দর্পণ || গল্প || আনন্দ আশ্রম ~ দেবাশীষ দত্ত




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

শীতের সকালে উঠতে একটু দেরি হয়েছে । সুকমল বাবু ঘুম থেকে উঠে সকালের নিজের কাজ টুকু সেরে ফেলেছেন । চা , জলখাবার খেয়ে মাথায় মাঙ্কি  টুপি পরে , গায়ে আপাদ মস্তক চাদর জড়িয়ে , ছাদে এলেন পায়চারি করতে । রোদের তেজ তেমন নেই । বেশ ঠাণ্ডা লাগছে । পায়চারি করতে করতে কোথায় যেন তিনি হারিয়ে গেলেন । আশেপাশের প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে , এখানে আসার আগের মুহূর্ত গুলো স্মৃতি চারণ করছিলেন  ,  ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো । মনে মনে ঠিক করলেন , তার এই করুণ পরিণতির কথা লিখে রেখে যাবেন । তিনি সিঁড়ি দিয়ে খুব সাবধানে নেমে এসে , নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরে গেলেন । খুঁজে পেতে বহু দিনের সঙ্গী  ডাইরিটা  পেলেন । সুকমল বাবুর সেই যুবক বয়স থেকেই ডাইরি লেখার অভ্যাস । তাঁর জীবনের বহু ভাল - মন্দের সাক্ষী এই নীল রঙের ডাইরিটা । প্রথম কয়েক পাতা ওল্টাতেই তাঁর নজরে পরল , স্ত্রীকে দেখতে যাওয়ার সেই অভিজ্ঞতার কথা লেখা আছে । চল্লিশটা বছর একসাথে কাটিয়ে যেদিন নলিনী দেবী , কমল বাবুকে ছেড়ে চলে গেলেন , সেই দিনের কথাও লিপিবদ্ধ করা আছে । সেই দিকে তাকিয়ে কমল বাবু নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না । প্রায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন । তারপর চাদর দিয়ে চোখের জল মুছে , চেয়ার টেনে বসে লিখতে শুরু করলেন .........


বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে আমার বিশেষ কোন ধারনা ছিল না । ছোট বেলায় এই শব্দটি কখনও শুনেছি বলে আমার মনে পরছে না । জীবনের শেষ প্রান্তে এসে , সেই আমি আমাকে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হবে , এমনটা স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি । প্রায় তিন বছর হয়ে গেল । মোটামুটি আর কয়েক জন বুড়ো - বুড়ির সাথে ভালই লাগে এখানে থাকতে । বলা বাহুল্য সবার সাথে মানিয়ে নিতে হয়েছে । উপায় নেই , বিকল্প কোন ব্যাবস্থাও নেই । নিজের মতোন করে থাকা যায় । কারও কোন খবরদারি নেই ।

মন চাইলে বই পড়ি , গান শুনি , আর না হলে ছাদে পায়চারি করি । কখনো সখনো বৃদ্ধাশ্রম এর স্থায়ী  বাসিন্দাদের সাথে গল্প করে সময় কাটাই । আমার ভাল লাগে , বলাটা ভুল বলাই হবে , বরং বলা যায় ভাল লাগাতে হচ্ছে । আর আমি ভাল আছি কিনা ! বা কতোটা ভাল আছি , তা আমি ছাড়া আর একজনই জানেন , তিনি স্বয়ং ঈশ্বর । তাই আমার যখন খুব কষ্ট হয় , যখন এই জীবন যাপনে হাঁপিয়ে উঠি , তখন ছাদে একা গিয়ে লোক চক্ষুর অন্তরালে চোখের কয়েক ফোঁটা জল ফেলে আসি । এই ভাবেই প্রায় তিন বছর কাটিয়ে দিলাম । এখানকার বাসিন্দাদের বিভিন্ন জনের বিভিন্ন সমস্যায় এখানে এসেছেন । তবে প্রায় সবারই কাহিনী একে অপরের সঙ্গে কোথাও না কোথাও মিল আছে । বৃদ্ধ বয়সে সঙ্গী - সাথি , আত্মীয় - স্বজন হারিয়ে সবাই যে খুব আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছে , এমনটা একেবারেই নয় । যাই হোক নিজের কথায় আসি । বীরভূমের এক গ্ৰামে জন্মানোর সুবাদে চিরকালই বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছি । শহরে গিয়ে পরাশোনা করতে , অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে । বাবা ছিলেন তৎকালীন প্ররতি জমিদার বাড়ির ম্যানেজার । সম্পত্তি বলতে ,  কিছু পৈতৃক জমি - জমা আর বাড়ি । বাবার সল্প আয় , আর এই সব নিয়ে মোটামুটি চলে যেত । বাবার ইচ্ছে ছিল , আমি যেন সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করি । আমারও চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না । মা ছিলেন সাদা মাটা এক গৃহ বধু । সংসারের সব কাজ শেষ করে সময় পেলেই আমায় নিয়ে পরাতে বসতেন । স্বল্প বিদ্যা থাকলেও , বিশ্ব সংসার এর খবর রাখতে ভালবাসতেন । এই খবরের জোগান দিতেন , পাড়ার এক বৃদ্ধ মাষ্টার মশাই । সন্তানাদি না থাকায় , আমার মা কে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন । কখনও সকাল , কখনও বিকাল , সময় পেলেই আমাদের বাড়ির দাওয়ায় বসে মায়ের সঙ্গে দেশ - বিদেশের খবর নিয়ে গল্প করতেন । আর সেগুলো মা আমায় শোনাতেন । বলতেন - কালু , এগুলো মনে রাখবি , মাষ্টার মশাই এর কথা । কোনদিন বিফলে যাবে না । যাইহোক এই ভাবেই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে একদিন আমার ছাত্র জীবন শেষ হয়ে গেল । কপাল জোরে সরকারি চাকরিও জুটে গেল । বাবা আনন্দে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন , যেদিন আমি প্রথম বেতনটা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম । বয়েসের ভারে অনেক দিন আগেই বাবা ম্যানেজারির চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন । মা হাতে অনেক গুলো টাকা পেয়ে  , কি করবেন ভেবে না পেয়ে , বাবার হাতে দিয়ে বলেছিলেন - এগুলো নিয়ে আমি কি করবো বলতো ? তুমি সংসার এর মাথা , তুমিই সামলাও এসব । মায়ের সরলতা দেখে আমি মনে মনে হেসেছিলাম । ইতিমধ্যে আমাদের গ্ৰাম পাল্টাতে শুরু করেছে । রাস্তা - ঘাট হয়েছে , যান - বাহনের আনা গোনা বেরেছে । একটা হাই স্কুল তৈরি হয়েছে । আরও কিছু প্রাথমিক সুযোগ সুবিধা উপলব্ধ হয়েছে । আস্তে আস্তে সময় পেরিয়ে আমার চাকরির সময় কাল চারবছর হয়ে গেছে । এবার এল সেই দিন , যেদিন মা - বাবা আর মায়ের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় দের সঙ্গে নিয়ে পাশের গ্ৰামে নলিনী দের বাড়ি গিয়েছিলাম । খুব রোমাঞ্চকর দিন ছিল সেটা । নলিনীর সাথে চোখাচোখি হতেই উত্তেজনায় হাত থেকে চায়ের কাপ উল্টে , যা তা কান্ড হয় । লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না । ফুলসয্যার রাতে আমি একটা গান শুনিয়েছিলাম ওকে -------

চলোনা সেথায় , যেথায় দিগন্ত মেশে সবুজের সাথে ,যেথায় নদীর ধারা পড়েছে ঝরে  , তৃষিত সাগরের বুকে  |

বলোনা সেথায় যাবে আমার সাথে  !!

শুধু তুমি আর আমি ,  আমি আর তুমি ......

থাকব দুজনে খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির প্রাসাদে ....

চলোনা সেথায় , যেথায় দিগন্ত মেশে সবুজের সাথে ...........


নলিনী হাসতে হাসতে গরিয়ে পরছিল । আমি ক্যাবলার মতো তাকিয়ে ছিলাম । বছর ঘুরতেই বাবা গত হলেন । মা যাতে নিজেকে একা না ভাবে  , নলিনী সর্বক্ষন তার পাশে পাশে থাকত । এরপর আমার আর নলিনীর দুই ছেলে কিংশুক , দেবরাজ আর একমাত্র মেয়ে বন্দনা হল । ততদিনে চাকরিতে আমার একটু উন্নতি হয়েছে । তবুও পাঁচ জনের সংসার চালাতে গিয়ে আমাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল । ছেলে - মেয়ে দের পরাশোনা আর তাদের সখ - আল্বাদ মেটাতে গিয়ে , আমার নাভিশ্বাস উঠত । সাধ্যের বাইরে গিয়ে চেষ্টা করেছি । ছেলে - মেয়েরা নিজেদের মতো করে বড় হতে লাগল । মনে পরে , সাধ আর সাধ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকায় , ভীষন মুশকিলে পরেছিলাম সেই দিন  , যেদিন বড়ো ছেলে কিংশুক এর উচ্চ শিক্ষার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন পরল । অদ্ভুত ব্যাপার , সেদিন নলিনী বিনা দ্বিধায় , তার বাপের বাড়ির দেওয়া গলার হার খানা আমায় দিয়ে বলেছিল - তুমি ছেলের পরার ব্যাবস্থা করো । আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম - এতো তোমার বাবার দেওয়া জিনিস , এটা আমি নিতে পারব না । তাছাড়া বাড়ির বৌ এর গলা ফাঁকা থাকতে নেই , দেখতে খারাপ লাগে । উত্তরে নলিনী বলেছিল - দুর , এই বয়সে ভাল আর খারাপ । তুমি দেখ , ছেলে - মেয়েদের পড়াশোনায় যেন কোন খামতি না থাকে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত পেতে গলার হার খানা নিয়ে , কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম । এরপর সেটাকে একটি গোপন জায়গায় কয়েক দিন লুকিয়ে রেখেছিলাম । ভেবেছিলাম যদি অন্য কোন উপায় টাকার সংস্থান করতে পারি । কিন্তু আমি পারিনি , ফলে হার খানা বিক্রি করে ছেলের ভর্তির ব্যাবস্থা করেছিলাম । সেই কিংশুক উচ্চপদস্থ চাকুরে । বিদেশেই থাকে , সেখানকার এক মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে । শুনেছি তাদের নাকি একটি ছেলে । তবে আজ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়নি । নলিনীর ভীষন ইচ্ছে ছিল দাদু ভাইকে দেখার । মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কষ্টে ছটফট করতে দেখেছি । আমি বলেছিলাম - হাসিখুশি থাকো ... যেভাবেই হোক  ।  জানি , তোমার কষ্ট হয় , তবুও মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে রাখো !! কি দরকার গোটা দুনিয়াকে দেখানোর যে তুমি ভালো নেই ... হয়তো বিশ্বাস করবে না , কিন্তু তোমার গোমড়া মুখ দেখে চারপাশের অনেকেই মনে মনে আনন্দ পাবে ... মানুষ বরাবরই অন্যের ভালো দেখতে পারে না , বোঝনা তুমি !! বিশেষ করে আত্মিয়রা তো নয়ই । নলিনীর নাতির মুখ দেখার বাসনা অতৃপ্তই থেকে গেছে । মা এর মৃত্যুর সংবাদে কিংশুক দু - দিনের জন্য এসেছিল । তার মধ্যে তেমন কোন তাপ উত্তাপ চোখে পরেনি । টুকরো কিছু কথা ছাড়া , আমিও এই নিয়ে কোন কথা বলিনি , বরং বলার ইচ্ছে টুকুও ছিল না । নলিনীর কাজের পরের দিন সকালেই আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে কর্তব্য শেষ করে চলে গেল । সেই থেকে আজ পর্যন্ত সাকুল্যে পাঁচ কি ছয় বার ফোনে কথা হয়েছে । দাদু ভাই এর গলা শুনেছি ফোনেই । ব্যাস ওই টুকুই । এখন আর ওদের কথা মনে আসেনা , নাকি, মনে আসতে চায়না , বলতে পারবোনা । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার চেষ্টা করেছিলাম । ভুল কোথায় জানতে ইচ্ছে করছিল । সময় কি দ্রুত হাঁটা শিখে যায় ....... ! শুধুই কি  তারিখ পাল্টায় !!! আমার জীবনের চেনা ছক পাল্টে যাচ্ছে , বুঝতে পারিনি । 

মেজ ছেলে দেবরাজ মোটামুটি নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছে । ওর পরাশোনায় আমায় বিশেষ বেগ পেতে হয়নি । অন্ততঃ নলিনীর কোন গয়না গাটি বিক্রি করতে হয়নি । ও যথেষ্ঠ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে । বোন বন্দনার বিয়েতে সিংহ ভাগ খরচা ওই করেছিল । আমার জামাই উচ্চপদস্থ সরকারী চাকরী করে । খুব ভালো পরিবার । স্ত্রীর মৃত্যু আর মেয়ের বিয়ের পর বাড়িটা শ্রী হারিয়ে ফেলে । কোন মহিলা না থাকায় কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে যায় । আমি আমার মতো আর দেবরাজ নিজের মতো জীবন যাপন করছিলাম । জানিনা কেন , বিয়ের ব্যাপারে কথা তুললেই দেবরাজ পাশ কাটিয়ে যেত । একদিন সুযোগ বুঝে ওর সঙ্গে আলোচনায় বসি । ঠিক হয় দেবরাজ বিয়ে করবে ঠিকই কিন্তু একটা শর্তে । আমি রাজি হয়ে যাই । সমন্ধ এনে দেয় আমার পূর্ব পরিচিত একজন । চাকচিক্য হীন অতি সাধারণ পরিবারের মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে হয় । একমাস যেতে না যেতেই শুরু হয় ছোট খাট বিষয় নিয়ে ঝামেলা । সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই অশান্তি বেরে যেতে লাগল । আমি বা আমরা কোনদিনই এই পরিস্থিতিতে পরিনি । ইতিমধ্যে দেবরাজ এর ফুটফুটে এক মেয়ে হল । আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরেছিলাম । ইস্ নলিনী নাতি - নাতনির সুখ পেলনা । সময়ে অসময়ে বৌমা ছোট্ট পরিকে আমার কাছে দিয়ে , কাজে ব্যাস্ত থাকত । আমিও নাতনির সাহচর্যে আনন্দ পেতাম । এই ভাবেই কয়েক বছর পেরিয়ে গেল । গোল বাঁধলো সেইদিন , যেদিন থেকে বাড়িতে , দেবরাজ এর শ্বাশুড়ির আনা গোনা বেড়ে গেল । ছেলের বিয়ের সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম ভদ্রমহিলা খুব সুবিধার নয় । নাতনি এখন ক্লাস টুতে পড়ে । সকালে আমি গিয়ে ওকে স্কুলে দিয়ে আসি । আর বৌমা গিয়ে নিয়ে আসে । এরমধ্যে আমার টাইফয়েড হয় । দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকি । ফাইনাল রেজাল্ট বেরতেই  , সেদিন সন্ধ্যায় দেবরাজ অফিস থেকে ফিরে আসার পর  বৌমা ভীষন চিৎকার করেছিল । নাতনির রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে । অসুস্থ আমাকে দেখতে আত্নীয় - অনাত্মীয় দের আনাগোনা বেড়ে  যায় , উপরি হিসাবে আমার দেখাশোনা  । তাই এ কদিন বাবা মা কেউই আর মেয়ের পড়া শোনা দেখার সুযোগ পায়নি । বৌমা বেশ গলা চরিয়ে বলছিল -- এই বাড়িতে আমার মেয়ে মানুষ হবেনা , কারন এখানে পড়া শোনার কোন পরিবেশ নেই । সারাদিন লোকজন লেগেই আছে , রান্নাবান্না করতে হচ্ছে , মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়া করতে হচ্ছে , তোমার বাবাকে দেখতে হচ্ছে । মেয়েকে নিয়ে একটু বসব তার সুযোগ পর্যন্ত পাইনা । এইসবের মধ্যে বাচ্চা মানুষ হয় শুনি ! আর এই মেয়েটা ও হয়েছে বদমাইশ এর হাড় , বেয়ারার হদ্দ । বলি, দিন - রাত দাদু , দাদু করে একেবারে অজ্ঞান হয়ে যাও কেন হ্যাঁ !? সারা দিন খালি দাদুর পেছনে ঘোরা । বৌমার কথায় , আমার সারা শরীরে একটা দোলা দিয়ে গেল । ছোট্ট পরিকে আমি অক্ষর জ্ঞান শিখিয়েছিলাম , মুখে মুখে নামতা শিখিয়েছিলাম , বিভিন্ন ছড়া , আর রামায়ন - মহাভারত এর কাহিনী শুনিয়েছিলাম । সেই আমি কিনা এখন ওর রেজাল্ট খারাপ হওয়ার জন্য দায়ী !!!! ভাগ্যিস নলিনী নেই । ওকে এই দেখতে হলনা । কিন্তু যদি উল্টোটা হত ! আমার বদলে ও থাকত ! ভেবেই আমার গা শিরশির করে উঠলো । দেবরাজ আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করছিল । আমি ঘর থেকে শুনতে পাই আর ভাবি , বৌমা ঠিকই বলছে । আজকালকার এই প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে হলে  , বাবা - মা কে সন্তানের জন্য একশ ভাগ সময় দিতে হবে । সেখান থেকে একটুও যদি অন্য কোথাও সময় খরচ হয় , তাহলে সন্তানের ভীষন ক্ষতি হবে । 

পরে বুঝতে পারলাম সমস্যা আমাকে নিয়ে । আমার দায়িত্ব বৌমা নিতে পারবেনা । অর্থাৎ নিজের বাড়িতে আমি এখন অপাংক্তেয় । হঠাৎ করে একজন অনাহুতের মতো এসে , নলিনীর তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসারকে ভেঙ্গে টুকরো করে দিল , তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি । চেনা মানুষের মুখ পাল্টে যাচ্ছে , চার দেয়ালের মুখোশ খুলে ঝুলে পরছে । শব্দরা সব হারিয়ে যাচ্ছে । মাথার ভেতর সাদা খাতা হয়ে গেছে । 

প্রকৃতি যতো না পাল্টেছে , তার থেকে বেশী এই বাড়ির মানুষের প্রকৃতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে । মনে হচ্ছে নিজের অজান্তেই অন্য একটা আমি বাসা বেঁধেছে শরীর ও মনে , এই নতুন আমি টা ধীরে ধীরে বন্ধু  হয়ে মিশে যাবে পড়ন্ত বিকেলের  শিরা ,উপশিরায় । দেবরাজ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল , কিন্তু কেন জানিনা পারেনি । ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিলাম , একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে । এই নিয়ে বৌমার সঙ্গে বন্দনার কথা কাটাকাটি হয় । মেয়ে বলেছিল - বাবু , তুমি আমার কাছে থাকবে । তোমার জামাই এর সাথে কথা বলে নিচ্ছি । উত্তরে বলেছিলাম - দুর পাগলি , তা কখনও হয় নাকি !! তোদের কাছে গিয়ে থাকলে , মান সম্মান বলে কিছু থাকবে !! আমি জানি , তোর শ্বশুর - শ্বাশুড়ি যথেষ্ট ভাল মানুষ । কিন্তু তাতে কি !! দিনের পর দিন সেখানে থাকলে , একদিন না একদিন সবাই বিরক্ত হবে , বুঝলি মা । তার চাইতে দেখি অন্য কোন ব্যাবস্থা করা যায় কিনা । বন্দনা কথা বাড়ায়নি । শুধু বলেছিল - বাবা তুমি যাই সিদ্ধান্ত নাও না কেন , আমায় একটু জানিও । 

এই ঘটনার দুদিন পর আমি বাজারের থলি হাতে ভাবলেশহীন হয়ে হাঁটছিলাম । হঠাৎ আশু বাবু আমার সামনে এসে দাঁড়াল । আমি প্রথমে চিনতে পারিনি । শীর্ণকায় চেহারা , মাথায় চুল নেই বললেই চলে । সুগারে নাকি এমন অবস্থা । হেঁসে বলেছিলেন - কি সুকমল বাবু , কেমন আছেন ?! আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিয়েছিলাম - ওই মন্দের ভালো । উনি বললেন - সেকি মশাই !!! আপনার মতো এত সুখি মানুষ পাওয়া যায় নাকি ? মনে মনে হাঁসি পেল । বলব না ভেবেও সব পেট থেকে বেরিয়ে গেল । শুনে আশু বাবু বলেছিলেন - এতো ভীষন দুঃখের বিষয় মশাই । কি আর করবেন , সংসারে থাকতে গেলে এই নিয়েই চলতে হবে । কিচ্ছু করার নেই । এই আমাকে দেখুন , ছেলে - মেয়ে কিচ্ছুটি হয়নি । প্রথমে ভাবতাম , শেষ জীবনে কে আমাদের দেখা শোনা করবে !! কিন্তু দেখুন আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছি । আপনার মতো মনে কষ্ট নেই ঠিকই , কিন্তু দেহে কষ্ট আছে । এই নিয়েই কর্তা - গিন্নি আপাততঃ ভালো আছি । ভাল থাকতে শিখে গেছি ।জানিনা পরে কি হবে । আপনি ভাল থাকার চেষ্টা করুন । মন খারাপ না করে বরং হাসিখুশি থাকুন । সত্যি সত্যি না হলেও মিথ্যে করেই ব্যস্ত থাকুন ... যা ভালো লাগে , সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকুন । ভালো থাকতে বেশি মানুষ লাগে না । একাই ঘুরতে বেরিয়ে পরুন । পছন্দের খাবারটা পেট ভরে খান । প্রিয় গানটা শুনুন । ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটুন । সূর্যাস্তের দিকে চেয়ে থাকুন ... জোছনার আলো মুঠোয় ভরে বাড়ি ফিরুন !! ভালো থাকতে যা যা করতে হয় , তাই করুন ,  তবুও মন খারাপ করে থাকবেন না... এসব চলবে না ... । সংসারে থেকে নির্লিপ্ত থাকতে পারবেন না জানি , এরিয়ে চলার চেষ্টা করুন । নিজেকে নিজেই ভালো রাখতে শিখুন ... বিশ্বাস করুন , আপনার কাওকে লাগবে না ... ভালো থাকতে কাওকে লাগে না ... নিজেকে লাগে শুধু ... নিজের ইচ্ছে টুকু লাগে শুধু । 

বাড়ি ফিরতে বড্ড দেরি হয়ে গেছিল । বৌমা বলেছিল - এত দেরি কেন আপনার !!? রান্না বান্না সেরে আমায় আবার মেয়েকে আনতে যেতে হবে । কখন কি করব শুনি ? উত্তরে আমি বলেছিলাম - থাক বৌমা , আজ না হয় আমি পরিকে নিয়ে আসব । থাক আর আদিক্ষেতা করতে হবে না । আমি আনতে পারব ।

আমি অনেক ভেবে দেখেছিলাম । বিভিন্ন দিক থেকে ভেবেছিলাম । তারপর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম । বিশ্বাস করুন , পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে চলে আসাটা ভীষন বেদনা দায়ক । বুকের ভেতরটা বাচ্চা ছেলের মতো কঁকিয়ে কেঁদে উঠেছিল ।

মেয়ে অনেক বারন করেছিল , শুনিনি । আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছিলাম ।

দেবরাজ ভীষন কষ্ট পেয়েছিল । বলেছিলাম - ভাবিস না , সব ঠিক হয়ে যাবে । তোদের আমি ভালবাসি । বিশেষ করে পরিকে । আর তাই চাই সম্পর্কটা সব সময় এমন ভালবাসাময় থাকুক ।

এক বাড়ির ছাদের নীচে থাকা সম্পর্কগুলোর মধ্যে প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে । যখন প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব মেলেনা তখনই সম্পর্কের টানা পোড়েন শুরু হয় ,পরিবারে অশান্তি নেমে আসে ।  সংসার , দায়িত্ত্ব পালন অনেক  করেছি । এবার নয় একটু নিজের মত থাকতে দে । তোদেরও আমাকে নিয়ে যন্ত্রনা থাকবে না ।  আমার এই বাড়িতে থাকার ইচ্ছে এখন মরে গেছে ।  মুচকি হেসে এর পরের কাজগুলো খুব দ্রতই করে নিলাম । তারপর চলে আসি এখানে । 

এখানে অনেকেই আছেন যারা ছেলে মেয়েদের সঙ্গে একটু সময় কাটানোর জন্য , জীবনে বাকি সঞ্চয় টুকুও দিতে প্রস্তুত , কিন্তু ছেলে মেয়েদের সময় নেই , বৃদ্ধ বাবা - মায়ের সঙ্গে দু - দন্ড সময় কাটানো বা কথা বলার জন্য । আবার অনেকে ভাগের মা কিংবা বাবা হয়ে থাকতে চাননি বলে , এখানে চলে এসেছেন । একদম নিরুপায় না হলে কেউ কি আর বৃদ্ধাশ্রমে আসার চিন্তা করতে পারে । অথচ বৃদ্ধাশ্রমে থাকাটা যে জীবনের পরন্ত বেলায় বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক জটিলতার পরিবর্তে  , কোন সুন্দর বা সম্মানজনক সমাধান হতে পারে  , এই ধারনাটা এখনও কারো আসতে চায় না । 

যতদিন আমরা পরিবার এর বাইরে নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে করব , ততদিন এই বৃদ্ধাশ্রম একটা ঋণাত্মক ব্যাপার হয়ে আমাদের মাঝে থাকবে ।  আমি জানি , আমার ছেলে -  মেয়ে আমাকে অনেক ভালবাসে , সম্মান করে । কিন্তু আমি এটাও বুঝেছি , এই ব্যস্ত জীবনে  আমি তাদের কাছে একটা বাড়তি দায়িত্ত্ব ছাড়া কিছু নই ।

বাবা -  মায়ের জীবন শুধু ছেলে মেয়ে কে বড় করে তোলা  , আর বৃদ্ধ বয়সে তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকা নয় । বড় হওয়ার সাথে সাথে সন্তানদের নিজের জগত তৈরি হয় , নিজস্ব  পরিবার তৈরি হয় । সেই সব ঘিরেই চলে তাদের জীবনের আবর্তন । আবর্তনে বৃদ্ধ বাবা - মায়ের স্থান হয়না , এটাই সত্য । অনেকেই এই সত্যটা বুঝতে পারেনা কিংবা  পারলেও না বোঝার ভান করে থাকে , আর বেঁচে থাকা পর্যন্ত একটু একটু করে ছোট হতে হতে মাটিতে মিশে যায় । 

হয়তো তাদের আর কোন উপায় থাকেনা । 

কিন্তু আমি এ সবের উর্ধ্বে গিয়ে ভাবতে পেরেছিলাম । শেষ বয়সটা আমার নিজের মত করে কাটাতে চেয়েছিলাম  । এইখানে আমরা সবাই এক সাথে মিলেমিশে থাকি । একে অপরের সঙ্গে বেঁধে থাকলেও ,  কেমন যেন আলগা লাগে । কেউ কাউকে চিনিনা , জানিনা । কেউ কিছু জানতেও চায় না , জানতে চেষ্টাও করেনা কখনও , তবুও মুখে বলি " আমরা "।

সবাই থাকি খুব কাছাকাছি ,

কিন্তু পাশাপাশি নয় ।  কাছে থেকেও যেন সহস্র যোজন দূরে সবার অবস্থান ।

মন উদাস করা সন্ধ্যায় ,  একসাথে বসা পরিবার গুলো কোথায় যে হারিয়ে গেলো ।

কে কেমন আছে খোঁজ নেবার সময়ও হারিয়ে গেছে । 

আসলে আমরা সবাই বড্ড একলা । কেউ বলে ,

আবার কেউ বলেনা , কেউ মনকে সান্তনা দেয় । সৃষ্টি কর্তার কাছে আমার জিজ্ঞাসা ছিল , এক সাথে অসংখ্য মানুষ পাঠিয়ে দিলে , কিন্তু কেউ কাউকে চেনেনা জানেনা । তুমি যদি পরিচয়টা দিয়ে পাঠাতে তবে ভাল হত পারতে !! মানুষ বড্ড  একলা ঈশ্বর , খুব একলা । 

হ্যাঁ , এখন এটাই আমার ঠিকানা । আনন্দ আশ্রম ।আমি নিজেই এই ঠিকানা বেছে নিয়েছি । আমি এখন আশু বাবুর কথা গুলো মেনে চলি । কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকি । বই পড়ি , গান শুনি , আর সবার সাথে গল্প করে কাটাই । আমি এখন আমাকে নিয়ে একটু আমি হয়ে বাঁচি ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. দেবাশীষ দত্তের লেখাটি ভীষণ ভালো লাগলো।। আপনার লেখা আরো বেশি বেশি করে পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। অনেক শুভেচ্ছা।।

    উত্তরমুছুন