দর্পণ পত্রিকা || নিবন্ধ সংকলন




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বাঙালির তেরো পার্বণের সেরা পার্বণ দুর্গা পুজো

জয়ীতা চক্রবর্তী আচার্য


আশ্বিনেরও শারদপ্রাতে..." জেগে ওঠা বাঙালির আবেগকে জাগ্রত করে কাশফুল...

"বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব’।

বাঙালির চিরকালীন আবেগ। 


শরৎ এলেই পাড়ায় পাড়ায় সেজে ওঠে রকমারি প্যান্ডেলের বাহার । বাতাসে আগমনী গান বেজে উঠলে মা দুর্গার উপর রঙ চড়ে ।


মণ্ডপে মণ্ডপে আজ জনজোয়ার। মায়াবি আলোর নিচে কত অসংখ্য মানুষ।


পুজো এলেই তো পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে খুব। এই শরতের কোনও পড়ন্ত বিকালে খোলা জানালা দিয়ে যখন চোখ চলে যেত বাইরে, মনে হত কেউ যেন নীল রঙে ডুবিয়ে আকাশটাকে শুকোতে দিয়েছে। আর সেই আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো টুকরো টুকরো ধবধবে সাদা মেঘগুলো যেন সঙ্গী করত আমার কল্পনাকে। -কিছু অতীত, যা-কিছু অপস্রিয়মাণ, তাকেই মনে হয় সুন্দর। 


দুটো রাস্তাহীন রাস্তা।

আগলে রাখি ঘর

শরতের ভোর

উঠোন-সাজানো শিউলি

দূর থেকে ভেসে ভেসে আসা ঢাকের শব্দ!

ওপাশে কে আছে?

স্বপ্নে বিভোর অতীত…

হামাগুড়ি দিয়ে আসছে 

শিরশিরানি বাতাস

অস্থির আকাশ

উচ্ছ্বাসস্তব্ধ অশ্রু ও বেদনার আর্তি

সময়ের দংশন...রাত্রির রোমাঞ্চ ধরে হাঁটি।।


জীবন থেমে থাকে না..

আবার নতুন পূজোর অপেক্ষায়

রূপ রস ঘ্রাণে মন্ত্রে উজ্জীবিত 

দেবীর আরাধনা।।

উৎসব, তোমাকে খুঁজছে।।

=====

"ফিরে দ্যাখা"

প্রণব কুমার বসু


বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নানান অনুভূতি পাল্টে যায় -


ছোটবেলায় বড়রা জামাকাপড় জুতো মোজা কিনে এনে দিলে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতাম, গন্ধ শুঁকতাম - মনে মনে চিন্তা করতাম কোন জামাটা পরে কোনদিন কোথায় ঠাকুর দেখতে যাব - অবশ্যই নিজের পছন্দের শ্রেষ্ঠ জামা, জুতো রেখে দিতাম অষ্টমীর দিন পরার জন্য !


কলেজ লাইফে চিন্তা ধারা পাল্টে যায় - তখন বাড়ির সকলের অনুরোধ রাখতে হয়তো একটা নতুন জামা অষ্টমীর দিন পরতাম - কেমন য্যান একটা ভাব এসে গিয়েছিল পুজোর কদিন নতুন জামাকাপড় শুধু ছোটরাই পরে !


বিবাহিত জীবনে প্রথম দু-এক বছর দুজনে মিলে নতুন জামাকাপড় পরে প্যান্ডেল হপিং!


পরে চিন্তা বাড়ে সন্তান সন্ততিদের পুজোর কেনাকাটা নিয়ে!


বার্ধক্যে মনে হয় আমাদের জীবনে আমরা অনেক উপভোগ করেছি - এবার না হয় যে সমস্ত মানুষদের নতুন জামাকাপড় কেনার ক্ষমতা নেই বা যে সমস্ত মানুষদের আজকের দিনেও দুবেলা ঠিকমতো খাবার জোটে না তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই |

=====

তোমার ছায়ায় মিশে যেতে পারি

ডরোথী দাশ বিশ্বাস


নীল সায়রে ভেসে থাকা স্বর্ণপুষ্পপত্রে কে যেন যত্নে চয়ণ করেছে স্বর্ণচাঁপাফুল। আলো ঠিকরে পড়ছে তা থেকে। সেই আলোতে রাতভেজা ঘাসপথ ধরে, নদীর জলোচ্ছ্বাসে সিক্ত মাটির গন্ধে, পুকুরের শাপলার রঙ ছুঁয়ে, বিশ্বাসী বাতাসে গা ভাসিয়ে বনহোগলার ছায়ায় ছায়ায় তোমার পদচিহ্ন অনুসরণ করি আমি।


তারপর কতবার জমাটবাঁধা অন্ধকারে ডুবে গেছে নীল সায়রের জল,একে একে নিভে গেছে তারার দীপ, একসময় বৃষ্টি নেমেছে অঝোরে, তবু, একপশলা বৃষ্টি হয়ে ছুঁতে পারিনি তোমাকে, অগত্যা বৃষ্টিজলে তোমার নাম লিখেছি শত সহস্র কোটি বার। শ্বাসকষ্টের রাত শেষে রক্তাভ ভোর এসেছে অপার্থিব সৌন্দর্য নিয়ে, এসেছে নির্জনে নতুনদিন .....তবু রৌদ্রঝলক হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে যেতে হাজার বার ভাবতে হয়েছে আমাকে। ঝনঝনে রোদে সেঁকে নিয়েছি দুঃখ-ব্যথার আঙরাখা।


কিভাবে ভালোবাসতে হয়, তোমার থেকে শিখেছি যে, তাই তো আজ নীল সায়রে ভাসমান স্বর্ণপুষ্পপত্র যখন দুঃখমেঘরাশির মতো ধোঁয়ায় আবৃত হয়, তখন জানো, আমার একটুও দুঃখ হয়নি, রাগ হয় নি। শুধু মনে হয়েছে, এ যেন সোনার মেয়েকে শত অপযশ, বেদনা, যন্ত্রনা থেকে আড়াল করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এখন আমি ভাবনাকে উল্টে পাল্টে ভাবি। তাতে দেখেছি,দুঃখের রাতে বৃষ্টি হয় না আর, সুখে দেখেছি অনুচ্ছ্বাসী ভাঁটার টান।


বিদ্যুতলতার মতো তোমার আমার সম্পর্কে সাময়িক চিড় ধরলেও স্থায়ী হয়নি মিথ্যে মেঘের ঘনঘটা। আজও আমি   সততামাখা অহংবোধে গর্বিতকায় তোমার ছায়ায় মিশে যেতে পারি কল্পনায় ....

=====

উৎসব কথা 

মাধুরী সাহানা


আমার প্রিয় উৎসবের মতো করে একটা রচনা লেখার ইচ্ছে হলো দর্পণের বিশেষ ওয়েব ম্যাগাজিন সংখ্যার বিষয় ভাবনা "পুজোর ক'টা দিন"। বাংলাদেশে "বারো মাসে তেরো পার্বণ"। উৎসব আসে উৎসব যায়, যা কিছু থেকে যায়, রেখে যায় পুজোর কটা দিন। শারদীয়া উৎসবের কটা দিনকে আমি বছরভর রেখেদি যত্ন করে। 

বর্ষা ঋতুর শেষ হতে হতে অনেকটা মাঝামাঝি শরৎ ঋতু চলে আসে। শরৎকালের আকাশ নীল সাদা মেঘের ক্যানভাস। সূর্যে তেজ বেশ প্রখর। মাঝে মাঝে হালকা বৃষ্টি। শহর থেকে একটু বাইরে বেরিয়ে গেলে দেখা যায় কাশফুলের ক্ষেত্র। বাতাসে শিউলি ফুলের সুবাস। খাল বিল জল থৈ থৈ টইটম্বুর। এই সময় বাঙালির নাকে পুজোর গন্ধ। কুমোরটুলি তে চরম ব্যস্ততা। পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের আয়োজন। কেনাকাটা করতে করতেই মহালয়ের মুহূর্ত এসে পরে।

ভারতীয় পুরান মতে মহালয় পিতৃ পুরুষের বিশেষ তর্পণের কাল। নদীতে মৃত পিতৃ পুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে জলদানের দিন।  এই আমাবস্যা তিথিতে মৃত আত্মারা মর্তে আসেন। অনেক বাড়িতে সেদিন কালির আরাধনা করা হয়।

রামায়নের রামচন্দ্র রাবন বধের জন্য শরৎকালের দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন। বাংলাদেশে সেই উৎসব শারদীয়া দুর্গোৎসব নামে খ্যাত। বাঙালির মহালয় মানে আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী চন্ডী স্ত্রোত্রপাঠ সাথে বাণীর কুমারের গ্রন্থনায় সংগীতের অনুষ্ঠান। সময়ের সাথে সাথে বাঙালি আধুনিক হয়েছে কিন্তু এই বিশেষ অনুষ্ঠানটির ক্ষেত্রে বাঙালি প্রাচীনপন্থী।

শারদীয়া দুর্গাপূজার পক্ষকাল পূর্বে মহালয়। প্রতিপদ থেকে ঘটে দেবীর আরাধনা এবং চন্ডীপাঠ হয়ে থাকে। ষষ্ঠী থেকে দেবীর "ষষ্ঠ্যাদদি কল্পরম্ভা" আর সপ্তমীতে বিগ্রহে পুজো।

অষ্টমীর দিন দেবী চিন্ময়ী রূপ ধারণ করেন। হিন্দুধর্ম অনুসারে মানুষের অভ্যন্তরেই দেবত্বের অবস্থান। একটি ছোট বালিকার মধ্যে মাতৃত্ব সুপ্ত অবস্থায় থাকে তাই তার মধ্যে দেবী চিন্ময়ী হয়ে ওঠেন। স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে দুর্গোৎসব প্রচলন করে এই কুমারী পুজোর আয়োজন করেছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠের দুর্গাপুজোয় কুমারী পুজো হয়। আমি বারাসাতের শিবানন্দ রামকৃষ্ণ মঠের কুমারী পুজো দেখি। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। মৃন্ময়ীর চিন্ময়ী রূপ।

আমার জন্মস্থান নৈহাটি হলেও বিবাহ পরবর্তী সময়ে আমি বারাসাতে থাকি। ইতিহাসের বারো ভুঁইয়া যশোররাজ প্রতাপাদিত্যের সেনাধ্যক্ষ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় মুঘোল সাম্রাজ্ঞী যোধাবাঈ এর নির্দেশে উত্তর ২৪ পরগণার বারাসাতের দক্ষিণ পাড়ায় দুর্গাপূজার সুচনা করেন। এখনও সেই দুর্গা "শিবের কোঠার দুর্গা" নামে পূজিতা হন। বাঙালির দুর্গোৎসবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। বাঙালির  ঐতিহ্য এই শারদীয়া উৎসব ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। এই উৎসবের বাঙালিয়ানা বজায় রাখতে আগামী প্রজন্মের যুবগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে।  সম্প্রদায়ের উর্ধ্বে উঠে উৎসবের মূল মন্ত্রটি অক্ষত রাখতে হবে।

=====

 "অভিজ্ঞতা "

 স্মৃতি বেগ বিশ্বাস


আসা-যাওয়া তো জীবনের চিরসত্য পন্থা।তাই তো হয় জন্ম-মৃত্যু,শুরু-শেষ।চিরাচরিত পন্থাতেই প্রতি বছর আসে-যায় নানা উৎসব।এ বছরও এসেছে দুর্গোৎসব।মহালয়ার তর্পণে পিতৃপক্ষ শেষে শুরু হয়েছে দেবীপক্ষ।ষষ্ঠী তিথিতে বোধন পুজোর পর এলো সপ্তমী,অষ্টমী।আজ নবমী-রাতেই মা মেনকার সেই আকুল আর্তি---'যেওনা রজনী আজি ল'য়ে তারাদলে,গেলে তুমি দয়ামী এ পরাণ যাবে।' তবুও মায়ের মিনতি ব্যর্থ ক'রেই আসবে দশমী তিথি।বাজবে বিসর্জনের বাজনা।উৎসব এসে চলে গেলেও মনে দাগ রেখে যায় পুজোর কয়টি দিন।এই ক'টা দিনের সব পাওয়াকে সঞ্চয় ক'রে রাখছি স্মৃতির পাতায়। 

উৎসব যেমন আনন্দের তেমনই বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জনেরও।পুজোর ক'টা দিনে ভালো-মন্দ মিশিয়ে অনেক খবর জানলাম।অনেকে মণ্ডপে-মণ্ডপে ঠাকুর দেখছে আবার অসুস্থ,অক্ষম মানুষ ঘরে বদ্ধ থেকে ভাবছে এবার উৎসবটা মাটি হয়ে গেলো।কয়েকজন মারণ-ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষের ভয়ানক পরিণতি জেনে ভারাক্রান্ত হলাম। আমার অভিজ্ঞতার ডালিটা তাই ভরলো সুখ-দু:খের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়।

মা দুর্গা আসেন স্বামী সন্তান সহ।স্বামী মহাদেব থাকেন দশভুজার বেদির উপরের দিকে।এখানে জগন্মাতার সাথে জগৎ-পিতা থাকলেও উৎসবের নাম দুর্গা পুজো।নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নিয়ে যারা যুক্তি-তর্কের মেলা বসিয়ে দেয় তাদের বুঝতে হবে প্রকৃত বিষয়টিকে।নারী ও নরের মধ্যে ভেদের কথা কিন্তু এই উৎসব শেখায়না৷মহাদেবের উপিস্থিতিই বুঝিয়ে দিলো নারী-পুরুষের গুরুত্ব।পুজোর কয়টি দিন মানুষ মিলেমিশেই থাকতে চায়।তাই তো বিজয়ার প্রীতি-বিনিময়ে বিভেদ দূর ক'রে শত্রু-মিত্রকে এক হ'তে দেখি।আগমনীতে শুরু হওয়া উৎসবের বিজয়াতে বাজে ঐকতানের বাঁশি।পুজোর ক'টা দিন আলোর রোশনাই শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও দেখতে পেলাম।বিলাস বহুল বসতিতে গিয়ে যেমন দেখেছি প্রাচুর্যের আতিশয্য তেমনই বস্তি অঞ্চলে গিয়েও দেখেছি মাথা গুঁজে থাকার মতো জায়গার অকুলান।পুজোর ক'টা দিন যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি তা পরিবেশন করছি ছন্দবদ্ধ পদে-----।


উৎসব আসে উৎসব যায় মানব-জীবন প্রাঙ্গণে

দিনগুলি যেন আল্পনা দেয় গভীর হৃদয়-অঙ্গনে। 

উচ্চবিত্ত অট্টালিকায় আলোর ঝর্ণা ঝরায় 

নিম্নবিত্ত না-পাওয়া বেদনে আকুল দৃষ্টি ছড়ায়।


মধ্যবিত্ত থাকে মাঝামাঝি বিলাস-বিহীন উল্লাসে

শিশুরা হয়তো থাকতেই চায় নির্বিবাদী উচ্ছ্বাসে।

নারীশক্তির মহিমাই যদি উৎসবে হয় মহীয়ান

কন্যাভ্রূণ নিধনে কেন মানুষই হচ্ছে আগুয়ান ! 


উৎসবের এই কয়টি দিনে পরখ করেছি বেশ

মানব জীবনে ঘিরে থাকে সদা বৈচিত্রের রেশ। 

কত ভাব কত ভাবনায় মেশে মানুষের সম্প্রীতি

তারই মাঝে দেখি কোথাও আবার বৈষম্যের রীতি।


নিজের মতোও থেকেছি আমি পুজোর কয়টি দিন

সেখানে যতই মত্ত হয়েছি বেড়েছে ততই ঋণ।

সেই ঋণ-ভার বহন করতে ক্লান্ত হইনি আমি

পাঠক হয়েই কুড়িয়েছি জ্ঞান সততই যাহা দামী।


আসা ও যাওয়ার উৎসব মাঝে করেছি যা কিছু সঞ্চয়

জীবনের মান বুঝতে বোঝাতে দামখানি তার কম নয়।

মহোৎসবের মাঝে থাকা এই পুজোর কয়টি দিন

বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় বাজালো জীবন-বীণ। 

=====

উৎসবের উপহার

সৌমিত্র চ্যাটার্জ্জী


মহাভারতের এই পুণ্যভূমিতে আছে নানা উৎসব,

সবার সেরা বাঙালির চার দিনের দুর্গোৎসব।

সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমী তিথি অনুযায়ী,

দুর্গাপূজার নির্ঘন্টের দিনক্ষণ হয় স্থায়ী।


পূজার আনন্দে ছেলে বুড়ো সবাই থাকে মেতে,

সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্য জোটে যে যেমন তার পাতে।

দুর্গাপূজার বোধন মহালয়া থেকে বিসর্জন,

সংগ্রহ করা হয় পূজার প্রয়োজনীয় উপকরণ।


বয়সের ভিত্তিতে যে বা যারা থাকে যেমন স্থানে,

সে বা তারা তেমনি আনন্দ উপভোগ করে মনে প্রাণে।

কচিকাঁচা থেকে শিশুরা নতুন পোশাকে আনন্দে মাতে,

কারো চঞ্চলতা দেখা যায় যারা পৌঁছেছে আঠারোতে।


কেউ কিছু না চাইতেই কিছু না কিছু পেয়েই যায়,

কারও সব কিছু থেকেও কেবলই হারিয়ে যায়।

কেউ আনন্দ তো দূরের কথা অভুক্তই থেকে যায়,

কেউ খাবার নষ্ট করে কেউ প্রয়োজনের অধিক খায়।


ঝলমলে দামি পোশাক থাকে অনেকেরই গায়,

অনেকে লজ্জা ঢাকার মতো পোশাক না পায়।

কালের নিয়মে নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব সংসার,

যা কিছু গ্ৰহণ-বর্জন সামাজিক অধিকার।


যুগ-যুগান্তর ধরে নিয়মের বেড়াজালে,

সামাজিক আচার অনুষ্ঠান আসছে চলে।

উৎসব আসে আবার চলেও যায়,

একে অপরের সম্পর্ক গড়ে আন্তরিকতায়।


কিছু স্মরণীয় ঘটনা রেখে য়ায় স্মৃতি,

মায়ার বাঁধনে থেকে যায় কারো প্রীতি।

যারা থাকে বিদেশে উৎসবে ফিরে নিজ দেশে,

শৈশবে ফেলে যাওয়া আত্মীয়ের সাথে যায় মিশে।


উৎসব আসছে আসছে করে নিয়ম মেনে আসে,

মহা সমারোহে উৎসব পালন হয় সকাশে।

বাদ বিবাদ ভুলে একত্রিত হয়ে সকলে আনন্দে হাসি,

উৎসব শেষ সব কিছু ম্লান-আগামী সকাল হয় বাসি।

=====

 উৎসব আসে,উৎসব যায়...

রীতা চক্রবর্তী ( লিপি )


উৎসব আসে ,উৎসব যায়,যা কিছু থেকে যায় ,রেখে যায় পুজোর কটা দিন।  কথাগুলো ভাবলেই,জাগিয়ে দেয় আমার মনের অন্তঃপুরের সুপ্ত স্মৃতিগুলোকে। ছোট্ট দুটি লাইন কিন্তু ব্যাপ্তি তার বিশাল। আসলে পুজো শেষ হলেও,মন জুড়ে থাকে পুজোর কটা দিনের মধুময় স্মৃতির সুরভি।  বিগত দিনগুলোর রেশ থেকে যায় আর সেই অনুভূতি সব স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় মনের ঘরে। 

                এখন শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি,আর বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের কত  স্মৃতিভার বয়ে নিয়ে পথ চলছি আমরা! কত উৎসব ,কত অনুষ্ঠান,তবু সব উৎসবকে ছাপিয়ে গেছে এই দশভূজা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী মায়ের আরাধনা। মহালয়ার ভোরে আগমনীর সুরেই বেজে ওঠে প্রকৃতির বীণা। শরতের নরম সোনালী রোদ মাকে আহ্বান জানায় । তারপর সেই মিঠে রোদ শারদীয়ার আগমনে  সকলের হৃদয়ে বুলিয়ে দেয় শান্তির প্রলেপ। ছুঁইয়ে দেয় সবকিছু ভুলে থাকার যাদুকাঠি। পুজোর দিনগুলোতে মনের মাঝে এমন এক অনুভূতি জেগে ওঠে,যা শব্দে প্রকাশ করা যায় না। এই আবেগকে দমন করতে পারে এমন সাধ্যি বোধহয় কোন বাঙালির নেই। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব এই দুর্গোৎসব। স্বভাবতই এই পূজাই সকলকে সব থেকে বেশি নস্টালজিক করে তোলে। প্রতিবছর শরৎ এলে পুজোর গন্ধ বাতাসে ভেসে আসতেই কিছু অভাববোধ জেগে ওঠে মনের পরতে পরতে। মা বাবা সহ প্রিয়জন বিচ্ছেদ মনের ঘরে আলোড়ন তুলে মনকে করে বিব্রত। এভাবেই পুজো আসে যায় আর কোন কোন বছরের পুজো গভীর স্মৃতিতে রয়ে যায় মনের মাঝে। কখনো সে স্মৃতি হয় বেদনার, কখনো খুশির। আমার মনে হয়,সাহিত্যে যে ' স্মৃতি সততই সুখের' বলে একটি আপ্তবাক্য আছে,তা আসলে সুখের স্মৃতি রোমন্থন করে জীবনকে এগিয়ে নেবার জন্য। পুজো আমাদের সকলের জীবনকে উজ্জিবীত করে তুলে। সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে পুজোর চারটে দিন আমরা জগৎজননী মায়ের সঙ্গে বসবাস করি। মায়ের চরণে অঞ্জলী প্রদান,ভোগ খাওয়া,ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা,চোখের পলক পড়তে না পড়তেই যেন কেটে যায় সপ্তমী,অস্টমী,নবমী তিথি। ব্যাথাতুর হৃদয়ে বেজে ওঠে দশমির বিসর্জনের বাজনা। মাকে বলি , 'কেন মা!! এত তারা কিসের তোমার? থেকে যাও আরো কটা দিন। আমরাও সবকিছু ভুলে এমন আনন্দের ভেলায় ভেসে বেড়াই'। কিন্তু তখন প্রকৃতি বিষন্ন। মায়ের চোখ ছলছল। নীলকন্ঠ পাখির ঠোঁটে খবর পৌঁছে গেছে কৈলাশে। মা মর্তলোককে কাঁদিয়ে সপরিবারে ফিরে আসছেন নিজের সংসারে। যেতে তো হবেই। মা নিজেই তো এই সমাজ সংসারকে কিছু নিয়ম শৃঙ্খলায় বেধে দিয়েছেন। তাই তিনি শত অনুরোধ উপেক্ষা করে আবার বছর পরে আসবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে যান তাঁর নিজের আলোয়। তবে যাবার বেলায় মা কিন্তু সকলের জন্য দু'হাত উপছিয়ে আশীর্বাদের ডালি ভরে রেখে যান। মা যে এই পৃথিবীর ধনী দরিদ্র জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মা! তাই গোটা পৃথিবীটাই তখন একটি সংসার হয়ে যায়।  মাকে ঘিরেই সকলের আনন্দ উন্মাদনা। আসলে এই উৎসব একটি সম্প্রিতির উৎসব।


              শৈশব কৈশোরে যখন শুভ্র মেঘের  ছানাপোনারা দল বেঁধে সুনীল আকাশে ভেসে ভেসে আকাশ আলোয় আলোকিত করে তুলত তখনই মনে এক উত্তেজনা অনুভব করতাম। কারণ,সেই সুনীল আকাশের সোনাঝরা রোদে আমার মা ততক্ষণ ঘরের ট্রাঙ্ক সুটকেস আলমারি খুলে দামী শাড়ি কাপড়,শাল সুয়েটার,বড়ি আচার সব রোদে শুকোতে দিয়েছেন। তখনি বুঝতে পারতাম আমাদের প্রাণের উৎসব আসন্ন। কারণ প্রতিবছরই মায়ের এই কাজ সারা হলেই মা দুর্গা ছেলেপিলের হাত ধরে এসে পুজো মন্ডপগুলোতে বিরাজ করতেন। আরো বুঝতাম যখন বাড়ির আঙিনায় ঝরে পড়া শিউলি, পুজোর বিশেষ উপকরণ স্থলপদ্ম,কাশের গুচ্ছ,আরো কত কত ফুলেরা হিমেল বাতাসে দোলে দোলে কানাকানি করত ' মা আসছেন,মা আসছেন '! 


             আমাদের মফস্বলে তখন খুব বেশি পুজো হতো না। হাতে গোনা পনের বিশখানা পুজো ঘিরেই ছিল আমাদের অনাবিল আনন্দ। তবে আমাদের বাড়ির চারপাশে ছিল পাঁচ ছ'খানা পুজো। কোন প্যান্ডেলে কখন বাঁশ পড়ল,কখন মণ্ডপে ঠাকুর আসবেন সব খবর স্কুলে গেলেই যোগাড় হয়ে যেত। স্কুলের পাশেই ছিল এক বনেদি বাড়ির পুজো। মহালয়ার পর টিফিন টাইমে ছুটে ছুটে যেতাম সেখানে আর অপার বিস্ময়ে উপভোগ করতাম মাকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে তুলতে একাগ্র মনে কুমোরের হাতের রঙ তুলির ছোঁয়া। তখনতো থিম পুজোর কোন নামগন্ধই ছিলনা। আলোর রোশনাইও ছিল স্তিমিত। নিয়নের সাদা আলোয় মণ্ডপের পথ আলোকিত হয়ে থাকত। প্যান্ডেল ছিল একেবারেই সাদামাটা কাপড়ের। তবু কী আনন্দ কী আনন্দ ....! রাজরাজেশ্বরী হয়ে মা মণ্ডপ আলোকিত করে রাখতেন।মফস্বল হলেও একদিন আমরা বাবা মায়ের সঙ্গে গাড়ি করে বেরোতাম আর সব পুজো দেখে ফিরতাম। সেসময় দেখতাম কিছু কিছু মণ্ডপে চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কোথাও অসমিয়াদের ভাওনা, কোথাও আবার রাবন বধ পালা মঞ্চস্থ হচ্ছে। যখন সেসব বন্ধুদের শোনাতে গিয়ে দশাসই রাবনের দশ মাথার বর্ণনা দিতাম তখন আধঘন্টা লেগে যেত আমার ইয়া বড় মাথার বর্ণনা করতে। সেসময় আমাদের খাওয়াদাওয়া বলতে ছিল, দিনের বেলায় কাঠি আইসক্রিম ও পাঁপড় এবং রাতের বেলায় শিববাড়ির বিশাল মেলা থেকে ভুজিয়া নিমকি জিলাপী এসব কিনে বাড়ি ফেরা।এগুলো আমার মধুময় সুখস্মৃতি। আমার পরম আনন্দের পুজো উদযাপন। খুব ইচ্ছে করে ওই দিনগুলোকে ফিরে পেতে। তাই পুজো এলেই আজকাল বড় বেশি নস্টালজিক হয়ে পড়ি। এখন তো অত্যাধুনিক আলোর রোশনাই,চোখ জুড়ানো মণ্ডপ সজ্জা,হরেক ধরনের রসনা তৃপ্তির উপকরণ তবু মন যেন বলে,এসব পুজোয় প্রাচুর্য আছে,প্রাণ নেই। সাত্ত্বিকতা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মধ্যরাত্রিতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে অগুনতি পুজো দেখে যখন বাড়ি ফিরি,মনে মনে ভাবি,সেই নিষ্ঠা সেই আন্তরিকতা কোথাও খুঁজে পেলাম না তো! যাক মা আসেন ফি বছর অশুভকে বিনাশ করে তাঁর মর্তবাসী সন্তানদের সুখ সমৃদ্ধি ও শান্তি প্রদান করতে। মায়ের কাছে আমাদের মতো মায়েদের শুধু একটাই প্রার্থনা, ' 'মাগো আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে'। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ