ধারাবাহিক উপন্যাস || এক সমুদ্র অনেক নদী ~ প্রদীপ গুপ্ত || পর্ব -- পাঁচ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বুকের দীর্ঘনিশ্বাস বুকেই চেপে রেখে বাইকের পেছনে এসে বসে শ্রেয়ান।

--- ভালোভাবে ধরে বসুন দাদাভাই, আজ চড়ার জল সরেনি এখনও। গাড়ি বালিতে পিছলে যেতে পারে যে কোনও মুহূর্তে।

---  জল সরতে সরতে কতক্ষণ লাগবে?

--- সে আরও প্রায় ঘন্টাখানিক তো লাগবেই, আরও সময় লাগতে পারে।

--- এতোক্ষণ!

--- আজ তো পূর্ণিমা। আকাশের দিকে নজর পড়েনি বোধহয়, আজ তো বুদ্ধ পূর্ণিমা। পূবের দিকে ওই গাছগুলোর মাথার পেছনে দেখুন। চাঁদ কেমন সোনারং মেখে সমূদ্রের জলে স্নান করবে বলে সেজেছে।

--- বাহ্, তুমি তো ভারী সুন্দর কথা বলো। কী সাবজেক্ট ছিলো তোমার?

--- আর সাবজেক্ট। সাবজেক্ট সব প্রেডিকেট হয়ে গেছে দাদাভাই। বাড়ির বড় ছেলে, বাবা চলে যাওয়ার পর...  তখন আমি হায়ার সেকেন্ডারি দেবো। সেই তখন থেকেই...

---- একটু দাঁড়াবে প্লিজ?

--- কেন চাঁদ দেখবেন?

--- না, এমনিই।

--- জলটা পেরিয়ে যাই আগে। এই সুবর্ণরেখাকে বিশ্বাস নেই, খুব খামখেয়ালি। একদম ক্ষেপা বাউলনির মতো। এখানে তো ওর কোনো পিছুটান নেই, শুধুই সমুদ্রে মেশার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়ার পাগলামো। 

--- তোমার আর পড়তে ইচ্ছে করে না?

--- না দাদাভাই, আমার এখন চব্বিশ। আমার ক্ষেপীর বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে খুব।

--- প্রেম করো?

--- আগে করতাম। এখন ভালোবাসার কাছে বাঁধা পড়ে গেছি। 

--- মাসে কতো আসে?

--- ওই যে বললাম, সবটাই সুবর্ণরেখার ওপর। ও চাইলে মাসে কুড়ি পঁচিশ, না চাইলে দশ বারো।

---- ক্ষেপী কি করে?

--- কিছুই না। তবে ভালো গান গায়। ওর গান শুনলে নদীও থমকে দাঁড়িয়ে শোনে।


জলের তোড়টা এখানে বেশ ভালো। গভীরতা নেই কিন্তু তড়বড়ানিটা আছে। শ্রেয়ানের প্যান্টের হাঁটু পর্যন্ত ভিজে গেছে। ওর খুব ইচ্ছে করছে জলে নেমে চুপচাপ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াতে। বাইকের চাকাটা কেমন ছরছর করে শব্দ তুলে দৌড়োচ্ছে। ছেলেটার কথাগুলো শুনে ওর কেন জানিনা ছেলেটাকে বলতে ইচ্ছে করছে, ভুল করছো ভাই। এই মায়া মোহ সবকিছুই আসলে একজন পুরুষকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রী। পৃথিবীতে প্রেম বলে আসলে কিছু নেই, ওটা একটা পাগলামো। একটা insanity. একটা ঘোর। ঘোর কেটে গেলেই তখন জীবন একটা ফক্কা, একটা খালি দেশলাইএর বাক্স। দুপাশে বারুদ আছে কিন্তু জ্বালবার মতো কাঠি নেই, বাক্সটার বুক খালি করে সব কাঠি বাক্সটাকে ঘষে ঘষে জ্বলন ক্ষমতা নিঃশেষ করে ছেড়ে চলে গেছে।

--- দাদাভাই...

--- উঁ

---- নামবেন না? আমরা জল পেড়িয়ে এসেছি। এখানে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে পারেন।

--- পৃথিবীর সব চাঁদ দেখা হয়ে গেছে। এখন আমি অমাবস্যার চাঁদের সাথে ঘর করছি। তখন তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিলো বলে দাঁড়াতে বলেছিলাম।

--- আমাকে! কেন?

--- তোমার কথাগুলো আমায় নাড়া দিয়েছিলো বলে।

--- তাহলে এগোই?

--- থাক, তুমি আমায় এখানেই নামিয়ে দাও। এই বালুচরটুকু আমি হেঁটে চলে যাবো।


ছেলেটি বাইকটা থামায়। শ্রেয়ানের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। শ্রেয়ান বাইক থেকে নেমে ব্যাকপকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে ছেলেটির দিকে একটা কুড়ি টাকার নোট এগিয়ে ধরে। শ্রেয়ানকে অবাক করে ছেলেটি বাইকের এক্সিলারেটর ধরে চাপ দিয়ে গিয়ার পালটায়।

-- আজ আপনার সাথে এসে আমার খুব ভালো লাগলো। এই ভালো লাগাটুকু আমি বেচতে পারবো না।


শ্রেয়ান ছেলেটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তখন চাঁদটা বুঝি সমুদ্রস্নান সেরে সুবর্ণরেখাকে সোনারঙটুকু দিয়ে রূপোলি বেশ ধরে পূব আকাশের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শ্রেয়ানের দিকে এগিয়ে এসেছে।


( ক্রমশ )

__________

আগের পর্ব পড়ুন --


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ