাবলাম চুল ছিঁড়ে ল্যাবে পাঠাতে হবে আমাকে। এরপর মাথায় চিন্তা এলো , কোথায় এই পরীক্ষা বা সমীক্ষা করা হয় তাও তো জানা নেই আমার! সম্ভবত ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে এই টেস্ট হবে। কিন্তু, ওরা তো জানি মৃত মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ নিয়ে পরীক্ষা করে। তাতে কেন মহাভারত অশুদ্ধ হবে ? মরা হোক বা জীবিত ---- মানুষ তো মানুষই ! এই যেমন শ্মশান ঘাটের কাছে একটা স্টুডিও থাকে । সেই স্টুডিওর ফটোগ্রাফার যে জীবিত মানুষের ছবিও অনায়াসে তুলতে পারে , এ আমি একবার স্বচক্ষে দেখেছি বলেই খুব ভাল করেই জানি।
এরপর ল্যাবরেটরি রিপোর্টের আসার অপেক্ষায় থাকলাম। এখানেই শেষ নয়। তাদের রিপোর্ট যদি মনে হয় ভুল সেক্ষেত্রে একটা সেকেন্ড ওপিনিয়ন নেওয়ার প্রয়োজন হবে। আরে মশাই, জীবনটাতো আপনার। মনে রাখবেন, নিজেকে ভালোবাসতে শিখলে তবেই আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবেন । তখন , ঠিক তখনই চারপাশের পরিবেশ , মানুষজন সুন্দর হয়ে ধরা দেবে আপনার কাছে। আর , সেখানেই আছে সৌন্দর্যর সার্থকতা , রূপচর্চার সফলতা ।
এই তো সামনেই পুজো । বছরের এই বিশেষ পাঁচ দিন সকালে সন্ধ্যায় তো বটেই, এমন কি দুপুরে বা বিকেলে কী রঙের পোশাক পড়বেন, কেমন হবে তার সঙ্গে মানানসই মেক-আপ কী যাবে ---- এসবই যে ঠিক করে দেবেন এই রূপ বিশারদরাই ! মেক আপের গুরুত্ব কখনও যেন খাটো করে দেখবেন না । ষষ্ঠীর বোধনের আনন্দ বার্তা আর দশমীর ' কান্না কান্না ' ভাব যদি আপনার শরীরে না ফুটে ওঠে তাহলে কেউ কি আর মূল্য দেবে আপনার শিক্ষাদীক্ষা এবং রুচিবোধকে !
এখনই হাঁপিয়ে উঠলেন ? দম নেই যখন লড়তে আসা কেন বাপু ! লড়তে হবে, না হলে পিছিয়ে পড়তে হবে। যাইহোক, এবার আসা যাক কিছুটা খুঁটিনাটি পারসোনাল ইনফোতে। আপনার মুখের গঠন কি চৌকো ? যদি এই প্রশ্নের উত্তর হয় ' হ্যাঁ ' , তারপর আরও ডিটেলে যেতে হবে। কেমন চৌকো ? বর্গক্ষেত্র , আয়তক্ষেত্র না রম্বস ? কী বললেন ? জ্যামিতিতে কাঁচা ছিলেন ? তাহলে বেশি কষ্ট করে চিন্তা করতে হবে না , এতে ব্রেনে প্রচন্ড চাপ পড়ে । আমাদের প্রতিনিধি আপনার বাড়িতে আসবে। সেই আপনার মুখের মাপজোক নিয়ে আমাদের জানিয়ে দেবে । তারপর আমরা জানিয়ে দেবো আপনার চোয়ালের হাড়ে কতটা পরিমাণে কোন রঙের শেড্ লাগালে আপনার মুখের গঠন অনেকটা গোল দেখাবে !
এ পর্যন্ত শুনে যাঁরা ভাবছেন , যাদের গোলাকার মুখ তারা নিশ্চয়ই ভাগ্যবতী । ডাঁহা ভুল। তবে টেনসন নেওয়ার কারণ নেই। যাদের মুখ বৃত্তাকার তাদের জন্যেও রূপবিজ্ঞানীরা চিন্তা করেন বৈকি। গবেষকরা জানিয়েছেন যে এমন মেক আপ করতে হবে যার ফলে গোল মুখ লম্বা , মানে ডিম্বাকৃতি দেখাবে । বিনা অস্ত্রপোচারে, কম খরচে এর চেয়ে বেশি কী বা আশা করতে পারেন আপনি ?
আরও আছে। কম খরচে একেবারে নাগালের মধ্যে রূপচর্চার প্রাকৃতিক উপকরণ পেয়ে যাবেন যদি আপনার রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি দেন। তার আগে
জেনে রাখা ভালো শসা , লেবুর রস, মধু , টক দই, ডাবের জল, ডিমের সাদা অংশ ও হলুদ কুসুম ইত্যাদি প্রভৃতি জিনিস ঠিক কতটা মুখে রাখবেন আর কতখানি মাথায় ঢালবেন !
এসব ফিরিস্তি শুনে একবার এক বয়স্ক ডাক্তারবাবু নাকি বলেছিলেন, " গরীব দেশ। এখানে এতসব ভালো ভালো পুষ্টিকর খাদ্য মুখে বা মাথায় না মেখে, পেটে খেলে অনেক বেশি করে রূপ খুলবে। " এই ডাক্তার ভদ্রলোক নিশ্চয়ই আমাদের ভূগোল স্যারের মতো খিটকেল ! অবশ্য মহাদেববাবু অকৃতদার ছিলেন --- বিয়ে-সাদি করেন নি । তাই তাঁর না ছিল কোনও সাংসারিক দায়বদ্ধতা , না ছিল এই দ্রুত পরিবর্তনশীল জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ইচ্ছা অথবা প্রয়োজন। ঘরে অবিবাহিত যুবতী মেয়ে থাকলে মেয়ের বাবার কেমন টেনসন হয় , তা ছিল তাঁর অজানা। কিন্তু, সুস্থ সামাজিকতার একজন মানুষ তো চোখ উল্টে বাঁচতে পারে না। তাই রূপচর্চার প্রয়োজন আছে বৈকি !
নিজেকে সুন্দর করে জগত সংসারের সামনে মেলে ধরার স্বপ্ন নারীর সহজাত প্রবৃত্তি। তাছাড়া, সত্যি করে বলুন তো , সুন্দরের পূজারি হওয়ার কি দোষের ? তবে কেন রবীন্দ্রনাথের ছবি ঘরে টাঙিয়ে রাখেন বলুন তো ! কেনই বা দেবী দুর্গার কাছে আমাদের প্রার্থনা শুরু হয় " জয় জয় রূপং দেহি " বলে ?
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে এখনকার এক রসিক পন্ডিতের কথা । তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আজকাল আমরা রাজনৈতিক নেতা নির্বাচন করি টেলিভিশনের পর্দায় বা সোস্যাল মিডিয়ায় তাদের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব অথবা সৌন্দর্য দেখে আর সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগিনীদের নম্বর দেওয়া হয় তাদের বুদ্ধি, সাধারণ জ্ঞানের গভীরতা মেপে এবং কোনও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলায় তারা কতটা দক্ষ সেইসব বিচার করে। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ !
শেষ করব একটা খবরের কাগজে হঠাৎ দেখা একটি ঘটনার কথা লিখে । ছোট্ট একটা খবরের সেদিনের কাগজে পড়েছিলাম। ইউরোপের একটা দেশে স্রেফ মজা করার জন্যে একটা অন্য রকম কিছু আয়োজন করেছিল --- বিশ্ব কুৎসিত প্রতিযোগিতা l সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সেরা কুৎসিত মানুষজন এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল । কেবল সুশ্রীর পরিবর্তে কুশ্রী ছাড়া বাকি নিয়ম কানুন বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার মতোই । আর হ্যাঁ , এখানে একা নয় স্বামী স্ত্রী একসাথে লড়াই করতে হবে।
শেষ পর্যন্ত বিচারক মন্ডলীর রায়ে যে কর্তা-গিন্নির জুটি বছরের সেরা কুৎসিত দম্পতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করল তাদের যথারীতি সম্মান প্রদর্শনের সাথে পুরস্কৃত করা হয়। এরপর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বিজয়ী দম্পতি জানালেন , তাঁরা আজ বিজয়ী হওয়ার কারণে অবশ্যই আনন্দ পেয়েছেন। কিন্তু, বিশ্ব সেরার মুকুট তাঁদের মাথায় উঠলেও তাঁরাই যে পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত দম্পতি এমনটা নাও হতে পারে।
একে কী বলা উচিৎ ? বিশ্বজয়ী দম্পতির বিনয় ? যে বিনয় বলতে চায় , হয়তো আমাদের চেয়ে যোগ্য প্রার্থী আছে , কিন্তু কোনো কারণে তাঁরা আজ পারলেন না ! আজকের দিনটা তাই আমাদের হয়ে গেছে। নাকি , এ হচ্ছে হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ ?
কী হলো ? সিরিয়াস হয়ে গেলেন নাকি ?
আরে, না না ! ওটা স্রেফ মজা ছিল। ওনলি ফান !
আসল কথা হচ্ছে প্রাকৃতিক ভাবে এ পৃথিবীতে কেউ কুৎসিত নয় , সবাই সুন্দর। তাই এ ব্যাপারে হীনমন্যতা অর্থহীন । এ কেবল মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে সে কাকে নিয়ে কী ভাবছে ! কথা তো সবাই জানে যে একজনের কাছে যে অসুর বিরোধী দলের কাছে তিনিই দেবতা ।
তাই , প্রার্থনা করি যেন শত ফুল বিকশিত হয়ে এই সুন্দর পৃথিবীকে আরও সুন্দর করে গড়ে তুলতে সহায়তা করুক। সেই ফুলের মালা গাঁথা হোক। পুজোর আয়োজন হোক ঘরে ঘরে । মালা বদলও হোক না !
0 মন্তব্যসমূহ