দর্পণ পত্রিকা || গল্পের পাতা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

শংকর ব্রহ্ম

অপমান


             সংকোচে এরপর থেকে আমি আর কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি।


             আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগের কথা। সালটা উনিশশো সত্তর , আমার বয়স তখন সবে মাত্র উনিশ বছর, সাউথ সিটি কলেজে পড়ি। অফ পিরিয়ডে, আমি আর অমিত তখন প্রায়ই গড়িয়াহাট মোড়ে চা সিগ্রেট সহযোগে আড্ডা দিতাম।

           পুজোর সময় দু'জনে একসঙ্গে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়াতাম, প্রতিমা দেখতে নয়, প্রতিমার মতো সুন্দর মুখ খুঁজতে। মেয়েদের তখন আমরা আজকালকার ছেলেদের মতো আওয়াজ দিতাম না, তবে কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠত।

          উনিশশো সত্তরে সে'বার ঠাকুর দেখতে বেড়িয়ে, আমি আর অমিত হাঁটছি, গল্প করছি আর সিগ্রেট টানছি, কিন্তু চোখদুটি উৎসুক হয়ে খুঁজছে কোন সুন্দরী মুখ। দেশপ্রিয় পার্কের পূজা প্যান্ডেলে তখনও বেশ ভিড় হতো। সেখানে হঠাৎ এক পলকের মধ্যেই আমার চোখ আটকে গেল একটি কিশোরীকে দেখে। যেন আমার আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব আমার একার।

             পরনে সবুজ ডুরে শাড়ি, কপালে সবুজ টিপ, কানে মুক্তোর দুল, সারা শরীর দিয়ে যেন লাবণ্য ঝরে পড়ছে। সে পিছনে ফিরে তাকাতেই চোখাচুখি হয়ে গেল আমার সঙ্গে। বুকের ভিতর যেন দামামা বাজতে শুরু করলো। ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল হৃদপিন্ডে। মনে হলো এমন রূপ যেন আমি আগে কখনও দেখিনি। পর মুহূর্তেই কিশোরী আবার ফিরে তাকালো। মনের ভিতর এবার ভীষণ তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। 

            তারপরই দেখলাম, মেয়েটি তার কোমল হাত দু'টি দিয়ে কানের মুক্তোর দুল দু'টি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, আমাকে দেখে।  আমি যেন কোন ছিনতাইবাজ।

           এ'রকম চূড়ান্ত অপমান বোধ এর আগে আমার কখনও করিনি। মনটা তিতো হয়ে গেল সে কারণে মুহূর্তে।


              এরপর থেকে আজও আমি আর কোন মেয়ের মুখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারি না, সংকোচে।

=========

গল্পের জীবন 

ছন্দা দাম 


অপর্ণা রাতের রক্তক্ষয়ী স্মৃতি ভেজা লালপাড় শাড়ি জড়ানো দেহটা পুকুরের জলে ধুয়ে নিল,

ফের শিউলি কুড়িয়ে আনল বাগান থেকে,

মণ্ডপে মৃন্ময়ীর পায়ে সাজিয়ে দিল তার খুলামকুচি হৃদয়টা...

দালানের মাটিতে পরম যত্নে অশ্রু আল্পনা দিল এঁকে।


অপর্ণা তার সন্তানেদের স্নেহের পরশে সাজালো...

এই কটা দিন মায়ের ছায়া দেয় যেন তাকে প্রশান্তি,

থোড় বড়ি খাড়া জীবনের প্রতিরাতে মৃত্যু যাপন তার...

সুঁই সুতোয় রিফু করে  রোজ  হৃদয়ের যত ক্ষয় ক্ষতি।।


অপর্ণা বাপের বাড়ি যাবার স্বপ্ন দেখে এই মরশুমে...

উমা,দূর্গা নামগুলো নাকি তার নামেরই সমার্থক,

তবুও তার ছুটি নেই পেরেক গাঁথা চৌকোজানালা থেকে...

মাতাল স্বামী যে শাঁখা সিঁদুরে তার জীবন করেছে স্বার্থক।


অপর্ণা স্বামী গরবিনী সিমন্তিনী ঢাকা তার সতীত্বের লালীতে

অপর্ণা দেখেনা আকাশ,

ছোঁয়না বৃষ্টি, চিৎকারে বলে না কষ্ট,

ঘরসংসার জুড়ে তার পূর্ণতার ছলকানো ঢেউ

তবু বুকের ভেতর পরাণ পাখিটার কতকাল ডাক শুনে না পষ্ট!!

=====

ধাত্রী 

 বন্যা গাঙ্গুলি


কি লাভ হয় আপনাদের রোজ রোজ এই বুড়ো মানুষটাকে নিয়ে উপহাস করে? মজা পান? 

অনেকদিন ধরে সহ্য করে করে আজ অর্পিতা  মাথা গরম করে বলেই ফেলল তার সহ যাত্রীদের। শারদীয়ার তিথি অনুযায়ী আজ মহা ষষ্ঠী। আজই অর্পিতার কলেজের লাস্ট ওয়ার্কিং ডে। চারটের এই রানাঘাট লোকালে তিল ধারণের জায়গা নেই। যাত্রীরা সবাই উন্মুখ। যে যার একান্ত আপন সংসারে ফিরবে। পরিবারের সঙ্গে দায়িত্ব,কর্তব্যের  তাল মিল গুলোকে মিলিয়ে নিয়ে উৎসবের আবহে গা ভাসাবে বলে। ওই দিকটাতে ডিজিটালি দুনিয়ার দ্রুত পরিষেবা চালু হলেও প্রকৃতির সঙ্গে নেট জগতের এখনও সে ভাবে গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতি এখানে এখনও জীবন্ত। সেই কারণে পুজোর সময় রেল লাইনের দু ধারে এখনও কাশ ফুল যেন ঢেউ খেলানো সাদা কার্পেটের নরম উত্তাপ। ট্রেন চলতে চলতে মাঝে মাঝে খেপে খেপে দূর থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে অর্পিতার কানে। আগমনীর আগমন বার্তায় চিন্ময়ী মায়ের আজ জয় জয়ক্কার। মাতৃ আরাধনার এ এক আন্তরিক উদযাপন করে থাকেন বিশ্ব চরাচরের সমস্ত সন্তানেরা।

 ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে অর্পিতা রোজ রোজ দেখে, এক বৃদ্ধা ভাঙ্গা চোয়ালে ওপর নিচে সব মিলিয়ে চারটে কি পাঁচটা দাঁত নিয়ে হাসি হাসি মুখে কাঁপা কাঁপা হাতে কিছু ঝুড়ি ভাজার প্যাকেট বিক্রি করতে ট্রেনে ওঠেন। বয়স হবে প্রায় আশি।  হেভি পাওয়ারের চশমার মোটা কাঁচের ভেতর থেকে ছানি পরা চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি ক্ষীণ আশায় উপস্থিত সব যাত্রীদের মুখের ওপর ঘুরতে থাকে। গায়ের চামড়ায় দীর্ঘ সময়ের ছাপ স্পষ্ট। অর্পিতার অভিযোগে  জনৈক সহ যাত্রী অর্পিতার দিকে তাকিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়ল।

 

এই বুড়ি মারাত্মক। ছেলে বউ বিধাননগরে একটা বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে দিয়েছিল। ওনার পোষাল না। বলে আশ্রমে নাকি প্রচুর টাকা বাকি পড়ে গেছে। ওরা বিনা পয়সায় আর রাখতে চাইছে না। এই বয়সে ট্রেনে ফেরি করে। ওনার মিইয়ে যাওয়া নরম নরম ঝুড়ি ভাজা না কিনলে আবার অভিশাপ দেন। সেটা আবার কিছু বলা যাবে না। বুড়ির জন্য এনার আবার দরদ উথলে উঠছে।  এতই যদি দরদ যা না নিয়ে যা না নিজের ঘরে বুড়িকে। যত্তসব ফালতু লোক ওঠে ট্রেনের কামরায়।


অর্পিতা মহিলার কথাগুলো দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে। কেননা প্রত্যেক কথার প্রতি উত্তর দেওয়া অর্পিতার একদম স্বভাব বিরুদ্ধ। নৈহাটি অর্পিতার গন্তব্য স্টেশন। গেটের  কাছে এসে দেখে  বৃদ্ধা মানুষের পায়ের ফাঁকফোঁকর দিয়ে অর্ধ চন্দ্রাকৃতি শরীরটাকে সরীসৃপের মতো গুটিয়ে নিয়ে তিন হাঁটু এক করে বসে আঁচলের খোঁট দিয়ে চোখ মুছছেন।


ও মেয়ে তুমি কি আমাকে চেনো? আমার হয়ে ওদের সঙ্গে ঝগড়া করলে যে। 


না আসলে আপনার মুখের সঙ্গে আমার বাবার মুখের খুব মিল খুঁজে পাই। তা ছাড়া আমাদের সিঁড়ির ঘরে আমার বাবার ছোটবেলাকার একটা ছবি দেওয়ালে টাজ্ঞানো আছে, ওখানে আমার বাবাকে যে ভদ্রমহিলা কোলে করে নিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন, তাঁর মুখের সঙ্গে আপনার মুখের খুব মিল খুঁজে পাই। বাবাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পেরেছি উনি আমার বাবার মা। মানে আমার ঠাকুমা। আমি কোনোদিনও আমার ঠাকুমাকে চোখে দেখিনি। আপনাকে দেখে একটু মায়া হয় এই আরকি। তাই প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলাম।


তুমি কি নৈহাটিতে নামবে? আছে তো! আমারও একটা ছেলে আছে, সে ও এই নৈহাটিতেই থাকে। আমার ছেলেও মাতৃমুখী।  জানেনা আমি ট্রেনে হকারি করি। জানতে পারলে খুব রেগে যাবে। বড় চাকরি করে, ওর ও তো একটা মান সন্মান আছে নাকি! লোকে কি বলবে! 


আপনার ছেলের নাম কি ?


অরুণ, অরুণ চক্কোত্তি। চেনো নাকি?


নামটা শুনে অর্পিতা একটু চমকে গেল। অস্ফুট স্বরে বলল, 

হ্যাঁ অল্প অল্প  চিনি।


অর্পিতা  নেমে গেলে, বৃদ্ধা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অর্পিতার চলে যাবার দিকে। 


এই যাঃ ভুল হয়ে গেল। মেয়েটাকে  জিজ্ঞাসা করা হল না তো! ছেলেটা আমার কেমন আছে। মেয়েটাকে পেরায় দেখি এই টেরেনে। আমার মুখ পানে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। চাকরি বাকরি করে মনে হয়। কিন্তু এখন তো বেশ কিছুদিন দেখা হবে না। পুজোর ছুটি পড়ে গেল যে আজ থেকে। সেই লক্ষী পুজো মিটল আবার হয়ত দেখা হবে। তখন একটু খবর নেব খোকার। দেখি আবার একটু চেষ্টা করে। যদি কানাকড়িও বিক্রি করতে পারি। তা না হলে খাব কি এই ক দিন! আর কানা বষ্টমি তো হাঁ করে বসে থাকবে আমার পথ চেয়ে। আ মরণ দশা,খেগুন।  বলে কিনা বিনি পয়সায় থাকতে দেব যদি পাঁপড় ভাজা বিক্রি করে দু পয়সা রোজগার করে আনতে পারি। এই I বয়সে আর শরীর দেয়! 


 নিজের মনে বৃদ্ধা বিড় বিড় করে বকতে থাকে। আর মুখস্থ বুলিতে শুকনো গলায় পাঁপড় বেচার চেষ্টা করতে থাকে। "টাটকা মচমচে খাস্তা পাঁপড়, কে নেবে বলো। এক প্যাকেট দশ টাকা,দু প্যাকেট নিলে পনের টাকা। পুজোর অফার। বলো কে নেবে।"


বাড়ি ফিরে পুরনো ফ্যমিলি এ্যালবাম ঘেঁটে অর্পিতা আরও কয়েকটা ছবি বার করল। প্রায় বিবর্ণ হয়ে যাওয়া আরও একটা ছবিতে অর্পিতা দেখল  ট্রেনের পাঁপড় বিক্রেতা বৃদ্ধা তাঁর ছেলেকে কোলে নিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন। মুখের হাসিটা কিন্তু আজও একই রকম অমলিন আছে বাবার জন্মদাত্রীর। আজ শারদীয়ার পুণ্য লগ্নে সারা পৃথিবী যখন মাতৃ আরাধনায় মগ্ন হয়ে মৃন্ময়ী মায়ের পুজো করতে ব্যস্ত তখন অর্পিতা  মনে মনে শপথ করল, রক্ত মাংসে গড়া জীবন্মৃত বাবার 'মা' কে  এ বাড়িতে আবার ফিরিয়ে আনবে। 

 শহরের কেতা দুরস্ত অঞ্চলের পাঁচ তলার ওপরের বিলাস বহুল ঘরটায় বসে অর্পিতা আজ ভীষন উদাসীন। সত্যি তো উৎসব আসে উৎসব যায়। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের লোল হয়ে যাওয়া চামড়ায় ঘেরা ছানি পড়া ঘোলাটে চোখের লোনা জল বয়ে চলে নিঃস্তব্দে নিরবে। অর্পিতার ঠাকুমারা উৎসবের দিনেও উল্লাসমুখর পথ হাঁটা ক্লান্ত মানুষদের জন্য পাঁপড় বেচেন।

=====

 বেলাশেষের গান

 সুমন ঘোষাল


সেদিন দুর্গা অষ্টমীর রাতে এক নিকট আত্মীয়ার শারীরিক অসুস্থতা বাড়তে আমায় যেতে হয়েছিল এক সরকারি হাসপাতালে। বাইরে তখন দুর্গাপূজার অষ্টমীর রাতের আলোর রোশনাই।প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখার ভীড়। কলকাতা জুড়ে এই মহামারীর ক্ষণেও যেনো উপচে পড়ছে সারা রাজ্যের মানুষের ঢল। প্রায় চতুর্থী থেকেই চলছে মা, বাবা, ছেলে, মেয়ে, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, দিদা, দাদু । পুরো পরিবার সমেত নতুন জামা কাপড়ে সেজে গাড়িতে গাড়িতে ঠাকুর দেখা।


সারা জীবন দেখে এসেছি এ উৎসব যেনো সারা পরিবারের মহা মিলনের উৎসব। আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে একজোট হয়ে প্রতিবারই বসি এক প্রিয় বন্ধুর বাড়ির ছাদে চাদোয়া টানিয়ে টুনি লাইট এর আলোক সজ্জায় ঝলমলে আলোয় ছাদ সাজিয়ে। এবারেও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। খাওয়া দাওয়া গান বাজনা সবই চলে সেখানে।


এইরকম এক সন্ধায় আমায় বেরোতে হলো এমন একটি কারণে.... মন খারাপ তো হবেই ভাবলাম মনে মনে একদিকে দুর্গা পূজার অষ্টমী বলে কথা আর একদিকে সেই নিকট আত্মীয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি। আমায় যে যেতেই হতো।পৌঁছলাম হাসপাতাল। সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলাম আত্মীয়ার অবস্থা খুব একটা খারাপ নয়। তাও ওনাকে ভর্তি করতেই হতো।


ভর্তির কার্যক্রম একটু সময় সাপেক্ষ । তাই একটু পায়চারি করছিলাম মহিলা বিভাগের বারান্দায়।আচমকাই কানে এলো এক মহিলার আর এক মহিলার উদ্দেশ্যে কটূক্তি ভরা কিছু কথা....শুনেও হয়তো শুনছিলাম না, তাও কিছু কথা মনকে নাড়া দিচ্ছিল । তাই কানটা ওদিকে চলে যাচ্ছিল....

কথা গুলি চলছিল একজন ব্যাক্তিগত আয়া এবং একজন আনুমানিক ৮০ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা রুগীর মধ্যে। যদিও আয়া টি বৃদ্ধার নয় পাশের বেডের রুগীর। আমার কানে যে কথা গুলি এসেছিল সেগুলি এরকম ,


বৃদ্ধা - বলছিতো খাবোনা !


আয়া - তোমার ছেলেকে বলেছিলাম মাত্র ৪০০ টাকার কথা তাও উনি দিতে পারলেন না উল্টে আমার সাথে ঝামেলা করে গেলেন। তুমি বুড়ি মানুষ হাত কাপে, খেতে পারোনা একা তাই আমি তোমাকে বিনা স্বার্থে সাহায্য করছি । খেলে খাও নাহলে পড়ে থাকো ।


বৃদ্ধা - চুপ করতো। নিজের কাজ কর। আমি বাঁচি মরি তোর তাতে কিরে মুখপুরি।


আয়া - ছেলে বৌমা তো ফেলে গেলো আল্লার নামে । তারা তো পুজোয় ভালো মন্দ খেয়ে দেয়ে আরাম করে পুজোয় চুটিয়ে ঠাকুর দেখছে । তুমি এখানে মরলেও তাদের যায় আসবে না। নিজের টা একটু ভাব। দয়া করে খেয়ে নাও....


বৃদ্ধা - খাবোনা বলছি না তোকে । খাবোনা ।( আঁচল নিয়ে চোখের কোন মুছে একবার দরজার দিকে তাকালেন বৃদ্ধা । তারপর মাথা নিচু ) 


আমার আর দাড়িয়ে কথা গুলি শোনার মতশক্তি এলো না । এগিয়ে গেলাম আয়ার কাছে।দিদি কি ব্যাপার ?আয়া - আরে ভাই দেখেন মহালয়ার দিন বিকাল বেলা এনার ছেলে বৌমা এনাকে নিয়ে আসলো এখানে। আমি বসেই ছিলাম আমার রুগীর পাশে। বুড়ি কানে ভালো শোনেন না। কিন্তু আমি তো শুনতে পাই.... শুনলাম সিস্টার বলছেন,

" উনি তো ভালই আছেন দেখছি , এই পুজোর মধ্যে না আনলেই পারতেন। "


ওনার ছেলে সিস্টার কে বললেন,

"নানা !  ওনার শরীর একদমই ভালো নয় রাতের দিকে টানের কষ্ট বারে। এই পূজার মধ্যে কখন কি প্রবলেম হয় । ডক্টর স্যার কে বলতে আমায় উনি বললেন অ্যাডমিট করে দিন আমি দেখছি। তাই আর কি..."


বৃদ্ধা মা কে ছেলে বললেন -"মা কদিন এখানে থাকো তোমায় এবার একদম সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাবো। দেখবে আর কোনো কষ্ট থাকবেন তোমার ।


"বৃদ্ধা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন ।


"আচ্ছা মা চলি কাল সকাল সকাল অফিস যাবার পথে এসে দেখা করে যাবো । চিন্তা করোনা কিন্তু। আমি আয়া কে বলে যাচ্ছি উনি তোমায় স্নান খাওয়া দাওয়া করিয়ে দেবেন।


"বৃদ্ধা বললেন - "সাবধানে যাস তোরা বাবা । আমি ঠিক থাকবো । আমায় নিয়ে চিন্তা করিস না। কাল তাড়াতাড়ি আসিস। তোকে না দেখলে মন টা ভালো থাকবে না।যা আর দেরি করিস না।


"ছেলে বললো - "আসি মা ।"


বৃদ্ধা মাথা নাড়লো , কাপা কাপা হাতে,

হাত তুলে সম্মতি দিল ।


যাবার সময় ওনার ছেলে আমায় ডেকে বললো দিদি আপনি কত টাকা নেন ? আমি বললাম ৪০০ টাকা । উনি বললেন সেকি এতো টাকা এই পুজোর সময় , পাগল নাকি ?  আমি আপনাকে ২০০ দেবো ।


আমি বললাম " দেখুন আমারও পরিবার রয়েছে ,এত কমে আমি কেনো কেউ ই ডিউটি করে না । উনি আমার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন ওনার বউ অনেক থামিয়ে দিয়ে বললেন , 


"ছাড়ো তো উনি একা নাকি ? ওনার মত আরো লোক পাবো এখন চলো কাল এসে দেখবো।"ওনারা চলে যাচ্ছিলেন ,

আমি বললাম "ওনার হাত কাপছে উনি খাবেন কি করে

আজ রাতে ? " 


বৃদ্ধার বৌমা বললেন "সেটা ভাবা তোমার কাজ নয় । নিজের কাজ করো...."


আমি কথা না বাড়িয়ে সরে গেলাম। ওনারা চলে গেলেন। বৃদ্ধা হা করে দরজার দিকে চেয়ে বসে রইলেন ।একটু পরে আমার এক আয়া বান্ধবী আমায় ডাকতে এলো রাতের খাবার খেতে যাবার জন্য।আমরা দুজন যখন বাইরের হোটেল এ খাবার খাওয়ার জন্য দাড়িয়ে আছি দেখি ঐ বৃদ্ধার ছেলে বৌমা দাড়িয়ে চা খাচ্ছে। আর দুজনের মুখেই তীব্র হাসি।ওনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন ,


বৃদ্ধার বৌমা - কেমন আইডিয়া টা দিলাম বলো ? 


বৃদ্ধার ছেলে - সে আর বলতে ? একদম মোক্ষম !


বৌমা - এবার পুজোয় জমিয়ে মজা করা যাবে ! বলো ?


ছেলে - এভাবে বলোনা আমার মা তো খারাপ লাগে একটু    হলেও ! তাও একটু নিশ্চিন্ত কটা দিন। হসপিটালে তো আছে । ভালই থাকবে ।


বৌমা - আরে তুমি আর চিন্তা করোনা তো । আজ কিন্তু ফেরার সময় একটু খেয়ে দেয়ে ফিরবো.....


ছেলে - বলো কোথায় খাবো ?


আয়া দিদি আরো বললেন - "ব্যাস এটুকুই আমার মনে হচ্ছিলো পায়ের জুতোটা খুলে আসে পাশের লোকজন ডেকে দি দুই ঘা ...... পারিনি।

সেই থেকে আজ পর্যন্ত ওনার বাড়ি থেকে আর কেউ আসেনি, কেউ ফোন করেও খবর নেয়নি। আমার তো মনে হয়না যে পুজো কেটে গেলেও তারা আর আসবে বলে.....

এরকম আমি কত দেখেছি এই হাসপাতালে বসে ।

এবার আপনি বলুন দাদা কেউ নিজের মা বাবার সাথে এমন করতে পরে ? বুড়ি কে দেখে আমার এত মায়া হয় যে কি বলবো। নিজের থেকে খাওয়াতে যাই । বুড়িমা খায়না। বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আলুথালু হয়ে বসে থাকেন। এরকম চললে তো দুদিন পরেই উনি মারা পড়বেন । ওনার বাড়িতেও ফোন করা হয়ছে কেউ ই ফোন ধরেন না।"


আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না । বৃদ্ধার প্রতি মায়ায় কষ্টে আমারও চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। নিজেকে সামলে আয়া দিদি কে বললাম আপনি একটু চেষ্টা করুন যাতে উনি খেয়ে নেন। হাতে ৫০০ টি টাকা দিতে যাচ্ছিলাম উনি নিলেন না । বললেন ,

"দাদা আমিও তো মানুষ , আমার ও তো মা বাবা আছেন । ছেলে মেয়ে আছে। ও টাকা আমি নিতে পারব না। আমি ওনাকে এখন নিজের মা এর মতই ভেবে ফেলেছি । তাই ওনাকে ভালো রাখতে নিজের থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছি।"


আমি ওনাকে কিছু সমাজ সেবী সংগঠনের ফোন নম্বর আর আমার নম্বর দিয়ে পা বাড়ালাম নিজের অসুস্থ আত্মীয়ার বেডের দিকে। সবে পাঁচ ছয় পা এগিয়েছি..... 

পিছন থেকে হঠাৎ ভেসে এলো এক সুরেলা গলার গান।

থমকে দাঁড়ালাম.... পিছন ফিরতেই দেখলাম বুড়িমা দুহাত আকাশের দিকে তুলে , দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে

গান গাইতে শুরু করেছেন.... ওনার গলায় যে গান শুনলাম আমার সারা গায়কাঁটা দিয়ে উঠলো..... 

আর সারা বারান্দা জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো

সেই গানের কথা.....


"বাজলো তোমার আলোর বেনু মাতলো রে ভুবন.......।।


"দরজার বাইরে যতই আলোর রোশনাই থাক, হোক যতই  মহামিলনের উৎসব, এক মা বেলাশেষের এই একাকীত্বের ঘনো অন্ধকারে যেনো নিজের মনেই জ্বেলে দিলেন নির্জন মণ্ডপে বিসর্জনের প্রদীপ.....।

দূরে কোথাও কোনো মণ্ডপে বেজে উঠলো দুর্গা আরতির ঢাক আর কাঁসর ঘণ্টা ।।

======

অবনী, বাড়ী আছিস? 

সুনীল কুমার হালদার


সে বছর বর্ষা দেরি করে এসে ছিলো, জমিতে ধানরোযার কাজ ভাদ্দরের মাঝ অবধি পিছিয়ে গিয়ে ছিলো। যখনকার কথা বলছি, তখন আশ্বিন পড়ে গেছে, প্রকৃতিতে পুজো পুজো ভাব এসে গেছে,

জমিগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়! কে বলবে, ক'দিন আগে অবধি এই জমিগুলোর বুক জৈষ্ঠ্যের মধ্যাহ্ন আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিলো, তেষ্টায় বুক ফেটে গিয়েছিলো! আর আজ! সেই বুকে সবুজের সমারহ, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়, যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ, কচি ধানগাছগুলো মাথা দোলাচ্ছে বাতাসে, যেন কোনো ছন্দে, তালে তালে।


কতকগুলো ধান মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে এলুম আর তিন মাস পরে সোনালী ধান নিজে থেকে উড়ে উড়ে গিয়ে ধানগোলা ভরিয়ে দিলো, যেমন করে মালক্ষী কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে গৃহস্থের প্রতি প্রসন্ন হয়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে তার বাড়িতে আজীবন অধিষ্ঠান করার অঙ্গীকার করেন, ব্যাপারটা এরকম জলবৎ তরলং নয়! যে ভাবে বাচ্চা মানুষ করতে হয়, সেরকম ভাবে ধানগাছগুলোকে একদিনের জন্যেও চোখের আড়াল করা চলে না। গাছ আজ একরকম তো কাল আরেকরকম, পরশু পাতাগুলো সাদা হয়ে যাচ্ছে, তরশু হলুদ হয়ে যাচ্ছে, ধান ঘরে তুলতে কতো রকম যে হ্যাপা আছে! আজ বিকেলে পরেশবাবুর তাঁর "বারোবিঘে" সরে জমিনে দেখতে গিয়েছিলেন আর বাড়ী ফেরার পথে অবনীর বাড়ীর সামনে এসে হাঁক দিলেন, "অবনী বাড়ী আছিস?" 


পরেশবাবুর বাস বেলসিং গ্রামে, ওখানকার স্থানীয় ইস্কুলের বাংলা শিক্ষক। সারা বেলসিং তল্লাটে, এমনকি আশেপাশের গ্রামে পরেশবাবুকে লোকে এক ডাকে চেনে, কারণ উনি ভীষন ভালো বাংলা পড়ান, অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতা মাত্র ম্যেট্রিকুলেশন অবধি! শুঙ্কুদা, যিনি ফতেপুর ইস্কুলের বাংলা শিক্ষক, বাংলায় এম এ, তিনি বলেন, পরেশবাবুর যদি একটু পড়াশুনা করতেন তাহলে কলেজের প্রফেসর হতে পারতেন! কিন্তু না, পরেশবাবুর সাথে বইয়ের কোনো যোগাযোগই নেই এখন, এমন কি পেপার অবধি পড়েন না! ইস্কুলে পড়ানো, সাংসারিক কাজ নিয়ে থাকেন আর থাকেন দিশি মদ নিয়ে! স্থানীয় সরারহাটে একটা দিশি মদের দোকান আছে, আর আছে লুকিয়ে চুরিয়ে শ্রীচান্দা গ্রামে।

পরেশবাবুর ছাড়া আরও তিন চার জন শিক্ষকও ওই গ্রামে বাস করেন, ফলে ধরে নেওয়া যায় বেলশিং গ্রামটা মোটামুটি শিক্ষিতের গ্রাম। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, মাত্র এক কিলোমিটার দূরে শ্রীচাঁদা গ্রাম অন্ধকারে ডুবে আছে। গ্রামের লোকজন জনমজুরি করে খায়। সমস্যাটা হলো, দিনমজুরি তো বছরের সব সময় মেলে না, তখন ওখানকার দু'একঘর বাসিন্দা বেআইনী চোলাই বেছে সংসার চালায়। কেন জানি না, পরেশবাবু "বাংলা"র টানে শ্রীচাঁদা গ্রামে যান আর অবনীর সাথে আলাপন, না, আগে অবনীর সাথে আগে আলাপ, পরে "বাংলা"য় আসক্তি জন্মানো, আমার মাথায় এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতো, উত্তর ছিলো না। আমি কে? আমি হলুম গিয়ে পরেশবাবুর একমাত্র শ্যালিকার বড়ো ছেলে, চারপুত্র দুইকন্যার সৌভাগ্যবান পিতা হওয়া সত্বেও পরেশবাবুর আমাকে পূত্রবৎ পালন করছেন, যে সময়ের কথা এখন হচ্ছে, সে সময় আমি নিতান্ত বালক মাত্র, পরেশবাবুর প্রায় সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী।


সে যাই হোক, পরেশবাবুর ডাক শুনে অবনী বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে এসে বললো, কাকা! এসো, বসো। সেই প্রথম, আর সেই শেষবারের মতন অবনীদার বাড়ীর অন্দরে আমার ঢোকা। এককামরার কোটা ঘর, অধিকাংশ জায়গায় প্লাস্টার খসে গিয়ে পুরোনো ইটগুলো বেরিয়ে পড়েছে, যেন দাঁত বের করে অবনীর দারিদ্র্যকে বিদ্রুপ করছে! মাথায় খড়ের ছাউনী, আলাদা রান্নার ঘর দেখলুম না, খাট বা চৌকি চোখে পড়লো না, সম্ভবত ফাটাচটা সিমেন্টের মেঝেতে বিছানা পেতে শোয়া হয়। অন্ধকার নামার আগেই খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়তে হবে, তাই অবনীর বউ ভুট্টার আটা জাল দিচ্ছিলো একটা মাটির উনুনে, দেখতে পায়েসের মতন, কিন্তু পায়েস নয়, নুন দিয়ে পাক করা। দূরে দশ বছরের ছেলে তারাপদ বলদদুটোকে গোটা বিচালী খাওয়াচ্ছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যে, ভাঙ্গা হোক, চোরা হোক, অবনী আস্ত একটা কোটা বাড়ীর মালিক কি ভাবে হলো! অবনীর পুরো নাম অবনী কান্ত রায়, জাতে বাগদি, আজকালকার জাতি বিন্যাসে বোধ হয় ও.বি.সি. অথবা এস.সি. বা ওই ধরনের কিছু হবে। এমন কি হতে পারে যে অবনীর পূর্বপুরুষরা এককালে অবস্থাপন্ন জমিদার ছিলো? পদবী, "রায়", এতো জমিদারদের হয় শুনেছি! এই হিসেবটা ঠিক মেলে না! মাথার ঘোমটা খানা একটু বেশি করে টেনে অবনীর বউ এগিয়ে এসে একটা কাঠের পিঁড়ে এগিয়ে দিলো।  


বেলসিং গ্রামে যাদের জমি-জিরেত আছে, তাদের একজন করে "মনিষ" ঠিক করা আছে চাষবাস দেখাশুনা করে জন্যে। ওই সব মনিষদের ঠিকানা হলো ওই শ্রীচান্দা গ্রাম। যেমন পরেশবাবুর অবনী। বেলসিং এর বাবুরা ইস্কুল, অফিস কাছারীতে কাজ করে টাকা আনে, আর শ্রীচাঁদা গ্রামের মনিষরা বাবুদের থেকে মজুরী পেয়ে পেট চালায়, এই হলো এখনকার ইকোনমিকস! আমার ছোট মাথায় খেলে যায়, এরাই আসল মাটির মানুষ, এরাই জমির আসল মালিক, জল, মাটি, কাদা, বলদ, হাল, ধানগাছ, ফসলের অধিকার এদের অথচ বর্ষা ক'দিন আর কাত্তিকের ধান ঘরে তোলার ক'দিন এদের হাতে কাজ থাকে, বাকি সময়টা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত জীবন যাপন। এখন বলুন, যদি এদের কেউ চোলাই তৈরি করে বেছে, সেটা কি সামাজিক ক্রাইম? আজ সন্ধ্যে বেলায় অবনীর পরিবার নুন দিয়ে জলে ফোটান ভুট্টা চুর্ণকে খেয়ে পেটের খিদে মেটাবে, কাল কি হবে? কারুর কাছে এর উত্তর নেই। উত্তরগুলো আমার ছোট্ট মাথায় প্রশ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কেন সারা বছর বর্ষা নয়, কেন কার্তিকের নবান্নের মাস নয়, কেনো আশ্বিন তার অনিশ্চয়তা নিয়ে হাজির হয় এইসব শ্রীহীন শ্রীচাঁদার মতন হাজররো বাংলার গ্রামে, অবনীর মতন প্রান্তিক মানুষদের জীবনে?


ঘরের ভিতরে না ঢুকে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পরেশবাবু বললেন, ধানগাছগুলো কি রকম ফ্যাকাসে দেখলুম রে অবনী, কাল জমিতে গিয়ে গাছের নিচে জলে হাত ডুবিয়ে দেখে আসিস তো, যদি দেখিস গোড়ায় "গেঁদে" হয়েছে, তাহলে বিকেল থেকে গেঁদে পরিস্কারের কাজে লেগে পড়বি। আর হ্যাঁ, তোর কাকী বলছিলো, গরুদের জাবনা দেবার খড় ফুরিয়ে এসেছে, কাল বাড়িতে আসিস, তিন "তড়পা" খড় কেটে দিয়ে আসিস। পরেশবাবু নিজে চোখে হয়তো না দেখলেন না, হয়তো আন্দাজ করতে পারেন, আমি তখন ঘরের ভিতরে, দেখলুম, অবনীর চোখদুটো কেমন হালকা ভিজে এলো, যাক, পরশু থেকে যে কদিন গেঁদে পরিস্কারের কাজ থাকবে, ভুট্টার আটা কেনার পয়সা নিয়ে আর চিন্তা রইলো না!


আমার কাহিনী এখানেই শেষ। আমি, পরেশবাবুর শ্যালিকার জ্যেষ্ঠ পুত্র, এখন কলকাতায় একটা পনেরশ স্কোয়ার ফিট মাপের তিন বেডরুম ফ্ল্যাটে মোটামুটি গুছিয়েই থাকি, সব ঘর এ. সি.। পুজোকে আমি লোকে যে ভাবে এনজয় করে, আমি তা পারি না, এনজয় করতে কোথায় যেন বাধে! মোটা অঙ্কের চাঁদা দিই, এই অবধি, পুজোর সাথে আমার আত্মিক যোগ কোনোদিন ছিলো না, আজ ও নেই। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমার বয়সী সেই অবনীপুত্র তারাপদ এখন কলকাতায় একটা চানাচুর কারখানায় অস্থায়ী ঠিকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। 


আশ্বিনের শারদপ্রাতে পাড়ার মানুষজনকে ঘুম থেকে ঘটা করে তুলে তারস্বরে বীরেদ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ শোনানো হয় বছর বছর, তাতে কি কাজ হয় কে জানে, কিন্তু অবনী তারাপদদের জীবিকার অনিশ্চয়তার উপরে তার কোনো ছাপ পড়ে না, তাদের দারিদ্র্য ঘোচাতে পারে না। অষ্টমীর দিনে ভুলভাল মন্ত্রচারনের মধ্যে দিয়ে স্বার্থপরতার নিদর্শন হিসেবে নিজেদের জন্যে রূপ গুন অর্থ যশ সব চেয়ে নেওয়া হয়, অবনী-তারাপদরা আজীবন ফাঁকি পড়ে যায়। ধানক্ষেতের গেঁদে হলো এক জাতীয় শ্যাওলা, ধানক্ষেতে জলের নিচে জন্মায়, মাটির খাদ্যরস নিজেরা টেনে নেয়, বেচারী ধানগাছগুলো রুগ্ন হয়ে পড়ে, তখন অবনীর মতন খেটে খাওয়া মানুষের পেশীবহুল হাতের শক্ত আঙ্গুলগুলো সেই গেঁদে নির্মূল করে ধানগাছগুলোকে অপুষ্টির হাত থেকে বাঁচায়। কিন্তু বাঁচাতে পারে না নিজের সন্তানকে অপুষ্টির হাত থেকে। উৎসব আসে, যায়, ওদের অভাব যায়না।

----------------০০০০-------------

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ